Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ট্রফি না জিতলেও বাঙালি খাবারে মন জয় করলেন কিশোয়ার

লাইফস্টাইল ডেস্ক
১৩ জুলাই ২০২১ ২২:৫১

মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া। ‘হোম কুক’দের নিয়ে সারাবিশ্বে রান্না নিয়ে যত প্রতিযোগিতা আছে, তার মধ্যে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ আসর। সেই আসরে অংশ নিয়ে প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হিসেবে গ্র্যান্ড ফিনালে পর্যন্ত পৌঁছেই সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন কিশোয়ার চৌধুরী। সেই গ্র্যান্ড ফিনালে’র দুই এপিসোডের তিন রাউন্ডের কঠিন লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত আর মাস্টারশেফ ট্রফি জেতা হয়নি তার। তবে গোটা সিজনেই নিজের শেকড়ের অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশের রান্নাকে সফলভাবে তুলে ধরেছেন বিশ্বমঞ্চে। বিচারকসহ দর্শকদেরও মন জয় করে নিয়েছেন কিশোয়ার।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) বাংলাদেশ সময় বিকেলে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার গ্র্যান্ড ফিনালের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত এপিসোডটি প্রচারিত হয়। মাস্টারশেফের ১৩তম এই সিজনে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন জাস্টিন। প্রথম রানার-আপ হয়েছেন পিট আর দ্বিতীয় রানার-আপ হয়ে সিজন শেষ করেছেন কিশোয়ার।

গ্র্যান্ড ফিনালের প্রথম এপিসোডে দুই রাউন্ড শেষে পিট এগিয়েছিলেন ৫৩ পয়েন্ট পেয়ে। কিশোয়ারের অর্জন ছিল ৫১ পয়েন্ট, জাস্টিনের ৫০। দ্বিতীয় এপিসোডের প্রথম রাউন্ডে কিশোয়ার চার বিচারকের কাছে পেয়েছেন ৮ পয়েন্ট করে মোট ৩২ পয়েন্ট। তাতে তার পয়েন্ট দাঁড়ায় ৮৩। এই রাউন্ডে চার বিচারকের কাছ থেকে ৯ পয়েন্ট করে ৩৬ পয়েন্ট জিতে নেন পিট। তাতে তার মোট পয়েন্ট দাঁড়ায় ৮৯। অন্যদিকে এই রাউন্ডে চার বিচারকের কাছ থেকেই ‘পারফেক্ট টেন’ অর্জন করে নেন জাস্টিন। তাতে বাকি দু’জনকে টপকে ৯০ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে চলে আসেন তিনি।

আরও পড়ুন- মাস্টারশেফে পান্তা-আলু ভাতেই বাজিমাত কিশোয়ারের

এরপর সবশেষ রাউন্ডে ছিল ডেজার্ট। তাতে তিন বিচারকের কাছে ৮ করে ও এক বিচারকের কাছে ৭ মিলিয়ে ৩১ পয়েন্ট জিতে নেন কিশোয়ার। তার মোট পয়েন্ট হয় ১১৪। রাউন্ডে পিটের অর্জন ছিল ৩৫, মোট পয়েন্ট ১২৪। এই রাউন্ডে জাস্টিনও পান ৩৫। তাতে তার মোট পয়েন্ট দাঁড়ায় ১২৫-এ। তাতেই মাস্টারশেফের টাইটেল জিতে নেন জাস্টিন।

 বাঙালি খাবারের মাস্টারশেফ যাত্রা

মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার এর আগের এক আসরে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাশিদুল হাসান। প্রথম পর্বেই তিনি বাংলাদেশি খাবারকে মাস্টারশেফ কিচেনে হাজির করেছিলেন। তবে প্রথম এলিমিনেশনের পর্বেই এক দুর্ঘটনায় তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গিয়েছিল মূল রান্নাটি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনোমতে একটি ডিশ তিনি হাজির করেছিলেন বিচারকদের সামনে। তবে তাতে এলিমিনেশন এড়াতে পারেননি। মাস্টারশেফের মঞ্চেও বাংলাদেশি খাবারকে খুব বেশি উপস্থাপনের সুযোগ পাননি তিনি।

বিজ্ঞাপন

রাশিদুল না পারলেও মাস্টারশেফের মঞ্চে বাংলাদেশি খাবারকে সফলভাবে উপস্থাপনের সুযোগ পেয়ে শতভাগ কাজে লাগিয়েছেন কিশোয়ার। একটির পর একটি পর্বে তিনি বাংলাদেশি খাবার এবং বাংলাদেশি খাবারের অনুপ্রেরণায় মাস্টারশেফের বিচারকদের মুগ্ধ করেছেন। প্রতিটি খাবারের পেছনে তার যে আবেগ, খাবারের স্বাদের পাশাপাশি সেটিও ছুঁয়ে গেছে দর্শক ও বিচারকদের।

মাস্টারশেফ কিচেনে প্রথম দিনেই আমাদের দেশের জনপ্রিয় মাছ ভাজির অনুপ্রেরণায় সার্ডিন মাছের ভাজি করেছিলেন কিশোয়ার। সঙ্গে রেখেছিলেন কাঁচা আমের ব্রথ। সে রান্নার অনন্য স্বাদে বিমোহিত হয়েছিলেন তিন বিচারক। এর পরের এক পর্বে কুলফি ফিউশনের সঙ্গে হোয়াইট চকলেটের একটি ডেজার্ট রান্না করেন তিনি। তার ওপর মেহেদির ডিজাইনের আদলে করা নকশা ছিল দৃষ্টিনন্দন, ব্যতিক্রমধর্মীও। একটি পর্বে হারিয়ালি চিকেনও রান্না করেছিলেন।

নিউ মার্কেটে যে বিফ পেটিস পাওয়া যায়, তার অনুপ্রেরণায় মাস্টারশেফেও বিফ প্যাটিস বানিয়েছেন কিশোয়ার। তার সঙ্গে ছিল টমেটো-তেঁতুলের চাটনি। এছাড়া খাসির রেজালার সঙ্গে পরোটা, চিংড়ির মালাইকারির আদলে ক্রেফিশের মালাইকারি, ক্রয়সান্টের সঙ্গে রসগোল্লার ফিউশন, ভাপা মাছ, গরু ভুনার অনুপ্রেরণায় নর্থ আফ্রিকান অক্সটেইল কারি, টমেটো দিয়ে মাছ রান্নার আদলে টমেটো দিয়ে বারামুক্তি মাছের ঝোল (তার সঙ্গে জিরা রাইস আর বিন ভর্তা), এমনকি বিয়ে বাড়ির পোলাও আর চিকেন কোরমাও ছিল কিশোয়ারের ডিশের তালিকায়।

এখানেই শেষ নয়, একেবারে গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে যে খাবার নিত্যদিনের, তাকেও পরিবেশন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। খিচুড়ির সঙ্গে মাছ ভাজি, বেগুন ভর্তা ও নিরামিষ— তার স্বাদও অমৃত লেগেছিল বিচারকদের কাছে। নওয়াবি নানের সঙ্গে নেহারি করেছিলেন একটি পর্বে। এমনকি লাউ-চিংড়ি পর্যন্ত করেছেন কিশোয়ার। তার সঙ্গে ছিল জাউ ভাত আর সার্ডিন মাছের টক ঝোল। বাঙালি রান্নার এই স্বাদ রীতিমতো চমকে দিয়েছে সবাইকে।

কিশোয়ারের আরও কয়েকটি ডিশ ছিল চমকিত করার মতো। বিয়ের পর কিশোয়ার হানিমুনে এসেছিলেন রাঙ্গামাটিতে। সেখানে বাঁশে রান্না মাংস খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই একটি পর্বে রান্না করলেন ভাতের সঙ্গে বারামুন্ডি কারি। আবেগজড়ানো সে রান্না মন জিতে নিয়েছিল বিচারকদের। ঢাকার সম্ভবত জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড ফুচকাকে পর্যন্ত কিশোয়ার বানিয়েছেন নিজের মতো করে। আলু সেদ্ধ করে মাঝ খান থেকে স্কুপ করে তুলে নিয়ে বাইরের খোলসটাকে বানিয়েছেন ফুচকা। আর চটপটির ওপরে কুড়কুড়ে যে অংশটি দেওয়া হয়, তার জন্য ব্যবহার করেছেন আলুর ফ্রাই। সেমিফাইনালের ডেজার্টে আফটার ডিনার মিন্টে পান পাতায় পরিবেশিত মৌরির আইসক্রিম আর এর ওপর পান মসলা ছিল চমকৃত করার মতোই। বিচারক মেলিসা এই ডেজার্টকে বলেছিলেন, ‘লাভ লেটার টু বাংলাদেশ’।

গ্র্যান্ড ফিনালেতেও কিশোয়ার দেশি খাবারে বাজিমাত করার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখেছেন। গ্র্যান্ড ফিনালের প্রথম এপিসোডের দ্বিতীয় রাউন্ডে কিশোয়ার কুকিং টেকনিক পেয়েছিলেন স্মোক, আর ইনগ্রেডিয়েন্ট পেয়েছিলেন হোয়াইট সয়া সস। স্মোক কুকিং টেকনিককে তিনি শেষ পর্যন্ত কাজে লাগান পান্তা ভাত তৈরিতে! আর হোয়াইট সয়া সসে মেরিনেট করে ভাজি করেন সার্ডিন মাছ। স্মোকড রাইস ওয়াটার তথা পান্তা ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করেন মাছ ভাজি। আর তার সঙ্গে ছিল ‍শুকনো মরিচ পোড়া ও আলু ভর্তা আর পেঁয়াজ-মরিচ-ধনে পাতার সালাদ তথা সালসা। পান্তা আর আলু ভর্তা খেয়ে তিন বিচারকের মুগ্ধতার অন্ত নেই। তাই কিশোয়ারের পরিবেশন করা গ্রাম-বাংলার খাবার পান্তা আর আলু ভর্তার এই ডিশ তিন জনের কাছ থেকেই পেয়েছিল পারফেক্ট টেন!

কিশোয়ার মানেই বাংলাদেশ

মাস্টারশেফের ১৩তম এই সিজনের প্রতিটি পর্বেই কিশোয়ারের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের খাবারকে উপস্থাপন করা। প্রতিটি খাবারের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তার আবেগ। বারবার মাস্টারফে কিচেনে অশ্রুসিক্ত হয়েছেন কিশোয়ার। তার সেই আবেগাশ্রু ছুঁয়ে গেছে বিচারক, প্রতিদ্বন্দ্বী ও টিভি সেটের সামনের হাজার দর্শককে। বিশেষ করে বাংলাদেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের যারা মাস্টারশেফের নিয়মিত দর্শক, তাদের কাছে মাস্টারশেফ কিচেনে কিশোয়ার মানেই যেন একটুকরো বাংলাদেশ। দেশি রান্নার স্বাদ-গন্ধে মাস্টারশেফের বিচারকরাও যেন সেই নিজের শেকড়ের আবেগকে খুঁজে পেয়েছেন বারবার। আর তাই খাতা-কলমের হিসাবে কিশোয়ার মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার ১৩তম সিজনে জিততে পারেনি, কিন্তু সবার মনটা ঠিকই জয় করে নিয়েছেন।

সারাবাংলা/টিআর

কিশোয়ার চৌধুরী বাঙালি খাবার মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর