Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রাকৃতিক নিয়মেই সারবে কষ্টদায়ক কোষ্ঠকাঠিন্য


২১ নভেম্বর ২০২০ ২০:৫৯

৪০ বছরের সুমাইয়া আক্তার। ফ্রিল্যান্সার। প্রথম যেদিন উনার সাথে পরিচয় সেদিনের কথা। কুঁজো হয়ে বসে আছেন। চোখে ঘুম ঘুম ভাব। আমার কাছে এসেছেন পেট পরিষ্কার করার সমাধান নিতে। ওনার সমস্যাগুলো বলছেন। ওনার পেটে প্রচন্ড গ্যাস হচ্ছে, এটা নিয়মিতই হয়, সাথে পেটব্যথা। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে, সাথে ব্যথাও হচ্ছে। মাথাব্যথা, কোমরব্যথা, মেরুদণ্ডে ব্যথা হয় নিয়মিত, এখনও হচ্ছে। ক্লান্তি আর ঘুম ঘুম ভাবের জন্য কোন কাজই মনোযোগ দিয়ে করতে পারেননা, জব মিটিং এবং ব্যক্তিগত কাজগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সময় ঠিক রাখতে না পারার কারণে। পায়ুপথ দিয়ে অনবরত গ্যাস বের হতে থাকে, মানুষের সামনে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। উনি কথা বলার সময় ঘন ঘন হাই তুলছেন। চারদিন ধরে পায়খানা হয় না। কখনো দুইদিন, কখনো তিনদিন আবার কখনো কখনো চারদিন পর পর পায়খানা হয়। কখনো কখনো এমন হয় যে, পায়খানা পায়ুপথের শেষপ্রান্তে এসে জমা হয়ে থাকে, কিন্তু বের হয় না। ব্যথা আর অস্বস্তি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন বাধ্য হয়ে আঙুল ঢুকিয়ে শক্ত মল বের করতে হয়, কিন্তু কখনোই পুরো মল বের হয় না। অবস্থা এখন অসহনীয় পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। পায়খানা পরিষ্কার হওয়ার জন্য প্রতিদিন রাতে ওষুধ খেয়ে ঘুমাতেন, কিন্তু এখন আর ওষুধেও কাজ হচ্ছে না। ওনার ঘনঘন ঠাণ্ডা লাগে। চুল পড়ে যাচ্ছে। শরীরের তুলনায় পেট মোটা হওয়ায় অস্বস্তিতে ভোগেন।

বিজ্ঞাপন

সব শোনার পরে আমি ওনার প্রতিদিনের রুটিনটা জানতে চাইলাম। উনি ঘুমান রাত ২ টার পরে। কখনো কখনো চার টার পরে। ঘুম থেকে ওঠেন বেলা বারোটায়। উঠে এক কাপ কড়া কফি খান। তারপর পাউরুটি বাটার, ডিম পোচ, কখনো পরোটা-ডিম। বাইরে কাজে থাকলে রেস্টুরেন্টের খাবার খান। রাতে বারোটা থেকে সাড়ে বারোটায় খান রাতের খাবার। রাত জেগে থাকার ফলে ক্ষুধা লাগে তখন ঘন দুধ চা, চিপস্ অথবা বিস্কুট খান। কোক খান প্রায় নিয়মিত। সুমাইয়া যে জীবনযাপনে অভ্যস্ত তাতে কোষ্ঠবদ্ধতায় ভোগা খুবই স্বাভাবিক।

বিজ্ঞাপন

দীর্ঘদিন এই অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করার ফলে এখন অবস্থা চরমে পৌঁছেছে। আমাদের শরীরটা প্রাকৃতিক নিয়মে চলে। বায়োলজিক্যাল ক্লক (Biological Clock) বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি পরিভাষা রয়েছে। এর মানে হচ্ছে শরীরের প্রতিটি অর্গ্যান প্রাকৃতিক নিয়মে নির্দিষ্ট সময় ধরে চলে ও নির্দিষ্ট কাজ করতে থাকে। আবার একইভাবে ট্রাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিনে অর্গ্যান ক্লক (Organ Clock) বলে একটা থিওরি রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, শরীরের প্রতিটি অর্গ্যান দিনে দুই ঘন্টা করে সর্বোচ্চ সক্রিয় থেকে তার মূল কাজটা করে। এই থিওরি অনুযায়ী আমাদের শরীরের বর্জ্য বের হওয়ার আদর্শ সময়টা হলো সকাল পাঁচটা থেকে সকাল সাতটা। কারণ এই দুই ঘন্টা সময়ের মধ্যে আমাদের বৃহদন্ত্র (Large Intestine) সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। আর বৃহদন্ত্রের মূল কাজটাই হলো শরীরের বর্জ্য মল আকারে বের করে দেওয়া। খেয়াল করে দেখবেন এই সময়ের মধ্যে পেট সাফ হওয়ার পর ঠিক সাতটা থেকে নয়টার মধ্যে আমাদের ক্ষুধা লাগে। কারণ সাতটা থেকে নয়টা এই সময়ের মধ্যে আমাদের পাকস্থলী (Stomach) সক্রিয় হয়ে ওঠে। এটা হলো স্বয়ংক্রিয় প্রাকৃতিক নিয়মের বাস্তবিক একটি উদাহরণ। প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী না চলে এলোমেলো চললে শুধু কোষ্ঠবদ্ধতাই নয় আরো নানান রোগব্যাধি শরীরে বাসা বাঁধবে। তাই সুমাইয়া আক্তারের মত এমন রোগীর সংখ্যা নিতান্ত কম নয় আমাদের চারপাশে।

দুই মাসের ন্যাচারোপ্যাথি থেরাপিউটিক কোর্স করে আর পরবর্তীতে সে অনুযায়ী নিয়ম মেনে সুমাইয়ার এখন ওষুধ ছাড়াই নিয়মিত পায়খানা হয়। সুমাইয়ার ক্ষেত্রে আমি যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলাম আজ আলোচনা করবো সেগুলো নিয়ে।

এনিমা থেরাপি
সুমাইয়া যে অবস্থা নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন তাতে প্রথমেই ওনার মল বের করা জরুরি ছিলো। ওনার সাথে সিটিং শেষে ওনাকে তখনই এনিমা থেরাপি করিয়ে ওনার জমাট মলগুলোর কিছুটা বের করাই। এতে উনি অনেকটা স্বস্তি বোধ করতে থাকেন।

কিছুক্ষন বসে থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সুমাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন আর বলতে থাকেন আমি ওনাকে জাহান্নামের কষ্ট থেকে যেন রেহাই দিলাম। অসুস্থতা মানুষকে কতোটা কষ্টে ফেলে দিলে একজন মানুষ এভাবে চোখের পানি ফেলতে পারেন ভাবা যায়!

ফুড থেরাপি
তবে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার জন্য ওনাকে প্রথমে চার সপ্তাহের একটি খাদ্যাভ্যাস রুটিন করে দেই। প্রথম চার সপ্তাহ শেষ হলে দ্বিতীয় চার সপ্তাহের জন্য আরেকটি ফুড চার্ট করে দেই। এবং দুই মাস শেষে একটি আদর্শ খাদ্যাভ্যাস রুটিন করে দেই, যেটা মেনে খাবার খেলে নিয়মিত পেট পরিষ্কার হবে।

হারবাল
একটি হারবাল বানিয়ে দেই, যেটা বৃহদন্ত্রের মুভমেন্টকে (Peristaltic Movement) উদ্দীপিত করে পায়খানা নরম হয়ে বের হতে সাহায্য করে। এই হারবাল দুই চা চামচ পরিমাণ এক গ্লাস পানিতে সারারাত ভিজিয়ে রেখে সকালে ঘুম থেকে উঠে খালিপেটে খাওয়া শুরু করার পর থেকেই ওনার দিনে দুইবার পায়খানা হওয়া শুরু হয়।

ইয়োগা
একমাসের একটি ইয়োগা কোর্স করাই যেখানে কোষ্ঠবদ্ধতা ভালো হওয়ার ইয়োগা আসনগুলো করানোর পাশাপাশি শিখিয়ে দেই। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার ওনাকে দুটো ইয়োগিক ক্রিয়া করাই।

ফাস্টিং থেরাপি
প্রতি বৃহস্পতিবার জুস ফাস্টিং করাই।

কোলন ক্লিন্জিং (Colon Cleansing)
আর ‍দ্বিতীয় মাসের প্রথম সপ্তাহে Colon Cleansing করাই। পুরাতন কোষ্ঠবদ্ধতা সারানোর জন্য এটা খুবই কার্যকরি থেরাপি। Colon Cleansing করার পর সুমাইয়ার শরীর পুরো ঝরঝরে হয়ে যায়।

আকুপাংচার
‍দ্বিতীয় মাসের শেষ দুই সপ্তাহে চৌদ্দটি আকুপাংচার সেশন করাই। এই সেশনগুলোতে কোষ্ঠবদ্ধতা সেরে যাওয়ার পাশাপাশি শরীর সবল হয়ে ওঠে এমন পয়েন্টগুলোতে আকুপাংচার করি।

কোষ্ঠবদ্ধতা দূর হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো ভোরে ঘুম থেকে ওঠা এবং রাত দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে ঘুমাতে যাওয়া। সুমাইয়া ঘুমের এই সাইকেলটা মেনে চলছেন। তার প্রতিদিন সকালে পায়খানা হচ্ছে। মেদভুড়ি কমে স্লিম হয়ে গেছেন একদম। মাথাব্যথা, কোমরব্যথা, মেরুদণ্ডে ব্যথা আর হয় না। চুল পড়া কমে গেছে। এখন উনার কর্মজীবন এবং ব্যক্তিজীবন অনেকটাই গোছানো। কথা ‍দিয়ে কথা রাখতে পারেন। সময়মত মিটিং এটেন্ড করতে পারেন। সুমাইয়া ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। প্রাকৃতিক নিয়মের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে সুমাইয়া বর্তমানে সুখি একজন মানুষ।

কোষ্ঠকাঠিন্য টপ নিউজ ডা. ঐন্দ্রিলা আক্তার ন্যাচারোপ্যাথি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর