স্নিগ্ধ প্রবেশ আর পরিপাটি অন্দর
১২ জুলাই ২০১৯ ১০:৫৩
‘বারান্দাটা পিছন দিকে, ডাইনে-বাঁয়ে ঘর,
সামনে গাছের সারি।
দৃশ্যটা খুব পরিচিত, এখনো পর-পর
সাজিয়ে নিতে পারি।’
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘দুপুরবেলায় নিলাম’ কবিতার লাইনগুলো এক ঝটকায় নিয়ে যায় কয়েক দশক আগের মফস্বলের কোনো এক শহরে। এই কংক্রিটের নগরি ঢাকাতেও এক সময় ঘরের সামনে গাছের সারি—এমন বাড়ির অভাব ছিল না। এখনো খুঁজলে দুএকটা এমন বাড়ি পাওয়া যেতে পারে। তবে সারি সারি সুউচ্চ ভবনের জঙ্গলে এখন একটুখানি সবুজের ছোঁয়া খুঁজে পেলেও যেন চোখ ও মনের শান্তি।
বাড়ির সামনে বাগান করার জায়গা বা গাছে ঘেরা উঠোন নেই তো কি হয়েছে, কেউ কেউ হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের সদর দরজার সামনেও গড়ে তোলেন সবুজের ঘেরা ওয়াকওয়ে। এমনই সুন্দর প্রবেশ দ্বার আর ছিমছাম বাসা মাশাওফি আমিন আর মাহমুদ নবী দম্পতির। লিফট থেকে তাদের ঘরের দরজা পর্যন্ত আর পাশের সিঁড়িতে নানা আকারের গাছের টব, কনসোল টেবিল, আয়না, শো-পিস আর নানারকম লাইটে সাজানো।
সুন্দর করে সাজানো ঘরের বাইরেটা দেখেই অনুমান করা যায় ঘরের ভেতরটাও চমৎকার হবে। ঘরে ঢুকতেই খোলামেলা পরিবেশ আর ছিমছাম আসবাবে সাজানো লিভিং এরিয়া দৃষ্টি কেড়ে নেয়। বসার ঘরটা লম্বাটে। এক জায়গায় ভারী ভারী আসবাব না রেখে কয়েক জায়গায় আলাদা আলাদা করে বসার ব্যবস্থা করা। ঘরের মেঝেটা খোলা থাকায় পুরো ঘরজুড়ে বেশ একটা খোলামেলা পরিবেশ।
দেওয়াল ঘেঁষে রাখা চাপা সাদা আর কালচে কাঠের স্লিম ডিজাইনের সোফা আর ডিভান। গৃহকর্তী মাশাওফি আমিন বলেন, ছিমছামভাবে ঘর সাজাতে পছন্দ করেন তিনি। তিনি চান ঘর যেন পরিবারের সদস্যদের স্বাচ্ছ্যন্দ এবং স্বস্তির একটি জায়গা হয়ে ওঠে। তাই ঘর সাজানোর সময় সেদিকটাতেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। অতিরিক্ত আর অপ্রয়জনীয় জিনিসে ঘর ভর্তি করেন না। এতে ঘর পরিষ্কার করতেও সুবিধা বলে জানান তিনি।
বসার ঘরের এক পাশে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত কাঁচের জানালা। জানালার ওপাশে খোলা আকাশ। পর পর বেশ কয়েকটি বাড়ি দুই বা তিন তলায় শেষ হওয়ায় বেশ অনেকটা দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলাচলে কোনো বাঁধা নেই। সারাক্ষণ আলো আর হাওয়া এসে ভরিয়ে তোলে ঘরের ভেতরটা। প্রাকৃতিক আলোর পাশাপাশি আছে কৃত্রিম আলোর ব্যস্থাও। দেয়ালের চাপা সাদা রঙে সেই আলোর প্রতিবিম্ব এসে চারদিকে কেমন একটা শান্তি শান্তি অনুভব। খোলামেলা গৃহকোণের প্রতি ভালোবাসার প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল মাশাওফি আমিনের কথাতেও। তিনি বলেন, ‘এই নিরিবিলি গৃহকোণের কারণেই হয়তো এই পরিবারের সদস্যরা যে যেখানেই যাক না কেনো সকলেই ঘরে ফিরতে ব্যাকুল থাকেন।’
দেয়ালজোড়া লম্বা জানালার নিচে চটের শতরঞ্জি বিছিয়ে রেওয়াজের আসন বানানো হয়েছেন। শতরঞ্জির দুপাশে গাছের টবে শান্তির অনুভূতি। এখানে হারমোনিয়াম, বসার কুশন আর কাঠ ও দড়ির তৈরি নিচু টুল। মাশাওফি আমিন আর তার একমাত্র মেয়ে জলছবি দুজনেরই গানের চর্চা চলে এখানে।
জানালার বাইরের খোলামেলা ভাবটা ঘরের ভেতরেও ধরে রাখার জন্য ঘরের ভেতর উঁচু বা ভারী আসবাব রাখা হয়নি। শুধু বসার ঘরের এক কোণে একটা নৌকা আকৃতির শো-পিস রাখার তাকে সাজানো অল্প কিন্তু রুচিশীল শো-পিস।
গৃহকর্তী মাশাওফি আমিন জানালেন গাদা গাদা ক্রিস্টালের শো-পিস তার পছন্দ নয়। এখানে তিনি স্মৃতিময় কিছু জিনিস রেখেছেন। সেখানে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা গৃহকর্তার বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা স্মৃতির টুকরো যেমন জায়গা পেয়েছে তেমনি জায়গা পেয়েছে মাশাওফির বাবার বাড়ি থেকে আনা পিতলের গোলাপ পানি ছিটানোর (মিলাদের সময় ব্যবহৃত হত) পাত্র।
দেয়ালে পারিবারির ছবি, সুভ্যেনির ভেন্যির, মাশাওফির নিজের হাতে আঁকা ছবি দুএকটা। ছায়ানটের বাংলা পঞ্জিকা ঘরের ভেতরের ছিমছাম পরিবেশে যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা। পারিবারিক ছবির দেখা মিলবে সব ঘরেই। সবগুলো ঘরের দেয়াল, পড়ার টেবিলে, সাইড টেবিলে সব জায়গাতেই। সুন্দর আর নিরিবিলি গৃহসজ্জায় আন্তরিক আবহ এনেছে পারিবারিক ছবির ব্যবহার।
অস্থায়ী নিবাস হলেও নিজেদের বাসগৃহ মনের মতো করে গড়ে নিয়েছেন এই দম্পতি। মাশাওফি আমিন বলেন, ঢাকা সেনানিবাসের এই বাড়িটা তার সপ্নের বাড়ি না হলেও ছিমছাম এই ফ্লাটটি তার বেশ পছন্দের। গল্পের ছলে তিনি জানান, দেশের নানা প্রান্তের সেনানিবাসের সরকারি বাড়িতে কেটেছে জীবনের বেশিরভাগ সময়। সবসময়ই তিনি নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছেন আপন গৃহকোণ।
জানতে চাইলাম, তার স্বপ্নের বাড়ি কী ঠিক এই বাড়ির মতোই হবে? বললেন, এই বাসার মতোই খোলামেলা হবে। তবে নিজের বাড়িতে গান, বই আর আড্ডার জন্য থাকবে আলাদা আলাদা জায়গা। এখন যেমন ঘর, বারান্দা আর বাসার সামনে গাছপালা তখন বাড়ির ছাদে রাখাত চান সবুজ ঘাসের গালিচা, শিউলি, বকুল, কাঠগোলাপ আর নানারকম ফুল থাকবে।
মাশাওফি আমিন আর মাহমুদ নবী দম্পতির স্বপ্নের বাড়িতে প্রচুর বই থাকবে যা এই অস্থায়ী আবাস দেখলেই বোঝা যায়। ছেলে অরণ্যের ঘরে বিশাল বইয়ের তাক। সেখানে পরিবারের সবার সবধরনের বই ক্যাটাগরি অনুযায়ী সাজানো। বইয়ের জন্য আলাদা জায়গা রয়েছে দম্পতির শোবার ঘরেও। মাশাওফি বলেন, বই আর গাছ ছাড়া জীবন কল্পনাও করতে পারেন না তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা।
প্রতিবছর বইমেলায় নিজেরা যেমন কেনেন তেমনি সন্তানদেরও প্রচুর বই কিনে দেন তারা। আছে স্মৃতিময় নানা সংগ্রহও। মাশাওফির কেজিতে পড়ার সময়ে উপহার পাওয়া ইউরি দ্রুজকভের লেখা, ‘পেন্সিল আর সর্বকর্মার অ্যাডভেঞ্চার’ ও হ্যারিয়েট বিচার স্টো’র লেখা ‘আঙ্কল টমস কেবিন’ এখনো আছে যত্নে সাজানো। বুকশেলফে যত্নে আছে মাহমুদের স্কুল আর কলেজের ম্যাগাজিনগুলোও। বাবা-মায়ের ছোটবেলার বইয়ের পাশাপাশি আছে দুই সন্তান জলছবি আর অরণ্যের ছোটবেলায় পড়া বইগুলোও। বইপ্রিয় এই পরিবারের সবাই রাতে ঘুমোতে যায় একটা বই সঙ্গে নিয়ে।
গৃহসজ্জা মাশাওফির অনেকটা জুড়ে। পুরো বাসা ছিমছাম ছবির মতো গুছিয়ে রাখতে সাহায্য করে তার স্বামী দুই সন্তান। সাহায্য পেলেও সবটা নিজের হাতেই করতে ভালোবাসেন তিনি। খুঁটিনাটি সব দিকে নজর দিতে গিয়ে অনেকটা সময় লাগলেও ঘরের কাজ ভালোবেসেই করেন তিনি। আর কে না জানে ভালোলাগার কাজে ক্লান্তি আসে না। কিছুদিন পর পর বাড়ির সাজসজ্জা পরিবর্তন করতেও তাই ক্লান্তি আসেনা মাশাওফির। একঘেয়ে ঘরে তার মন টেকে না যে।
যখন ছোট ছিলেন, ছুটির দিনে বাবার সঙ্গে ভাই-বোন সবাই মিলে তাদের বাসার সব আসবাবপত্র মোছা, বাগান পরিষ্কার করা ও বাসা গোছাতেন। মা-বাবা দুজনকেই দেখেছেন অসম্ভব গোছানো। সেই প্রভাবই পড়েছে তার ওপর। ছোট থেকেই গোছানো আর সুন্দরের প্রতি তাই তার অন্যরকম আকর্ষণ। বিয়ের পর জীবনসঙ্গী হিসেবে যাকে পেয়েছেন তিনিও অসম্ভব রকম পরিপাটি এবং সৌখিন হওয়ায় গৃহসজ্জা তাদের দৈন্দদিন জীবনের অংশ। সবাই মিলেই পরিপাটি রাখেন তাদের স্বপ্ন-সুন্দর সবুজে ঘেরা গৃহকোণ।
ছবি- আশীষ সেনগুপ্ত
সারাবাংলা/আরএফ