অতীতের কাছে জিম্মি হয়ে থাকব না: নাওমি ক্যাম্পবেল
২০ নভেম্বর ২০১৯ ১০:৩০
নাওমি ক্যাম্পবেল— আশির শেষ ও নব্বইয়ের দশকের সাড়া জাগানো সুপার মডেল। নব্বইয়ের দশকে ফ্যাশন ও সংবাদ মাধ্যমে যে ছয় জনকে সুপার মডেলের তকমা দেওয়া হয়, নাওমি তাদের একজন। তীব্র সৌন্দর্য ও সাহসী ব্যক্তিত্বের জন্য আলোচনায় থেকেছেন সবসময়ই। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ভালোবাসা আর দ্বন্দের কারণে খুব একটা সাক্ষাৎকার দেন না তিনি। টানা ৩৩ বছরের ক্যারিয়ার তার। এই ৪৯ বছর বয়সেও কাজ করছেন বিশ্বের নামি ব্র্যান্ড ও ডিজাইনারদের সঙ্গে।
সম্প্রতি দ্য গার্ডিয়ানে তার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে তিনি বন্ধুত্ব-শত্রুতা, ট্যাবলয়েডের সঙ্গে সম্পর্ক আর বর্তমান ফ্যাশন জগত নিয়ে কথা বলেছেন। নোশিন ইকবালের নেওয়া সাক্ষাৎকারটি ভাবানুবাদ করেছেন সারাবাংলা ডটনেটের সিনিয়র নিউজরুম এডিটর রাজনীন ফারজানা
নাওমি ক্যাম্পবেল সাক্ষাৎকার দিতে পছন্দ করেন না— এটি নতুন কোনো খবর নয়। মডেলিং ও ফ্যাশন জগতে তার দীর্ঘ ৩৩ বছরের সফরে ট্যাবলয়েডগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অনেকটা দড়ি টানাটানির। এই দীর্ঘ সময়ে তাই তিনি কর্কশকণ্ঠী, দুর্দান্ত আর স্পষ্টবক্তা হিসেবে সুনাম অথবা দুর্নাম কুড়িয়েছেন!
সেই নাওমি শেষ পর্যন্ত সাক্ষাৎকার দেবেন বলে পণ করলেন। কিন্তু গুরুতর অসুস্থতায় পিছিয়ে যায় আমাদের প্রথম সাক্ষাতের সময়। তবে নতুন একটি সময় দিলেন তিনি। অবশষে রোববার (১০ নভেম্বর) লন্ডনের এক হোটেলের লবিতে নাওমির সঙ্গে দেখা হওয়ার দিন ঠিক হয়। সেদিন বিকেলে হোটেলের লবিতে বসে তার যোগাযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে গল্প করছিলাম। মনে মনে তখন নাওমির ‘বিখ্যাত’ উদাসীনতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।
একসময় ডাক পড়ে নাওমির স্যুইটে। তবে সেখানে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না মোটেও। সোফায় বসে আছেন ৪৯ বছর বয়সী নাওমি, বেশ খোশমেজাজে রয়েছেন। রীতিমতো এটা-ওটা নিয়ে কৌতুক করছেন। আহত একটি পা তুলে রেখেছেন অন্য সোফায়। জ্বলন্ত সিগারেট সিগারেট হাতে বসে থাকা নাওমিকে দেখাচ্ছিল ঠিক আদুরে বেড়ালের মতো। দেখে মনে হয়, ঈশ্বরের একান্ত যত্নে গড়া মানবী তিনি। অর্ধশতাব্দী ছুঁই ছুঁই বয়সেও কী টানটান শরীর! ত্বকের উজ্জ্বলতায় ভ্রম জাগে, কেউ বুঝি এয়ারব্রাশের সাহায্যে রঙ করেছে মাত্রই। মুখের দু’পাশে পরিপাটি টানটান চুল। সেই চুল ছুঁয়ে তার বিখ্যাত সেই চিকবোন (কপোলের হাড়) যা সেই যুগের ফ্যাশনের ধারা নির্ধারণ করেছিল। সাকাই ব্র্যান্ডের সবুজ রঙের শিফনের জাম্পস্যুট আর চেলসি ব্র্যান্ডের ট্র্যাকটর সোল বুটে হোটেলের সোনালি আলোয় তাকে দেখাচ্ছিল দারুণ উজ্জ্বল আর অপার্থিব।
আমরা ঢুকতেই নাওমি তার আহত পা’টি দেখালেন আমাকে আর তার যোগাযোগ কর্মকর্তাকে। হাঁটু ফুলে গেছে, অনেকটা ছোট্ট তরমুজের মতো আকৃতি নিয়ে। জানা গেল, সপ্তাহের শুরুর দিকে শিল্প বিষয়ক এক পার্টিতে সিঁড়ি থেকে পড়ে এই অবস্থা। নাওমি আমাদের জানালেন, দ্রুত সেরে না উঠলে আবার বুঝি দীর্ঘ সময়ের জন্য ওড়াউড়ি বন্ধ হয়ে যাবে তার— এটিই এখন তার একমাত্র চিন্তা। বললেন, ‘জমাট বাঁধা রক্ত কোনো মজার বিষয় না।’ অথচ তার কণ্ঠে খেলা করছি মজার সুর। জানলাম, বছর দুই আগে একবার একই কারণে ছয় সপ্তাহের জন্য বিশ্রাম নিতে হয়েছিল তাকে। বন্ধ ছিলো বিমান ভ্রমণ। এবারও সেরকম কিছু ঘটুক, চান না তিনি।
তিনি যে উড়তে ভালোবাসেন— তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মাসের অর্ধেকটা না যেতেই অন্তত আধা ডজন বিমান ফ্লাইটে ভ্রমণ করেছেন। সামনে আরও কতগুলো ফ্লাইট এরই মধ্যে বুক করা আছে। তার বর্তমান আবাস নিউইয়র্ক থেকে প্যারিস, প্যারিস থেকে লন্ডন, সেখান থেকে আবারও প্যারিস, আবারও নিউইয়র্ক, সেখান থেকে অ্যারিজোনা, সেখান থেকে লসঅ্যাঞ্জেলেস— এভাবে চলতেই থাকে। কিছুদিন আগেই ইউটিউবে নাওমি ক্যাম্পবেলের ফ্লাইট রুটিন নামের ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি সব বিমানে নিজস্ব সিট কভার আর কম্বল নিয়ে যান।
পায়ের অবস্থা দেখিয়ে আবারও ভেলভেটের সোফায় পা তুলে রাখেন নাওমি। এতক্ষণে ভালো করে তাকান আমার দিকে। এরপর তার যোগাযোগ কর্মকর্তাকে চলে যেতে বলেন। সিগারেট রাখতে রাখতে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমি ঠিক আছি, তোমাকে প্রয়োজন নেই এখানে।’
ঘরের মধ্যে একলা মুখোমুখি হতেই আমার কাজের জন্য ধন্যবাদ দিতে শুরু করেন। বলেন, ‘তোমার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করার ইচ্ছা ছিল। তোমার কাজ সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি। আমার মনে হয়েছে তুমি বেশ স্পষ্টবক্তা এবং সততার সঙ্গে কাজটি করো।’ চমকে উঠলাম তার কথায়। কিছুটা বিপদের আভাসও পেলাম। বুঝতে পারলাম, যেকোনো কঠিন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বেশ কৌশলী হবেন এবং এ বিষয়ে তিনি যথেষ্ট দক্ষ। ‘আমার সঙ্গে কথা না বলেই যেভাবে আমার পক্ষে লিখেছিলে, সেটা আমার ভালো লেগেছে,’— আমি ভাবতে ভাবতেই যোগ করলেন নাওমি।
আমতা আমতা করে কোনোরকমে একটা ধন্যবাদ জানাতে পারলাম। ঘটনা হচ্ছে, দুই বছর আগে আমি ব্রিটিশ ভোগ ম্যগাজিনের তৎকালীন সম্পাদক অ্যালেক্সান্দ্রা শুলম্যানের একটি সাক্ষাৎকারের পরিপ্রেক্ষিতে কলাম লিখেছিলাম। নাওমি সেই কলামের উদাহরণ টেনেছেন বুঝতে পারলাম। শ্যুলম্যান ১৯৯২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০০ ভোগ ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। এই দীর্ঘ ২৫ বছরে ব্রিটিশ ভোগের প্রচ্ছদে মাত্র ১২ জন কালো মডেলের স্থান মেলে। এদের মধ্যে আছেন আমেরিকান গায়িকা বিয়ন্সে ও ক্যারিবিয়ান-আমেরিকান গায়িকা রিহানা, যারা সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছানোর আগে ব্রিটিশ ভোগের কাভারে জায়গা পাননি। এই দু’জনের বাইরে জায়গা পেয়েছেন নাওমি ক্যাম্পবেল, যিনি দীর্ঘ তিন দশক ধরে বিশ্বের সেরা পাঁচ জন সুপার মডেলের একজন।
নব্বইয়ের বিখ্যাত সুপার মডেলরা
বিখ্যাত সুপার মডেল নাওমি কিংবা অন্য কালো মডেলদের নিয়ে কাজ কম করার প্রসঙ্গে সেই সাক্ষাৎকারে শ্যুলম্যান নাওমিকে একজন আগ্রাসী চরিত্রের নারী হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। একজন দায়িত্বশীল ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে আমি তখন শ্যুলম্যানের সময়ে করা ৩০০ প্রচ্ছদ শ্যুটে মাত্র ১২ বার কালো মডেলকে নিয়ে কাজ করার প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। আরও অনেক ব্রিটিশের মতোই এই আচরণ আমার কাছে বর্ণবাদী বলেই মনে হয়েছিল। বুঝলাম নাওমি সেই সময়কার কলামের উদাহরণ টেনে আমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।
ব্রিটিশ ভোগের দায়িত্বে এনিনফুলের নিয়োগ এবং পরপরই নাওমিকে একজন কন্ট্রিবিউটিং এডিটর হিসেবে নিয়োগ সেই সময়ের ফ্যাশন বিশ্বে বেশ ঝড় তুলেছিল। গায়ের রঙের দিক থেকে কালো এনিনফুল মূলত শ্যুলম্যানেরই আগের প্রজন্মের ভোগ সম্পাদক। অথচ শ্যুলম্যান দীর্ঘ ২৫ বছরে গায়ের রঙের ভিত্তিতেই মডেল নির্বাচন করেছেন। সেই সময়ে টেলিভিশনের লেখক ও প্রযোজক লেনা ওয়াইদি (মাস্টার অব নান ও ডিয়ার হোয়াইট পিপল শোয়ের জন্য খ্যাত) লেখেন, ‘কালো ও বাদামি গায়ের রঙের মানুষেরা এখন একটা মজার অবস্থানে আছি। আমরা ভোগের চেয়েও বেশি কিছু। আমরা এখন সংস্কৃতির (ব্রিটিশ) অংশ।’
নাওমিও কথাটায় সম্মতি জানান। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গাতেই একটা পরিবর্তন যে এসেছে, সেটা আমি অনুভব করতে পারি। কিন্তু সম্প্রতি আমার পরিচিত একজনের একে ‘কাল্ট’ (কোনো কিছুর প্রতি প্রবল ভক্তি প্রদর্শন) বলাটা আমার ভালো লাগেনি।’ বিরক্তি ফুটে ওঠে তার চোখেমুখে। তিনি বলেন, আমার অর্জন মোটেই সহজ পথে আসেনি। কেউ আমার সামনে প্লেটে করে সাজিয়ে এনে দেয়নি। যথেষ্ট কাঠখড় পুড়িয়েই অর্জন করতে হয়েছে, যা অর্জন করেছি আমরা। অতিরিক্ত ভক্তি দেখায় আর ‘কাল্টে’র মতো শব্দ ব্যবহার পছন্দ করেন না, আরও একবার জানান তিনি।’
নাওমি মনে করেন, এতে করে তাকে তার অর্জনের জন্য প্রচ্ছন্নভাবে আঘাত করার চেষ্টা থাকে, যেন তিনি একজন কালো নারী হয়ে অনেককিছু অর্জন করছেন— ‘এটাই বিশেষ কিছু। তিনি বলেন, আমরা চাই না যে দুনিয়াটা কালোদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাক। আমরা ভারসাম্য চাই। আমরা চাই, সবাই মিলেমিশে সমান অধিকার ভোগ করুক।’ মানুষে মানুষে গায়ের রঙ বা অন্য কোনো কারণে ভেদাভেদ হোক, তা চান না তিনি ও তার মতো অন্য অনেকেই। জানালেন, কিছুদিন আগেই কেবল কালোদের জন্য নির্মিত হওয়া বিপুল অঙ্কের একটি অনুষ্ঠানের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। এখন যে পোশাক ও প্রসাধন ব্র্যান্ডগুলো বিভিন্ন ধরনের গায়ের রঙ ও আকারে মানুষের জন্য পণ্য বাজারজাত করছে, এই পরিবর্তন দেখে তিনি আনন্দিত। তিনি মনে করেন এটাই সময়োচিত সিদ্ধান্ত।
নাওমি আমাকে জানান, গার্ডিয়ানের এই সাক্ষাৎকারের জন্য শ্যুট করতে যে তরুণ ফটোগ্রাফার এসেছেন, তিনি কালো। এই বিষয়টি তার ভালো লেগেছে। কারণ, এই প্রথম তিনি কোনো ‘মেইনস্ট্রিম’ ম্যাগাজিন বা প্রত্রিকায় কালো ফটোগ্রাফারের সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি তরুণদের সৃজনশীলতা পছন্দ করি। তাই এদের সঙ্গে কাজ করতে চাই। নতুন নতুন প্রতিভাবান তরুণদের দেখে আমার ভালো লাগে। সেইসঙ্গে আমার জীবদ্দশাতেই সঙ্গিত, সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের যে ধারা ফ্যাশন জগতকে আলোড়িত করছে, তা দারুণ উপভোগ করি।’ তিনি বলেন, জিয়ান্নি (ভারসাচি ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা) সবসময় এই মিশ্র সংস্কৃতির যুগ আসার কথা বলত। অবশেষে সেই দিন এসেছে।
অতীতে অনেকবারই ক্যাম্পবেলকে নানা প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি করার চেষ্টা হয়েছে। এদের মধ্যে টায়রা ব্যাংকস অন্যতম। ব্যপারটা যেন এমন, মডেলিং জগত যদি একটা কেক হয়, তবে এর একটা মাত্র টুকরো একজন কালো মডেলের জন্য বরাদ্দ। সেই জায়গায় দ্বিতীয় কোনো প্রতিদ্বন্দী থাকতে পারবে না।
‘অনেকে ভাবেন, আমিই বোধহয় এমনটা চেয়েছিলাম’,— বলেন তিনি। বলতে বলতে জ্বলে ওঠে তার বেড়ালের মতো ধারালো চোখ, ‘আমি কখনোই এমনটা চাইনি। আমি যদি সেখানে না থাকতাম তাহলে সেখানে আর কোনো কালো মডেলের অস্তিত্বই থাকত না। আমাদের কাউকে না কাউকে ওই জায়গাটায় থাকতেই হতো।’
তবে কি আমরা বলতে পারি, ‘ডাইভারসিটি’ বা বৈচিত্র্যের জন্য নাওমি যেভাবে সোচ্চার, সেটার অন্যতম কারণ তিনি নিজের গায়ের রঙের জন্য অস্বস্তিতে ভোগেন না? নাওমি বলেন, ‘বিষয়টা এমন না যে আমি স্বস্তি অনুভব করি। আমার মনে হয় না এই বিষয়ে বেশি কিছু বলি আমি। বলার চেয়েও অনেক বেশি কাজ করি এটা নিয়ে। এখন সবাই জানেন যে আফ্রিকা আমার জন্য নতুন জায়গা না। সেই ১৯৯৪ সাল থেকে আমি আফ্রিকার নানা প্রজেক্টের যুক্ত।’
একজন বৈশ্বিক পরিবর্তনের একজন কর্তা (a global changemaker) হিসেবে তিনি আফ্রিকার বঞ্চনা ও সেটা দূর করতে তার পদক্ষেপ নিয়ে অনেক কথাই বলেন সেদিন। তিনি বলেন কীভাবে ফরাসি বিলাসবহুল পণ্য উৎপাদনের প্রতিষ্ঠান কেরিং গ্রুপকে ঘানা, নাইজেরিয়া এবং কেনিয়ার ফ্যাশন কলেজগুলোতে বিনিয়োগ করতে রীতিমতো ঠেলেছেন (pushing)। তিনি বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠানই নিজেদের আন্তর্জাতিক বলে দাবি করে। অথচ তারা তা নন। কারণ তারা ৫৪টি দেশ নিয়ে গঠিত একটি মহাদেশকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক হতে পারেন না।’ নাওমি বলেন, ‘এই ৫৪টি দেশে অত্যন্ত মেধাবী ও উচ্চ শিক্ষিত মানুষ আছেন যাদের আমাদের অর্থাৎ পশ্চিমাদের মতো দক্ষতা অর্জনের সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য। অথচ তারা সেটা থেকে বঞ্চিত।’
মা ও নানীর সঙ্গে নাওমি
চাইনিজ-জ্যামাইকান বংশদ্ভুত নাওমির নৃত্যশিল্পী মা যখন ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ব্যস্ত, নাওমি তখন দক্ষিণ লন্ডনে তার দাদীর কাছে মানুষ হয়েছেন। নাওমি বলেন, ‘শৈশবের ওই অংশটুকু ছাড়া, আফ্রিকাতেই সবচেয়ে ভালো লাগে আমার। ওই মহাদেশে গেলে আমি শান্তি অনুভব করি। হৃদয়ের গভীরের শান্তি।’ বলার সময় চেহারায় অন্যরকম দ্যুতি খেলে তার।
নাওমিকে নিয়ে প্রচলিত গল্পগাঁথায় তিনি একইসঙ্গে অনন্য আবার দুর্দান্ত। সামনাসামনিও তিনি ঠিক তেমনই— জটিল কিন্তু আকর্ষণীয়। ২০০৫ সালে ফ্যাশন ফর রিলিফ নামের একটি চ্যারিটি ক্যাটওয়াক শো (সাহায্য করার উদ্দেশ্যে ক্যাটওয়াক) এবং অভিজাত নিলাম শুরু করেন নাওমি। এসবের মাধ্যমে তিনি প্রায় ১৫ মিলিয়ড ডলারেরও বেশি সংগ্রহ করেন, যা হ্যারিকেন ক্যাটরিনা, ২০১১ সালে জাপানের ভূমিকম্প ও সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত এবং পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলা আক্রান্তদের জন্য ব্যয় করেন। একদিকে তার এই উদারতা যেমন লক্ষণীয়, তেমনি চার চার বার তিনি বেআইনিভাবে আঘাত করার কারণে দোষী সাব্যস্ত হন। একবার সহকারীর দিকে ফোন ছুঁড়ে মেরেছিলেন, একবার এক গৃহকর্মীর দিকে ফোন ছুঁড়েছিলেন, একবার একজন পুলিশ অফিসারকে লাথি মারেন এবং একবার একজন পাপারাজ্জোকে ব্যাগ দিয়ে আঘাত করেন তিনি।
লাইবেরিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি চার্লস টেইলরের বিরুদ্ধে আনা কুখ্যাত ‘ব্লাড ডায়ামন্ডস’ মামলার শুনানি চলাকালে সাক্ষ্য দিতে আদালতে ডাকা হয় নাওমিকে। নেলসন ম্যান্ডেলার বাড়িতে এক ডিনার বৈঠকে টেইলর নাওমিকে একটা হীরা উপহার দেন। আদালতে নাওমি বলেন, তিনি সেটাকে একটা নোংরা পাথরের টুকরো (‘dirty rocks’) ভেবেছিলেন।
একইসঙ্গে দারুণ উদ্যমের সঙ্গে নতুনদের উৎসাহ দেন তিনি। তরুণ মডেল অদুত আকিচ এবং আনোক ইয়াই সবসময়ই নিজেদের পরামর্শদাতা এবং অনুপ্রেরণাদায়ী আদর্শ হিসেবে নাওমি ক্যাম্পবেলের কথা বলেন। নাওমির কাছের বন্ধুদের মধ্যে রয়েছে ফটোগ্রাফার স্টিভেন মেইজেল, ডিজাইনার মার্ক জ্যাকবস ও কিম জোনস। তারা প্রায়ই বলেন, কোনো শর্ত ছাড়াই সমর্থনের জন্য নাওমিকে সবসময় পাওয়া যায়। এদিকে নাওমির জীবনে বিশ্বস্ত বন্ধু ও পথ প্রদর্শক হিসেবে সবসময়ই ম্যান্ডেলা এবং ক্যুটরিয়ের (couturier) অ্যাজেডাইন আলাইয়ার নাম নেওয়া হয়। ম্যান্ডেলা নাওমিকে দিয়েছিলেন নাতনীর সম্মান, আর আলাইয়ার মেয়ে ছিলেন তিনি।
উপরে ম্যান্ডেলার সঙ্গে ও নিচে ‘পাপা’ আলাইয়ার সঙ্গে নাওমি
বিভিন্ন টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তাকে অতর্কিত সমালোচনামূলক এবং আক্রমণাত্মক প্রশ্নের মাধ্যমে বিব্রত করা হয়েছে অনেকবারই। অপরাহ উনিফ্রের শো’তে তাকে ‘a petulant diva’, টায়রা ব্যাংকস বলেছেন ‘a bully’ এবং বারবারা ওয়ালটারস তাকে ডেকেছেন ‘a bitch’ । এসব কথার পরিপ্রেক্ষিতে নাওমি কখনোই তার মাপা আভিজাত্য থেকে বিচ্যুত হননি। সবসময়ই তিনি বলে এসেছেন, নিজের অতীতের সব কার্যক্রম নিয়ে তিনি মোটেই গর্বিত নন এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে অনেকটাই বদলেছেন। সরু আর ঠাণ্ডা চোখে সেই কথাই আবারও বললেন, ‘অতীত কর্মকাণ্ডের কাছে আমি আমার বর্তমান আর ভবিষ্যতকে জিম্মি থাকতে দিতে রাজি নই।’
এই একই কথা তিনি তার ‘বিয়িং নাওমি’ ইউটিউব চ্যানেলে এক ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, যখন অগাস্টের মেইল অন সানডে’তে তার চরিত্র হরণের চেষ্টা হয়েছিল। আগামী ডিসেম্বরে ব্রিটিশ ফ্যাশন কাউন্সিল নাওমিকে সম্মানজনক আইকন অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার কথা উঠলে পত্রিকাটি যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠা হার্ভে ওয়েনস্টেইন ও জেফ্রি এপস্টেইনের সঙ্গে অতীত ঘনিষ্ঠতার জন্য নাওমিকে দোষারোপ করেন। প্রমাণ হিসেবে তারা ওই দুই ব্যক্তির সঙ্গে নাওমির ছবি ছাপান।
একে অন্যায্য দাবি করে নাওমি কিছুটা কটাক্ষ করেই বলেন, ‘ধন্যবাদ!’ নাওমি বলেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার হাজার হাজার লোকের সঙ্গে দেখা হয় ও ছবি তোলেন। তেমনি তাদের দু’জনের সঙ্গেও শত শত মানুষের ছবি আছে। এদের মধ্যে থেকে আমাকে আলাদা করে তাকেই মেনশন করা হচ্ছে, অথচ বাকিদের নয়।
চোখ ঘুরিয়ে নাওমি বলেন, ‘আমি চুপচাপ এসব সহ্য করব না। আমরা সবাই জানি, এগুলো কেন করে তারা। শুধু আমি নই, রাহিম স্টারলিংয়ের সঙ্গে যে ব্যবহার তারা করেছে, লুইস হ্যামিলটন ও সেরেনা উইলিয়ামসের সম্পর্কে যেভাবে বলেছে, সেগুলোও আমার নজর এড়ায়নি। আমি বুঝতে পারি না, মেগান মার্কেল এসব কীভাবে সহ্য করেন।’ ব্যক্তিগত বিষয়ে অবৈধ সীমালঙ্ঘনের জন্য মেইল অন সানডে’র বিরুদ্ধে ডাচেস অব সাসেক্স মেগান মার্কেল সম্প্রতি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ায় খুশি হয়েছেন বলেও জানান নাওমি। ২০০৪ সালে প্রাইভেসি লঙ্ঘনের অভিযোগে ডেইলি মিররের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে জিতেছিলেন নাওমি। মিররের সেই সময়ের সম্পাদক পিয়েরস মরগান নাওমির বিরুদ্ধে বেনামে চেতনানশক গ্রহণের ছবি ছেপেছিলেন। নাওমি বলেন, ‘মার্কেলের সঙ্গে তার দেখা হয়নি কখনো। এমন কোনো পরিকল্পনাও নেই। কিন্তু যখনই মেগানের আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার খবর শুনেছেন, তিনি নিজেই বলেছেন, ‘ব্রাভো। গুড ফর হার!’
যেকোনো জায়গাতেই টানা ৩৩ বছর কাজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, সেখানে মডেলিং ইন্ডাস্ট্রির জন্য বিষয়টি আরও গৌরবের ও চ্যালেঞ্জিং। নাওমি জানান, আগামী বছর পঞ্চাশে পা দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন তিনি এবং এখন থেকেই পার্টির পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছেন। তিনি বলে, ‘পঞ্চাশে পা দেওয়া নিয়ে মোটেই ভীত নই আমি। বরং আমার ভালো ও খারাপ— দুইয়েই পাশে ছিল, এমন মানুষদের সঙ্গে সারারাত নাচার পরিকল্পনা করছি।’
যেসব পুরনো বন্ধু অনেকদিন ধরেই তার সঙ্গে রয়েছেন এবং সবসময় যাদের সাহায্য পেয়েছেন, তারা থাকবেন এই পার্টিতে। এমন ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন ক্রিস্টি টারলিংটন ও লিন্ডা ইভাংলেইস্টার, যারা ডলচে অ্যান্ড গাবানার ডিজাইনারকে বলেছিলেন, নাওমিকে না নিলে তারা এই ব্র্যান্ডের হয়ে কাজ করবেন না।
বন্ধু ক্রিস্টির সঙ্গে নাওমি
ফ্যাশন ডিজাইনার ইওভেস সেইন্ট লরেন্টের কথাও বলতে হয়, যিনি ফরাসি ভোগ কাভারে নাওমিকে না নেওয়া পর্যন্ত বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন। তিনি বলেন, ‘একটা সময় ডিজাইনার ও মডেলরা একসঙ্গে কাজ করত, একসঙ্গে খাবার খেত। যেসব ডিজাইনারদের আমি ভালোবাসি যেমন— অ্যাজেডাইন, জিয়ানি, মার্ক জ্যাকবস, অ্যালেক্সান্ডার ম্যাককুইন ও ভিভিয়েন ওয়েস্টউড— প্রত্যেকেই প্রত্যকেরে সঙ্গ পছন্দ করতেন। আমি মনে করি, আমার পছন্দ সঠিক ছিল। আমি সৃষ্টিশীলতাকে ভালোবেসেছিলাম। টাকার জন্য সঙ্গী বাছাই করিনি আমি, বরং ওদের প্রত্যেকের কাছ থেকে কিছু না কিছু শিখেছি। তাছাড়া পাপার (আলাইয়া) মেয়ে হওয়াটাও আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা। তিনি আমাকে তার নিজস্ব শিল্প, আসবাব এবং আরও নানারকম শিল্প সম্পর্কে শিখিয়েছেন। এই অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা হয় না।’
নাওমি ক্যাম্পবেলের উত্থান এমন এক সময়ে, যখন ফ্যাশন ও মডেলিং ইন্ডাস্ট্রি পুরোটাই বলতে গেলে শিকারী পুরুষদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই ৩৩ বছরে নাওমি কতটাই না দেখেছেন এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এলিট মডেল ম্যানেজমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জন ক্যাসাব্লাঙ্কা তখন সুপার মডেলদের সাইন করিয়েছিলেন। এই তালিকায় আছে এভাংলেইস্টা, সিনডি ক্রফোর্ড এবং নাওমি ক্যাম্পবেলের মতো নাম। জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এলিট ম্যানেজমেন্টে বয়ঃসন্ধিতে পা দেওয়া মডেলদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলা নিয়ে। তিনি এপস্টেইন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ব্যক্তিদের সামাজিক সম্পর্কের কেন্দ্রে চলে আসেন। হ্যাশট্যাগ মিটু (#মিটু) আন্দোলনের আগে তিন জন পুরুষ তার বিরুদ্ধে নতুন আসা কিশোরীদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনেন।
সেই সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি যৌন নির্যাতনের প্রসঙ্গে কী পদক্ষেপ নিয়েছে বলে মনে করেন নাওমি? ‘তাদের সঙ্গে যা হয়েছে এবং তার ফলে যে পরিমাণ মানসিক আঘাত তাদের সইতে হয়েছে, সেটা নিয়ে আমি চিন্তিত এবং তাদের প্রতি সহমর্মিতা রয়েছে আমার’,— বলেন তিনি।
সেই সঙ্গে তিনি এও বলেন, যে তার সঙ্গে এমন কিছু ঘটেনি। নিজে সেই পরিস্থিতির শিকার না হওয়ার পেছনে খারাপ ব্যবহারের জন্য তার কুখ্যাতির কথা বলেন তিনি। এটা তার জন্য প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করেছে এবং এর জন্য স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। তাছাড়া তিনি নিজের ভাগ্যকে প্রসন্ন মনে করেন যে ফেরেশতার মতো কিছু মানুষ— অ্যাজেডাইন আলাইয়া, জিয়ান্নি ভারসাচি ও ইওভেস সেইন্ট লরেন্ট— তাকে সুরক্ষার প্রাচীর ঘিরে রেখেছিলেন।
ওপরের ছবিতে মাইকেল জ্যাকসন ও নিচে ইওভেস সেইন্ট লরেন্টের সঙ্গে নাওমি
ক্যাম্পবেল ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত টানা ছয় বছর এলিটের মাধ্যমে কাজ করেছেন। এই ছয় বছরে কয়েকবারই কাসাব্ল্যাংকার মাধ্যমে অপসারিত হয়েছেন উদ্ধত ও দুঃসহ আচরণের জন্য। নাওমি অস্বীকার করেন এই অভিযোগ। তিনি বলেন, “আমি বরং তোমাকে বলতে চাই যে আমি খুব অল্প সময়ের জন্য এলিটের সঙ্গে ছিলাম এবং কাসাব্ল্যাংকা আমাকে অপসারণ করেননি, আমি নিজেই সরে এসেছি। আমি বরং বলব, আমি যখন তার সঙ্গে ছিলাম তখন তাকে ট্রাম্পের সঙ্গে দেখিনি। তাই ‘দ্যাট বিহেভিয়ার’ অর্থাৎ যৌন নির্যাতনের কোন ঘটনা আমি দেখিনি।”
ন্যায্য কথা বললে বলতে হয়, তার বন্ধুদের বিশ্বস্তটা রক্ষার বিষয়ে তিনি প্রচণ্ড ভয়ংকর। যেমন কিছুদিন আগেই মাইকেল জ্যাকসনকে নিয়ে তার ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডেলে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ভালোবাসার ও কাছের মানুষদের প্রসঙ্গে যদি বলো, তাহলে আমি তাদের রক্ষা করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
বিশ্বস্ততা ও বিবেচনাবোধ তার জীবনের অন্যতম দুই দিক। এই কারণেই একজন ছাড়া তার বাকি সব সাবেক প্রেমিকের সঙ্গে এখনও অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে জানান। সেই তালিকায় আছেন, ইউ২ ব্যান্ডের অ্যাডাম ক্লেটন, রবার্ট ডি নিরো, ব্যবসায়ী ফ্ল্যাভিও ব্রেইটর, ভ্ল্যাদিসলে ডোরোনিন এবং রিহানার বর্তমান প্রেমিক হাসান জামিল।
এ বছরের শুরুর দিকে তাকে ওয়ান ডিরেকশনের সাবেক সদস্য লিয়াম পেইনের সঙ্গে দেখা যাওয়ার গুঞ্জন ওঠে। সেই মুহুর্তে কী তার প্রেমে পড়েছিলেন? কিছুটা লাজুক ভঙ্গিতে বলেন, ‘হ্যাঁ’। অনুভূতিটা কেমন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রচণ্ড অস্থির’। এর বেশি বলেন না তিনি। নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বেশি কিছু বলতে চান না, মনে করিয়ে দেন আমাকে। ‘এটা আসলে অন্য কাউকে নিয়ে নয়, বিষয়টা আমার হৃদয় নিয়ে। হৃদয়ের ভেতর থেকে সুখি আমি। আসলে বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন কারণে ভালোবাসি আমি। এবং আরও যেসব বিষয় আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে তা হলো— আমার বেড়ে ওঠার সময়েই আমি অন্য কারও দ্বারা নয় বরং সবার আগে নিজেকে গ্রহণ করতে ও ভালোবাসতে শিখেছি,’— ধৈর্যশীল প্রেরণাদায়ী বক্তা থেকে দক্ষিণ লন্ডনের আসল চেহারায় ফিরে যেতে একটুও সময় লাগে না ক্যাম্পবেলের।
চেতনানাশক ওষুধ ও থেরাপির দীর্ঘ চিকিৎসায় তার মধ্যে দারুণ ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষণীয়। ‘আমি আলোয় থাকতে চাই’, ব্যাখ্যা করেন তিনি, ‘অন্ধকার আমার জায়গা নয়। আমার বিষণ্ণতাও নেই। মানসিক স্বাস্থ্য এমন একটা বিষয় যেটার ব্যপারে আমি অনেক সচেতন এবং সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকার এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়ায় আমি আনন্দিত। আমি মনে করি, প্রিন্স উইলিয়াম ও হ্যারি এই বিষয়টাকে সামনে আনার ব্যাপারে যে ভূমিকা রেখেছেন, তা দারুণ। মনে করো, নব্বইর দশকে কেউ মানসিক চিকিৎসকের কাছে গেলে লোকজন তার দিকে এমনভাবে তাকাত যেন যে পাগল। এসব অতি পুরনো ধারণা। কিন্তু যেকোনো পেশার ব্যক্তিরই কথা বলার মতো একজন বিশ্বস্ত কেউ থাকা দরকার। এটা তার অধিকার এবং অনেক স্বাস্থ্যকর। আরোগ্য লাভ করা বিষয়টাই স্বাস্থ্যকর। নিজেকে ভালো রাখাই ছিলো আমার প্রথম যুদ্ধ এবং এই বিষয়ে আমার অবস্থান স্থির।’
বন্ধু লিন্ডার সঙ্গে নাওমি
সম্প্রতি অনেকটাই পরিপক্কতা এসেছে তার আচরণে। তিনি বলেন, লোকজন জেনে অবাক হবে, ‘আমি আর আগের মতো কথায় কথায় প্রতিক্রিয়া জানাই না।’ তবে এর মানে এই না যে তিনি কখনোই ভেঙে পড়েন না। নাওমি বলেন, কেবল তার শ্যুটের সময়, পরিচিত ও কাছের বন্ধুদের সামনে অর্থাৎ যাদের মধ্যে নিরাপদ বোধ করেন, তাদের সামনেই প্রতিক্রিয়া দেখান তিনি। স্বভাবে শান্তভাব আসলেও এখনো তিনি ঘরে ঢুকলেই রোমাঞ্চ আর স্বতন্ত্র্যতার স্রোত বয়ে যায়। তিনি কি নিজে উপলব্ধি করেন যে তিনি কতটা সুন্দর? আর তার প্রতি মানুষের মুগ্ধতাই বা তিনি কতটা উপভোগ করেন? জবাবটা আসে এভাবে, “না। মানে আমি বোঝাতে চাই যে লোকে যখন বলে, ‘আপনার উপস্থিতিতে জায়গাটা আলোকিত হয়ে উঠেছে’, সেটা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যাপারটা আসলে অতটা সহজ না…।” অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ‘সুন্দর’ শব্দটাকে এড়িয়ে গেলেন তিনি। বরং তিনি বলেন, ‘একজন নারীর জন্য দৃঢ় মানসিকতা বা চালিকাশক্তি অর্জন করা সহজ কথা নয়। আমি বরং অনেকটাই সহজগম্য হতে চাই! আমি মনে করি, এটা একটা আশীর্বাদ আমার জন্য।’ পরের বাক্যেই কিছুটা নমনীয় হয়ে তিনি বলেন, ‘এটা একটা অভিশাপও।’
আমি তাকে বললাম যে, কয়েক বছর আগে যখন কাতারে ভোগ অ্যারাবিয়ার উদ্বোধন হলো, আমি তাকে দেখেছিলাম ঘরের মধ্যে কীভাবে পিছলে চলে গেলেন। সেই পার্টিতে লরেন হিলের সঙ্গতে মুগ্ধ ছিল সবাই। অন্যদিকে নাওমি তখন সামনে এসে গানের সুরে সুর মেলাচ্ছিলেন আর তার ফোনে ভিডিও করছিলেন। তখন অন্তত কয়েক ডজন মানুষ নাওমির ছবি তুলছিল। এই কথা বলতেই নাওমি হেসে ফেলেন। বলেন, ‘লরেন একজন চমৎকার নারী। এরপর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ফ্যাশন ফর রিলিফ উৎসবে তাকে নিমন্ত্রণ জানালে তিনি আসেন এবং ১২টা গান পরিবেশন করেন।’
সবসময় আলোচনায় থাকা নিয়ে কি তিনি চিন্তিত?— ‘এই কথাটি আমাকে অনেক শুনতে হয়।’ বলার সময় তার চেহারায় মোটেই সন্তুষ্টি ছিল না। ‘আমি প্রাসঙ্গিক বা আলোচনায় থাকার ব্যাপারে চিন্তিত নই, নিজেকে কারও প্রতিদ্বন্দ্বীও মনে করি না।’ ভি-লগিংয়ে তার আগ্রহ ও ইনস্টাগ্রামে প্রবল উপস্থিতি দেখা যায়। নাওমি বলেন, ‘এই ক্ষেত্রে আমার আগ্রহের অন্যতম কারণ, পুরো বিষয়টাই আমার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে আর আমি নিজেকে ঠিকঠাকভাবে উপস্থাপন করতে পারি। ইউটিউব আর ইনস্টাগ্রাম আমি নিজে নিয়ন্ত্রণ করি। তাই এখানে পুরোপুরিভাবে আমার আমি হয়েই উপস্থিত হই। ইচ্ছামতো নিজেকে উপস্থাপন করতে পারি, কেউ কীভাবে এডিট করে তার উপর নির্ভর করে বসে থাকতে হয় না। এছাড়াও আমার দু’টো বই আসবে সামনে। সেটার কাজ চলছে। এগুলো আমার জীবনী নয়, আমার জীবনের সবকিছু এখানে প্রকাশ করা হবে না।’
স্মিত হাসিমুখে নাওমি বলেন, ‘আমি শুধুমাত্র লেখার জন্যই লিখব, তা না।’ তার চেহারায় আবারও সেই মানবিকতা ও বিশ্বসুন্দরীর দ্যুতি খেলে যায়। ‘আমি চাই, কোনো না কোনো উপায়ে অল্প বয়সী মেয়েদের উৎসাহ দিতে, সাহায্য করতে। আমি যেসব সুযোগ পেয়েছি বা এখনো পাই, সেটা আমার জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কিন্তু জীবনে এতবার আমাকে বিচ (খারাপ মেয়ে) বলা হয়েছে, কেন? আমার নিজের পক্ষে আওয়াজ তুলেছি সেসময়, তাই? এখন এসে অবস্থা কিছুটা বদলেছে। কিছুটা ভারসাম্য এসেছে। কিন্তু আমার সম্পর্কে মানুষ কী ভাবে তা নিয়ে আমি চিন্তিত নই। তাই আমি একটুও বদলাইনি। আমি সবসময়ই একইরকমই আছি।’