দ্য লাস্ট প্যারাডাইজ অন আর্থ।। ৭ম পর্ব: মনোমুগ্ধকর গিলি
২৩ নভেম্বর ২০১৯ ১০:৩০
ভাবুন তো, একটি পড়ন্ত বিকেলে এক খন্ড অবসর! পাশে প্রিয়মুখ! সামনে বিশাল সমুদ্রের নীল জলরাশি! বাঁধ দেওয়া সমুদ্রের মৃদু গর্জন, শরীর ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া কিছু স্নিগ্ধ বাতাস! জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য কি আরও বেশি কিছু প্রয়োজন আছে?
আমার মনে হয় নেই। এরকম আরও কিছু সুন্দর মুহূর্ত জন্ম দিতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হওয়ার উপলব্ধি। তার সাথে যদি আবার যোগ হয় বিশাল পর্দা জুড়ে বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র, লাইভ মিউজিক, সামুদ্রিক মাছ দিয়ে তৈরি খাবারের ঘ্রাণ তখন আরও অনেকদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠে। বয়সটাও কমে যেন বিশের ঘরে নেমে আসে। সৈকতের পাশের ঝাঁকজমকপূর্ণ উৎসবমুখর পরিবেশ যে কারও জীবনটাকে উপভোগ করতে সাহস জোগাবে দারুণভাবে।
গিলি দ্বীপে সেদিন আমাদের এমনই এক সন্ধ্যা কেটেছে। কোলাহল মুখর। আনন্দমুখর এবং রোমাঞ্চকর! আমরা গিলিতে ‘অ্যাশ্টন বিচ রিসোর্ট’ নামের একটি হোটেলে উঠেছিলাম। গিলির ভালো মানের হোটেলগুলির মধ্যে একটি। গিলিতে হোটেল ভাড়া বাংলাদেশী টাকায় প্রায় এক হাজার থেকে দুই হাজারের মধ্যে। আমারা যে হোটেলে ছিলাম, তার লবি থেকে একটু এগোলেই সমুদ্র। নীল সবুজ পানির মধ্যে ছবির মতো সুন্দর দোলনা ঝোলানো। গিলির হোটেল ব্যবসায় এটি বেশ বলে মনে হল আমার কাছে। অন্য কোথাও এভাবে দোলনা ঝোলানো হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
গিলিতে একটি রাত কাটিয়েছিলাম আমরা। একটা মাত্র দিন কীভাবে যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলো, টেরই পাই নি। তাই আরও একটি দিন গিলিতে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু আমাদের ট্যুর প্ল্যান অনুযায়ী সেটা সম্ভব হয়নি। যারা গিলিতে যেতে চান, অন্তত দু’রাত গিলিতে থাকার পরিকল্পনা নিয়ে যাবেন।
যেভাবে গিলি গেলাম
আগের দিন বালির কুতা এলাকা থেকে সাড়ে ছটায় রওনা দিয়ে আটটায় পাদাং হারবারে পৌঁছাই আমরা। হোটেল থেকে চেক আউট করে লাগেজ হোটেলেই রেখে এসেছিলাম। সকালের রাস্তা প্রায় ফাঁকাই ছিল। ফাস্ট বোট কোম্পানি গুলো সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যাত্রী আনা নেওয়া করে। এই বন্দর দিয়ে শুধু গিলি নয়, লম্বুক নামের আরেও একটি দ্বীপেও যাওয়া-আসা করা যায়।লম্বুক বালির মতোই আয়তনে বড় আরেকটি দ্বীপ। বালির মতো লম্বুকেরও রয়েছে নিজস্ব বিমানবন্দর। লম্বুক গরম মসলার জন বিখ্যাত।
সকাল নয়টার পর কুতা থেকে হারবার পর্যন্ত বেশ ভারী ট্র্যাফিক থাকে। দিনের শুরুতে কুতা থেকে রওনা দিয়ে হারবারে পৌঁছতে যেখানে মাত্র দেড় ঘন্টা সময় লাগে, সেখানে এক বা দুই ঘন্টা পঅরে রওনা হলে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা লেগে যায়। তাই গিলি যেতে চাইলে সকাল সকাল হোটেল ছাড়া ভালো।
হারবারে পৌঁছে আমরা একটি দোতলা রেস্টুরেন্টে (নাম মনে নেই) নাস্তা সেরে নিলাম। ওখান থেকে আমাদেরকে ফাস্ট বোটের নাম সম্বলিত ইয়েলো কালার স্টিকার দেওয়া হয়। আমাদের বোটের নাম, ওয়াহানা। টিকেট আগেই কাটা ছিল। ট্যুর এজেন্টের মাধ্যমে যাওয়ায় সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিলো। টিকেটের দাম (রিটার্ণ টিকেট সহ) জনপ্রতি সাড়ে চার থেকে ছয় লাখ ইন্দোনেশিয়ান রুপি বাংলাদেশী টাকায় তিন হাজার থেকে তিন হাজার ছয়শ টাকার মতো।
‘ওয়াহানা’ শিপের স্টিকার এই দোতলা রেস্টুরেন্ট থেকে দেওয়া হয়।
আপনি চাইলে অনলাইন বা ট্যুর গাইড থেকে কিংবা হোটেলের মাধ্যমেও টিকিট করতে পারেন। তবে অনেকের মতে, অনলাইনে টিকিটের দাম বেশি। যেখান থেকেই টিকিট করুন বোট কোম্পানির গাড়ি এসে আপনাকে হোটেল থেকে পিক করে পাদাং হারবারে পৌঁছে দিবে। যে বোট কোম্পানির টিকিট কাটেন না কেন, মনে রাখবেন, পোর্টে এসে বোট কোম্পানির অফিসে যেয়ে আপনাকে আপনার উপস্থিতি জানাতে হবে। অর্থাৎ টিকিট এন্ট্রি করাতে হবে। এটি গিলিতে যাওয়া এবং আসা দু’সময়েই প্রযোজ্য।
আগের পর্ব, দ্য লাস্ট প্যারাডাইজ অন আর্থ।। ৬ষ্ঠ পর্ব: জিম্বারান বিচে একদিন
বালি থেকে গিলিতে দুই উপায়ে যাওয়া যায়- ফাস্ট বোটে করে আর জাহাজে। বোট ভেদে দেড় থেকে আড়াই ঘন্টার মতো সময় লাগবে। আমাদের দেড় ঘন্টার মতো সময় লেগেছিল। খেয়াল করে দেখলাম, বোটের পেছনে ৬ টি ২৫০ হর্স পাওয়ারের ইন্জিন লাগানো ছিল। অন্যদিকে জাহাজে গেলে আট ঘন্টার মতো সময় লাগবে। সময় বেশি লাগার কারণেই পর্যটকদের কাছে জাহাজের তেমন একটা চাহিদা নাই। বেশিরভাগ বিদেশি পর্যটকই সময় বাঁচানোর জন্য ফাস্ট বোটে করেই গিলি যায়।
কুতা এলাকার আশেপাশে অনেক জায়গায় ট্যুরিস্ট স্পটগুলো সম্পর্কে ইনফরমেশন বুথ পাবেন। সেখান থেকে গিলির ব্যাপারে তথ্য নিয়ে সুবিধাজনক প্যাকেজ নিতে পারেন। গিলিতে নেমে কয়েক ঘন্টার জন্য বোট ভাড়া করে চলে যেতে পারেন স্নোরকেলিং, ওয়াটার ওয়াক বা স্কুবা ডাইভিংয়ে। দেখে আসতে পারেন প্রবাল প্রাচীর, কচ্ছপ ও পানির নীচে মানব-মানবীর অসংখ্য মূর্তি। খরচ পড়বে প্রায় দেড় লাখ ইন্দোনেশিয়ান রুপি। বালিতে যেমন সবকিছুতে বারগেইন চলে গিলিতেও তাই! নিউমার্কেটে গেলে যেমন দর কষাকষি করেন, বালি আর গিলিতেও তাই। নইলে ধরা খাবেন নিশ্চিত!
গিলি ত্রাওয়াংগান, গিলি মেনো এবং গিলি এয়ার নামে ৩ টি ছোট ছোট আইল্যান্ড নিয়ে গিলি গঠিত। তিনটি দ্বীপের মধ্যে গিলি ত্রাওয়াংগান সবচেয়ে বড় এবং ট্যুরিস্ট সমাগম এখানেই সবচেয়ে বেশি। আমরা গিলি ত্রাওয়াংগানে গিয়েছিলাম। ত্রাওয়াংগান’ শব্দটি ইন্দোনেশিয়ান শব্দ ‘তেরোওংগ’ যার অর্থ টানেল বা সুড়ঙ্গ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিদের দখলে ছিলো এই এলাকা। তারাই একটি গুহার মতো সুড়ঙ্গ বানায়। সেই থেকেই এই নাম। মুসলিম অধ্যুষিত এই দ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ১৫০০ এর মতো।
গিলি খুবই সুন্দর। সমুদ্রের পানি যেন স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। পানি কোথাও নীল আবার কোথাও সবুজ। সৈকতজুড়ে সাদা মিহি বালির বিছানা। সৈকতে অগণিত প্রবালের মৃত দেহাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাই সৈকতে খালিপায়ে হাঁটা বেশ মুশকিল।আমাদের দেশের প্লাস্টিকের স্যান্ডেল বা বার্মিজ স্যান্ডেল এই বিচে বেশ কাজে দেবে।
দ্বীপ জুড়ে অসংখ্য নারকেল গাছ। গিলিতে কোন মোটরযান বা ভারী যানবাহন নেই। সাইকেল চালাতে না জানলে দ্বীপ ঘুরে বেড়ানোর একমাত্র মাধ্যম ঘোড়ার গাড়ি অথবা এগারো নাম্বার গাড়ি (দুই চাকাওয়ালা)। হোটেলগুলো সাধারণত ঘন্টার হিসেবে সাইকেল ভাড়া দিয়ে থাকে। তবে আমরা যে হোটেলে ছিলাম সেখানে বিনামূল্যে যতক্ষণ ইচ্ছা ততক্ষণ সাইকেল চড়ার ব্যবস্থা ছিল।
পুরো দ্বীপ জুড়ে সারি সারি নারকেল গাছ। অনেকটাই আমাদের সেন্টমার্টিনের মতো। বেশিরভাগ জায়গায় ভাঙাচোরা মাটির রাস্তা। এসব মাটির রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি পাশ দিয়ে গেলে ধূলো ওড়ে। আর গিলিতে একমাত্র বিরক্তিকর ব্যাপার ছিল আমার কাছে এটাই।
পরের পর্বে থাকছে- রাতের গিলির বর্ণনা