বিজ্ঞাপন

অতলান্তিক পেরিয়ে পর্ব ৭

June 18, 2021 | 10:00 am

জাকির হোসেন

থার্মোমিটারে টেম্পারেচার দেখাচ্ছে মাইনাস এক ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রচণ্ড গরম যাকে বলে। আজকাল আমরা মাইনাস দশের নিচের ঠান্ডাকে ঠান্ডাই মনে করি না। ডাবল প্যান্ট, ডাবল মোজা পরে বাইরে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। ইদানিং একটা করে পরলেই কাজ চলে যায়। তুষারপাত দেখলে যেই আতাউরের মাথা খারাপ হয়ে যেত, সে এখন তুষার সহ্যই করতে পারে না। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার সময় রাস্তার পাশে পড়ে থাকা তুষারে ইদানিং সে মাঝে মাঝে লাথি মারে। আমেরিকাতে থাকার সময় শিখলাম কোন্‌ বরফের উপর দিয়ে হাঁটা যায় আর কোন্‌টায় হাঁটা রিস্কি। সদ্য পড়া তুষারের উপর দিয়ে হাঁটা অনেকটা বালির উপর দিয়ে হাঁটার মতই। খুব একটা আনসেফ না সেটা, আনলেস যদি না নিচে কোন গর্ত ফর্ত থাকে। কিন্তু তুষার জমে শক্ত হয়ে গেলে সেটার উপর দিয়ে সাবধানে হাঁটাই ভাল। সবচাইতে ভাল হচ্ছে জায়গাটা এড়িয়ে যাওয়া। বরফের রঙ দেখেও অনেক কিছু আঁচ করা যায়। ব্ল্যাক আইস হচ্ছে মারাত্মক জিনিস। এর উপর দিয়ে বেখেয়ালে হাঁটলে আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় একশ ভাগ। আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পরের বছর আমাদের অফিস ট্রিপে শিমলা-মানালি যাবার প্ল্যান হয়েছিল। প্রতি বছরই কোথাও না কোথাও অফিস ট্যুর হয়। ডিসেম্বরে মানালিতে বরফ পাওয়া যাবে এই উৎসাহে সবাই মহা উত্তেজিত। শুধু আতাউরের মধ্যে কোন উত্তেজনা নেই। সে গম্ভীর গলায় বলল, বরফের গল্প কেউ আমার কাছে করতে আসবেন না, আই হেইট বরফ। তবে অন্য কারো কাছে যা-ই মনে হোক না কেন, আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, আমি বলব তুষার আমার অলটাইম ফেবারিট। এক আমেরিকান লেখিকা নিজের ছেলেবেলার সময়কাল নিয়ে কয়েকটা বই লিখেছিলেন। উইসকনসিনের (Wisconsin) জঙ্গলে কেটেছিল তার ছেলেবেলা। বইগুলোর কোথাও কোন এক শীতের সন্ধ্যার একটা অসাধারণ বর্ণনা আছে। বর্ণনাটা এরকম।

বিজ্ঞাপন
রাস্তার পাশে ফুল ফুটে আছে, অকারণে।

রাস্তার পাশে ফুল ফুটে আছে, অকারণে।

কাঠের গুঁড়ি দিয়ে বানানো তাদের ছোট্ট বাড়িটার ভেতর লরাদের সবাই বসে আছে। একপাশে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। লরার মা চেয়ারে বসে আছেন। উল দিয়ে কিছু একটা বুনছেন তিনি। লরাদের একটা কুকুর ছিল, নাম জ্যাক। জ্যাক বসে আছে লরার বড় বোন মেরির কোলে। লরার বাবা খুব ভাল ভায়োলিন বাজাতেন। সেদিন কোন কারণে বাবার মন খুউব ভাল। তিনি ভায়োলিনে একটার পর একটা পুরনো গানের সুর তুলছেন। বাড়ির সবাই তন্ময় হয়ে শুনছে সেই সুর। বইয়ে লরা লিখেছে, সে তার এই পারিবারিক মূহুর্তের প্রতিটা পল প্রতিটা অনুপল উপভোগ করছে। একসময় জানালা দিয়ে সে বাইরে তাকাল। দেখল গাছপালা, বন সবকিছু আস্তে আস্তে শ্বেতশুভ্র হয়ে উঠছে চোখের সামনে। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে সে দেখতে থাকল এই নিঃশব্দ তুষারপাত। তার কাছে মনে হল এই মূহুর্তে তার চাইতে সুখী এই পৃথিবীতে কেউ নেই। ……কেউ কি বলতে পারবেন আমি কোন্‌ বইটার কথা বলছি? বিটিভিতে আশির দশকের শুরুতে একটা ইংরেজি টিভি সিরিজ দেখাত। সিরিজটার নাম, “লিটল্‌ হাউজ অন দ্য প্রেইরি”। লরা ইঙ্গালস্‌ ওয়াইল্ডার (Laura Ingalls Wilder) এর লেখা বইটার নামও তাই। আঠারশো সালের শেষের দিকে কেমন ছিল আমেরিকার সাধারণ জীবন সেটা জানতে চাইলে এই বই পড়তে হবে। সেই সময়টাকে লরা এতটাই অসাধারণভাবে এই বইয়ে তুলে এনেছেন যে আমেরিকান সাহিত্যে প্রেইরি সিরিজের বইগুলোকে ক্লাসিকের মর্যাদা দেয়া হয়। বইটা পড়ার পর থেকেই আমি স্বপ্ন দেখতাম কোন একদিন ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে আমিও ঠিক এইভাবে তুষারপাত দেখব। এখানে আসার পর তুষারপাত আমি দেখেছি ঠিকই। তবে লরার মত করে নয়। যতদিন আমেরিকায় থেকেছি, ঠান্ডায় কিভাবে মরে শক্ত হয়ে যেতে না হয় সেই গবেষণাতেই আমার দিন গেছে। তারপরেও বলব, তুষার জিনিসটা আমার বড় ভাল লাগে। তুষারপাত দেখার জন্য আমি যেকোন জায়গায় যেতে রাজি। উৎসাহী পাঠকেরা প্রেইরি সিরিজের বইগুলো পড়ে দেখতে পারেন।

আরও পড়ুন

এই হপ অন হপ অফ বাসে চড়ে সারাদিন বোস্টন শহর ঘুরে বেড়ানো যায়।

এই হপ অন হপ অফ বাসে চড়ে সারাদিন বোস্টন শহর ঘুরে বেড়ানো যায়।

এর মধ্যে মার্চ পার হয়ে এপ্রিল মাসও চলে গেল। এপ্রিলের ২৫ তারিখে নেপালে ঘটল সেই ভয়াবহ ভূমিকম্প যার কথা আগের কোন এক পর্বে লিখেছি। আমি নেপালিদের সান্নিধ্যে এসেছি দার্জিলিং-এ গিয়ে। যেহেতু দার্জিলিং আমার পছন্দের জায়গা, নেপালিরাও আমার পছন্দের মানুষ। পৃথিবীর সব জায়গাতেই ভাল মন্দ মিলিয়ে মানুষ আছে। কিন্তু নেপালিদের মত এত কর্মঠ, এত সৎ আর এত সরল মনের মানুষ আমি অন্তত পাইনি। মজার বিষয় হচ্ছে আমি নেপাল যাইনি কোনদিন, শুধু দার্জিলিংয়ের অভিজ্ঞতা থেকেই নেপালিদের আমি ভালবাসি। তাই ভূমিকম্পের খবরটায় আমার খুবই খারাপ লাগল। কিভাবে এই বিপদে তাদেরকে সাহায্য করতে পারি ভাবতে গিয়ে মনে হল ওয়াসফিয়া নাজরীনকে একটা নক করলে কেমন হয়? মাউন্টেনিয়ার ওয়াসফিয়াকে ফেসবুকে ফলো করছি দীর্ঘদিন ধরে। নেপাল তারও প্রিয় জায়গা। মনে হল, একটু জিজ্ঞেস করে দেখি না যদি ওর মাধ্যমে কিছু অর্থ সাহায্য পাঠানো যায়? ম্যাসেঞ্জারে ওয়াসফিয়াকে ব্যাপারটা জানালাম। কিছুদিন পর ওয়াসফিয়া রিপ্লাইও দিয়েছিল। ততদিনে অবশ্য আমি ফেসবুকের মাধ্যমেই নেপালে কিছু সাহায্য পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। দেশে ফেব্রুয়ারির একুশের বইমেলাও মিস করেছি, এপ্রিলে পহেলা বৈশাখও মিস করেছি। মন এমনিতেই ছিল খারাপ। এখন নেপালের ঘটনাটায় মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। ছয় মাসের জন্য এখানে এসেছি। ছয় মাস হতে এখনও দু’ মাস বাকি। তবে যে কাজের জন্য আমার এখানে আসা সেটা প্রায় শেষের পথে। আশা করা যাচ্ছে আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সব শেষ হবে।

বিজ্ঞাপন
টার্নার স্ট্রিটে বাসের অপেক্ষায়, পাবলিক গার্ডেনের এক বাজিয়ে আর আমি।

টার্নার স্ট্রিটে বাসের অপেক্ষায়, পাবলিক গার্ডেনের এক বাজিয়ে আর আমি।

বহ্নি এখানে আসার আগে আমাকে বলেছিল কোন ভাল সোলজার তার ব্যাটল-গ্রাউন্ড ছেড়ে পালিয়ে যায় না। আজকাল আর নিজেকে ভাল সোলজার বলে মনে হয় না। মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করে সব ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাই। এই ইচ্ছাটা দমিয়ে রাখার জন্য নানানভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করি। যেমন আজ রোববার। অফিস নেই। বাসায় বসে নতুন একটা খাবার আবিষ্কারের চেষ্টায় আছি। ছুটির দিনে খাবার নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করাই যায়। এর আগে একদিন দুধ-সেমাই বানানোর চেষ্টা করেছিলাম, খেতে খারাপ হয়নি। তবে বানাতে গিয়ে যা ঘটেছিল তার ডিটেইল বর্ণনা দিতে চাচ্ছি না। সূর্য পূব-দিকে উঠবে, পশ্চিমে অস্ত যাবে, পাখিরা গান গাইবে, চুলায় দুধ গরম হবে, কিছু বুঝে উঠার আগে সেই দুধ হাইজাম্প দিয়ে নিচে পড়ে চুলা, পাতিল, মেঝে সব মাখামাখি হয়ে যাবে, এগুলো আসলে জাগতিক নিয়ম। আমরা এইসব নিয়মের বাইরে কখনোই যেতে পারব না। যাই হোক, আজকের মেন্যু হচ্ছে ভাত আর এগপ্ল্যান্ট-উইথ-চিজ। বেগুন ছোট ছোট করে কেটে মসলায় কিছুক্ষণ কষানোর পর তাতে শেডার চিজ দিলে খেতে কেমন লাগে সেটার পরীক্ষা চলছে। রান্না শেষ হতে বেশিক্ষণ লাগল না। আয়েশ করে খেতে বসে এক লোকমা মুখে দিয়েই নাড়ি উল্টে আসল। শেডার চিজটা অতিরিক্ত স্ট্রং। বেগুনের তরকারি তিতা হয়ে গেছে পুরা। অতি অখাদ্য হয়েছে খেতে। ফ্রাইং প্যানের বাকি এগপ্ল্যান্ট-উইথ-চিজের দিকে তাকালাম। এই বস্তু নিয়ে এখন আমি কী করব? পুরোটা কমোডে ঢেলে ফ্লাশ করে দিলাম। তারপর বিস্কুট খেয়ে একটা বই নিয়ে বসলাম। সুনীলের ছবির দেশে কবিতার দেশে। আজকে রাতে এক বাসায় দাওয়াত আছে। আমার যাওয়ার কোন ইচ্ছা নেই। কিভাবে দাওয়াতটা অ্যাভয়েড করা যায় ভাবছি মনে মনে।

ম্যাসাচুসেট্‌সে যে গুটিকয়েক বাংলাদেশি পরিবার আমি পেয়েছি, কেন জানি না মনে হল তারা আমাকে পেয়ে আকাশের চাঁদ পেলেন। সম্ভবত নিজের দেশের কাউকে কাছে পেলেই তারা এরকম করেন। অবশ্যই এটা চমৎকার একটা ব্যাপার। অনেকেই হয়ত এটা এনজয় করে। কিন্তু আমি এসবের সাথে অভ্যস্ত না। কোনকালে অভ্যস্ত ছিলামও না। আমার পরিচিত সার্কেলের সবাই যারা আমাকে চেনে তারা জানে যে আমি গর্তজীবি মানুষ। নিতান্ত প্রয়োজনে নিজের গর্ত থেকে বের হয়ে প্রয়োজন শেষে দ্রুত গর্তে ঢুকে যাওয়াই হচ্ছে আমার নিয়ম। কিন্তু ওয়ালথামে এসে সেই গর্তসূত্র মেনে চলা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। একেক শনিবার কিংবা রবিবার একেকজনের বাসায় দাওয়াত। মহা যন্ত্রণা যাকে বলে। আজ রাতে এক পরিচিত বাঙালির বাসায় দাওয়াত। বিকেলের দিকে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তিনি নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে আসলেন আমাকে নেয়ার জন্য। আতাউর আর রাজীবও যাচ্ছে। বোস্টন এবং কেমব্রিজ থেকে আরো কয়েকজন আসবেন তার বাসায়। সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া হবে। আড্ডা হবে। ছুটির দিনে আমারও যে কিছু কাজ থাকতে পারে, কিংবা জাস্ট শুয়ে শুয়ে আকাশ বাতাস ভাবতে যে ইচ্ছা করতে পারে এটা তাকে বলি কি করে। তাছাড়া নিজেই চলে এসেছেন গাড়ি নিয়ে, এ অবস্থায় যাব না বলাটাও অভদ্রতা। গেলাম তার সাথে। ঘন্টাখানিক ড্রাইভ করে চার পাঁচটা শহর পার হয়ে তার বাসা। গিয়ে দেখি আরো অনেকে এসেছেন। উনো খেলা হচ্ছে। সেই প্রথম উনো (Uno) খেলাটা দেখলাম। বেশ ইন্টেরেস্টিং খেলা। খাবার পর শুরু হল বঙ্গ দেশীয় রাজনৈতিক আলোচনা। আমি চুপ করে রুমের এক কোনার সোফায় কাত হয়ে পড়ে আছি। শুনলাম রাজনীতি থেকে আলোচনা দ্রুত চলে গেল আমেরিকান লাইফে। আমেরিকান লাইফ যে কত খারাপ সেটা নিয়ে আমি জ্ঞান অর্জন করতে থাকলাম। জানলাম যে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে আমেরিকায় থাকা সম্ভব না। আরো জানলাম বাংলাদেশে তারা অত্যন্ত ভাল ছিলেন আর এখানে এসে অত্যন্ত কষ্টে আছেন। কনভার্সেশনের একটা পর্যায়ে গিয়ে তারা কে কে গ্রিনকার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করেছেন সেই আলোচনা শুরু হল। যারা করেননি তারা কবে করবেন, কিভাবে করলে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি গ্রিনকার্ড পাওয়া যায় এই সমস্ত খুঁটিনাটি ব্যাপারে আমার জ্ঞানভান্ডার বৃদ্ধি পেতে থাকল। মানুষ অনুরোধে ঢেঁকি গেলে। আমি ঢেঁকির ফ্যাক্টরি গিলে এরপরে আরো কয়েকবার এই ধরণের দাওয়াত খেতে গেছি। যতবার গেছি, এই টক-শোর সিকুয়েন্সে তেমন একটা উনিশ বিশ হতে দেখিনি। আলোচনার প্রথম ভাগে থাকত রাজনীতি। তারপর আমেরিকার গুষ্ঠি উদ্ধার পর্ব। এবং তারপরেই ভাব গাম্ভীর্যের সাথে মূল পর্ব শুরু হত। মূল পর্বের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে  গ্রিনকার্ড পাবার সহজ, জটিল ও মিশ্র পদ্ধতি।

বাসায় হেঁটে যাবার পথে।

বাসায় হেঁটে যাবার পথে।

এই আলোচনার পুরোটা সময় আমার একমাত্র কাজ ছিল ঘরের কোন এক কোনায় সোফার উপর কাত হয়ে পড়ে থাকা আর মনে মনে বলা ‘দে পানাহ্‌ দে ইয়া ইলাহি দে পানাহ্’‌। সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার বিশেষ কারণ ছিল। আমার গাড়ি নেই। এত রাতে কোন বাস সার্ভিসও নেই। দয়া করে কেউ আমাকে ফেরার পথে ওয়ালথাম নামিয়ে দিলে তবেই বাসায় যেতে পারব। একবার রাত তিনটার সময় একজন আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল যার নিজের বাসা কেমব্রিজে। আমেরিকায় থাকাকালীন সময়ে এই বাঙালি পরিবারগুলো যে ভালবাসা আমার মত অভাজনকে দেখিয়েছেন, সেটা কোনদিন ভোলার নয়। ভাল থাকার অধিকার প্রতিটা মানুষের আছে। তারা আমেরিকায় পড়ে আছেন পেটের দায়ে, একটু ভাল থাকার জন্য, কিন্তু দেশকে তারা ভুলে গেছেন এরকম কখনও আমার মনে হয় নি।

বিজ্ঞাপন

মে মাসের নয় তারিখ শনিবার একটা ঘটনা ঘটল। আমাদের ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টরের কাছ থেকে একটা ইমেইল পেলাম। আমাদের প্রোজেক্ট শেষ পর্যন্ত অ্যপ্রুভড্‌ হয়েছে। বাজেট পাস হয়ে গেছে। এখন পুরোদমে কাজ শুরু হবে। একটার পর একটা ইমেইল রিপ্লাই আসা শুরু হল। সবাই সবাইকে কংগ্রাচুলেট করছে। সবাই খুব খুশি। খুশি হওয়াই স্বাভাবিক। এই প্রজেক্টের প্ল্যানিং-এ সবার সমান পরিশ্রম আছে, শুধু আমার একার না। আমি শৈবালের মত দীঘির জলে এক ফোঁটা শিশির যুক্ত করেছি মাত্র। শুধু তা করতে গিয়ে আমার শির যাতে উচ্চ না হয়ে যায় সেদিকে দৃষ্টিটা ছিল। এমনিতেও আজকের দিনটা ছিল আমার জন্য একটা বিশেষ দিন। ২০০২ সালের এই দিনে আমার মা অতি অল্প বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান। আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তার অনেক দুঃশ্চিন্তা ছিল। তার বোকাসোকা ছেলেটা যে কিছু একটা করে খেতে পারছে তা তিনি দেখে যেতে পারেননি।

প্রোজেক্ট-লঞ্চ উপলক্ষে ঠিক হল পরের সপ্তাহে সবাই মিলে বাইরে কোথাও খাওয়া হবে। একজন একটা সি-ফুড রেস্টুরেন্ট সাজেস্ট করল। সি-ফুডে আমার কোন আপত্তি নেই। শুধু রেস্টুরেন্টের নামটায় একটু অস্বস্তি হচ্ছে। রেস্টুরেন্টের নাম নেকেড ফিশ। ফিশ তো নেকেড থাকে বলেই জানি। বস্ত্র পরিহিত মাছের কথা শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না। রেস্টুরেন্টে যাবার পর নামের মাহাত্ম বুঝতে পারলাম। এখানে অন্যান্য আইটেমের সাথে কাঁচা মাছও পাওয়া যায়। জীবনে প্রথম আক্ষরিক অর্থেই নেকেড ফিশ, অর্থাৎ কাঁচা মাছ ট্রাই করলাম। স্যামন মাছ, খেতে খারাপ লাগল না। তাছাড়া টেম্পুরা দিয়ে ভাজা স্কুইডের স্টার্টারটাও ছিল অসাধারণ। মেইন কোর্সে ‘মাহি মাহি’ নামের একটা মাছ খেলাম। মাহি মাহি নামে কোন মাছ যে থাকতে পারে আমার কোন ধারণা ছিল না।  আসলে আমার জ্ঞান যে কত সীমিত মাঝে মাঝেই সেটা বুঝতে পারি। খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল। কোথায় ভাল সুশি পাওয়া যায়, কোথায় বুফে সস্তা এসবই হল গল্পের বিষয়। আমেরিকাতেও রেস্টুরেন্টগুলো ঠিক আমাদের দেশের মতই খাবার দিতে দেরি করে। এই দেরিটা পুষিয়ে যায় যদি খাবার টেবিলে গল্পবাজ কেউ থাকে। আমাদের ডেটাবেজ অ্যাডমিন ভারসাম পাপাকিন হল সেরকম একজন। ইউক্রেইনের লোক। এই অফিসে আছে প্রায় বারো বছর। এত বছর ধরে আছে, অথচ আমেরিকান অ্যাক্সেন্টে কথা বলে না, বলার চেষ্টাও করে না। তার থিক রাশান এক্সেন্টে বলা কথাগুলো শুনতে বড়ই ভাল লাগে। অনেক বছর আগে একটা মুভি দেখেছিলাম নাম হচ্ছে দ্য সেইন্ট। সেখানে এক রাশান বলেছিল, “ইউ আর ইন রাশা, এভ্রিথিং ইজ কমপ্লিকেতেদ”। ওর কথা শুনলে আমার সেই সিনেমার ডায়ালগটা মনে পড়ত। খেতে খেতে দেখছিলাম আমাদের দলটাকে। হানা রউফ মিশরীয়, ভারসাম ইউক্রেনিয়ান, মিশেল চাইনিজ, চার্লস কলাম্বিনো হাফ ইটালিয়ান, অমল ইন্ডিয়ান, আমরা চারজন বাংলাদেশি। এখানে আমরা সবাই কলিগ এবং কারোর প্রতি কারো কোন জাতিগত বিদ্বেষ নেই। আমরা ভাল, তোমরা খারাপ এটা কারো মনের ভেতর যদি থেকেও থাকে সেটা কখনোই কারো কথায় কিংবা আচরণে বিন্দুমাত্র প্রকাশ পায়না। অমলের সাথে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলার সময় সে একবারও বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে কোন বাজে কমেন্ট করেনি। এই ব্যাপারগুলো আমার ভাল লাগত। খাওয়া শেষে কেউ কেউ গাড়িতে অফিসে ব্যাক করল। আমি বললাম হেঁটে যাব। কেউ আপত্তি করল না। ভরপেট লাঞ্চ শেষে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হেঁটে অফিসে গেলাম।

চার্লস রিভার রিজার্ভেশনের ভেতরের ব্রিজ।

চার্লস রিভার রিজার্ভেশনের ভেতরের ব্রিজ।

সেদিন বিকেলে অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর আমার বিচিত্র একটা অনুভূতি কাজ করা শুরু করল। মনে হল, আর কেন আমাকে এখানে থাকতে হবে? যে কাজের জন্য আমার এখানে আসা, যে প্রোজেক্টের ডিজাইন ডিসকাশন করা, মিটিং করা, পুরো প্রোজেক্টে কোথায় কিভাবে কাজ হবে সেটা বুঝে নেয়া, টিমকে বুঝিয়ে দেয়া সবই তো করেছি। প্রোজেক্ট অ্যাপ্রুভও হয়ে গেছে। এখন শুধু কাজ চালিয়ে যেতে হবে। আর সেটা এখানে বসেই যে করতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। চাইলে বাংলাদেশে বসেই সেটা করা সম্ভব। যেরকমটা আমি এবং আমার অন্যান্য কলিগরা করে এসেছি এতদিন ধরে। যতই ভাবতে থাকলাম, ততই এই চিন্তার পেছনে যুক্তিটা শক্ত হতে থাকল। এখন বুঝি যুক্তি ফুক্তি কিছুই না, আমার এখানে আর ভাল লাগছিল না। কিছু একটা যুক্তি দিতে হবে বলে আমার মন এসব নিজেই বানিয়েছে। মানুষ নিজের করা সবচাইতে হাস্যকর কাজের পেছনেও প্রয়োজনে কঠিন যুক্তি দাঁড়া করাতে পারে। এবং যুক্তিটা যে হাস্যকর সেটা অনেক সময় বুঝতেও পারে না।

ছোট একটা পায়ে চলা পথ।

ছোট একটা পায়ে চলা পথ।

পরের দিন অফিসে গিয়ে আমি হিমাংশুকে বললাম তুমি কখন ফ্রি আছো? সে বলল, বিকেলের আগে সে ফ্রি আছে। বিকেলে তাকে নিয়ে কিচেনে গেলাম। কফি বানিয়ে তার হাতে দিলাম, নিজে এক মগ নিলাম। তারপর বললাম, হিমাংশু, আমি দেশে ফিরে যেতে চাই। এখানে আমার কাজ শেষ। আমার মনে হয় না আরো দুই মাস এখানে আমার থাকার খুব দরকার আছে। তুমি যদি অ্যাপ্রুভ কর, তাহলে আমি ডিরেক্টরকে ইমেইল দিব। হিমাংশু কফির মগে চুমুক দিল। তার গোঁফের ফাঁকে মুচকি মুচকি হাসি। সে বলল, ঢাকা খুব মিস করছো জাকির? আমি বললাম, হ্যাঁ তা করছি। আর ঢাকায় আমার বাসার সামনের কিছু কাকও সম্ভবত আমাকে মিস করছে। আমাকে দেখতে পেলেই তারা উপর থেকে বম্বিং প্র্যাকটিস করত।

বিজ্ঞাপন

ব্যাপারটা যেরকম কঠিন হবে ভেবেছিলাম সেরকম কঠিন কিছু হল না। আমার দেশে ফিরে যাওয়াটা অ্যাপ্রুভড্‌ হয়ে গেল। সুতরাং বলা চলে ব্যাটল-গ্রাউন্ড ছেড়ে সোলজার পালিয়ে যাচ্ছে না। ব্যাটল যদি আগেই শেষ হয়ে যায় সোলজার সেখানে পড়ে থেকে করবে টা কি? বহ্নিকে বললাম যে বাসার কাউকে ব্যাপারটা এখনই না জানাতে। তাছাড়া অ্যাপ্রুভ হয়ে গেলেই তো হবে না। এখানে আসার সময় যেরকম একটা প্রিপারেশন ছিল, ফিরে যাবারও একটা প্রিপারেশন আছে। প্লেনের টিকিট আপডেটের ব্যাপার আছে। কিছু কেনাকাটা আছে। তার চাইতেও বড় কথা আমার স্যুটকেস তো সেই এখানে আসার দিনই হার্ট অ্যাটাক করেছে। হয় এটা রিপেয়ার করাতে হবে, নয়ত নতুন স্যুটকেস কিনতে হবে। সুতরাং, বেশ অনেকগুলো কাজ এখন সামনে। প্রথম যে কাজটা করলাম সেটা হল ব্যাংক অব আমেরিকায় গিয়ে আমার অ্যাকাউন্টটা ক্লোজ করে আসলাম। এখানে কাজের সুবিধার জন্যই অ্যাকাউন্ট ওপেন করেছিলাম। এখন আর সেটার প্রয়োজন নেই। এই অ্যাকাউন্ট ওপেন রেখে দেশে ফিরে কোন ঝামেলায় পড়তে আমি চাই না।

বোস্টন লোগান এয়ারপোর্টের ভেতরে।

বোস্টন লোগান এয়ারপোর্টের ভেতরে।

আমার ফেরার টিকিট কনফার্ম করা হল। জুনের এক তারিখে আমি ফ্লাই ব্যাক করব। ঢাকায় পৌঁছাব তিন তারিখ ভোরে। টার্কিশ এয়ারলাইনসেই ব্যাক করছি। হানাফোর্ড মার্কেটের উল্টো দিকে মুলান রেস্টুরেন্টের পাশে ‘সুপেরিয়র শু রিপেয়ার’ নামে একটা দোকান আছে। তারা সাত পুরুষের কব্‌লার। ব্যাগ এবং জুতা মেরামতের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে সাত জেনারেশন ধরে, কল্পনা করা যায়! অফিসে আসা যাওয়ার পথে দোকানটা লক্ষ্য করতাম। ভাবলাম স্যুটকেসটা সেখানে নিয়ে একবার দেখাই দেখি তারা কী বলে। স্যুটকেসটা তারা রেখে যেতে বলল। তিনদিন পরে গিয়ে জানতে পারলাম, এটার যে পার্ট্‌সগুলো নষ্ট হয়েছে সেগুলো চায়না থেকে আনাতে হবে। সময় লাগবে তিন সপ্তাহ। আমার হাতে তিন সপ্তাহ সময় নেই। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

মুলান রেস্টুরেন্টের পাশে ল্যাম্পপোস্ট বরাবর “সুপেরিওর শু রিপেয়ার” ।

মুলান রেস্টুরেন্টের পাশে ল্যাম্পপোস্ট বরাবর “সুপেরিওর শু রিপেয়ার” ।

তারপর দোকানের ছেলেটাকে বললাম, এই স্যুটকেসের অন্য পার্টস্‌গুলোকে কি চাইলে কাজে লাগানো যাবে? সে বলল, হ্যাঁ, কেন নয়? চাকা থেকে শুরু করে বাকি সব তো ঠিকই আছে। এমনকি স্যুটকেসের চেইনগুলো পর্যন্ত ঠিক আছে। তুমি এই স্যুটকেসটা উঠিয়ে রেখে দাও, কখনো যদি কোন পার্টস্‌ লাগে এখানে থেকে নিয়ে ইউজ করতে পারবে। আমি বললাম, আই হ্যাভ অ্যান অফার ফর ইউ। হাউ অ্যাবাউট ইউ কিপ দিস স্যুটকেস, আর এর পার্টস্‌গুলো তুমিই ইউজ কর? সে বলল, তুমি এর জন্য কত চাইছ? বললাম, কিছুই চাইছি না। আমি চাই আমার এই স্যুটকেস কিছু ভাল মানুষের হাতে থাকুক, যারা এর অপটিমাম ইউটিলাইজেশন করতে পারবে। তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে, এটা আমি তোমাকে গিফট্‌ করলাম। সে একটু অবাক হয়ে হাসিমুখে আমাকে বলল থ্যাংক্স ম্যান! আমি স্যুটকেসটার দিকে তাকালাম। এই স্যুটকেস আমার আর বহ্নির বহু বছর ধরে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সঙ্গী। অনেক স্মৃতি এর সাথে। ঢাকার নিউমার্কেট থেকে কেনা আমাদের প্রিয় ব্রাউন স্যুটকেস শেষ পর্যন্ত রিটায়ার করল হাজার হাজার মাইল দূরের ওয়ালথাম নামের ছোট্ট এক শহরে।

কোয়ালিটি এস্যুরেন্স ম্যানেজার অ্যালেনের সঙ্গে আমি।

কোয়ালিটি এস্যুরেন্স ম্যানেজার অ্যালেনের সঙ্গে আমি।

এখন স্যুটকেস তো আরেকটা কিনতেই হবে। দুই দিন ধরে রিসার্চ করে অ্যামাজন থেকে ট্রাভেলপ্রো ব্র্যান্ডের একটা স্যুটকেস কিনলাম। খুবই লাইটওয়েট, কিন্তু স্পেস প্রচুর। তারপর শুরু হল বাসার এবং পরিচিত সবার জন্য গিফট্‌ কেনার পালা। কিছু না কিছু তো সবার জন্য নিতেই হয়। অফিসের কলিগদের জন্যও টুকিটাকি কিছু কিনলাম। এখানে এত রকমের, এত ধরণের চকোলেট পাওয়া যায় যে দেখলে মাথা খারাপ লাগে। এসব চকোলেট কেনার জন্য একটা স্যুটকেস যথেষ্ট না, চার পাঁচটা বস্তা ভর্তি করে কিনতে পারলে মন শান্ত হত। আশ্চর্যের বিষয়, আমি সত্যি সত্যি এত বেশি চকোলেট কিনে ফেললাম যে দেখি স্যুটকেসে অন্য জিনিসপত্র ঢুকিয়ে চকোলেটের সবটা আর ঢোকাতে পারছি না। এখন এত ভাল ভাল চকোলেটগুলো কি ফেলে চলে যাব? ভেবে দেখলাম কিছু বইপত্র কেনাও বাকি ছিল। জায়গার অভাব হবে বলে আগে কিনি নি। এখন যেহেতু বোঝা যাচ্ছে যে স্যুটকেস আরেকটা কিনতেই হবে, এই চান্সে বইগুলো কিনেই ফেলা যাক। ছোটখাট একটা স্যুটকেস কিনলেই কাজ হয়ে যায়। কিন্তু নিজেকে বোঝালাম যে মিনি স্যুটকেস কিনে পয়সা নষ্টের কোন মানেই হয় না। সুতরাং আরেকটা ট্রাভেলপ্রো কেনা হল। এখানে যে আরো বেশি পয়সা গেল, সেটা গায়েই লাগল না। মানুষের লজিক মাঝে মাঝে অত্যন্ত জটিল হতে পারে। সবকিছু যখন প্যাক করা শেষ করলাম তখন আমার চোখ পড়ল টেবিলের নিচে। দেখি একটা বড়সড় বাকসো সেখানে। ও মাই গড, এটা আমার চোখে পড়েনি কেন! বহ্নির জন্য আমি KitchenAid ব্র্যান্ডের একটা স্ট্যান্ড-মিক্সার মেশিন কিনেছিলাম কয়েকদিন আগে। বহ্নির বেকিং-এর শখ আছে। সম্পূর্ণ প্যাশন থেকে নিজের চেষ্টায় বই পড়ে আর ইউটিউব টিউটোরিয়াল দেখে বেকিংটা সে ভালই রপ্ত করেছে। আমাদের পরিচিত অনেকে তার বানানো কেক খেয়ে বিশ্বাস করতে পারেনা যে এটা বাসায় বানানো। বেকিংয়ের জন্য দরকারি কিছু কিছু এক্সেসরিজ আমরা দু’জন মিলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে জোগাড় করেছি। তবে আমি দেখেছি ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখার সময় এই মেশিনটা নিয়ে কেউ কাজ করছে দেখলে সে ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলত। বাংলাদেশে কোথাও এই মেশিন আমি খুঁজে পাইনি। এমনকি ইন্ডিয়াতেও না। তাই ঠিক করে রেখেছিলাম যদি কখনো সুযোগ আসে, ওর জন্য এটা আমি কিনবই। আশ্চর্যের ব্যাপার মেশিনটা যে কিনেছি সেটা আমি ভুলেই গেছিলাম। বাকসোটা আমার ডাইনিং টেবিলের তলাতেই পড়ে ছিল আর এটার সাইজ যে এত বড় সেটা হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলাম। এটা যে এখন আমি ব্যাগে ঢোকাতে পারছি না এই খবরটা বহ্নিকে দেয়ার সাথে সাথে ও বলবে এক্ষুনি এটাকে রিটার্ন কর, লাগবে না আমার কিচেনেইড। কিন্তু আমি তো সেটা হতে দেব না। ভাবলাম বাকসোটাকেই লাগেজ হিসেবে ডিক্লেয়ার করে নেয়া হয়ত যাবে। কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে? যদি ভেঙে যায়? এর সমাধান কি? সংস্কৃতে একটা প্রবাদ আছে “অধিকন্ত ন দোষায়”, অর্থাৎ “The more, the merrier”. আমি অ্যামাজন থেকে আরেকটা ট্রাভেলপ্রো অর্ডার করলাম। KitchenAid-এর সেই মেশিন ট্রাভেলপ্রোতে চড়েই এসেছিল। এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মেশিনটা স্যুটকেসে ঢোকানোর পর একটা কাগজ ঢোকানোরও আর জায়গা ছিল না। যেন এই মেশিনের জন্যই এই স্যুটকেস, কিংবা এই স্যুটকেসের জন্যই এই মেশিনটা বানানো হয়েছে। আমার এয়ার টিকেটে তিনটা ফ্রি স্যুটকেস নেয়া অ্যালাউড ছিল। কখনো কল্পনা করিনি যে আমাকে তিনটা স্যুটকেস নিয়েই ফিরতে হবে।

হিমাংশু, আমাদের প্রোজেক্ট ম্যানেজার।

হিমাংশু, আমাদের প্রোজেক্ট ম্যানেজার।

ওয়ালথাম অফিসে শেষ দিন সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সবাই বলল, আবার আসবে জাকির, তোমাকে মিস করব। আমিও বললাম আমিও তোমাদের অনেক মিস করব। মিন্ডি বলল, এই কেউ আমাকে একটা ছবি তুলে দাও জাকিরের সাথে। মিন্ডিকে বললাম, মিন্ডি, তোমার পাশে তো আমাকে লিলিপুট লাগবে, তুমি কি সত্যিই ছবি তুলতে চাও? মিন্ডি আমাদের একজন প্রোডাক্ট ম্যানেজার। ওর হিমালয়সম উচ্চতার সামনে মেয়েরা তো বটেই এমনকি অফিসের অনেক পুরুষকেও মার্বেল সাইজ লাগে। যাবার আগে হিমাংশুকে বললাম, তোমার কাছ থেকে অনেক ভাল প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট টিপস্‌ পেয়েছি, ভবিষ্যতে আমার সেগুলো কাজে লাগবে।

লিলিয়ান, মিন্ডি আর আমি।

লিলিয়ান, মিন্ডি আর আমি।

অফিস থেকে বেরিয়ে ভাবলাম বাসে চড়ব না, শেষবারের মত কবরখানার ভেতর দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরব। মাউন্ট ফিক সেমেটারিতে ঢুকে আজকেও মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এত সুন্দর গাছপালা, পাখি ডাকছে, চারদিক কী অদ্ভুত সুন্দর! এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন যে হাঁটতে খুবই ভাল লাগছিল। সারি সারি কবরের হেডস্টোনগুলো পর্যন্ত ঝকঝক করছে। বোঝাই যায় নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় এগুলো। প্রতিটা এপিটাফে নিচে যে শুয়ে আছে তার নাম, সংক্ষিপ্ত জীবনী, ছোট কোন কবিতা, কিংবা একটা কৌতুক এসব দেয়া। হাঁটতে হাঁটতে আমার সেই প্রিয় কবরটার সামনে এসে একটু দাঁড়ালাম। জেনি রবার্টসনের কবর। এর কথা আগের পর্বে লিখেছি। এর এপিটাফে উপরে বড় বড় করে লেখা “মাদার”। আর তার নামটা নিচে ছোট করে লেখা। নামের চাইতেও মাদার লেখাটায় চোখ আটকে যায়। কবরটার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। মনে হল এর থেকে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট এপিটাফ আর হয় না। কোন বর্ণনা নেই, কোন কবিতা নেই। ইনি কারো মা ছিলেন আর সেটাই যথেষ্ট। এই এপিটাফে নিজস্ব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন সবার মা। যে-ই এর পাশ দিয়ে যাবে, একবার হলেও দাঁড়াবে, একটা উষ্ণতা অনুভব করবে। চলে আসার আগে ফিসফিস করে উচ্চারণ করলাম, “আম্মা!”

মাউন্ট ফিক সেমেটারির ভেতরে।

মাউন্ট ফিক সেমেটারির ভেতরে।

জুনের এক তারিখ বিকেলে আতাউর আর রাজীবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লোগান এয়ারপোর্ট চলে এলাম। ওরাও কিছুদিনের মধ্যেই দেশে চলে আসবে। আমার প্লেন লোকাল টাইম রাত এগারটায়। ঢাকায় ল্যান্ড করলাম তিন তারিখ ভোরে। আমার প্রিয় ঢাকা। সারা পৃথিবীতে আমার প্রিয়তম শহর। এয়ারপোর্টে নয়ন আমাকে নিতে এসেছিল। সেই নয়ন, যে আমাকে বাসা থেকে ভোরবেলা এয়ারপোর্টে নিয়ে গেছিল আমার অতলান্তিক যাত্রার সময়। গাড়িতে যেতে যেতে মনে হল এত ফাঁকা কেন রাস্তা ঘাট? মনে পড়ল, গতকাল ছিল শব-ই-বরাত। আজকে সরকারী ছুটি। মানুষজন সারারাত জেগে নামাজ পড়ে হয়তো এখন ঘুমাচ্ছে। সম্ভবত সেজন্য রাস্তাঘাটে লোকজন কম। বাসায় পৌঁছে কলিং বেল দিলাম। মনে হচ্ছে এক শতাব্দী পর এই বেলটা বাজালাম আমি। আমার বাসার কলিং বেলের আওয়াজ এত সুন্দর কেন? কই আগে তো কখনও মনে হয় নি? বাসায় ঢুকে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিয়ে বহ্নিকে সাথে করে গেলাম আব্বার বাসায়। তারা কেউ জানে না যে আমি চলে এসেছি, বহ্নি জানায়নি কাউকে। কলিং বেল দেয়ার পর দরজা খুলে দিল আব্বা। আমাকে দেখে প্রথমে একটু অবাক হলেন, তারপরেই হেসে ফেললেন। আমি বললাম, কেমন আছেন আব্বা? আব্বা হাসছেন। সেই সহজ সরল হাসি। বহ্নিও হাসছে এরকম একটা সারপ্রাইজ দিতে পেরেছে বলে। আব্বা ভিতরে ডাক দিলেন, এই ঝুনু, তোর ভাইয়া আসছে। রাতুল, নাবিলা দ্যাখ কে আসছে…! দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনে হল এখানে তুষারপাত হয়ত হচ্ছে না, ফায়ারপ্লেসে আগুনও জ্বলছে না, তবে লিটল্‌ হাউজ অন দ্য প্রেইরি গল্পের সেই সন্ধ্যায় লরার কেমন লেগেছিল আমি সম্ভবত একটু একটু বুঝতে পারছি।

(সমাপ্ত)

সারাবাংলা/এসএসএস

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন