হঠাৎ দুর্ঘটনায় কী করবেন
১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৫:২১
কথায় আছে, বিপদ কখনো বলে কয়ে আসে না। যে কোনও সময় যে কোনও মূহুর্তে আসতে পারে বিপদ। আর এই বিপদ মানে দুর্ঘটনা। বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখার বিকল্প নেই। মাথা ঠান্ডা রাখতে না পারলে হঠাৎ আসা এই উটকো বিপদ সামলাতে পারবেন না। হঠাৎ এইসব বিপদের মধ্যে আপনার বা আপনজনের দেহের কোথাও কেটে যাওয়া, আঘাত পাওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া, খিঁচুনি ওঠা, আগুনে বা গরম পানিতে পোড়া, পানিতে ডুবে যাওয়া ও সাপের কামড় অন্যতম। এছাড়া অন্যান্য শারীরিক জরুরি অবস্থা, যেমন হঠাৎ করেই যে কোনো সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়া, নাক দিয়ে হঠাৎ রক্তপাত, হাঁপানির টান বা আকস্মিক অজ্ঞান হয়ে গেলে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।
আর এসব সমস্যা যদি রাতের দিকে হয় তাহলে বিভিন্ন কিছুর দুষ্প্রাপ্যতায় পাল্লা দিয়ে জটিলতাও বাড়ে। এছাড়াও রাস্তায় হঠাৎ দুর্ঘটনায় পড়লে কিছু চিকিৎসা সাথে সাথে প্রয়োজন। নিত্যদিনের এরকম আকস্মিক দুর্ঘটনায় ঘরোয়াভাবে প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য দরকার সচেতনতা ও কিছু জরুরি সরঞ্জাম। কিন্তু ঘরোয়াভাবে এইসব উটকো দুর্ঘটনার প্রাথমিক চিকিৎসা কীভাবে করবেন সেটিই বুঝে উঠতে পারি না অনেকে। কিন্তু ওই প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুই অনেকসময় অনেকের প্রাণ বাঁচিয়ে দেয়। হঠাৎ অসুস্থতায় ঘরেই প্রাথমিকভাবে কী করবেন সেই উপায়গুলো জানিয়েছেন চিকিৎসক আদনান আহমেদ।
আঘাত পেলে
অনেক সময় শিশুরা তাদের স্বভাবজাত দুরন্তপনার জন্য বিভিন্ন ধরনের আঘাত পায়। পড়ে গিয়ে হাত-পা ফুলে যাওয়া কিংবা মচকে যাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বড়রাও কম যান না। নানা কারণে অথবা দুর্ঘটনায় আঘাত পাওয়া নৈমত্তিক সমস্যা। হঠাৎ আঘাত পাওয়া মানেই শরীরের বাইরের কোন একটি জায়গায় অতিরিক্ত চাপ পড়া। এই ধরনের আঘাতে যে সমস্যা হয় তাকে বলে সফট টিস্যু ইনজুরি। সফট টিস্যু ইনজুরি হলে আঘাতপ্রাপ্ত জায়গায় ফুলে যায়, প্রচণ্ড ব্যথা হয়, ওই অংশটি লাল হয়ে যায় এবং জায়গাটা গরম থাকে। কোন দুর্ঘটনায় আঘাত পাওয়া, খেলাধুলার সময় আঘাত পাওয়ায়, মাংস পেশিতে হঠাৎ টান লাগা, কিংবা পা পিছলে পড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে এই সফট টিস্যু ইনজুরি হয় তবে আঘাতের পরিমাণ যদি খুব বেশি হয় তাহলে হাড় ভেঙ্গে যেতে পারে।
পড়ে গিয়ে হাত বা পা ফুলে যায়, ঠান্ডা বরফের সেঁক দিতে হবে। মালিশ বা গরম শেক দেওয়া উচিত নয়। হাত বা আঘাতপ্রাপ্ত স্থানটির ফোলা বেশি হলে, ব্যথা বেশি হলে এবং যে জায়গা ফুলে গেছে, তা স্পর্শে বেশি গরম মনে হয়, তখন জরুরিভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। হাত-পা ভাঙার ঘটনা ঘটলে রোগীর ভাঙা অংশটিকে নাড়াচাড়া না-করে যতটা সম্ভব স্থির থাকুন। অনেকে হাড়জোড়া লাগানোর জন্য জোরে চাপ দেন এটি খুবই খারাপ। এছাড়া ওই অংশে কোনো ব্যথার মলম ঘষে লাগানো যাবে না। খেয়াল রাখতে হবে যেন রোগী পুনরায় আঘাত না পায় এবং অবশ্যই পূর্ণ বিশ্রামে থাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বরফ ব্যবহার করতে হবে ১৫-২০ মিনিট করে। ভিজা গামছার ভেতর বরফ নিয়ে আক্রান্ত অংশে মুড়িয়ে দিতে হবে। যদি বেশি ঠান্ডা লাগে ৩ মিনিট পর উঠিয়ে এবং শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে আবার একটা টানা ১২-১৪ মিনিট পেঁচিয়ে রাখতে হবে।
মাথায় আঘাত পেলে
আকস্মিক দুর্ঘটনায় যে কোনও সময়ে যে কারও মাথায় আঘাত লাগতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনায়, বিশেষ করে মোটরসাইকেল আরোহীদের মাথায় আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি বেশি। অনেক সময় মাথায় আঘাত লাগার পর রোগী দিব্যি হাঁটা-চলা করে, কথা বলে ও সচেতন থাকে। তবু এসব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এবং সিটি স্ক্যান পরীক্ষাটিও করাতে হবে। কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাথায় আঘাত লাগার পর রোগীকে আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ মনে হলেও পরে হঠাৎ অবস্থা জটিল হতে পারে। যত দ্রুত সম্ভব, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আঘাতের মাত্রা নির্ণয় এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে ক্ষতির মাত্রা কমবে।
শরীর কেটে গেলে
হঠাৎ ছুরি বা চাকু দিয়ে কিছু কাটার সময় অসাবধানতাবশত হাত বা আঙুল কেটে গিয়ে রক্ত পড়তে পারে। তখন প্রথম কাজই হলো দ্রুত রক্তপাত বন্ধ করা। কাজেই যেখান থেকে রক্ত ঝরছে, সেখানটায় চেপে ধরতে হবে, যাতে রক্তপাত বন্ধ হয়। অল্প কিছুক্ষণ রক্তক্ষরণের জায়গাটি চেপে ধরে রাখলে শরীরের স্বাভাবিক নিয়মেই দু-এক মিনিটের মধ্যেই রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া রক্তক্ষরণ কমাতে হলুদ গুঁড়ো, গাঁদা পাতা বাটা বা চিনি দিলেও রক্ত বন্ধ হয়।
ক্ষত যদি গভীর না হয়, তাহলে রক্তপাত বন্ধ হলে একটু হেক্সিসল দিয়ে তুলা ভিজিয়ে জায়গাটা মুছে যে কোনো অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে দিতে হবে। যদি ক্ষত বেশি ও গভীর হয়, তখন সেলাইয়ের প্রয়োজন হবে এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগে পরিষ্কার কাপড় বা ফার্স্ট এইড বক্সে রাখা ব্যান্ডেজ দিয়ে ক্ষতস্থানটি পেঁচিয়ে হালকাভাবে বেঁধে রাখতে হবে। যদি কেটে না গিয়ে স্থানে স্থানে চামড়া ছিলে যায়, তাহলে ছিলে যাওয়া বা ছিঁড়ে যাওয়া জায়গাগুলোতে আয়োডিন বা অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে দিতে হবে।
রক্তনালি কেটে গেলে
দুর্ঘটনায় যখন হাত বা পা আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন চামড়া, হাড়, মাংস, স্নায়ু ইত্যাদির সঙ্গে আমাদের রক্তনালি কথা শিরা ও ধমনিগুলোও কেটে যেতে পারে বা আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনা, শিশুদের ক্ষেত্রে গাছ বা অন্য কোনো উঁচু জায়গা থেকে নিচে পড়ে যাওয়া, ভারি যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র নিয়ে কাজ করার সময় দুর্ঘটনা এমনকি নিজের হাত বা পায়ের রক্তনালি কেটে ফেলার মতো ঘটনাও দেখা যায়। আর এসবের ফল আঘাত পাওয়া ধমনিতে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়া বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া।
দুর্ঘটনার পর ধমনীর ক্ষতি হয়েছে কিনা তা বোঝা সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজ নয়। তাই এসব ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র দেরি না করে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠাতে হবে। প্রাথমিকভাবে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য রক্তনালির ওপর পরিষ্কার কাপড় বা গজ দিয়ে সাময়িকভাবে বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। অন্যথায় রক্তক্ষরণে জীবনহানিও হতে পারে।
চোখে আঘাত পেলে
দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে চোখের আঘাত মানেই নিশ্চিতভাবে জরুরি অবস্থা। কারণ মানুষের শরীরে এই অঙ্গটির মতো স্পর্শকাতর আর কিছুই নেই। চোখে সরাসরি আঘাত, ছিটকে কোনো বস্তু প্রবেশ করা বা রাসায়নিকসহ বিভিন্ন কিছু পড়া চোখে অনেক বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে। চোখের সমস্যায় প্রাথমিকভাবে চোখ একেবারে ডলা চলবে না। শুধু বারবার পানির ঝাপটা দিতে হবে। এখানে একটা কথা মনে রাখা জরুরি যে কোনো চোখের আঘাত যে কাউকে দৃষ্টিহীন করতে পারে, তাই সময় নষ্ট না করে যত তাড়াতাড়ি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
মনে রাখুন
স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত কোনো সমস্যা বা বিপদে পড়লে যে কোন নম্বর থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কল সেন্টার স্বাস্থ্য বাতায়নের ১৬২৬৩ নম্বরে ফোন করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারবেন। এই নম্বরটি খোলা থাকে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা। নম্বরটিতে কল করে চিকিৎসকের কাছ থেকে রোগ বা সমস্যার ধরন বুঝে পরামর্শ পাওয়া যায়। এখান থেকে মোবাইলে মেসেজ করে প্রেসক্রিপশন বা চিকিৎসাপত্রও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া অসুস্থতায় নম্বরটিতে কল দিলেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে যাবে অ্যাম্বুলেন্স।
এছাড়া খুব বিপদে পড়লে পুলিশের অধীনে পরিচালিত জাতীয় জরুরি সেবা (৯৯৯) নম্বরে ফোন করতে পারেন। কেউ হঠাৎ বড় কোনো বিপদে পড়লে বিনামূল্যে এই সেবা গ্রহণ করা যাবে। হঠাৎ অসুস্থতায় ৯৯৯ কর্তৃপক্ষ জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসে যোগাযোগের সহায়তা দিয়ে থাকে।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
তামান্না সুলতানা লাইফস্টাইল সুস্থ থাকুন হঠাৎ দুর্ঘটনায় কী করবেন