শীত এলেই পুরো দেশ যেন বিয়ের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। একাধিক বাড়িতে একসঙ্গে মাইকের শব্দ, সাজসজ্জা, অতিথি সমাগম— সব মিলিয়ে শীতকাল যেন হয়ে যায় উৎসবের ঋতু। কিন্তু শীতেই কেন বিয়ের চাপ বাড়ে? কারণের তালিকা এক নয়, বহু। আবহাওয়া, অর্থনীতি, সামাজিক রীতি, মনস্তত্ত্ব— এসবের সঙ্গে আরও কিছু বাস্তব কারণ জুড়ে শীতকে তৈরি করেছে ‘পারফেক্ট ওয়েডিং সিজন’।
আবহাওয়ার আরাম ও কাজের সুবিধা
বিয়ের আয়োজন মানেই দাওয়াত দেওয়া, প্যান্ডেল সাজানো, রান্নার প্রস্তুতি, অতিথিদের আপ্যায়ন— অগণিত পরিশ্রম। গরমে সামান্য কাজেই হাঁপিয়ে ওঠে মানুষ, ঘাম আর আর্দ্রতার কারণে কর্মশক্তি কমে যায়। শীতে তার উল্টো— শরীর চাঙা থাকে, কাজের গতি বেড়ে যায়।
শীতের ঠাণ্ডা বাতাস অনুষ্ঠান আয়োজনকে শুধু সহজই করে না, পুরো অভিজ্ঞতাটাই আনন্দময় করে তোলে।
সাজগোজে বাড়তি স্বস্তি
গরমে যে সাজ সকাল থেকে দুপুরই টেকে না, শীতে তা থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। দক্ষিণ এশিয়ার মেকআপ আর ভারী বিয়ের পোশাক গরমে অনেক সময় অসুবিধা তৈরি করে— ঘাম, অস্বস্তি, মেকআপ নষ্ট হওয়া— সব মিলিয়ে ঝামেলা।
কিন্তু শীতে কনে-বর থেকে শুরু করে অতিথি— সবার সাজগোজই থাকে স্থায়ী ও স্বস্তিদায়ক। ফলে সবাই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারে মন খুলে।
ফুল-ডেকোরেশনের সহজলভ্যতা
শীত হল ফুলের রাজত্বের সময়। ডালিম, রজনীগন্ধা, অর্কিড, গাঁদা, গোলাপ, জুঁই— শীতকালে পাওয়া যায় সবচেয়ে টাটকা, দৃষ্টিনন্দন ফুল। তাই কৃত্রিম ফুল ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে না। চাইলে পুরো বিয়ের মণ্ডপ প্রাকৃতিক ফুলে সাজানো যায়— যা দেখতে যেমন অপূর্ব, খরচেও অনেকটা সাশ্রয়ী।
মৌসুমি ছুটি ও পারিবারিক মিলন
শীতে স্কুল-কলেজের শীতকালীন ছুটি থাকে। দেশে অনেক পরিবারের প্রবাসী সদস্যও বছরের শেষে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফেরেন। সবাই যখন একসঙ্গে থাকে, তখন বিয়ের মতো বড় অনুষ্ঠান করা সহজ হয়। বিশেষ করে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে উৎসবমুখর পরিবেশ— ভাই-বোনেরা একসাথে, কাজের চাপ কম, ফ্রি সময় বেশি— এসবই সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে।
অর্থনৈতিক হিসাব–নিকাশ
শীতে বিয়ে করার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক দিক রয়েছে। বহু ক্ষেত্রেই বছরের শেষে বোনাস পাওয়া যায়— কর্পোরেট, ব্যাংকিং, সরকারি চাকরি— সব জায়গায়ই। ফলে পরিবারগুলোর হাতে থাকে অতিরিক্ত টাকা, যা তারা বিয়ের মতো খরচসাপেক্ষ অনুষ্ঠানে ব্যয় করতে পারেন।
এ ছাড়া বিয়ের বাজারে (ক্যাটারিং, সাজসজ্জা, ফটোগ্রাফি, ভাড়া) ব্যবসাগুলোর প্রস্তুতিও শীতে থাকে সর্বোচ্চ শিখরে, ফলে সেবা পাওয়া সহজ এবং বৈচিত্র্যময় হয়।
বাংলাদেশি রীতি ও বিশ্বাস
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় ‘শুভ লগ্ন’ বা বিয়ের শুভ তারিখ নির্ধারণে শীতকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। অনেকে মনে করেন, শীতের সময় তারকা-সংক্রান্ত শুভ দিন বেশি থাকে, যা ঐতিহ্যগতভাবে বিয়ের জন্য উত্তম।
যদিও আধুনিক শহুরে দম্পতিরা এসব কম মানেন, তবে পরিবারিক প্রভাব ও রীতির কারণে শীতকালীন বিয়েই প্রধান থাকে।
মৌসুমি ফলের ঝামেলা নেই
গরমকালে বিয়েতে ফল কেনা বড় এক চ্যালেঞ্জ— আম, লিচু, তরমুজের সময় না হলে দাম বেশি, আবার পাওয়া যায় কম। শীতে এমন মৌসুমি ফলের চাহিদা থাকে না। ফলে বিয়ের খরচ ও আয়োজন দুটোই সহজ হয়।
বিদ্যুৎ বিলের বাড়তি সুবিধা
শীত মানেই কম বিদ্যুৎ ব্যবহার। ফ্যান চলে না, এসির তো প্রশ্নই আসে না, রাতেও ঘুমাতে যায় সবাই তাড়াতাড়ি। ফলে বিয়ের মৌসুমে ঘরভাড়া বা বাড়ির বিদ্যুৎ খরচও কম থাকে— যা অনুষ্ঠানের অতিরিক্ত ব্যয়ের মাঝে এক বড় সুবিধা।
মশার ঝামেলা কম
বিয়ের বাড়িতে সাধারণত অতিথির ভিড় থাকে, কিন্তু সবার জন্য মশারি থাকে না। গরমে মশার উৎপাত বিয়ে বাড়িকে পরিণত করে কষ্ট-কাহিনিতে। কিন্তু শীতে মশা তুলনামূলক কম— অতিথিরা কাথা-কম্বল দিয়ে ঘুমালে মশা কামড়ানোর সুযোগই থাকে না।
হানিমুনে অসাধারণ অভিজ্ঞতা
বিয়ের পর নতুন সম্পর্ক উদ্যাপনের সেরা সময়ও শীত। সূর্যের তাপ নেই, ক্লান্তিকর ভ্রমণ নেই, আরামদায়ক আবহাওয়া নতুনত্বের আনন্দকে করে আরও পূর্ণ। কক্সবাজার, সিলেট, কাপ্তাই— সব জায়গাই শীতে যেন নিজের সৌন্দর্য দিয়ে নবদম্পতিকে স্বাগত জানায়।
মনোবিজ্ঞান ও সামাজিকতার প্রভাব
গবেষণা বলছে, শীতে মানুষ বেশি সামাজিক, বেশি উচ্ছ্বসিত ও পরিবারকেন্দ্রিক হয়। বছরের শেষ মানেই নতুন পরিকল্পনা, নতুন যাত্রা। পরিবারগুলো তখন বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহী হয়— বিয়েও তার একটি।
শেষ কথা
শীতকালে বিয়ে শুধু রীতি বা সুবিধার বিষয় নয়— এ এক অপূর্ব সমন্বয়। আবহাওয়ার স্বস্তি, সৌন্দর্য, কম ঝামেলা, সাজসজ্জার সহজতা, উৎসবের আবহ এবং নতুন শুরুর মানসিকতা— সব মিলে শীতই হয়ে ওঠে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর উৎসব— বিয়ের সেরা সময়।