Monday 09 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কাচের চুড়ি— সময়ের কাচে বাঁধা এক রঙিন ঐতিহ্য

ফারহানা নীলা
৯ জুন ২০২৫ ১৬:৫৬ | আপডেট: ৯ জুন ২০২৫ ১৭:৩৭

রঙিন আলোয় ঝলমল করা একটি ছোট্ট অলংকার ‘কাচের চুড়ি’। যা শুধু একটি গয়না নয়, বাঙালি নারীর আবেগ, সংস্কৃতি আর স্মৃতির এক গল্প। আমাদের সমাজের এক সময়কার প্রাত্যহিক অনুষঙ্গ হলেও, আজও আবেদন কমেনি এই কাঁচের চুড়ি’র।

শৈশবের হাতেখড়ি

শৈশবের হাতেখড়ি হয়তো মায়ের বা নানির সাজঘর থেকে চুড়ির টুকটুক আওয়াজে। বিয়েবাড়ির কনে কিংবা উৎসবের সাজে কাচের চুড়ির রঙ বেছে নেওয়ার অভ্যাস যেন নারীর জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। রঙের এই বহর শুধু বাহারি নয়, বরং প্রতিটি রঙের পেছনে লুকিয়ে আছে এক একটি অর্থ—সবুজ আশা ও সুখের প্রতীক, লাল ভালোবাসা আর উচ্ছ্বাস, আর সাদা নিঃসঙ্গতা ও শান্তির প্রতিচ্ছবি।

বিজ্ঞাপন

সময়ের পালা বদলেও কমেনি চুড়ির আবেদন

চুড়ির শব্দে একধরনের সুর থাকে, যেন নিঃশব্দে কথা বলে। শহরের কোলাহলে হারিয়ে গেলেও, গ্রামবাংলার সকালের শব্দে আজও চুড়ির কাচ কাচ ধ্বনি শোনা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলালেও, কাচের চুড়ির আবেদন থেকে যায় অমলিন। প্লাস্টিক, ধাতব কিংবা ডিজাইনার চুড়ির ভিড়ে আজও কেউ যখন হাতে পড়ে কাঁচের চুড়ি, তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলার চিরায়ত রূপ।

নতুন করে ফ্যাশনে যুক্ত হচ্ছে কাচের চুড়ি

আজকের তরুণীরাও আবার ফিরে আসছেন এই ঐতিহ্যে। আধুনিক পোশাকে একটুকরো পুরনো দিনের সৌন্দর্য যোগ করছে রঙিন কাচের চুড়ি। সোশ্যাল মিডিয়ার ছবিতেও এই ট্র্যাডিশনাল টাচ আজ খুবই জনপ্রিয়। কাচের চুড়ি যেন এক সময় আর সময়ের বাইরের মাঝে এক সেতুবন্ধন—যা ধারন করে চলে নারীর সৌন্দর্য, অনুভব ও উত্তরাধিকারের এক অপূর্ব মেলবন্ধন।

শুরু যেখান থেকে

কাচের চুড়ির ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। ভারতবর্ষের মোহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতায় (খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৬০০ অব্দে) পাওয়া গেছে চুড়ির প্রমাণ—মাটির গহনার সাথে ছিল কাচের মতো বস্তু দিয়ে তৈরি হাতের অলংকার। সেখানে নারী মূর্তির হাতে পাওয়া গেছে চুড়ির আভাস, যা ছিল সেই সময়ের সৌন্দর্য ও সামাজিক অবস্থানের প্রতীক।

বাংলার চুড়ি শুধু অলংকার নয়, ঐতিহ্য

বাংলাদেশে কাচের চুড়ির কদর ছিল গ্রাম থেকে শহরজুড়ে। ঈদ, পূজা, বিয়ে, মেলা—প্রতিটি উপলক্ষেই চুড়ির দোকানে থাকত উপচে পড়া ভিড়। আজও পুরান ঢাকার ‘চুড়ি তলি’ বা রাজশাহীর বোয়ালিয়া বাজারে গেলে দেখা যায় সেই পুরনো রঙিন দোকানগুলোর আলো।

নারীরা শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং বিশ্বাসের জায়গা থেকেও চুড়ি পরতেন। বিশেষ করে লাল ও সবুজ রঙ ছিল শুভর প্রতীক—সবুজ মানে শান্তি, লাল মানে ভালোবাসা ও মাতৃত্ব। বিধবা নারীরা একসময় চুড়ি পরতেন না—এই নিষেধাজ্ঞাও বলত সমাজ কীভাবে চুড়িকে নারীর অবস্থানের প্রতীক করে তুলেছিল।

আধুনিকতায় ঐতিহ্যের ছোঁয়া

বর্তমান যুগে ডিজাইনার জুয়েলারির ভিড়ে কাচের চুড়ি হয়তো কিছুটা কোণঠাসা, কিন্তু হারায়নি তার আবেদন। তরুণীরা আজ আবার কাচের চুড়ির দিকে ফিরে তাকাচ্ছেন—ওয়েস্টার্ন ড্রেসের সাথে একজোড়া লাল কাচের চুড়ি যেন হয়ে উঠছে আত্মপরিচয়ের প্রকাশ।

শিল্পী, ফ্যাশন ডিজাইনার, এমনকি টিকটক-ইনস্টাগ্রামের ইনফ্লুয়েন্সারদের হাতেও এখন দেখা যায় এই রঙিন কাচ—যেটা বলে, ‘আমি আধুনিক, কিন্তু আমার শিকড় হারায়নি।’

চুড়ির শব্দে ফিরে দেখা

যখন কেউ হাতে পরে কাচের চুড়ি, তখন শুধু রঙ নয়—জেগে ওঠে একটা ইতিহাস। প্রতিটি কাচের টুকরো যেন সময়ের আয়নায় বাঁধা এক স্মৃতি, এক গল্প, এক সংস্কৃতি।

কাচ ভেঙে যায়, চুড়িও ভেঙে পড়ে। কিন্তু এর ইতিহাস ভাঙে না। তা রয়ে যায় আমাদের মনের ভেতর, একটি মৃদু শব্দের মতো—টুন টুন টুন…

সারাবাংলা/এফএন/এএসজি

কাঁচের চুড়ি ফারহানা নীলা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর