Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নতুন মায়ের বিষন্নতা- অবহেলা মানেই বিপদ!


২৭ নভেম্বর ২০১৭ ১২:৫৩

রাজনীন ফারজানা 

শাহেদ (ছদ্মনাম) একজন মনোবিদের কাছে এসে জানালেন যে তিনি তার সদ্য মা হওয়া স্ত্রীর বেশ কিছু আচরণ নিয়ে চিন্তিত। তার স্ত্রী মারিয়া (ছদ্মনাম) তাকে প্রায়ই বলে সে কেন বাসার বাইরে যায়না বা কখন যাবে। গেলেই সে নাকি স্বামীকে কোন একটা চমকে দেওয়া খবর দেবে। চিন্তিত শাহেদ স্ত্রীকে শাশুড়ির তত্বাবধানে রেখে মনোবিদের কাছে এসেছেন সাহায্যের আশায়। মনোবিদ বেশ কয়েকটা সেশনের পরে জানতে পারেন, সাতাশ বছর বয়সী মারিয়ার মানসিক অসুস্থতার এক ভয়াবহ রূপ- সে তার চারমাস বয়সী সন্তানকে মেরে ফেলতে চায়।

বিজ্ঞাপন

মনোবিদের সাথে কথোপকথনে বের হয়ে আসে গর্ভাবস্থায় মারিয়ার উপর শ্বশুরবাড়ির করা অন্যায় আচরণের চিত্র। শাহেদ মারিয়াকে ভালোবেসে বিয়ে করায় শাশুড়ি কখনোই তাকে মেনে নিতে পারেননি এবং যৌথ পরিবারে মারিয়াকে সংসারের সব কাজ করানো থেকে শুরু করে মানসিক নির্যাতন করতে থাকেন তিনি। মারিয়া গর্ভবতী হলে তার উপর অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। যখন সে নিজের শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন নিয়ে সে অস্থির সময় পার করছিলো, তখন তার উপর অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং আপত্তিকর মন্তব্যের কারণে সে মানসিকভাবে আরো ভেঙে পড়ে। এক্ষেত্রে শাহেদের নির্বাক ভূমিকা মারিয়ার মানসিক বিপর্যয়ের পিছনে অন্যতম অনুঘটক হিসাবে কাজ করে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে বাচ্চা হওয়ার পরে শাহেদ স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বাসায় ওঠে এবং নিয়মিত মনোবিদের পরামর্শ মত চলার পর মারিয়া এখন ভালো আছে। শুধু কাউন্সেলিং করেই মারিয়ার সমস্যা সমাধান সম্ভব ছিলনা, তাই তাকে একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের সাহায্য নিতে হয় এবং তার পরামর্শ মতো ওষুধ খেতে হয়। কারন নিজের দুরাবস্থার জন্য সে তার পেটে আসা সন্তানকে দায়ী করতে থাকে ও নিজের অজান্তেই তাকে মেরে ফেলতে চায়।

বিজ্ঞাপন

দুজন চিকিৎসকের নিয়মিত তত্বাবধান এবং স্বামীর একনাগাড়ে পাশে থাকায় মারিয়া এখন সুস্থ আছে।

মারিয়ার ক্ষেত্রে তার স্বামীর সতর্কতার কারনে তাদের সন্তানকে বাঁচানো সম্ভব হলেও আমেরিকার ইসাবেল তার পাঁচটি সন্তানকে ছুরিকাঘাত করে যাদের মাঝে চারজনকেই রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার নেপথ্যে কাজ করে ইসাবেলার পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন যা সংক্ষেপে পিপিডি নামে পরিচিত। এটা একধরনের মুড ডিজঅর্ডার যা বাচ্চার জন্মদানের সাথে সংশ্লিষ্ট।

সারা বিশ্বেই পিপিডি এখন একটি আলোচিত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী সারা পৃথিবীতে শতকরা ১০ ভাগ নারী গর্ভাবস্থায় এবং শতকরা ১৩ ভাগ সদ্য মা হওয়া নারী বিষণ্ণতায় ভুগছে। আবার বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এটির হার অনেক বেশি। এদেশে শতকরা ১৫.৬ ভাগ নারী মাতৃত্বকালীন বিষণ্ণতায় এবং শতকরা ১৯.৮ ভাগ নারী বাচ্চা হওয়ার পরে বিষণ্ণতায় ভোগে। দারিদ্র্য, দেশান্তর, মানসিক চাপ, জুলুম, পারিবারিক, যৌন এবং লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতন ইত্যাদি নানা কারনে গর্ভবতী এবং প্রসূতি নারীরা বিষণ্ণতায় ভুগছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর নিম্ন সামাজিক সহযোগিতা এক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়ায়।

আমাদের দেশে পিপিডি আক্রান্ত নারীর সংখ্যা আশংকাজনকহারে বাড়ছে। মানবাধিকার সংস্থা প্রেরনা’র জেনারেল সেক্রেটারি এবং সাইকো থেরাপিস্ট এস জেড রেজিনা পারভীনের কাছে এধরনের রোগী হরহামেশাই আসছে। তাঁর অভিজ্ঞতা মতে সন্তান গর্ভে আসলে নানাধরনের শারীরিক আর মানসিক পরিবর্তন নিয়ে এমনিতেই নারীরা বিদ্ধস্ত থাকে। তখন শ্বশুরবাড়ি, বিশেষত স্বামীর কাছ থেকে মানসিক সাপোর্ট বা যত্ন না পেয়ে একজন গর্ভবতী নারী আরো ভেঙে পড়ে। বিশেষ যত্ন তো দূরে থাকুক, তাকে অনেকসময় অনেকধরনের মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কাউকে হয়তো বাবার বাড়ি যেতে দেওয়া হয়না, কাউকে ছোটখাটো কারনে সালিশ বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। এছাড়া বোন বা বান্ধবীর গর্ভকালীন সময়ের সাথে নিজের গর্ভাবস্থার তুলনা করা, বিশেষ যত্ন না পাওয়ার পাশাপাশি কেউ কেউ স্বামীর পরকীয়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়।

এসব নানা কারণে গর্ভধারনকালীন সময়েই অনেক নারী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে এবং দেখা যায় সন্তান জন্মদানের পরেও প্রায় বছরখানেক ধরে বিষন্নতায় ভুগতে থাকে, যাকে বেবি ব্লু বলা হয়।

রেজিনা পারভীন আরো জানান, পোস্টপারটাম ডিপ্রেশনের নানা কারণের মাঝে অন্যতম হল, গর্ভবতী স্ত্রীর সাথে স্বামীর জোর করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাওয়া। সাতমাসের গর্ভবতী পঁচিশ বছর বয়সী রুমানা (ছদ্মনাম) তাঁর স্বামীকে এতোটা ভয় পেতে থাকে যে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বার থেকে কিছুতেই বাসায় যেতে চায়না। কারন একা হলেই তাকে শারিরীক সম্পর্কের জন্য জোর করে স্বামী। এই অবস্থায় চিকিৎসক যখন স্বামীকে বিরত থাকতে বলেন, সে তখন অন্য নারীর কাছে যাওয়ার অনুমতি চায়, যা রুমানার ওপর নতুন করে মানসিক চাপ তৈরি করে। স্বামীটি একবারও ভাবেনা যে গর্ভের সন্তানটি তার নিজেরও। সুস্থ স্বভাবিক একটি সন্তানের জন্য কিছুদিন নিজের জৈবিক তাড়না নিয়ন্ত্রণ তাকে করতেই হবে। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা থাকলে অবশ্য এমনটি ঘটার সম্ভাবনা কমে যায়।

এরকম চরম পরিস্থিতি সব ক্ষেত্রে ঘটে, তা নয়। তবে এক্ষেত্রে দুজনেরই মনোবিদের পরামর্শের প্রয়োজন আছে। কারন মায়ের মানসিক বিপর্যয়ের ফল ভোগ করে তার গর্ভের সন্তান। ডাঃ রেজিনা বলেন যখনই কোন গর্ভবতী নারী সারাদিন শুয়ে থাকছে, কাজে অনীহা দেখাচ্ছে বা বিমর্ষ থাকছে তাকে যত দ্রুত সম্ভব একজন সাইকো থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন যাতে সে তার সমস্যা শেয়ার করতে পারে।

আনোয়ার খান মডার্ণ হসপিটালের স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডঃ শারমিন আব্বাসীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো মনোসামাজিক কারণের পাশাপাশি পিপিডির জন্য আর কী কী কারণ থাকতে পারে। তিনি বলেন হরমোনাল পরিবর্তন ছাড়াও অপরিকল্পিত গর্ভধারণ একটি বড় সমস্যা এক্ষেত্রে। একজন দম্পতিকে সন্তান জন্মদানের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে এবং গর্ভাবস্থায় নারীর সর্বোচ্চ যত্ন নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, বিষন্নতায় ভুগছে এমন গর্ভবতী রোগী পেলে তারা নিজেরাই কাউন্সেলিং করে ঠিক করতে চেষ্টা করেন। না পারলে তখন সাইকো থেরাপিস্টের কাছে পাঠান। ড. শারমিনের পরামর্শ, যেকোন বয়সী নারীরই সন্তান জন্ম নেয়ার আগে একজন স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন যাতে আগে থেকেই সে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে পারে।

আসুন এবার জেনে নেই কিছু ভুক্তোভুগি মায়ের কথা।

পাপিয়া (৩১) গর্ভধারনের কিছুদিন পরে খেয়াল করে তার শরীরে বেশকিছু পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে প্রাথমিক অবস্থায় যেটা মেনে নিতে তার কিছুটা সমস্যা হচ্ছিলো। ধীরে ধীরে শরীর ভারি হতে থাকে, শরীরের নানা জায়গায় কালো হয়ে যেতে থাকে বা ফাটা দাগ দেখা দিতে থাকে, গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে যায়। পাপিয়ার প্রথমেই যে আশংকা করে তার তা হল, এইসব পরিবর্তন যদি আর কোনদিন ঠিক না হয়!

পাপিয়ার মতো অনেকেই নিজের শরীরের এই অস্বাভাবিকতা মেনে নিতে পারেনা। জিনিয়ার (২৮) মতো অনেক মা আছে যারা প্রসূতি অবস্থায় তাদের প্রতি মনযোগ সরে গিয়ে নতুন বাচ্চার প্রতি সবার মনযোগ চলে আসাটাকে মানতে পারেনা।

এর মানে এই না যে এই মায়েরা খুব খারাপ বা বাচ্চা চায়নি। এইসব পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক যেমন স্বাভাবিক তাদের এই হঠাৎ আসা নেতিবাচক অনুভূতি। এই নেতিবাচকতা থেকে মুক্তি পাওয়া খুব কঠিন নয় যদি গর্ভধারনটা পরিকল্পিত হয় আর গর্ভাবস্থায় নারীর প্রতি স্বামীসহ, পরিবার, বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীরা সহমর্মী আচরন করে।

একজন নারীও পারেন নিজেকে বঞ্চিত বা আলাদা না ভেবে নিজের ভালোলাগার কাজগুলো করে নিজেকে সুখি করতে। গর্ভধারণ মানেই সে সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে গেলো তা নয়। সেই নারীর চারপাশের মানুষদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে যেন সে নিজের ভেতরে আরেকটা প্রাণের অস্তিত্ব লালনের বিষয়টি নিয়ে গর্বিত হয়। তাঁর খাওয়াদাওয়া এবং মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিও অন্যদের বিশেষ যত্নসহকারে দেখতে হবে।

একজন মা যেটা পারে সেটা আর কেউ পারেনা। এই মহৎ অনুভূতি ও মাতৃত্বের সৌন্দর্যকে ধারণ করে চলতে পারলেই একজন মা পিপিডির মতো অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

অলংকরণ: আবু হাসান

সারাবাংলা/ আরএফ/ এসএস

পোস্টপারটাম ডিপ্রেশন বিষন্নতা মাতৃত্ব শিশু

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর