অনিদ্রায় সমাধান ন্যাচারোপ্যাথি- ০৪
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৮:৪২
রাতে ঘুম হয় না- এই কথাটা আমাদের আশেপাশের মানুষ, পরিচিতজনদের কাছ থেকে আমরা প্রায়ই শুনি। কথাটা শুনতে হালকা মনে হলেও যার ঘুম হয় না, তিনিই কষ্টটা বুঝতে পারেন। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুম হওয়া জরুরি। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়াকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় অনিদ্রা বা ইনসোমনিয়া (Insomnia) বলে। অনিদ্রা বা ঘুম না হওয়া ক্ষণস্থায়ী (Acute Insomnia) এবং দীর্ঘস্থায়ী (Chronic Insomnia) হতে পারে। ক্ষণস্থায়ী অনিদ্রা কয়েকদিন থেকে সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা মাস থেকে বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
অনিদ্রা একটা কষ্টকর অবস্থা। রাতে ঘুম হচ্ছে না আর সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব, ক্লান্তি, অবসাদ, বিরক্তিভাব, খিটখিটে মেজাজসহ নানা বাজে অনুভূতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আজকাল স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে তরুণ, বয়স্ক সব বয়সের ব্যক্তিকেই অনিদ্রা সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়। Wrong Lifestyle বা অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অনিদ্রার মূল কারণ হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই কোন জটিল অসুখের কারণেও অনিদ্রা বা ঘুমের সমস্যা হয়ে থাকে।
ধরন এবং কারণ
ক্ষণস্থায়ী অনিদ্রা (Acute Insomnia)
দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ যেমন, পরীক্ষার চাপ, চাকরি চলে যাওয়া, অতিরিক্ত কাজের চাপ, পরিবারের কারও মৃত্যু, বিবাহিত জীবনে সম্পর্কের জটিলতা, ডিভোর্স- এধরনের নেতিবাচক মানসিক চাপ থেকে যেমন অনিদ্রা হয়ে থাকে তেমনি ইতিবাচক মানসিক চাপ যেমন নতুন বিয়ে, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট, চাকরিতে পদোন্নতির মত বিষয় থেকেও ঘুমের সাইকেলে ব্যঘাত ঘটে থাকে।
এছাড়াও ঘুমের জায়গা পরিবর্তন যেমন কোথাও বেড়াতে গেলে, প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে না যাওয়া, অতিরিক্ত আলো বা শব্দের মধ্যে ঘুমানো, পাশে শোয়া ব্যক্তি নাক ডাকলে, ঘুমের আগে মোবাইল, ল্যাপটপ, ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস চালানো, অতিরিক্ত চা-কফি পান করা, নেশাদ্রব্য গ্রহণ, খাবারে অনিয়মের কারণে হজমের সমস্যা, রাতের শিফটে কাজ করা, অন্য টাইম জোনে স্নানান্তরিত হলে, গর্ভাবস্থা, মাসিকের সময় হরমোনের তারতম্য, কোন কোন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও ঘুমের সমস্যা হয়ে থাকে।
দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা (Chronic Insomnia)
শারীরিক কোন অসুস্থতা যেমন, হৃদরোগ, হাঁপানী, থাইরয়েড সমস্যা, মোনোপজ, ডায়াবেটিসের জন্য রাতে প্রস্রাবের চাপে ঘুম ভেঙে যাওয়া, অতিরিক্ত ওজন থেকে স্লিপ এপনিয়া, স্নায়ুর অসুখ যেমন পারকিনসন্স, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাসিয়ামের অভাব ইত্যাদি কারণে যেমন অনিদ্রার জটিলতা শুরু হয়, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যের অসুখ যেমন, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, ডিপ্রেশন, সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি থেকেও অনিদ্রা সমস্যা তৈরি হয়।
অনিদ্রার লক্ষণ
অনিদ্রার সমস্যায় ভুগছেন কিন্তু জটিলতা শুরু না হওয়া পর্যন্ত অনেকে বুঝতেও পারেন না যে তার সমস্যাগুলো মূলত পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব থেকে হচ্ছে। অনিদ্রার সমস্যা বোঝার লক্ষণ এবং উপসর্গগুলো হলো-
- রাতে ঘুম না হওয়া
- হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া
- দেরিতে ঘুমালেও খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যাওয়া
- দিনের বেলায় ঘুম ঘুম ভাব লাগা
- সারাদিন ক্লান্তি আর অবসাদ অনুভূতি
- অল্পতে রেগে যাওয়া বা খিটখিটে মেজাজ
- দুশ্চিন্তা
- হতাশা এবং বিষাদগ্রস্ততা
- কাজে মনোযোগি হতে না পারা
- এলোমেলো কাজ করা এবং কাজে বার বার ভুল করা
- অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা
- মাথাব্যথা
- বুক ধড়ফড় করা
- হজমে সমস্যা
- কোষ্ঠবদ্ধতা
অনিদ্রা থেকে পরবর্তী স্বাস্থ্য ঝুঁকি
- স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল হয়ে যাওয়া
- অস্বাভাবিক মোটা হওয়া
- মানসিক অসুখ
- নেশাদ্রব্যে আসক্তি
- হার্টের সমস্যা
- ডায়াবেটিস
- উচ্চ রক্তচাপ
- পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে জটিলতা। ইত্যাদি
অনিদ্রা সমস্যা কাটাতে ন্যাচারোপ্যাথি ব্যবস্থাপনা
অনিদ্রা শব্দটি শুনতে সহজ লাগলেও এর প্রভাবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনিদ্রার সমস্যা দূর করার জন্য চিকিৎসা শুরু করার আগে অবশ্যই এর মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। কারণ, মূল সমস্যার চিকিৎসা না করে শুধু ঘুম হওয়ার জন্য চিকিৎসা করলে বা ঔষধ খেলে সাময়িক উপকার পেলেও পুনরায় অনিদ্রা সমস্যা দেখা দেবে এবং সমস্যা আরও জটিল আকার ধারন করবে।
ন্যাচারোপ্যাথির যেসব পদ্ধতি অনিদ্রা সারাতে খুবই কার্যকরি, সেগুলো হলো-
লাইফস্টাইল মোডিফিকেশন বা স্বাস্থ্যকর জীবনব্যবস্থা
ঘুমের সমস্যা দূর করার প্রথম এবং প্রধান উপায় হলো সঠিক জীবনব্যবস্থা মেনে চলা। আসুন দেখে নেই সুন্দর আর ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপন পদ্ধতি মেনে চলার জন্য কী করতে হবে-
- প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে ওঠা
- ঘুমানোর দুই থেকে আড়াই ঘন্টা আগে খাবার খেয়ে নেওয়া
- ঘুমানোর জন্য বিছানায় যাওয়ার পর মোবাইল, ল্যাপটপ ইত্যাদি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস না চালানো
- ঘুমের সময় লাইট এবং আওয়াজ বন্ধ রাখা
- অতিরিক্ত মশলা, ভাজাপোড়া খাবার না খাওয়া। ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড না খাওয়া
- ক্যাফেইন, সিগারেট, মদ এবং নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ না করা
- দুশ্চিন্তা এবং হতাশা পরিহার করা। ইতিবাচক মানসিকতার চর্চা করা। অতীত-ভবিষ্যতে ডুবে না থেকে বর্তমান সময়ে থাকা এবং উপভোগ করা
- প্রতিদিন সকাল বা বিকালে এক্সারসাইজ করা
- অলস এবং ঘরবন্দী জীবনযাপন না করে কর্মময় জীবনে অভ্যস্ত হওয়া
- পর্যাপ্ত পানি পান করা। ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। যেমন, কলা, তরমুজ, ডাবের পানি, শিমের বিচি, কুমড়া বিচি ইত্যাদি। এছাড়াও যা করতে পারেন-
- ফুট থেরাপি: ঘুমাতে যাবার আগে এক বালতি সহনীয় গরম পানিতে একমুঠো লবন মিশিয়ে তাতে ১০ মিনিট পা ডুবিয়ে রেখে তারপর পা পরিষ্কার করে ঘুমাতে গেলে ভালো ঘুম হয়।
- গরম দুধ পান: হলুদ দিয়ে ফোটানো এক গ্লাস হালকা গরম দুধ খেয়ে ঘুমালে ভালো ঘুম হয়।
- মাসাজ: অনিদ্রা কাটাতে মাসাজ খুব উপকারি। প্রথমদিকে সপ্তাহে একদিন এবং পরে মাসে একদিন নিয়মিত মাসাজ করলে ঘুমের সমস্যা দূর হয়।
- রিফ্লোক্সোলজি এবং আকুপ্রেসার: হাত এবং পায়ের তালুর থেরাপির পাশাপাশি শরীরের বিন্দুগুলোতে আকুপ্রেশার করলে শারীরিক জটিলতা দূর হওয়ার পাশাপাশি অনিদ্রা ভালো হয়।
- ইয়োগা এন্ড মেডিটেশন: নিয়মিত ইয়োগা এবং মেডিটেশন চর্চা করলে স্থায়ীভাবে অনিদ্রার সমস্যা ভালো হয়ে যায়।
- হারবাল: ক্যামোমিল ফুলের চা, আদা চা ভালো ঘুমের জন্য উপকারি।
অনিদ্রা হচ্ছে কিনা এবং হলেও কোন পর্যায়ে হচ্ছে তা সঠিকভাবে বোঝার জন্য কতগুলো বিষয় প্রতিদিন নোট করতে হবে। যেমন-
- কতক্ষণ ঘুমাচ্ছি (ঘন্টা)
- কখন ঘুমানোর জন্য বিছানায় যাচ্ছি (সময়)
- কখন ঘুম এলো/আসে
- কখন এবং কতবার ঘুম ভেঙে যায়
- সকালে ঠিক কয়টায় ঘুম ভাঙে
- দিনে ঠিক কখন এবং কতক্ষণ ঘুম হয়
- ঘুমের পরিবেশ
সুস্থ-সুন্দর ও স্বাভাবিক একটি জীবন আমরা সবাই যাপন করতে চাই। দিনশেষে শান্তির একটি ঘুম প্রশান্তিময় জীবনের জন্য খুবই জরুরি। ইতিবাচক জীবনের চর্চা আমাদের নিশ্চিন্ত এবং প্রশান্তির ঘুম উপহার দেয়।
আরও পড়ুন,
পর্ব-০১।। ন্যাচারোপ্যাথি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা
পর্ব-০২।। কোভিড-১৯ পরবর্তী ফ্যাটিগ সারাতে ন্যাচারোপ্যাথি
পর্ব-০৩।। বিভিন্ন ধরনের মাথাব্যথা ও ন্যাচারোপ্যাথি ব্যবস্থাপনা
অনিদ্রা ইনসোমনিয়া ক্ষণস্থায়ী অনিদ্রা টপ নিউজ ডা. ঐন্দ্রিলা আক্তার দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা ন্যাচারোপ্যাথি