অতলান্তিক পেরিয়ে পর্ব ৪
২৮ মে ২০২১ ১০:০০
বোস্টন এয়ারপোর্ট থেকে ওয়ালথাম মোটামুটি চল্লিশ মিনিটের ড্রাইভ। অ্যাডামস্ স্ট্রিটে যেখানে উঠলাম, সেটা একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। স্যুটকেসের ট্রলির হাতলটা ভেঙে যাওয়াতে সেটাকে গড়িয়ে টেনে নেয়ার কোন সুযোগ ছিল না। হ্যাঁচড়-প্যাঁচড় করে কোনরকমভাবে সেটাকে তিনতলায় ওঠানো গেল। রুমের দরজা ঠেলে ঢুকেই দেখলাম একদিকে একটা সেমি-ডাবল খাট। দরজার ঠিক বিপরীত দিকের দেয়ালে একটা জানালা। জানালার পাশে ছোট একটা গোল ডাইনিং-টেবিল আর দু’টো চেয়ার। একপাশে ছোট একটা গ্যাস-বার্নার আর রান্নার টুকিটাকি সরঞ্জাম। দরজার পাশে একটা ছোট দেয়াল-আলমিরা, আর তার পাশেই অতি ছোট একটা বাথরুম। এত ছোট যে বাথরুম হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। এই হচ্ছে আমার আগামী কয়েক মাসের আস্তানা। সব মিলিয়ে দুইশ স্কয়ারফিট বা তার চাইতে কমই হবে। কাঠ এবং কংক্রিটের স্ট্রাকচারে তৈরি বাড়ি। দেয়াল আর মেঝে কাঠের। হাঁটলে ঢপ ঢপ সাউন্ড হয়। বিছানায় মাথার দিককার পেছনের দেয়ালটা হচ্ছে পাশের আরেকটা অ্যাপার্টমেন্টের অংশ। ফোনে একটু বেশি জোরে কথা বলে ফেললে, কিংবা ল্যাপটপে একটু জোরে সাউন্ড হলে দেয়ালের অন্যপাশ থেকে দুমদুম করে তিন চারটা কিল এসে পড়ত। প্রথম দিন এরকম আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। চেষ্টা করতাম যতটা কম শব্দ করে কাজ করা যায়। পরের দিকে অবশ্য আর ভয় টয় পেতাম না। বরং ওইপাশ থেকে কখনো জোরে সাউন্ড এলে আমিও দুমদাম কয়েকটা কিল বসিয়ে দিতাম আমার সাইডের দেয়ালে। এভাবেই অদৃশ্য প্রতিবেশীর সাথে আমার দেয়াল-যোগাযোগ চলত। তাকে সামনা সামনি দেখিনি কোনদিন।
বাসায় ঢুকে বিছানায় কাত হয়ে পড়ে রইলাম কিছুক্ষণ। খুব ক্লান্ত লাগছিল, যদিও ঘুম পাচ্ছিল না মোটেও। ঘুম পাবার কথা না কারণ বাংলাদেশে এখন সকাল। দূরদেশ ভ্রমণের এই হচ্ছে সমস্যা। ঢাকার সাথে ওয়ালথামের প্রায় ১১ ঘন্টা সময়ের তফাৎ। এই তফাতের কারণে ঘুমের সাইকেল পুরোই উলোটপালট হয়ে যাবার কথা এবং আমার হয়েওছিল তাই। প্রথম প্রথম প্রায়ই দেখা যেত অফিসে কোন মিটিং হচ্ছে, আমার কানে মিটিংয়ের কিছুই ঢুকছে না, আমি তখন জেগে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে এমন ঘুম পেত যে মনে হত একটা সানগ্লাস পরে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে মুখ সোজা রেখে বসে বসে ঘুমাই, যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে আমি ঘুমাচ্ছি। অনেকের এই ঘুমের সাইকেল দ্রুতই ঠিক হয়ে যায়, আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। আমার প্রায় দুই সপ্তাহ লেগেছিল এই সাইকেল ঠিক হতে।
পরের দিন সোমবার সকালে আতাউর আর রাজীব অফিসে চলে গেল। যাবার আগে দেখা করে গেল আমার রুমে এসে। আজকে আমার ছুটি। ছুটিটা আগেই নেয়া ছিল। এখানে আমাকে একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ওপেন করতে হবে, সিমকার্ড কিনতে হবে, বাসের মান্থলি টিকেট করাতে হবে। কিছু বাজার-হাটও করতে হবে। এসব কাজ করার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন তাতে মনে হল একটা দিন ছুটি নিয়ে নেয়াই ভাল। সকালে নাস্তা করলাম প্লেনে না খাওয়া একটা স্যান্ডউইচ দিয়ে। জানালা খুলেই বুঝতে পারছিলাম বাইরে ভীষণ ঠান্ডা। এখন চিন্তা করলে হাসি পায়, কিন্তু আমি প্রথম দুই মাস সেখানে গরম ট্রাউজারের উপর দিয়ে জিন্স পরতাম। মাথায় থাকত দার্জিলিং থেকে কেনা কানটুপি, গলা আর মাথা জড়াতাম মাফলারে। শার্টের উপর দিয়ে সোয়েটার পরে তার উপরে জ্যাকেট পরতাম। হাতে থাকত হ্যান্ড-গ্লাভস্ আর পায়ে দুই জোড়া মোজা। তারপর সব শেষে জুতা পরতাম। সব পরা শেষ করে আয়নার সামনে দাঁড়ালে আমাকে স্পেসস্যুট পরা নাসার মহাকাশচারীর মত দেখাত। এত কিছু গায়ে চাপিয়েও বাসা থেকে বের হয়ে ঠান্ডায় আমি ঠকঠক করে কাঁপতাম।
ঠান্ডার প্রসঙ্গ যেহেতু এলোই, একটা ঘটনা বলি। ফেব্রুরায়ির শেষের দিকের এক সকালে আমি, আতাউর আর রাজীব বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। বাসস্ট্যান্ডটা ছিল আমাদের অ্যাডামস্ স্ট্রিটের বাসা থেকে বেরিয়ে ডান দিকে মেপল স্ট্রিট ধরে মাত্র দুই মিনিটের হাঁটা দূরত্বে। ৫৫৩ নাম্বার বাস, যেটায় করে টার্নার স্ট্রিটে আমাদের অফিস যাবার কথা, সেই বাসের আসার কথা ছিল সাতটায়। ঘড়িতে তখন বাজে সাতটা পনের অথচ বাসের দেখা নেই। এমবিটিএ (Massachusetts Bus Transport Authority) এর সব রুটের কোন্ বাস কোথায় আছে সেটা দেখার জন্য মোবাইল অ্যাপ পাওয়া যায়। জিপিএস দিয়ে বাসের গতিবিধি সেসব অ্যাপে ট্র্যাক করা হয়। আমরা অ্যাপে দেখছি যে বাসটা আমাদের থেকে তিন স্টপ দূরে এসে বসে আছে। কেন যে বসে আছে জানি না। অনেক সময় বেশি তুষারপাত হলে রাস্তা ক্লিন করতে সময় লাগে। আগের দিন ভয়াবহ তুষারপাত হয়েছে। কে জানে হয়ত এ কারণেই আসতে দেরি হচ্ছে। আজকেও আকাশ ঘোলাটে হয়ে আছে, বোঝা যাচ্ছে তুষারপাত শুরু হতে পারে। ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য যা পরেছি তাতে আমাদের তিনজনকে দেখাচ্ছে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে রাখা তিনটা আলুর বস্তার মত। এত কিছু পরেও শরীরের খোলা অংশে হিমশীতল বাতাস সূঁচের মত ফুটছে। বাসস্ট্যান্ডে বসার জন্য একটা লোহার বেঞ্চ আছে, কিন্তু আমরা সেখানে বসতে পারছি না। বেঞ্চের অর্ধেকটা জুড়ে বরফ উপচে পড়ছে আর বাকি অর্ধেকে বসার কোন মানেই হয়না। বসা মাত্রই হাই ভোল্টেজ ইলেক্ট্রিক শক খাবার মত অনুভূতি হতে পারে। এমন সময় হঠাৎ দেখি রাজীব লাফাতে শুরু করল। বছর ত্রিশেক বয়সের একটা লোক বাচ্চাদের মত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছে এ দৃশ্য অন্য কোন সময় দেখলে হয়ত হাসি পেত, কিন্তু আমাদের তখন হাসি পাচ্ছিল না। আমরা বুঝতে পারছিলাম দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রাজীবের পা অসাড় হতে শুরু করেছে। আরো দশ মিনিট পেরিয়ে গেল। বাসের কোন খবর নেই। আমরা তিনজনেই অস্থির হয়ে উঠেছি। হঠাৎ দেখি আতাউর ঝেড়ে দৌড় দিয়েছে। মেপল স্ট্রিট ধরে বাসার দিকে দৌড়। ওর দেখাদেখি রাজীবও দিল দৌড়, তার সাথে আমিও। বাসায় এসে তিনজন আতাউরের রুমে ঢুকে হিটার চালিয়ে দশ মিনিট ধরে ঠকঠক করে কাঁপলাম। সেদিন বাইরে ছিল মাইনাস বাইশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সাথে ছিল ঠান্ডা বাতাসের প্রবাহ। মাইনাস বাইশ ডিগ্রি সেলসিয়াস যে আসলে কী জিনিস, সেটা আমার পক্ষে লিখে বোঝানো সম্ভব না। শুধু মনে আছে আমি দীর্ঘসময় আমার নাকে হাত বুলিয়েও নাকের মাথা খুঁজে পাইনি। নাকের উপরের অংশে কোন অনুভূতি ছিল না। আমরা যদি আর কিছুক্ষণ বাইরে থাকতাম, খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারত। বাসায় ব্যাক করাটা ছিল বুদ্ধিমানের কাজ। সেদিন আমাদের আর অফিস যাওয়া হয়নি।
যাই হোক, বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে ব্যাংক অব আমেরিকার একটা ব্রাঞ্চ আছে। রাজীবদের কাছ থেকে ডিরেকশনটা জেনে নিয়েছিলাম। চিনতে একেবারেই সমস্যা হল না। পাসপোর্ট দেখিয়ে মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে আমার একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হয়ে গেল। শুনেছিলাম আমেরিকায় ক্যাশ টাকা নিয়ে ঘোরার কোন প্রয়োজন নেই, সবকিছুই ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডে কেনা যায়। তাই সামান্য কিছু ক্যাশ রেখে সাথে করে আনা ডলারের সবটাই আমার সদ্য তৈরি হওয়া অ্যাকাউন্টে জমা করে দিলাম। ডেবিট কার্ডটা ইস্যু করতে সময় লাগল আরো দুই মিনিট। সব মিলিয়ে মোট পাঁচ মিনিটে ব্যাংকের কাজ শেষ। জীবনে এর চাইতে দ্রুত কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কখনও ওপেন করেছি বলে মনে পড়ে না। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তো ওপেন করলাম, এখন সিমকার্ড কিনতে যেতে হবে। পাশেই ওয়ালথামের বিখ্যাত মুডি স্ট্রিট। বিখ্যাত এ কারণে যে এই রাস্তাটাকে হার্ট অব ওয়ালথাম বলা যায়। এর দুই পাশে অসংখ্য দোকান। খাবারের দোকান, শপিং মল, বইয়ের দোকান, হেন কোন জিনিস নেই যে এখানে পাওয়া যায় না। প্রায় সারাক্ষণই এই রাস্তার পাশের ফুটপাথে ভিড় লেগে থাকে। বিশেষ করে বিকেলে এই রাস্তাটা স্থানীয় আর ট্যুরিস্টদের উপস্থিতিতে গমগম করে। মুডি স্ট্রিটের একটা দোকান থেকে লাইকা মোবাইলের (Lycamobile) সিমকার্ড কিনলাম।
এই কোম্পানির সিমের বিশেষত্ব হচ্ছে বাংলাদেশে কথা বলার প্যাকেজ আছে। সাথে পাঁচ গিগাবাইট ইন্টারনেট ফ্রি। আমার যদিও ইন্টারনেট হলেই চলে তারপরেও মনে হল ইমারজেন্সি কাউকে ফোনে পাওয়ার দরকার হতে পারে। এক মাসের জন্য প্যাকেজের দাম নিল ২৩ ডলার। আমেরিকায় মোবাইল-ডেটার খরচ বাংলাদেশের চাইতে যে অনেক বেশি সেটা পরে বুঝেছি। এর পরে বাসের টিকিট কেনার পালা। এখানে আমার গাড়ি নেই। তাই কোথাও যেতে হলে পাবলিক বাস কিংবা ট্রেনই ভরসা। MBTA থেকে একটা কার্ড ইস্যু করে যার নাম চার্লি কার্ড। প্রায় সব স্টেশনারি দোকানেই চার্লি কার্ড পাওয়া যায়। এই কার্ডের সুবিধা হচ্ছে ইচ্ছামত টাকা বা প্যাকেজ রিলোড করা যায়। মান্থলি প্যাকেজ রিলোড করে একটা কার্ড নিলাম। কার্ডের দাম ফ্রি, প্যাকেজ রিলোডের খরচ পড়ল ২৯ ডলার। মান্থলি প্যাকেজের সুবিধা হচ্ছে এই কার্ড নিয়ে এক মাসের জন্য আমি MBTA-এর যেকোন বাসে চড়তে পারব আর যেখানে ইচ্ছা যতবার ইচ্ছা যেতে পারব। যদি মান্থলি প্যাকেজ না নিতাম, তাহলে প্রতিবার অফিস যাবার আর অফিস থেকে আসার সময় এর প্রায় দ্বিগুণ খরচ করতে হত।
পরের দিন অফিসে গিয়ে আমাদের প্রজেক্ট ম্যানেজার হিমাংশু, প্রোডাক্ট ম্যানেজার মিন্ডি, রন, সারা, এমি, অনশোর লিড ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে মিশেল, রিতেন, রিয়াজ ভাই, পারভেজ ভাই, হানা, কোয়ালিটি এস্যুরেন্স টিমের নেট নিকারসন, অ্যালেনসহ আরো অনেকের সাথে পরিচয় হল। এদের অনেকের সাথেই আমরা প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে স্কাইপে মিটিং করি, কিন্তু সামনাসামনি দেখা হল এই প্রথম। সবাইকেই খুব আন্তরিক মনে হল। হিমাংশু নিজে সাথে করে আমাকে নিয়ে আমার বসার জায়গা দেখিয়ে দিল। তার কিউবিকলের পাশের রো’তে আমার বসার জায়গা। আমার ঠিক পাশের কিউবিকলটা ছিল হানার। হানা ইজিপশিয়ান। ইজিপ্টের হিস্ট্রি নিয়ে আমার ছেলেবেলার কৌতূহল ওর সাথে একটা ভাল সম্পর্ক করতে হেল্প করেছিল। আমরা মাঝে মাঝে পিরামিড, ফারাও ইত্যাদি নিয়ে গল্প করতাম। হানার পাশের কিউবিকলটা অঙ্ক ভাইয়ের। অঙ্ক ভাই এই কোম্পানিতে জয়েন করেছিলেন পনের বছরের বেশি সময় আগে। তিনি এখন আমাদের ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টর। ইউএসএতে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। অফিসে দিনের একটা বড় সময় আমার চলে যেত নতুন প্রোজেক্টের খুঁটিনাটি নিয়ে বিভিন্ন টিমের সাথে মিটিং করে। তারপর একটা সময় আবার ঢাকায় আমার টিমের সাথে ডিসকাশন করতে হত। দুপুর বারোটায় ছিল লাঞ্চ টাইম। আমেরিকানরা সাধারণত খুব আর্লি রাইজার হয় বলে আমার ধারণা। অন্তত আমি যেখানে ছিলাম সেখানে তা-ই দেখেছি। এরা সকালে ব্রেকফাস্ট করে সাতটার মধ্যে। আর লাঞ্চ সেরে নেয় বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে। মুডি স্ট্রিটে একদিন দুপুর তিনটায় এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে লাঞ্চ আছে কি না জিজ্ঞেস করাতে তারা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল। দুপুর তিনটায় এখানে কেউ লাঞ্চ খায় না। ডিনার টাইম শুরু হয়ে যায় বিকাল পাঁচটার পর থেকেই। সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে ডিনার খতম। তবে পাব্ কিংবা বার্ খোলা থাকত। খানা না খেলেও পিনায় দোষ নেই। অফিসে কেউ কেউ বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসত। লাঞ্চ টাইমে তারা যার যার কিউবিকলে বসেই খাওয়া সারত। যেমন মিশেল। মিশেলের বাড়ি চায়নায়।
সে বসত আমার উল্টোদিকের কিউবিকলে। দুপুরে খাবার সময়টা ছিল তার বাসায় কথা বলার টাইম। আমি ম্যান্ডারিন বুঝি না, শুধু মাঝে মাঝে শুনতাম “হাও দা”। এর মানে যে “OK” সেটা জেনেছিলাম পরে। আমার চায়নিজ বিদ্যার দৌড় এতটুকুই। আমি নিজেও চেষ্টা করতাম বাসা থেকে কিছু একটা বানিয়ে আনতে। মূল উদ্দেশ্য ছিল পয়সা বাঁচানো। অধিকাংশ দিনই আনতাম স্যান্ডউইচ। একটা ডিম পোঁচ করে দুই টুকরা পাউরুটির মাঝখানে দিয়ে দিতাম। সাথে থাকত একটা চিজ-স্লাইস, একটু টমেটো আর সামান্য মেয়োনেইজ। খেতে যে খুব সুখাদ্য হত তা না, খাওয়া যেত। তবে পয়সা বাঁচত। এমনও হয়েছে তিনবেলাই স্যান্ডউইচ খেয়েছি। স্যান্ডউইচ না খেলে দুটো ডিম ভাজি করে খেয়ে নিতাম। ক্ষিদে পেলেই ডিম পোঁচ, না হয় ডিম দিয়ে বোম্বাই টোস্ট, না হয় ডিম সিদ্ধ, নয়তো ভাজি। ডিমের চাইতে সহজ খাবার আর কী হতে পারে। আমি থাকতে থাকতেই ওয়ালথামে ডিমের দাম ডজনে ত্রিশ সেন্ট বেড়ে যায়। এখানে কোন জিনিসের দাম সাধারণত চট করে বাড়ে না। আমার ধারণা এর পেছনে আমার একক ডিম-বিধ্বংসী ভূমিকাটা দায়ী ছিল। মাঝে মাঝে অবশ্য বিরতি দিতাম। অফিসের গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা ক্যাফে ছিল। যেদিন কিছু বানাতে ইচ্ছা করত না সেদিন সেখানে যেতাম। কোল্ড চিকেন, টমেটো, অলিভ, কোলস্ল ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিস দিয়ে একটা বাটি ভরাতাম, ওজন করে দেখা যেত বিল এসেছে সাত ডলার। বিস্বাদ খাবার, কি যে খাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারতাম না। তবে খেয়ে কোনদিন অসুস্থ হইনি। খাবারের ব্যাপারে এরা অত্যন্ত সচেতন। কোন খাবার নিয়ে সামান্য পরিমাণ সন্দেহ থাকলেও তারা সেটা ফেলে দেবে। আর একদিনের খাবার অন্যদিন সার্ভ করার তো প্রশ্নই ওঠে না। এই ক্যাফেতেই আমি প্রথম আমেরিকান কোকাকোলা খেলাম একদিন। অনেক বেশি মজা লাগল, জানি না কেন। শুনেছিলাম আমাদের দেশের কোক-এ কেইন-সুগার দেয়া হয়, আর আমেরিকান কোক-এ ব্যবহার করে কর্ন-সিরাপ। কথাটা সত্য কিনা জানি না। সত্য হলে স্বাদের তফাৎটা কি এ কারণেই হয় কি না তা-ও বলতে পারব না।
আরও পড়ুন
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ১
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ২
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৩
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৫
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৬
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৭
আমাদের অফিস ছুটি হত পাঁচটায়। আমি, আতাউর আর রাজীব হেঁটে হেঁটে টার্নার স্ট্রিটের বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বসে থাকতাম বাস আসার জন্য। অফিস থেকে এই বাসস্ট্যান্ড বেশ দূরে, প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার হাঁটতে হত, আবার অফিসে আসার সময়ও এখানে নেমে এই পরিমাণ রাস্তা হেঁটে অফিসে পৌঁছাতে হত। হাঁটতে আমাদের খারাপ লাগত না মোটেই, বরং ভালই লাগত। হেঁটে কোনদিন হাঁপিয়ে গেছি এরকম মনে পড়ে না। মাঝে মাঝে অফিস শেষ করে আমরা তিনজন বাসায় না গিয়ে মুডি স্ট্রিটে এসে ঘুরতাম। এমনিই ঘুরতাম, কিছু কেনার উদ্দেশ্যে না। কোনদিন হয়ত আমাদের আরেক কলিগ সন্দিপন আমাদের সঙ্গ দিত। মুডি স্ট্রিট আমাদের বাসা থেকে তিন মিনিটের হাঁটা পথ। এখানের ইন্ডিয়ান মার্কেট ছিল আমাদের বাজার করার মেইন জায়গা। আমাদের বাঙালি জিভ যেসবে খাবারে অভ্যস্ত সেরকম সব ধরণের সবজি, ফল, মাছ, মাংস ইত্যাদি সবকিছুই এখানে পাওয়া যেত। এমনকি এখানে বাংলাদেশের অনেক প্রোডাক্টও দেখেছি। রুচির চানাচুর কিংবা প্রাণের ডাল দেখেছি এখানে। তবে আমার পছন্দ ছিল হানাফোর্ড নামের আরেকটা সুপার শপ। সেটা মুডি স্ট্রিটে না, একটু দূরে রাসেল স্ট্রিটে। অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে রাসেল স্ট্রিট আগে পড়ত। আমি মাঝে মাঝে সেখানেই নেমে যেতাম। হানাফোর্ডে এমন অনেক কিছু পাওয়া যেত যেগুলো ইন্ডিয়ান মার্কেটে পেতাম না। বিশেষ করে বিভিন্ন রকমের চিজ এবং জুস। আমি ফ্লোরিডা’স ন্যাচারাল ব্র্যান্ডের অরেঞ্জ জুসের ভক্ত হয়ে গেলাম অল্পদিনের মধ্যে। চিনি ছাড়া জুস, কিন্তু এত চমৎকার খেতে! হানাফোর্ড থেকে আরো কিনতাম লিকুইড মিল্ক। হুড নামে একটা ব্র্যান্ডের দুধ বেশ পপুলার ছিল। ডিম দুধ আর জুস, এই তিনটা ছিল কোয়ালিটির তুলনায় অসাধারণ রকম সস্তা। আড়াই লিটারের একটা অরেঞ্জ জুসের কন্টেইনার ছয় ডলার, বাংলাদেশি টাকায় পাঁচশো টাকা। দুই লিটার দুধের জার আড়াই ডলারের মত। হানাফোর্ডের নিজস্ব ব্র্যান্ডের লার্জ সাইজের ব্রাউন ডিমের ডজন মাত্র দেড় ডলার। কারো যদি ভাত খেতে না পেয়ে মারা যাবার ভয় না থাকে, আমেরিকায় সে শুধু বিভিন্ন রকমের ব্রেড, মিল্ক, চিজ আর জুস খেয়েই কাটিয়ে দিতে পারবে বলে আমার ধারণা।
হানাফোর্ডের নিজেদের বানানো রোটিসেরি চিকেন ছিল অসাধারণ স্বাদের একটা বস্তু। আর এর ছোট্ট পেস্ট্রি কর্নারটার বিভিন্ন রকমের পেস্ট্রির স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে একটাই মুশকিলে পড়তাম সেটা হল ওজন নিয়ে। প্রায় সারা দুনিয়াতে যেখানে লিটার, কিলোগ্রাম, কিলোমিটারে ভলিউম, ওজন কিংবা দূরত্ব মাপার কাজ হয়, আমেরিকাতে ওরা এখনও ইম্পেরিয়াল সিস্টেমে পড়ে আছে। জিনিসপত্রের ওজন এখনও ওরা পাউন্ডে কিংবা ফ্লুইড আউন্সে মাপে। দূরত্ব মাপে মাইলে। গায়ে লেখা পাউন্ড কিংবা আউন্স থেকে মনে মনে কনভার্ট করে আমাকে গ্রামে কিংবা লিটারে বের করে নিতে হত।
মাঝে মাঝে বাস না ধরে আমরা অফিস থেকে হেঁটেও বাসায় ফিরতাম। সেদিন মাউন্ট ফিক সেমেটারির শর্টকাট রাস্তাটা ধরা হত। টার্নার স্ট্রিটের বাস স্ট্যান্ডটার পাশ দিয়ে সামান্য হেঁটে গেলেই একটা কবরখানা পড়ত। নাম মাউন্ট ফিক সেমেটারি (Mount Feake Cemetery)। এটার মেইন গেট অন্য কোনদিকে, তবে শর্টকাট নেবার জন্যই বোধহয় কেউ এদিকের কাঁটাতারের বেড়াটা ভেঙে রেখেছিল। আমরা সেই ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে কবরখানায় ঢুকে পড়তাম, তারপর বাড়ির দিকে রওনা দিতাম। যেতে যেতে দেখতাম দুই দিকে অত্যন্ত প্রাচীন সব কবরের হেডস্টোন, বরফে ঢেকে যাওয়া খোলা প্রান্তর, বড় বড় গাছ আর তাদের নিচে পড়ে থাকা শুকনো পাতা, সাথে পাখির গান।
সব মিলিয়ে এত সুন্দর ছিল জায়গাটা যে কবরখানার ভিতর দিয়ে হাঁটছি বলে মনেই হত না। আমরা প্রায়ই এই রাস্তাটা ধরতাম শুধু এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য। পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে হেঁটে বাসায় যখন পৌঁছাতাম তখন মনে হত পথটা যেন দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। বাসায় এসে কিছু একটা রান্না করতাম। ভাত খাওয়া হত না বললেই চলে। শুধু রোববার ছুটির দিনে মাঝে মাঝে শখ করে ভাত রান্না করতাম। আমার সময় রাতের দিকে যখন ঢাকায় সকাল হত, তখন বহ্নির সাথে ম্যাসেঞ্জারে কথা বলতাম। সাবধানে একটা নির্দিষ্ট ভলিউম মেইনটেইন করে কথা বলতে হত, তা না হলে দুমাদুম কিল পড়ত মাথার পেছনের দেয়ালে।
আমরা মাঝে মাঝে বেড়াতেও যেতাম। একটু দূরে যেতে হলে বোস্টন, কিংবা কেমব্রিজ। তবে বেশি যাওয়া হত ওয়াটারটাউন নামে একটা জায়গায়। মানুষ ঢাকায় ছুটির দিনে বসুন্ধরা সিটিতে যায়। আমেরিকায় আমাদের বসুন্ধরা সিটি ছিল ওয়াটারটাউন। কি সুন্দর নাম তাইনা, ওয়াটারটাউন, পানির শহর। ওয়ালথাম ছিল নিতান্তই একটা গ্রাম। এবং ছবির মত সুন্দর। সেই তুলনায় ওয়াটারটাউন একটু বড়লোকি এলাকা। ওয়ালথাম থেকে আধা ঘন্টার বাসের দূরত্ব। আমরা ছুটির দিনে মাঝে মাঝে ওয়াটারটাউন চলে যেতাম। সেখানে আর্সেনাল মলের (এখন আর নেই সেটা) সাবওয়ে আমাদের পছন্দের খাবারের দোকান ছিল। সাবওয়ের টুনা স্যান্ডউইচ ছিল আমার অত্যন্ত পছন্দের। সাবওয়েতে কাজ করে একটা মেয়ের সাথে সেখানেই আলাপ হয়। নাম সুপ্রিয়া। প্রথমে ভেবেছিলাম ইন্ডিয়ান। পরে কথায় কথায় জানতে পারি সে নেপালি। সুপ্রিয়ার সাথে ভাল একটা বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আমি দোকানে এলেই সে ব্রেড কাটা শুরু করত, জিজ্ঞেস পর্যন্ত করত না কোন স্যান্ডউইচটা খেতে চাই কারণ সে জানত আমি টুনা ছাড়া অন্য কিছু খাই না। খেতে খেতে টুকটাক গল্প হত তার সাথে। জেনেছিলাম এখানে সে থাকে তার বোনের সাথে। কিভাবে সে এখানে এসেছে সে প্রশ্ন কোনদিন করিনি। তবে বুঝতে পারতাম ভাগ্য পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে কোন একটা অসম্মানজনক উপায়েই তার এখানে আসা। আমেরিকায় ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে মানুষ মিশে যায় জনস্রোতে, আর কোনদিন ফিরে যেতে পারবে না জেনেও। অড জব করে কোনরকমভাবে টিকে থাকে, বাড়িতে টাকা পাঠায়। স্বপ্ন দেখে কোনদিন হয়ত তাকে লিগ্যাল করা হবে। এরকম প্রচুর মানুষ সারা আমেরিকায় ভর্তি। আমেরিকার অর্থনীতিতে এদের ভূমিকা মোটেই তুচ্ছ করার নয়। টম হ্যাংকসের সেই বিখ্যাত মুভি “দ্য টার্মিনাল”-এ দেশ থেকে পালিয়ে আসা একজন, যে এয়ারপোর্টের ক্লিনারের কাজ করত, সে বলেছিল, “অ্যাজ লং অ্যাজ আই কিপ মাই ফ্লোর ক্লিন, কিপ মাই হেড ডাউন, দে হ্যাভ নো রিজন টু ডিপোর্ট মি, দে হ্যাভ নো রিজন টু নোটিস এ ম্যান লাইক মি”।
আমি আমেরিকায় থাকতে থাকতেই এপ্রিলে নেপালের সেই ভয়াবহ ভূমিকম্পটা হয়। রিখটার স্কেলে যার ম্যাগনিচিউড ছিল ৭.৮। আমার শখের দরবার স্কয়ার, ফেলুদার যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে যার কথা পড়েছি, সেটার প্রায় পুরোটাই হয়ে গেল ধ্বংসস্তুপ। তার চাইতেও বড় কথা দশ হাজারের বেশি মানুষের তাৎক্ষনিক মৃত্যু হল। আমি দু’দিন পর ওয়াটারটাউনে সাবওয়েতে গেলাম। সেদিন এই প্রথম হাসিখুশি সুপ্রিয়ার চোখে কোন হাসি দেখলাম না। জানলাম নেপালে ওর আত্মীয়-স্বজন সবাই ভাল আছে, শুধু ওর এক কাকার বাড়িটা একেবারে মাটির সাথে মিশে গেছে। বিষণ্ণমুখে সে ব্রেড কাটা শুরু করল, আমি নিষেধ করলাম। বললাম আমি শুধু এসেছি ওর খবর নিতে। আরেকজন কাস্টমার আসাতে ও একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কাউন্টারের সামনে দেখলাম একটা কাঁচের জার রাখা, সেখানে লেখা “হেল্প ফর নেপাল”। ওকে বুঝতে না দিয়ে সামান্য কিছু দিয়ে এসেছিলাম সেই পাত্রে।
এভাবেই বাসা থেকে অফিস, অফিস থেকে বাসা, মাঝে মাঝে ওয়াটারটাউন, মাঝে মাঝে কারো বাড়িতে দাওয়াত এভাবেই দিন কাটতে থাকল। ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হয়ে গেল। এ বছর আমি বইমেলা যেতে পারিনি। ১৯৮৪ সালে ক্লাস টু’তে পড়ার সময় আব্বার হাত ধরে বইমেলা যাওয়ার শুরু, কোনবছর আমার মিস হয়নি। এই প্রথম একুশের বইমেলায় আমার যাওয়া হল না। এখানে প্রায়ই তুষার ঝড় হয়। ঝড়ের সময় জুবুথুবু হয়ে পড়ে পুরো শহরটা। বাসার ভেতরে বসে বাতাসের ধাক্কা টের পেতাম কাঠের দেয়ালে। এর মধ্যে একদিন আমি ডান হাতের গ্লাভস্টা হারিয়ে ফেললাম। মুডি স্ট্রিটের কোন দোকানে গ্লাভস্ খুঁজে পেলাম না, সব আউট অব স্টক। আরেকদিন বাসায় ফেরার সময় মেপল স্ট্রিটে বাস থেকে নেমে মাটিতে পা রাখতেই পট করে একটা সাউন্ড হল শুনলাম। দেখি বাম পায়ের জুতার সাইডটা ফেটে অল্প হা হয়ে গেছে। ঢাকা থেকে কেনা আমার শখের বুটজুতা অবশেষে আমেরিকান ঠান্ডা আর সহ্য করতে পারল না। আতাউর আর রাজীব হেঁ হেঁ করে হাসল কিছুক্ষন। বলল, বলছিলাম ভাই জুতা আইনেন না, লাভ নাই। আগামীকাল ছুটির দিন। ঠিক হল আমরা বোস্টন যাব। রথ দেখা আর কলা বেচার মত আমার জুতা কেনা হবে, বোস্টন শহরটাও আরেকবার ঘোরা হবে।
(চলবে)
সারাবাংলা/এসএসএস