বিশ্ব নিয়ে বিশ্বভ্রমণ
২৬ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:৫৫
আমার পৃথিবী বলতে ঘিরে আছে আমার মা। আর মা আছেন বলে বাবাও যেন ঘোরপাঁক খাচ্ছেন এই জগতে। তাই আমি বলি আমার ব্রহ্মাণ্ড যেন আমার ঘরেই। আমার বোধ কিংবা জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখছি এরা যেন স্থির এক একটা নক্ষত্র, কোনো চাহিদা নাই কেবল দায়িত্ব পালন। কোথাও যাবার কথা এলেই তাদের ভাবনায় আসে সাত আর পাঁচ। ঘরে কে থাকবে! কত খরচ হবে, গাছে জল দিবে কে, কেউ এলে কী হবে! আর সবশেষে এত খরচ করার কি দরকার! হয় না তাই এইসব। আর কোথাও ছুটি মিলে না তাদের। আমার কাকি মাসিদের অনেকের গল্প শুনেছি যারা বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি ছাড়া আর কোথাও যাননি। প্রত্যেকেই যেন এক একজন ইন্দুবালা। ঠাকুমার কাছে শুনেছি সাড়ে তিন বছর বয়েসে এসেছেন এই বাড়ি; এরপর আবার বাপের বাড়ি বলে কিছু থাকে আবার!
সে সময়টা বদলে গেছে কি না জানি না তবে মা আমাকে বের হতে দেন। কোথাও পাহাড় ডেকে গেলে অথবা স্বপ্নে দেখা হলে সমুদ্রের সাথে আমি বের হতে পারি নিশ্চিন্তে। এই বেরিয়ে আসায় আমি পেয়ে যাই নতুন নিঃশ্বাস। কিছুদিন থাকা যায় হতাশাহীন, প্রাণপূর্ণ। ভ্রমণের বিকল্প কী আমার জানা নাই। এই আটপৌড়ে জীবনের গল্পে বাবা বেশকিছুদিন অসুস্থ আছেন সাথে নিজের কিছু সংকট।
তাই নানা সংকট নিয়ে আমাদের এবারের যাত্রা ভারত। মা বাবা আর আমি। গোপনে মনে পড়েছিল মা একদিন বলেছিল আমাকে, ‘আমি মরার আগে আমার বোনকে একবার দেখায়ে আনবি!’ এই বাক্যের কোনো উত্তর আমি দিতে পারিনি সেদিন। সেদিন কেবল মনে হয়েছিল- যে ইতিহাসের পাতায় কতকিছু পড়েছি কেবল আমাদের মায়ের জীবনের পৃষ্ঠা আমাদের পড়া হয় না। বড়ো মাসি ত্রিপুরা থাকেন। শুনেছি প্রায় ত্রিশ বছর দুই বোনের দেখা হয়নি। ভাবা যায় জীবনের মানে কীরকম হয়! অন্যদিকে বড় পিসি বিছানায় প্রায় ১৩বছর। বছর ঘুরলেই বাবা কলকাতা যাবার উছিলায় গরম হয়ে যান। সাথে এবার আমার কুবুদ্ধি; বাবা মায়ের হানিমুন। মানে সোজা তাজমহল।
তো আমাদের যাত্রা আগরতলা-কলকাতা-দিল্লি-ঢাকা। একজনের বয়েস ৭৫ আরেক জনের ৬৪ আর আমি আমারটা বললাম না; জানুয়ারির প্রচণ্ড শীতে প্রতি লাগেজে ২০কেজির একটু বেশি নিয়ে আমাদের ভ্রমণ। তাতে কি! বাবা মাকে দাঁড় করায়ে একটা একটা করে লাগেজ টেনে শুরু আমাদের ভ্রমণ।
আগরতলা
আখাওড়া বন্দর হয়ে আগরতলা দিয়ে ভারতে প্রবেশ আমাদের। ঢাকা থেকে ভোরের অনেক আগে আমরা যাত্রা শুরু করি যেন সকালে ইমিগ্রেশন শেষ করা যায় কেননা আমরা যাব ধর্মনগর। ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল আগেই। ১১টার ট্রেন ধরতে হলে আমাদের ৮টার মধ্যে বন্দর ইমিগ্রেশন সব শেষ করা লাগবে। আমাদের সময়টা ঠিকঠাক ছিল একেবারে। তবে আমার মন খারাপ হলো আমাদের বন্দরের দৈন্য দশা দেখে। শুনেছি আখাওড়া আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য বন্দর। সকালেই বন্দরে এত যাত্রী কিন্তু সেই তুলনায় কর্তৃপক্ষ নাই। টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে ভাঙ্গা একটা টিনের ঘরে, তাতে পাসপোর্ট তো দূর কুয়াশা কাটিয়ে আমার হাতও আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। বাইরে বেরিয়ে লাগেজ টানার মতো যথেষ্ট রাস্তা নাই, মানে বালির এবড়ো থেবড়ো পথে আমি থেমে থেমে টানছি লাগেজ। বাবা কিছু চেষ্টা করলেও আমার গরম চোখ দেখে আবার থেমেও যান। তবে যখন জানলাম যে ব্যাগের ভিতরে খুদ-চাল, শুঁটকি আর মাসকলাইয়ের ডাল; আমার মেজাজ তিরিক্ষি তখন।
এইসব দেশবিভাগ আমাদের জিভের রুচি কিংবা স্বাদের কিছুই নিয়ে যেতে পারে নাই। শুনেছিলাম পিসিমা মায়ের হাতের মাসডাল খাবে। তো এইসব ভাগ বাটোয়ারা কাদের জন্য আর কাদের নিয়ে হলো! জানি না জানা নাই। ছুটছি তখন ব্যাগ নিয়ে, সামনে ভারতীয় বন্দর। এত সুন্দর আর ঝাঁ চকচকে বন্দর। অথচ পাশেই আমাদের কী দৈন্যদশা! কর্মকর্তা ব্যাটা প্রথমে আমাকে বেশ তুমি তুমি করে কথা বলছিল। মা বাবাকে নিয়ে যাচ্ছ! যাও যাও ঘুরে আসো। কিন্তু যেই দেখলেন আমার অফিসিয়াল পাসপোর্ট অমনি আমার জিন্স আর টি শার্ট ভেদ করে আবিষ্কার করতে না পেরে বললেন, ‘আপনি এডুকেশনে আছেন!’ বললাম ‘জ্বি । তাড়াতাড়ি ছাড়ুন আমরা ট্রেন ধরবো।’
আগরতলা রেল স্টেশনে এসে আমি সত্যি মুগ্ধ। রাজবাড়ির মতো একটা স্টেশন। একটার পর একটা ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে স্টেশন। এইবার মা আর আমি। বাবাকে রেখে গেলাম তাঁর ভাগ্নির বাড়ি। এই দুটি দেশই কেবল আলাদা আর সবার আত্মীয় ছড়াছড়ি। শিলচর এক্সপ্রেসে মা আর আমি উঠে পড়লাম। টানা কমপক্ষে চার ঘণ্টার পথ। বড়ো মাসি জানে না মা আসছেন! কেমন একটা রোমান্স ভাবা যায়! ট্রেন তখন ছুটছে পাহাড় আর বেলে মাটি ডিঙিয়ে। কমপক্ষে চারটা ট্যানেল আমরা অতিক্রম করেছি। পাহাড়ি নদী নতুন শহর আদিবাসী মানুষ সব ছেড়ে আমরা ছুটছি তখন। আমি বই পড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছি ঠিক তখন মা পানের বাটা নিয়ে বসলেন। তাঁর চোখে যেন এক দীর্ঘ দিনের যাত্রা যেন জানতে পারছে না সময় সামনে না পিছনে ছুটছে। কতদূর গেলে ছুঁয়ে আসা যায় নিজস্ব বোন, কোনো দেশের ভোগোলিক সীমা কী পারবে ফিরিয়ে দিতে সেইসব স্মৃতি যাদের ভুলে যাওয়ার কোনো দোহাই দেয়া যায় না। আমি আচমকা বললাম আমার খিদা লাগছে, মা বললো পানিসাগর চলে এসেছি। আর কিছুদূর পরেই নামবো।
ছিমছাম একটা ষ্টেশন ধর্মনগর। শুনেছি আগরতলার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ন শহর ধর্মনগর। স্টেশন থেকে বেরিয়ে টুকটুক নিয়ে মা আর আমি হোটেলে। এত রঙ করা হোটেলে আমি এর আগে থাকিনি কোনোদিন। কেমন সবুজ রঙের বাতি। রঙে আমার বমি আসছিল প্রায়। হোটেলের নাম মনে করতে পারছি না কিন্তু সেটাই সেখানকার সবচাইতে ভালো হোটেল। ফ্রেশ হয়ে মা আর আমি রওনা করলাম মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমরা কেউ কোনো কথা বলছি না। অপেক্ষা করছি মা মাসি কেমন করে তাদের এ দেখার যাত্রায়। লম্বা সুপারি গাছের ছায়া ঘেরা একটা বাড়ির দক্ষিণের পুকুরে আমি আর মা বসে আছি। পুকুরের ওইদিক থেকে তখন মাসি আসছেন। মাসির পাগুলো মনে হচ্ছে কোথাও আটকে যাচ্ছে। দুই বোন এগিয়ে যাচ্ছে পরস্পরের দিকে। এইরকম দুইদেশের মিলনে যে ক্ষণ তা চিত্রায়ণের ভাষা আমার জানা নেই। বাকীটা অনুভূতিজাত। তখন লম্বা পাওয়ালা সুপারি গাছগুলো আকাশ থেকে নেমে আসে শীর্ণ পুকরের জলে। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার যে সফর আমাদের ধর্মনগরের পথে তাতে দেখেছি একটা বাংলাদেশই যেন।
ধর্মনগরের কাছেই উনকোটি। মাকে বললাম যাবে? আবার বললাম তুমি যাবে! কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে তাই ফেরার দিন সকালে গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম আমরা উণকোটি। ধর্মনগর শহর থেকে গাড়িতে যেতে ৩৫মিনিটের মতো লাগলো। কৈলাশহর জায়গাটির নাম, সম্ভবত সেখানে গিয়ে আবার বাংলাদেশের কাছেই চলে এসেছিলাম। উণকোটির রয়েছে পৌরাণিক কাহিনি। পাহাড়ের গায়ে জড়িয়ে থাকা চিত্রকর্ম দেখতে একবার নিচে নেমে আবার উপরে উঠে আবার নামতে হলো। সম্ভবত পৌষ সংক্রান্তি ছিলো আর উনকোটির দেবতার পায়ের নিচে তখনো লাল জবা আর দূর্বার পূজা বিদ্যমান। হালকা নেমে আসা ঝর্ণার জলে তখনও স্নান করে নিচ্ছে কয়েকজন মণিপুরি নারী। মাকে বললাম উঠতে পারবে এত উঁচুতে? বলে এসেছি আর কী আসবো, চল উঠি! মা মেয়ে পাহাড় বেয়ে উঠে গেলাম মূল সংগ্রহশালায়। এখানে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা আছে জটাধারী শিব, গণেশ, দুর্গা, রাম, রাবণ, হনুমান, নন্দী, বিষ্ণু দেবতাদের মূর্তি; কথিত আছে একবার কালু কামার দেবতা শীবের সঙ্গে কৈলাসে যেতে চাইলেন। তখন মহাদেব আদেশ করেন এক রাত্রির মধ্যে সে যদি এক কোটি দেবতার মূর্তি তৈরি করতে পারে তবে কালু কামারকে নিয়ে যাবে, কিন্তু কালু একরাতে এক কম কোটি বা উনকোটি দেবতার মূর্তি তৈরি করতে পেরেছিল। অন্য কাহিনীতে শোনা যায়, মহাদেব এই পথে বারানসি যাচ্ছিলেন। পথে এই পাহাড়ে তাঁর সমস্ত সঙ্গীরা ঘুমিয়ে পড়লে তিনি একাই যাত্রা শুরু করেন। আর অভিশপ্ত হয়ে সকল দেবতা পাহাড়ের গায়ে খোদাই মুর্তি হয়ে রয়ে গেলেন অনন্তকালের জন্য। সে থেকে এই রঘুনন্দন পাহাড় হয়ে গেলো তীর্থস্থান ঊনকোটি।
পৌরাণিক আবহ যাই হউক আমি দেখছিলাম পাহাড়ের গায়ে কি এক অনবদ্য শিল্পকর্ম তৈরি করা হয়েছে তাঁর নির্মাণ কাজ। তখনও সকাল। রোদের আঁচ কম। কুয়াশাও নেই। মা আর আমি নামছি পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে। একদল লোক তখন ঢুকছে, মাকে দেখে বলল, মাসিমা আপনি উঠলেন, মা বলল উঠলাম তো। যাও ভালো লাগবে। আমি টাসকি খাচ্ছি কেননা আমার মায়ের বাতের ব্যথা কই গেলো!
উনকোটি থেকে ফিরে সোজা আগরতলা। সেই রাতে আমরা দেখলাম ত্রিপুরা রাজার বাড়ি। রাতের আলোকসজ্জায় দূর থেকে এত সুন্দর লাগছিল। পরদিন সকালে চেষ্টা করলাম রাজবাড়ি যাবার। কিন্তু সকাল ১১টার আগে রাজবাড়ির দ্বার খোলা হয় না, এই বিষয়টি অবশ্যই খেয়াল রাখবেন। শহরে মা মেয়ে আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম বুদ্ধ বিহার, স্বাধীনতার স্তম্ভ আর বাংলাদেশের মানুষ।
আগরতলার আশ্চর্য সুন্দর তাদের বিমানবন্দর। লোকজ ঐতিহ্য আর শিল্পিত কারুকার্যে এত চমৎকার তাদের কৌশল! বিকেলের বিমানে বাংলাদেশের উপর দিয়ে আমরা চলে এলাম কলকাতা।
কলকাতা
প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমি অনেকবারই এসেছি কলকাতায়। একবার তো আমার বাবা সব ফেলে চলে আসতে চাইলেন। সেইবার মায়ের পাসপোর্টে এলাম আমরা, খুব বেশি কিছু মনে নাই তবে মা থাকেননি দেশ ছেড়ে। এবার বহুদিন পর মায়ের সাথে কলকাতায়। বাবার ডাক্তার দেখানোর দায়িত্ব পিসাতো দাদার কাছে, আর এই সময়ে মা আর আমি চলে গেলাম কফি হাওজ। কলেজ স্ট্রিটের সেই বিখ্যাত কফি হাউজ খোলে ১২টায়। আমরা পৌঁছে গেলাম ১১টায়। কাছেই নিয়ে গেলাম মাকে হিন্দু কলেজে। হন্দু কলেজ ঘুরে কফি হাউজ হয়ে চলে গেলাম আমার মায়ের বহুদিনের স্বপ্ন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি। ঠাকুর বাড়ির সমস্ত অলি গলি ঘুরে ঘুরে মা দেখছিল, আর আমি তাঁর পিছনে উৎকৃষ্ট গাইড তখন। কেবল দেখতে চাইছেন ঠাকুরের বউয়ের ছবি। ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায় এসে মা বেশ কিছু সময় বসে থাকলেন। এক ফাঁকে বলেন, নিয়ে এলি বলে আজ দেখা হলো! জীবনে আসতে পারতাম!
জানি আমাদের মায়েদের দেখা হয় না কোনোদিন প্রিন্সেপ ঘাট। এই প্রিন্সেপ ঘাটে এবার আমিও প্রথম। কলকাতায় এলে আপনারা অবশ্যই প্রিন্সেপ ঘাটে আসবেন। গঙ্গা যেন এখানে বাড়ির ঘাটের জলের মতো কলকল করে বইছে। মায়ের অনেক ছবি তুলে নিলাম আমি। ঘাটের রাস্তাটা পেরিয়ে ওই পথেই ফোর্ট উইলিয়াম। ভাবলাম দেখে যাই ফোর্ট উইলিয়াম, কিন্তু জানতাম না যে ফোর্টে ঢুকতে হলে আগে তাদের ওয়েবসাইটে সময় ও পারমিশন নিতে হয়।
মাকে নিয়ে গেলাম দুপুরের খাবার খেতে কস্তুরিতে। ম্যাককিন স্ট্রিটের কস্তুরি রেস্টুরেন্টের স্বাদ অবশ্যই নিতে হবে। মা তো নিজের রান্না খেয়ে খেয়ে বিস্বাদ আর তখন ভিন্ন স্বাদের পোস্ত দিয়ে ভেটকি মাছ মা এত স্বাদ নিয়ে খেল আমার চোখে জল এসে যায় তখন। কলকাতায় আর একদিন আমাদের ভ্রমণে ছিল বেলুর মঠ আর দক্ষিণেশ্বর। এরপর আমাদের আসল ভ্রমণ শুরু। সোজা দিল্লি।
দিল্লি
দুইজন মানুষকে নিয়ে এই যাত্রাটা আমার খুব সহজ ছিল না। তবুও কোথাও যেন একটা সাহস করে শুরু করেছি। কলকাতা থেকে দিলির ফ্লাইট ভোর ৫টায়। রাত দুটার দিকে প্রবেশ করে মা বাবা আর আমি দীর্ঘ সময় গল্প করি। এই গল্পের বেশিরভাগই মা বাবার ঝগড়া। আর পুরো সময় আমার সাইড অবশ্যই মার দলে। দিল্লি নেমে গেলাম আমরা সকাল ৮.০০ টা থেকে ৮.৩০ এর মধ্যে। আমি আগে থেকেই গাড়ি বুক করে রেখেছিলাম। দিল্লি থেকে মথুরা বৃন্দাবন হয়ে আগ্রা হয়ে জয়পুর হয়ে আবার দিল্লিতে এই গাড়ি আমাদের রেখে যাবে। দিল্লি থেকে যাত্রা শুরু করেই ঘুমিয়ে যাই গাড়িতে আমরা তিনজনই। হঠাৎ টের পাই গাড়ি দিল্লির আশেপাশেই ঘুরছে। আমি গুগল ম্যাপ অন করে বলি,‘ভাইয়া জ্বি আপ কাহা হে! -কিউ মেডাম?- নেহি গুগল পাতা রাহা হে হাম জাইসি কি বাইসি হু!’ এইবার ও সাবধান হয়। গাড়ির রুটে মাইলেজ একটা বড়ো বিষয়। এই পথে বাবার শরীরটা খারাপ করতে শুরু করে। মা আর আমি ভয় পেয়ে যাই। দ্রুত একটা পাঞ্জাবি ধাবাতে দাঁড়িয়ে আগে তাঁকে ভাত খায়ানোর ব্যবস্থা করি। এই ড্রাইভারের খাওয়া কিন্তু আমাদের সাথে না কিন্তু সে শুরুতেই খেয়ে বিল আমাদের সাথে জমা করে গাড়িতে গিয়ে বসে আছে। আমি কটমট করছি কিন্তু কিছু বলতে পারছি না।
মথুরায় এসে পৌঁছেছি আমরা দুপুর ১টার দিকে। বলে রাখি বৃন্দাবন ও মথুরার দ্বার দুপুর ১২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। আর এখানে এত বাটপার টাইপের লোক থাকবে যারা আপনাদের জীবন কিছু সময়ের জন্য নরক বানায়ে ফেলবে। আর এই বদমাইশ ড্রাইভারগুলি আপনাকে ওই বাটপারগুলির হাতেই নিয়ে ছেড়ে দিবে। এইদিকে বাবার শরীর খারাপ হচ্ছিল। মা আর আমি ঠিক করে নিলাম এতক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। কপালে থাকলে পরে হবে। গাড়ি এইবার সোজা আগ্রার পথে। এই পথে প্রচুর মোগল নিদর্শন চোখে পড়বে; কেবল ঘুমানো যাবে না।
আগ্রার পথে আমরা ঘুমিয়ে যাচ্ছিলাম। সারারাতের সজাগ দৃষ্টি রাখা খুব কষ্টকর হলেও আমি মাঝে মাঝে চোখ খোলে দেখছিলাম সাইনবোর্ড। খানিক জড়ানো চোখে মনে হল, আমরা একটা নদী পার হচ্ছি। ঘাড় ঘুরিয়ে সাইনবোর্ড দেখে বুঝলাম খানিক আগে যমুনাকে অতক্রম করেছি। আমার বা দিকে বসে আছে মা, দৃষ্টিতে ঘুম। আচমকা জোরে বললাম গাড়ি থামান… সৌধের মতো কিছু একটা দেখে আমি আবার গুগল অন করি। মাই গড আমরা সেকান্দ্রায়। আর গর্দভ ড্রাউভার কিছু বলছে না। ভাবা যায়! মাকে বললাম, চল নামি। বাবাকে বললাম পারবে?- বলে পারবো!
বিকেলের আলো তখন শেষ হয়ে আসছে। ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভাষায় কথা বলছে মানুষেরা। জানুয়ারির ঠাণ্ডা বাতাস পতপত করে বইছে। খাকি পোশাকের পুলিশের মতো লোকগুলো হাসছে কথা বলছে। সম্মক্ষে দৃশ্যমান গম্বুজের মতো কারুকাজের মিনার। সেকান্দ্রায় প্রবেশ করতে ৫০রুপি করে টিকিট লাগে। টিকিট কেটে আমি দৌড়াতে শুরু করি। মা বাবা পিছনে গল্প করতে করতে হাঁটছে। তাদের গল্প করা দেখে আমি পিছনে ফিরে আর দেখিও না। হাল্কা বাতাসে আমাদের ক্লান্তি তখন একেবারে নাই। মোগল স্থাপত্যের সাথে পরিচিতি এটা আমার প্রথম নয় কিন্তু তাই বলে ইতিহাসের পাতায় পড়া সেই সেকান্দ্রায় দাঁড়িয়ে আছি আমি তখন!
সেকান্দ্রায় প্রবেশের ৪টি ফটক রয়েছে, আমরা মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করি। ১৬০৫ সালে এই সৌধের কাজ শুরু হয় আর শেষ হয় ১৬১৩ সালে। এখানে প্রবেশের পর বাতাসের সাথে সাথে অজানা পাখির ডাক মাতাল করে দিচ্ছিল। ফটক পেরিয়ে কিছুদূর গেলেই হাতের বা দিকে প্রহরীদের আবাস। সামনে আছে একটা কূপের মতন। আর একটু এগিয়ে গেলে বিশাল বড়ো প্যাসেজ। সামনে ভবনে ছোটো ছোটো ঘর ভর্তি কবর। এখানে বসে আছেন এক বুড়ি মা। কিছু বলছেন নিজের মতো করে। ছোটো ছোটো ঘরগুলো ফেলে জুতা খুলে এগিয়ে যাই ভিতরের দিকে। খানিক পর এক শূন্যস্থান, যেই স্থান পরের প্রায় সব মহলেই প্রত্যক্ষ করেছি। এখানে মাথার উপরে তাকালেই দেখা যায় কারুকায। সামনে একটা লম্বা সরু পথের পর দেখলাম জীর্ণ অবহেলায় পড়ে থাকা এক কবর। বাঁধাই করা আছে কিন্তু নেই কোনো জৌলুস। কয়েকটা কলাবাদুড় উড়ে গিয়ে দেয়ালের এপাশ থেকে ওপাশে বসে।
কেউ একজন বলছিলেন এটাই কবর। মোগল বাদশাহ আকবরের কবর এটি। আমার খানিক মায়া লাগে। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে ভালো লাগছিলো না। বের হয়ে এসে আমি একটা দির্ঘশ্বাস ফেলি নিজের ভিতরে।
আগ্রা
সেকান্দ্রা থেকে সোজা আগ্রায় মূল গন্তব্য আমাদের। বলে রাখি আগ্রা বড়ো শহর। হোটেল আগে থেকেই ঠিক করে যাওয়া ভালো। বদমাইশ ড্রাইভার আমাদের নিয়ে এদিক সেদিক কেবল ঘুরছে আর আমাদের হোটেল খুঁজে পাচ্ছে না। আমি আগেই হোটেল যে ঠিক করেছি এবং তাতেই উঠবো। বলে রাখি একেবারে তাজমহল ঘেষেই রয়েছে খুব ভালো ভালো হোটেল। ওরা বলে ফোর্ট এরিয়া। আমাদের হোটেল ছিল অতুল্য তাজ। খুব কম দামের একটি চমৎকার হোটেল। হোটেলে ঢুকে শুনেছি এই হোটেল থেকে তাজমহল দেখা যায়। বিকেল ৫টা পর্যন্ত অথবা সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত তাজ খোলা থাকে। একদম তর সইছিল না আমার। কি করি! হাতে সময় নাই। বাবা মাকে রুমে ঢুকিয়ে দিলাম দৌড় হোটেলের ছাদে। কি অবাক আমার সামনে তখন দৃশ্যমান সাদা ধবধবে আগ্রার তাজমহল। আরও স্পষ্ট করে দেখতে আরো উপরে চলে যাই। না তাতেও মন ভরছিলো না। চটি পায়ে চলে যাই তাজের গেটে। ৭০রুপি দিয়ে টিকেট কেটে প্রায় ঢুকে পড়েছিলাম কিন্তু হাই বিধি বাম। আমি তো বিদেশি। আমাদের টিকিট ৭০০ রুপি। অগত্যা হোটেলের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করি।
ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম থেকে উঠে দেখি আগ্রার আকাশ জুড়ে মেঘের রাজ্য। কি বিপদ! রাতেও দেখেছি যে সাদা গম্বুজ সে যেন সহসা হারায়ে গেলো। মায়ের রুমে গিয়ে তাদের পাশে শুয়ে পরলাম। আলো ফুটলে হোটেলে নাস্তা করেই বাবা মা সহ আমরা ঢুকে যাই তাজমহলে। কী বলব! ভাষা নাই! এত আশ্চর্য স্থাপনা! টানা সাড়ে চার ঘন্টা আমরা তাজমহলের সৌন্দর্য দেখলাম। বলে রাখি এক একটা কর্নার থেকে এটি আলাদা আলাদা সুন্দর। তাজের ঐতিহাসিক কোনো প্রেক্ষাপট নিয়ে আমার বিশ্লেষণ নাই কেবল জেনেছি সুন্দরের তীব্র আকাঙ্ক্ষা না থাকলে এমন সৃষ্টি সম্ভব না।
তাজমহল থেকে খুবই নিকটে রেড ফোর্ট। বৃষ্টি হচ্ছিল বলে বাবাকে রেখে আমি আর মা ফোর্টে যাই। আগ্রার রেড ফোর্ট আরেক ভিন্ন জগত। অন্তত রেড ফোর্ট দেখতে একটি আলাদা দিন দরকার। ও বলে রাখি রেড ফোর্টে ঢুকতে জনপ্রতি ৬৫০রুপি লাগে।
এরপর সোজা ফতেহপুর সিক্রি। আগ্রা থেকে ফতেহপুর গাড়িতে করে প্রায় ৩ঘন্টা লেগে যায়। এটি আরেক ঐতিহাসিক স্থান সাথে পবিত্র ক্ষেত্র। এখানে আসলেও আপনাকে ঘিরে ধরবে গাইড নামক যন্ত্রণা! ফতেহপুর আসার পর একটা পার্কের মত জায়গায় আমাদের গাড়িটা থেমে গেলো। বুঝতে পারছি না কি করবো। গবা টাইপের যে ড্রাইবার তাকে কিছু বলার চাইতে না বলার সুবিধা অনেক। খেয়াল করলাম একটা টুরিস্ট বাস এসে থামল। আমাকে ঘিরে ধরলো একদল লোক; আমাকে নিন আমাকে নিন আমাকে নিন। আমি জোরে চিৎকার করতে একটি ছেলে এগিয়ে আসলো আমাদের কাছে। এখানেই রয়েছে ভারতীয় টুরিস্ট দপ্তর থেকে বাসে করে উপরে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা। টিকিট ৩০ রুপি করে। গাইডদের টাকা লাগে না। আসলে ফতেহপুর সিক্রি যেখানে গাড়ি থেকে নেমেছি তার উপরের পাহাড়ে অবস্থিত। আমি মনোজগতে হয়ত সুফিবাদে বিশ্বাস রাখি। এখানে এসে দেখলাম সেলিম চিশতির মাজার, তিন রানীর মহল, বুলন্দ দরওয়াজা, দেয়াওয়ান-ই-খাস, দেওয়ান-ই-আম, যোধার প্রাসাদ, হাওয়া মহল, শাহি দরওয়াজা, বুলন্দ দরওয়াজা, সব মিলিয়ে অসাধারণ! এতক্ষণে আমাদের গাইড হয়ে গেছে রাফিক। জানলাম ও বেঙ্গালুরের ছেলে। হিস্ট্রিতে গ্রিজুয়েট। এবং তাদেরকে ভারত সরকার গাইড হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। রাফিক আমার ছবি তুলতে শুরু করলে আমার বাপ এবারে অস্থির হয়ে উঠেন। রাফিক অবশ্য আমার বাপ মাকেও বেশ যত্ন করছে; কিন্তু বাপের তা পছন্দ হচ্ছে না। একবার শুনলাম আমার মাকে বলছে এইসব বাড়িঘর আর কবর আর কত দেখার আছে!
আমার বাপ ঠিকই ধরেছে। রাফিক একবার বলে বসলো, তুমি বিয়ে করনি! বললাম করেছি তো। একা এলে কেন? বললাম সে আমেরিকা থাকে। তার খুব মন খারাপ হয়ে গেল! আচমকা এই প্রেমেরও কিন্তু অর্থ থাকে! আমি কী করে অস্বীকার করবো যখন রাফিক ফেরার পথে আমাকে একটা অড়না কিনে দিল আর আমি তাকে দিলাম ৫০০ রুপি।
গোয়ালিওর
আমাদের এ যাত্রায় সবচাইতে অবাক করা ঘটনা ঘটে ফতেহপুর থেকে বের হয়ে। আমার দাদা থাকেন গোয়ালিওর। আমরা আগ্রা থেকে জয়পুর যাত্রা করেছি। আচমকা আমার বাপ বললেন, আমি জয়পুর যাব না আমি গোয়ালিওর যাব। মানে কী! মাকে বললাম বাবা কি বলে_ মা বললেন, তুই ত জীবনে আরও আসতে পারবি জয়পুর, গোয়ালিওর যাই চল! সাথে সাথে মত পালটে গাড়ি চলল মধ্যপ্রদেশ! নিজেকে খুব বড়ো লাগছিল তখন। পথের পাশে বিকেলের আলোয় কেবল সরিষা ফুলের বিস্তীর্ন হলুদ। ভারতের এই আন্তপ্রদেশের সড়কগুলো যারপর নাই ভালো। গাড়ির স্পিড দেখতে ভয় পাচ্ছি। তাকিয়ে আছি গুগল ম্যাপে। বাবা বেশ সুস্থ এখন। মনে হচ্ছে মাকে তার একটা স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পেরে খুব ভালো বোধ করছে, দাদা অনবরত ফোন করছে। এখানে এসেছিস, এই নদী দেখেছিস, ধাবা পেয়েছিস, কী খাবি, এইসব আলোচনা করতে করতে আমরা মা বাপ বেটি এসে পৌঁছে গেলাম মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিওর! ভাবা যাচ্ছিল না কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছি! গোয়ালিওরে মধ্যরাতে আমরা এক বাঙালি কলোনিতে রাজ্যের গল্প জুড়ে বসে আছি আমরা। পৃথিবীকে মনে হচ্ছিল হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছি। সকালে গেলাম গোয়ালিওর ফোর্ট, তানসেনের বাড়ি আর মোনাস্ট্রি। গোয়ালিওর ফোর্ট অসাধারণ এক জায়গা। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা চিত্র আর ঝাঁসির রানীর ইতিহাসের পাতায় নিজেকে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি যেন দুর্গের পাথরে। মায়ের চোখের জল আর অসংখ্য স্মৃতি নিয়ে আমরা ফিরে আসি দিল্লিতে।
দিল্লি
আহ দিল্লি। এক অসাধারণ ইতিহাসের রাফখাতা। পুরো দিল্লিতে বাবাকে হোটেলে রেখে মা আর আমি ঘুরে বেড়ায়েছি। দিল্লি মানেই তো দিল্লিগেট! এক অসাধারণ স্থাপত্য দিল্লিগেট। নতুন দিল্লিতে আমাদের হোটেল একটু বেশি খরচের ছিল, কেননা মা আর বাবাকে নিয়ে আমি চেয়েছি নিরাপদে থাকতে। নতুন দিল্লি খুব সুন্দর। দিল্লিগেট নেমে সোজা হাঁটা দিয়েছি মা আর আমি রাষ্ট্রপতি ভবন বরাবর। আগেরদিন ছিল ২৬জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবস। তখনো পর্যন্ত দিল্লির রাস্তায় সাজসাজ রব। মা আর আমি হেঁটে যাচ্ছি রাষ্ট্রপতি ভবন বরাবর, জানুয়ারির বাতাস। আমরা মা মেয়ে হাঁটছি তো হাঁটছি। হাত ধরে বললাম তোমার খারাপ লাগছে মা, মা বললও না। চল আরও হাঁটি। একবার গিয়ে আসায় আমাদের প্রায় মাইল চারেক হাঁটা হলো। এত পর্যটক তবু কী চকচকে ইন্ডিয়া গেটের মাঠ আর সমস্ত। শান্ত বাতাস, জমানো জলে বাতাসের ধাক্কা, মাথার উপরে রোদের খেলা, সব মিলিয়ে আনন্দ! ইন্ডিয়া গেট থেকে বের হয়ে মা আর আমি অটো নিলাম কুতুব মিনার দেখবো বলে। ও মাই ঈশ্বর কি বলবো কুতুবের কথা! যেমন ইতিহাস তেমন গভীর কারুকার্যের জায়গা কুতুব। বলে নিচ্ছি আবারও কুতুব মিনার ঢুকতে জনপ্রতি ৬৫০ রুপি লাগে। তবে গ্যারান্টি আপনার পয়সা উসুল হবে। কতুব থেকে বের হবার সময় আমার ফোনের চার্জ শেষ। গুগল নেই। ঠিকানা ভুলে গেছি। খালি নাম মনে আছে হোটেলের। একজনকে বললাম, ভাই কিয়া আপ পাতা সাক্তে হে কি হোটেল NO3 কাহা প্যা হ্যা! হিন্দি শুনে বেচারা বুঝছে বাঙালি। কয় আপা বাড়ি কই! বললাম ঢাকা। বলে আমার কুমিল্লা। আসছি ব্লগ করতে সাথে টিকটক। কি আজীব! বাংলাদেশিরা দুনিয়াতে কেউ একা জন্মায় না! বললাম ভাই ঠিকানা বের করে দাও।
এরপর বিকেলে চলে গেলাম লোটাস টেম্পল। লোটাস বহুদূর থেকেই দেখা যায়। সাদা রঙের পাপড়ি মেলা থাকা এক মন্দির। লোটাসে প্রবেশের সময়ও আমি জানি না আসলে আমরা কোথায় যাচ্ছি। এত এত সিকিউরিটি আর পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় আমরা লোটাসে প্রবেশ করি। লোটাসে প্রবেশের জন্য আপনাকে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হবে। ঠিক প্রবেশের আগে জেনেছি এটি মূলত বাহাই সম্প্রদায়ের মন্দির। বাহাই কারা তা আমার আগে জানা ছিলো না! মোবাইলও নেই যে আস্ক গুগল করব। এই প্রথম এমন এক মন্দিরে প্রবেশ করলাম যার ভিতরে নেই কোনো প্রতিমা, নেই প্রার্থনার কোনো ব্যবস্থা। কেবল মেডিটেশন আর মানবকল্যাণ কামনাই এই মন্দির এর প্রার্থনা।
দিল্লির দ্বিতীয় দিন মা আর আমি চলে গেলাম শহরের বাইরে অক্ষরাধাম দেখতে। গুগল বলছে এটি পৃথিবীর সবচাইতে বড়ো মন্দির। ব্যাগ মোবাইল পাসপোর্ট এমনকি হাত ঘড়িটা পর্যন্ত রেখে প্রবেশ করতে হলো এই মন্দিরে। বাবারে বাবা প্রবেশ করে বুঝতে পেলাম কেন এতো বিশেষ ব্যবস্থা! এ তো প্রাচীন ভারতবর্ষের এক নগরী! রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে পৌরাণিক কারুকাজ। প্রাচীন সরোবর, রাজকীয় ঝর্ণা, দেয়ালের গায়ে চিত্র সমস্ত যেন এক ভিন্নজগত; পরিচিত অথচ অচেনা, যেন হাতছানি দিয়ে ডাকা বইয়ের পৃষ্ঠা। এই মন্দিরে রয়েছে ভারতীয় লোক দর্শন আর প্রাচীন কথার ম্যুরাল চিত্র। সেখানে লোককথার শিক্ষনীয় গল্পকে চিত্রায়িত করা হয়েছে যাতে রয়েছে ধর্মের সাথে লোকজ জীবনের এক সম্মিলন। হাতি এই মন্দির স্থাপত্য কলার বিশেষ ভাগ। দেয়ালের গায়ে লিখা বিবরণী থেকে জেনেছি হাতি শৌর্য্য, আভিজাত্য, শ্রম, নিষ্ঠা আর ধৈর্যের প্রতীক। এই মন্দিরটি বাস্তুশাস্ত্র ও পঞ্চতন্ত্র শাস্ত্রের রীতি মেনে নির্মান করা হয়েছে। বোচা সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু শ্রী অক্ষর পুরুষোত্তম স্বামীনারায়ণ সংস্থার ধর্মগুরু ও তাঁদের প্রচেষ্টায় এই মন্দির নির্মাণ করা হয়। ১৪১ফুট উঁচু, ৩১৬ ফুট চওড়, ৩৫৬ ফুট লম্বা এই মন্দিরে রয়েছে ২০ হাজারের বেশি সাধু আচার্য ও হিন্দু দেব দেবতার স্থাপত্য। রাতের লেজার শো দেখার কথা শুনেছি কিন্তু মা মেয়ের আর সাহসে কুলায়নি।
অক্ষরাধাম থেকে সোজা মা আর আমি চলে এলাম গালিবের মাজার। আসলে দিল্লিতে সব অটো বা গাড়িওয়ালা গালিবের মাজার চিনেও না। তাই একটু কষ্ট হলো যদিও গুগল ঠিকঠাক পথ দিয়েছে। গালিবের পারিবারিক কবরশ্তহানে তখন কতগুলো ছেলে ব্যাটবল নিয়ে খেলছে। আমাদের প্রতি তাঁদের আগ্রহ নেই কিন্তু আছে উৎসুক দৃষ্টি। অদেখা গালিবকে খুঁজে পেতে আমার বেশ কষ্ট হয়, অথচ তখন সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গালিব চর্চা কেন্দ্রের ঠিক নিচেই আমি জানতে চাইছিলাম গালিবের মাজার কোথায়, বলতে পারছিলো না অনেকে! কাছেই নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজার। এই গলিতে প্রথম দেখলাম দিল্লির আদিরূপ। মাংসের দোকান, কাবাব, কসাইয়ের চাপাতি, বিরিয়ানির গন্ধ। বেড়িয়ে এসে গন্তব্য হুমায়ূনের টম্ব, কাছাকাছি হলেও আমরা একটা অটো নিয়ে চলে যাই। এখানেও আপনাকে ৬০০ রুপি দিতে হবে। তবে দিল্লির অন্যসব স্থাপনার চাইতে এটি অনাদর আর অবহেলায় রয়েছে। এখানেও রয়েছে বেশকিছু কবর। তবে বয়স্ক কাউকে না নেওয়াই ভালো। উঁচু পাথরের সিঁড়িতে সেখানে প্রবেশ বেশ কষ্টসাধ্য। বলা হয়ে থাকে হুমায়ূনের কবর এই উপমহাদেশের প্রথম উদ্যান সমাধিকেন্দ্র। এই সমাধিচত্বরে আরও রয়েছে হুমায়ূনপত্নী হামিদা বেগম, শাজাহানপুত্র দারাশিকোর কবর।
দিল্লির সবচাইতে বড়ো আনন্দ ছিল আমার বাবাকে কারিমস কিচেনের মাটন বিরিয়ানি খেতে দেখা। এই আমাদের দিল্লির সময়। ঢাকা ফিরে যে গতির জীবনে ফিরতে হলো আবার তার নতুন কোনো নাম নাই। আমাদের যে জীবন বইছে নদীর মতো শান্ত জলের স্রোতে তার বিবিধ রঙের নাম আমি লিখে রাখছি আমার স্মৃতির পাতায়।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ বিশ্ব নিয়ে বিশ্বভ্রমণ বেড়ানো ভ্রমণ স্নিগ্ধা বাউল স্নিগ্ধা বাউলের 'বিশ্ব নিয়ে বিশ্বভ্রমণ'