কে কত সুন্দর?
১ অক্টোবর ২০১৮ ১৩:৪১
রাজনীন ফারজানা।।
মহামতি প্লেটোর মতে, ‘Beauty lies in the eyes of the beholder‘ অর্থাৎ সৌন্দর্য নির্ভর করে দেখার চোখের উপর। যেহেতু একেকজনের দেখার চোখ আলাদা হয় তাই সৌন্দর্যের সংজ্ঞাও ব্যক্তিভেদে বদলে যায়।
এই কারণেই পৃথিবীর এক এক প্রান্তে এক একরকম বৈশিষ্ট্যকে সৌন্দর্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই যে কোন প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে গৌর বর্ণ, টিকলো নাক আর গোলাপি ঠোঁটকে সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে ঠিক করা হয়েছে তা যেন আর বদলালোই না।
প্রাচীন হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণরা ছিলেন সমাজের উঁচু শ্রেণির বাসিন্দা। ব্রাহ্মণরা সাধারণত ফর্সা, লম্বা, তীক্ষ্ণ নাক চোখের হতেন। সমাজের বাকি সব নিম্ন শ্রেণির লোকের কাছে উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণদের চেহারাই ছিল সুন্দর তা বলা বাহুল্য। এরপর আমাদের শ্যামবর্ণের দেশে একে একে মোগল, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ আর ইংরেজরা শাসন করে যাদের সবারই গায়ের রঙ ফর্সা। দীর্ঘদিন ধরে নানারকম গৌরবর্ণের ককেশীয় জাতির শাসক দ্বারা শাসিত হতে হতে আমাদের রক্তের মাঝেই যেন ঢুকে গেছে সুন্দর মানেই চকচকে ফর্সা গায়ের রঙ। এর থেকে আর যেন বের হতেই পারিনি আমরা।
তাই তো এখনও আমাদের দেশের অধিকাংশ মেয়ের কাছে প্রসাধনী মানেই রঙ ফর্সাকারী ক্রিম, সাবান কিংবা ফেসওয়াশ। অবস্থা এমনই করুণ যে স্থানীয় বাজারে নিজেদের রঙের সাথে ম্যাচিং করে এমন মেকআপ পণ্য দুষ্প্রাপ্য বলতে গেলে। ফাউন্ডেশন বলেন কিংবা ফেসওয়াশ, সবই কয়েক শেড হালকা পাওয়া যায়। কারণ নিতান্ত শ্যামা বর্ণের মেয়েটাও চায় তাকে যেন ফর্সা দেখা যায়। তাই সে লাইট শেডের মেকআপ কেনে।
এভাবেই আমাদের কাছে সুন্দর মানেই ফর্সা চেহারা। কিন্তু সৌন্দর্য তো একজন মানুষের আত্মিক এবং বাহ্যিক প্রেজেন্স বা উপস্থিতি। সেই উপস্থিতি মানে শুধু গায়ের রঙ, নাক মুখের গঠন বা শারীরিক গঠনই নয়, সৌন্দর্য একজন মানুষের পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি সৌন্দর্য বাহ্যিক রূপে নয়, পরিপূর্ণ জীবনযাপনে।
একইসাথে বাহ্যিক সৌন্দর্য এবং চমৎকার অভিনয় দিয়ে খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন অভিনেতা আরেফিন শুভ। শুভর কাছে জানতে চেয়েছিলাম মানুষ কিসে সুন্দর হয়। তিনি বললেন, ‘মানুষ সুন্দর হয় তার ব্যক্তিত্বে। গায়ের রঙ কিংবা শারীরিক গঠন সুন্দর হলেই একজন মানুষ সুন্দর তা কিন্তু না। সামগ্রিক আচার আচরণ আর জীবনযাপন মিলিয়েই একজন মানুষ সুন্দর হয় ।’
বাহ্যিক সৌন্দর্য সাময়িকভাবে আকৃষ্ট করলেও তার ভেতরটা সুন্দর না হলে তাকে বেশিক্ষণ ভালো লাগে না, বলেন শুভ।
তিনি আরও বলেন, ‘দেখবেন একজন মানুষের চেহারা হয়তো তত আকর্ষনীয় নয়, কিন্তু তার আচরণ এতো চমৎকার, যে আপনি তার ম্যানার দেখে মুগ্ধ হবেন। আবার গায়ের রঙ ফর্সা, চেহারা ভাল কারও আচরণ সুন্দর বা পরিশীলিত না হলে তাকে আর ভালো লাগবেনা। অর্থাৎ যার ভেতরটা সুন্দর সেই সুন্দর মানুষ।’
কীভাবে সুন্দর হতে পারে একজন মানুষ, জানতে চাইলে আরেফিন শুভ বলেন, শিক্ষিত, জ্ঞানী আর সংস্কৃতিবান একজন মানুষ ভেতর থেকে সুন্দর হয়। সেইসাথে কেউ যদি প্রচুর ভ্রমণ করেন তাহলেও তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয় বলে তিনি জানান। নানা জায়গায় গেলে নানারকম মানুষ আর সংস্কৃতির সাথে পরিচয় হয় যা মানুষের মননকে সুন্দর করে। আর এভাবেই ভালো বই পড়ে, ভালো সিনেমা দেখেও মানুষের ভেতরটা আলোকিত হয় আর সে মানুষ হিসেবে সুন্দর হয়।
আর নিতান্ত বাহ্যিক সৌন্দর্যের কথা যদি বলি তবে গায়ের রঙের থেকেও একজন মানুষের পরিশীলিত বাচনভঙ্গি, পারসোনাল হাইজিন বা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, কথা বলার সময় শব্দচয়ন এসব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে জনপ্রিয় মডেল এবং উপস্থাপক শারমিন লাকির কাছে সৌন্দর্য মানে ‘হ্যাভিং এ গুড সৌল’। লাকির কাছে যে ব্যাক্তির ভেতরটা আলোকিত, যিনি মানুষ হিসেবে সৎ, দয়াবান অর্থাৎ বিশুদ্ধ হৃদয়ের সেই মানুষ হিসেবে সুন্দর, তার বাহ্যিক সৌন্দর্য যেমনই হোক না কেন।
তিনি আরও বলেন, বাইরের চাকচিক্য সাময়িকভাবে আকৃষ্ট করলেও কারও ভেতটা বিশুদ্ধ না হলে তাকে বেশিক্ষন ভালো লাগে না। ঠিক কোন আচরণের কারণে একজন মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, অহংকার, রুঢ় বাচনভঙ্গি, নির্দয় আচরণ, অযথা ঝগড়াঝাঁটি এসব একজন মানুষকে অসুন্দর করে। চমৎকার সব মানবীয় গুণাবলীর সমন্বয়েই একজন মানুষ সুন্দর হয়, বলেন তিনি।
ব্যাক্তিগত জীবনে নিজেকে একজন সুন্দর মানুষ হিসেবে প্রকাশ করতে তিনি যেটা ফলো করেন তা হল কখনও কারও সাথে রুড বা রুঢ় না হতে চেষ্টা করেন আর ঝগড়াঝাটি এড়িয়ে চলেন। মানুষ হিসেবে অনেকসময় হয়ত ভুল ত্রুটি হয়ে যায় কিন্তু চেষ্টা করেন ভুলটা শুধরে নিতে। স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেন আর কখনও যেন কারও সাথে রুঢ় আচরণ না করেন। এভাবেই তিনি নিজেকে সুন্দর রাখতে চেষ্টা করেন।
গ্রুমিং প্রতিষ্ঠান উজ্জ্বলার ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও রেড বিউটি স্যালনের সত্ত্বাধিকারী আফরোজা পারভীন। একজন গ্রুমিং এক্সপার্ট হিসেবে তার কাছে সুন্দর থাকার মানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, পরিচ্ছন্ন মানানসই পোশাক পরা, গোছানো থাকা আর সর্বোপরি মনটাকে সুন্দর রাখা। সৌন্দর্য চেহারার কিংবা গায়ের রঙের উপর নির্ভর করে না বলে জানান তিনি।
নিজেকে একজন সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে পারসোনাল গ্রুমিঙয়ের বিকল্প নাই বলে জানান তিনি। বাহ্যিক সৌন্দর্যের জন্য ছেলে মেয়ে উভয়কেই হাত পায়ের পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। নখ সবসময় কেটে, শেপ করে, পরিষ্কার রাখতে হবে। মেয়েদের নখে নেইলপলিশ দেওয়া থাকলে সুন্দর লাগে বলে জানান তিনি। অনেকসময় অনেক জায়গায় হ্যান্ড শেইক করতে হয়, তখন হাত খসখসে থাকলে বিপরীত পাশের ব্যাক্তিটির আপনার সম্পর্কে ভালো কোন অনুভূতি তৈরি হবে না। তাই সবসময় হাতে লোশন দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেন তিনি। এতে হাতের ত্বক নরম থাকবে।
একজন মানুষের সৌন্দর্য কমে যেতে পারে যদি কারও গায়ে, চুলে, মুখে কিংবা পায়ে দুর্গন্ধ থাকে। তাই এ ব্যপারে সবসময় সচেতন থাকতে হবে। আফরোজা পারভীন বলেন, মুখের দুর্গন্ধ একজন ব্যক্তির শুধু সৌন্দর্যই নয় তার ব্যক্তিত্বও হানি করে। তাই প্রতিদিন ব্রাশ করা, মাউথওয়াশ ব্যাবহার ও ফ্লসিং করার উপর গুরুত্ব দেন তিনি। ব্যাগে পিপারমিন্ট চিউইংগাম বা চকলেট রাখা যায়। কিছুদিন পরপর একজন ডেন্টিস্ট দেখিয়ে ওরাল হেলথ বা মুখের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে হবে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, গায়ের দুর্গন্ধ দূর করতে পরিষ্কার কাপড় পরতে হবে ও প্রতিদিন গোসল করে ডিওডোরেন্ট, পারফিউম ইত্যাদি ব্যাবহার করতে হবে। অনেকসময় আন্ডার গার্মেন্টের কারণেও মানুষের গায়ে দুর্গন্ধ হয়। প্রতিদিন ধোয়া আর শুকনো অন্তর্বাস ব্যবহার করলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে বলা জানান আফরোজা পারভীন।
কারও কারও দেখা যায় পায়ে খুব দুর্গন্ধ হয়, বিশেষত যারা দীর্ঘসময় জুতা মোজা পরেন তাদের এই সমস্যা বেশি হয়। তারা পা পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি প্রতিদিন পরিষ্কার মোজা ব্যবহার করবেন। সম্ভব হলে রোদে শুকানো মোজা ব্যবহার করলে ভালো হবে বলে জানান আফরোজা পারভীন। জুতাও ব্যবহারের পর রোদে কিংবা বাতাসে শুকিয়ে নিতে হবে, বলেন তিনি।
বাহ্যিক সৌন্দর্যের সাথে পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি সাজ পোশাকও গুরুত্বপূর্ণ। আফরোজা পারভীন বলেন, নিজেকে সুন্দর দেখাতে বয়স এবং পরিবেশ বুঝে পরিচ্ছন্ন কাপড় পরার পাশাপাশি ব্যাগ এবং জুতার দিকেও নজর দিতে হবে। একসেসরি সবসময় পোশাকের সাথে মানানসই হতে হবে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ব্যাগ নেবেন সেই একই ব্যাগ অফিসে কিংবা শপিংয়ে যাওয়ার জন্য মানানসই কিনা সেটা বুঝতে হবে। বাইরে যাওয়ার সময় সুন্দর একটা কাপড় পড়ে সাথে যদি তলা ক্ষয়ে যাওয়া জুতা পরেন তাহলে একদমই ভালো লাগবে না। নিজের ব্যক্তিগত স্টাইল স্টেটমেন্ট ঠিক করে নিতে চাইলে কোন একজন ফ্যাশন এক্সপার্টের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, জানান আফরোজা পারভীন।
ত্বকের যত্ন সৌন্দর্য চর্চার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবারই প্রতিদিন ত্বক পরিষ্কার করে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। ত্বকে কোন সমস্যা থাকলে কিংবা নিজে নিজে যত্ন নিতে না পারলে একজন বিউটি এক্সপার্টের সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দেন এই গ্রুমিং এক্সপার্ট।
নিজেকে সুন্দর দেখাতে পোশাকের পাশাপাশি চুলের দিকেও নজর দিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেকেই দেখা যায় চুলে তেল দিয়ে বের হয়ে গেছেন। চুলে তেল নেওয়া সমস্যা না কিন্তু তেল দিলেও চুলটাকে সুন্দর করে সেট করে রাখতে হবে। ছেলেরা ব্যাক কম্ব করে আর মেয়েরা মানানসইভাবে চুলটাকে আঁচড়ে, বেঁধে রাখলে ভালো দেখাবে। এলোমেলো চুল একজন ব্যক্তির সৌন্দর্য নষ্ট করে।
বাহ্যিকভাবে কেউ যত সুন্দরই দেখাক না কেন ভেতরটা সুন্দর না হলে সব সৌন্দর্য মাঠে মারা যাবে। তাই নিজের মানসিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। আফরোজা পারভীন বলেন একজন গ্রুমিং এক্সপার্ট হিসেবে তিনি সবাইকে বই পড়ার পরামর্শ দেন।
সারাদিনে অন্তত দুই ঘন্টা বই, ম্যাগাজিন কিংবা সংবাদপত্র পড়লে একজন ব্যক্তি নতুন নতুন অনেককিছু শিখতে পারবেন বলে পরামর্শ দেন আফরোজা পারভীন। বই থেকে পাওয়া তথ্য তাকে আলোকিত করবে। কিন্তু এই সময়টা সোশাল মিডিয়ায় কাটালে অনেকধরণের নেতিবাচকতার সংস্পর্শে আসে যা একজন ব্যক্তির ভেতরে হতাশা, অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। কেউ বই পড়ার সময় না পেলেও একটা ভালো সিনেমা দেখতে পারে কিংবা প্রতিদিন অন্তত আধাঘন্টা মিউজিক শুনতে পারে। এতে মন ভালো থাকবে, নেতিবাচকতা থেকে দূরে থাকবে। যার ভেতর অর্থাৎ মন যত সুন্দর সে মানুষ হিসেবে তত সুন্দর, তত আকর্ষণীয়।
ফিচার ফটো মডেল- নীল এবং আত্রলিতা
সারাবাংলা/আরএফ/ এসএস
আরও পড়ুন, বব চুলে বিউটিফুল
আফরোজা পারভীন আরেফিন শুভ গ্রুমিং এক্সপার্ট ব্যক্তিত্ব মানসিক সৌন্দর্য শারমিন লাকি সুন্দর সৌন্দর্য সৌন্দর্য চর্চা