গুল্মজীবন
১ নভেম্বর ২০১৯ ১০:০০
স্মৃতির বয়ামে শৈশবের ভালোবাসা এবং স্নেহের হলুদ পাতাগুলো তো জমা থেকেই যায়, তার গায়ে লেগে লেগে থাকে ছোট ছোট আরো অগুনতি সাদা কালো ফিল্ম রীল- যা ফ্ল্যাশ ব্যাকে চোখের পাতায় এসে ভর করে কখনো সখনো। পিয়ানোর টুংটাং কর্ডের আবহ সংগীতে মনে পড়ে যায় ‘একসময় আমাদেরও ………….’
কখনো যন্ত্রণাবিদ্ধ হই- বয়ামের মুখে ছিপি এঁটে দিই ততক্ষনাৎ আবার, কখনো বা আমুদে হয়ে পড়ি সেই ভাবনায়। যা সুখের, তার শরীর থেকে কিছু কিছু হীরের কুচি উড়ে এসে জায়গা করে নেয় বর্তমানের কৌটোয়।
ছোট্ট একটি বাগান, অফুরন্ত মানসিক প্রশান্তির উৎস
ভাসা ভাসা মনে পড়ে, খুব খুব ছোটবেলায় আমরা একটা সাদা একতলা বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। সামনে একটা মাঝারি আকারের খোলা জায়গা, সঙ্গে লাগোয়া বারান্দা। আম্মাকে দেখতাম সেই খোলা জায়গায় , এই গাছের চারা, ওই গাছের বীজ জোগাড় করা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। পাখি খেয়ে ফেলবে বলে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে গাছের চারপাশে গোল করে ঘেরা দিয়ে দেওয়া, সার দেয়া, গাছের গোড়াতে মাটি দেয়া ইত্যাদি নিয়ে দুপুরের অবসরগুলো কুর্শি কাটায় বুনে ফেলতো।
আরও মনে পড়ে, কোনো কোনো সন্ধ্যায় এক স্নিগ্ধ সুবাস বারান্দা হয়ে ভেসে ভেসে এসে আমাদের ঘরগুলোতে ঢুকে যেতো, তখন জেনেছিলাম ওদের নাম, রজনীগন্ধা। আর সকালে মাখনের মতো নরম নরম কুসুম রঙা হলুদ আর সাদা ফুলগুলো যাদের ভার সহ্য করতে না পেরে গাছগুলো নুয়ে পড়তো, ওরা হলো চন্দ্রমল্লিকা। মনে পড়ে, কোনো কোনো দিন, রান্নার সময় দৌড় দিয়ে কাঁচামরিচ, কিংবা দুটো ঢেঁড়স , কিংবা করল্লা, বা কিছু লাল শাক তুলে নিয়ে এসে পরম যত্নে রান্না করে দুপুরে খাওয়ার টেবিলে গর্ব করে খাওয়ানো।
কংক্রিটের জঙ্গলে সবুজের ছোঁয়া
তখন কিছুই বুঝতাম না এসবের। দেখে গেছি শুধু। আরো মনে আছে একটা সময়, কবুতর আর হাঁস-মুরগী নিয়ে আম্মা মেতে উঠলো খুব। আকাশের গায়ে কাঁচা হলুদ, বেগুনি-গোলাপি রঙের পোঁচ লাগবার আগেই, কানে এসে সপাটে আছাড় খেতো ‘কুক্কুরু কু।
এরপর, আমাদের যখন কৈশোর, ঢাকা শহরের আকাশ তখন সংক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে আর উঠোনগুলো ভরে উঠছে ইট আর সিমেন্টে। রিপল ইফেক্ট হিসেবে আমাদের বিপন্ন কৈশোর গিয়ে ঠেকলো ১৫০০ স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাটবাড়িতে। সেখানে নেই কোনো খোলা জায়গা, আকাশের এক টুকরো নীল দেখা যায়, বাড়ির কোণার একচিলতে ঝুল বারান্দা থেকে।
আগে কখনই বোঝা যায় নি, কিন্তু আমার মায়ের সেই বৃক্ষপ্রেম একটু একটু করে নিশ্চয়ই বিকীর্ণ হয়েছিল আমার ছোট বোনের প্রাণে। আমি ছিলাম বই প্রেমিক। তাই চারদিকের ঘটনাগুলো আমাকে স্পর্শ করতো কম। দৃষ্টি আটকে থাকতো বইয়ের পাতায়। এক বিকেলে বই থেকে চোখ তুলে হঠাত যেন দেখলাম, লোহার গ্রীল দেয়া সবেধন ওই সামান্য জায়গাকে সে দিনের পর দিন জল দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে করে তুলেছে অমূল্য এক বারান্দা বাগান। নানান রঙের কৈলাশ, অর্কিড আর ফার্নে সাজানো সেই বারান্দা বাগান আমাদের চোখের আরাম, মনের শান্তি হয়ে ছায়া দিয়ে মায়া দিয়ে ঘিরে রইল বহুবছর।
চলমান জীবন তার সময় এবং নিয়ম অনুযায়ী আমাদের সবাইকেই যার যার গন্তব্যে পৌঁছানোর ট্রেনে তুলে দেয় স্টেশন থেকে। আমিও একসময় সেই ট্রেনে করে ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌছালাম পৃথিবীর অন্য এক গোলার্ধে, এক মরুভূমির দেশ ডালাস-টেক্সাসে। হ্যাঁ, টেক্সাস একসময় মরুভূমি ছিল। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের ঘূর্ণিতে সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু উচ্চ তাপমাত্রা এবং শুষ্কতা মাঝে মাঝে সহনীয়তার পারদ অতিক্রম করে। এখানকার গরমে এই রুক্ষ জমিতে বাগান করা খুব একটা সহজ কাজ না।
কিন্তু শৈশব কৈশোরের স্মৃতির বয়াম থেকে উপচে পড়ে সেই সবুজ হলুদ কমলা রঙের পালক গুলো। আমার মধ্যেও এই বৃক্ষক্ষুধা বোধের জন্ম নিতে শুরু করলো একসময়। ঘরের আসবাব পত্র, বুকশেল্ফ আর প্রিয় গৃহকোণে লতা পাতাগুলোকে মেলতে দিলাম আপন মনে।
যে সব গোত্রের উদ্ভিদ একটা বাড়িকে করে তুলতে পারে মনোরম তাদের মধ্যে “Succulent” অন্যতম। এরা মূলত Africa, Central America, European Alps, South America and South Africa থেকে উদ্ভূত। কান্ড এবং পাতা গুলো হয় বেশ ভারী, কারণ এরা এই জায়গাগুলোতে জল ধরে রাখে। এ কারণেই Succulent এর আক্ষরিক অর্থ ‘Juicy’ (রসালো)। এরা ক্যাকটাস বংশোদ্ভূত। আমরা যাকে ঘৃতকুমারী বা Aloe Vera বলে জানি সেটিও Succulent পরিবারের সদস্য। দেশে এই গাছগুলো দেখেছি কিন্তু এই গাছে যে কখনো ফুল হয় তা জানতামই না। হঠাৎ, একদিন এর একটি চিকন ডালে দেখলাম কুড়ি এসেছে, কিছুদিন পর চোখ জুড়ানো মন ভুলানো অপূর্ব গোলাপি রঙের ফুল ফুটলো। Succulent দের প্রাণস্পন্দনে ভরপুর দেখতে হলে কয়েকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, তা হলো –
১. এদের পর্যাপ্ত পরিমান আলো দরকার।
২. সরাসরি এদের মাটিতে জল দিয়ে আর্দ্র রাখতে হবে, কিন্তু অতিরিক্ত জল বের হয়ে যাবার জন্য প্লান্ট পট এর নিচে একটি খোলা জায়গা প্রয়োজন।
৩. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না রাখলে পোকা ধরে যেতে পারে পাতাগুলোতে।
৪. কিছুদিন পর পর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাখতে হবে যাতে করে সব দিকেই আলো পায়।
৫. যে কোনো মাটিতে এরা বাঁচতে পারেনা। এদের জন্য দরকার Mixed Potting Soil, যাতে মিশে থাকে বালি ও ঝামাপাথর। Succulent এর শেকড় খুব সহজেই আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তাই যখন এক পট থেকে আরেক পটে নেওয়ার প্রয়োজন হবে তখন খুব নরম ভাবে স্থানান্তর করতে হবে।
অন্দরবাগানে আরো অনেক পছন্দের লতা গুল্ম আছে আমার, আইভি লতা তাদের মধ্যে সুন্দরীতমা। এই অনিন্দ্যসুন্দর লতাটি সরাসরি সূর্যের আলোয় বাঁচেনা, কিন্তু প্রয়োজন হয় উজ্জ্বল আলোর। তাই বাড়িতে রাখলে জানালার পাশে রাখা যেতে পারে। টেবিল টপে অথবা ঝুলিয়েও দেয়া যেতে পারে। এরা সাধারন মাটিতেই আনন্দে বড় হয়ে ওঠে, ছড়িয়ে দেয় তাদেরকে চারদিকে। প্রচুর জল দিয়ে এদেরকে আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ভিজিয়ে রাখতে হয়। মাসে একবার সার দিয়ে আইভির মন রক্ষা করে নিতে হবে।
আর একটি লতা, যা সবার বাড়িতে বাড়িতে থাকবেই তা হল, মানি প্ল্যান্ট। মসযুক্ত মাটি হচ্ছে মানি প্ল্যান্ট এর প্রিয় নিবাস। সহনীয় তাপমাত্রা এবং উজ্জল আলো এদের অনুকুলে থাকলে এদের আর কিছু তেমন চাহিদা নেই। এছাড়া Dieffenbachia, Spathiphyllum Sweet Pablo এদেরকে কোলাজ করেও ঘরের প্রিয় কোণগুলোকে করে তোলা যায় আকর্ষনীয় এবং আরামের।
আমার এই ক্ষুদ্র পরিসরে অন্দরবাগান করার পেছনে আর একজনের উৎসাহ এবং সাহায্যের কথা উল্লেখ করতেই হয়। সে হল আমার সংসার সহযোদ্ধা। তার নিজস্ব শখ বাইরের বাগানে নানারকম সবজি আর biannual bulb দিয়ে মনোরম ল্যান্ডস্কেপিং করা। এদের মধ্যে প্রতিবছর ফিরে ফিরে আসে গ্ল্যাডিওলাস, টিউলিপ আর ড্যাফোডিল। এছাড়া রয়েছে গাদা, কসমস আর পিটুনিয়ার সমারোহ। সবজির মধ্যে করল্লা, জুকিনি, ঝিঙে, দুধকুসি, চালকুমুড়া, লাউ এবং বিভিন্ন ধরনের কাঁচামরিচ। এই শহরে ধীরে ধীরে শীত পড়ছে। দুদিন হল তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রী ফারেনহাইটের নীচে নেমে যাওয়াতে সব্জিসহ গাছগুলো এবং অন্যান্যদের অকাল মৃত্যু হয়েছে।
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে যখন ঘরে ফিরে জানালার পাশে আমার এই সন্তানসম গাছগুলোকে দেখি- ওরা সবাই মিলে একটু একটু করে সবুজ ছড়িয়ে দিচ্ছে আমার ঘরের কোণ গুলোতে তখন এক স্বর্গীয় সুখ এসে মনের অন্ধকার গুলোকে শাঁসিয়ে যায়। আর খাবার সময় নিজের বাগানের লাউ, করল্লা, কাঁচামরিচ এর স্বাদ যে কোনো রেস্তোরার থেকে সুস্বাদু তা বাজি রেখে বলতে পারি।
কিছুদিন আগে এক সমীক্ষায় পড়লাম, বাতাসে ওজোন লেয়ার বেড়ে যাচ্ছে বলে বড় বড় বৃক্ষগুলো উচ্চতায় বেড়ে উঠতে পারছেনা। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশগত ভারসাম্য এবং প্রতিক্রিয়া হিসেবে বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমান্বয়ে জলের ঘাটতি। এ ভাবে চলতে থাকলে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে রেখে যাবো বৃক্ষহীন আর জলহীন, এক ভয়াবহ পৃথিবীতে। আমাদের সচেতন হবার সময় বহু আগেই পেরিয়ে গেছে। কিন্তু যা আছে, তা এখনো আমরা সংরক্ষণ করতে পারি। আসুন অন্যোন্যজীবিত্বে আমরা একে অন্যকে বাঁচিয়ে রাখি।
লেখক- সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং রেডিও প্রোগ্রামার, ডালাস