ঝকঝকে রোদ, কনকনে শীত আর কড়া নিয়ম-কানুন
১৯ জুলাই ২০২২ ১৯:৫৯
২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়াতে ইদুল আজহা পালিত হয় ১০ জুলাই। বাংলাদেশেও এদিনও ইদ ছিল। ইদের দিন অনেক সকালে নাজাম পড়তে যাই স্থানীয় মসজিদে। সাত সকালে এ দিন ব্রিজবেনের আকাশে ঝকঝকে রোদ। পরিষ্কার, সুনীল আকাশ, মাঝে মধ্যে সাদা মেঘের ভেলা। তবে শীত ছিল কনকনে। কুইন্সল্যান্ডের শীতের সাথে এখানেই বাংলাদেশের শীতের পার্থক্য। বাংলাদেশে সাধারণত শীত যখন অনেক বেশি তখন ঘন কুয়াশা থাকে। চারপাশে কুয়ার চাদর ছড়ানো থাকে। সাথে ঠাণ্ডা। কিন্তু কুইন্সল্যান্ডে সম্পূর্ণ উল্টো। কুয়াশার কোনো নাম গন্ধ নেই। কিন্তু কড়া শীত। কনকনে শীত। হাড় কাঁপানো শীতের দিনেও চারপাশ রৌদ্র উজ্জ্বল ঝকঝকে থাকে বলেই হয়তো কুইন্সল্যান্ডকে সানসাইন স্টেট নামে ডাকা হয়। কুইন্সল্যান্ডের প্রতিটি গাড়ির নম্বর প্লেটের নম্বরের নিচে লেখা থাকে Queensland-Sunshine State.
আমার গ্রামের বাড়ি বা জন্মস্থান বগুড়ার নিশিন্দারা পশ্চিম পাড়া। ইদের দিন সাধারণত আমরা পরিবারের সদস্যদের সাথে পাশের গ্রামের একটা মাঠে ইদের নামাজ পড়তে যাই। নাম বেলতলা ইদগাহ। এই ইদগাহে সাধারণত অনেক বয়স্ক হুজুর খুৎবা পড়ে থাকেন, নামাজ পড়ান। ব্রিজবেনের মসজিদে ইদের নামাজ পড়তে গিয়েই অবাক হই। বয়সে যুবক, সৌম্য চেহারার একজন হুজুর বা ইসলামিক স্কলার বয়ান করছিলেন। বয়ান ইংরেজিতে। কিন্তু অনেক সহজ, সুমধুর। প্রতিটি বাক্যই বুঝতে পারছিলাম। মনটা ভালো হয়ে গেল। খুব আগ্রহ নিয়ে বয়ান শুনলাম। ইসলামী ভাতৃত্বের কথা বলা হলো। সুন্দর সমাজের কথা উঠে আসলো। একে অপরকে সহযোগিতার কথা আসলো। আসলো সহনশীলতার কথা। ছিল না ইহুদি, নাসারা বা অন্য কোনো জাতি গোষ্ঠীর প্রতি উগ্র ঘৃণার প্রকাশ। ছিল না জিহাদের আহ্বান। আমাদের দেশের মসজিদ বা অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কেনো যে যুদ্ধংদেহী উগ্রতার সাথে ইসলামিক আলোচনা হয় তা আজও আমার বোধে আসে না। হুজুরদের কথা শুনে মনে হয় বয়ান শেষেই তারা যুদ্ধে চলে যাবেন। আগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া অথবা কাশ্মির। আর কেনোই বা জন্মগতভাবে একজন মুসলিমকে ইহুদি-নাসারা বা খ্রিস্টান জাতিকে ঘৃণা করতে হবে তাও আমার বোধগম্য নয়। নামাজ শেষে খুৎবা হলো। আহা কি সুমধুর! কি সুন্দর খুৎবা। মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। নামাজ শেষে ঐ ইসলামিক স্কলার যুবকের সাথে কথা হলো। তার নাম আবু জুবায়ের। কুশল বিনিময় হলো, ইদ শুভেচ্ছা বিনিময় হল। মনে অনেক অনেক আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
কনকনে শীতের ঝকঝকে দিনের সাথে এবার আসা যাক অস্ট্রেলিয়ার আইন-কানুন সম্পর্কে। খুব সম্ভবত সংস্কৃতি ভাষায় চাণক্যশ্লোকে একটা কথা আছে, ‘যদা দেশ তদা চার’। মানে যেমন দেশ, তেমন আচার। অস্ট্রেলিয়ান অন্য কোনো রাজ্য বা কুইন্সল্যান্ডে বসবাস করতে হলে কোন কোন আইন মানতে হবে তা জানার চেষ্টা করেছিলাম ব্রিজবেনে আমাদের আশ্রয় দেওয়া মহানুভব পরিবারটির কাছে। তারা অনেকগুলো বিষয় আলোচনা করেছিলেন। সে বিষয়ে পরে আসছি। প্রথমেই আসা যাক, আমরা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে কোন সমস্যায় পড়েছিলাম সেই বিষয়ে।
ঢাকা থেকে আমরা ব্রিজবেনের পথে রওনা হই মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সে। পথ ঢাকা-কুয়ালালামপুর-ব্রিজবেন। কুয়ালালামপুর থেকে ব্রিজবেনের ফ্লাইট প্রায় সাড়ে আট ঘন্টার। দীর্ঘ বিমান ভ্রমণ। আমরা ব্রিজবেন এয়ারপোর্টে পৌঁছায় সকাল আটটার দিকে। ব্রিজবেনে ল্যান্ড করার আগে আমাদের বিমানে একটি ফর্ম দেওয়া হয়। এটাকে ডিক্লারেশান ফর্ম বলে। এই ফর্মে টিক দিয়ে স্বীকার করে নিতে হয় একজন যাত্রী ঠিক কি কি জিনিস বহন করছেন। আমাদের সাথে আমার দুই বাচ্চা ছিল। সকালে কোথায় কি খাবার পাওয়া যায় কি না যায়, এই ভেবে বিমান থেকে এক প্যাকেট খাবার (ভাত ও মুরগীর তরকারী) আমরা ব্যাগে নিই। কিন্তু অসাবধনাবশত এ বিষয়টি ডিক্লারেশান ফর্মে বলা হয়নি। এয়ারপোর্টে নামার পর ইমিগ্রেশান হলো। তারপর শুরু হলো নিরীক্ষা। কয়েক ধাপে চললো এই কাজ। একজন শুধু জিজ্ঞাসা করেই ছেড়ে দিলেন। আরেকজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর দিয়ে ব্যাগগুলো নিরীক্ষা করালেন। তবে শেষ জনের কাছে এসেই বাঁধলো বিপত্তি। Australian Border Force (ABF)-এর ঐ সদস্য আমাদের কাছে রান্না করা ঐ খাবার সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমরা উত্তর দিলাম। তিনি বুঝলেন। তবে এটাও বললেন, এ বিষয়টা আমরা ফর্মে ঘোষণা করিনি। তাই এটা নিয়ে আসা অন্যায় হয়েছে। এরজন্য দেড় থেকে দু হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার ফাইন হতে পারে। তবে যেহেতু আমরা না বুঝে করেছি এবং প্রথমবার করেছি তাই আমাদের ফাইন করা হলো না। বিষয়টি শুধু নোট করে রাখা হলো। কি কঠিন আইন রে বাবা! যাই হোক যারা অস্ট্রেলিয়া আসবেন তারা অবশ্যই বিষয়টি মাথায় রাখবেন। তবে মনে রাখতে হবে আপনি যা কিছুই আনেনা কেন তা অনশ্যই ঐ ফরমে ঘোষণা করতে হবে।
এবার আসা যাক আরও কিছু নিয়ম কানুনে। যা আমাদের শিখিয়েছিলেন ঐ বাঙালি দম্পতি। প্রথমেই আসা যাক রাস্তাঘাটের নিয়ম-কানুনে। এখানে চাইলেই কেউ হাত উচিয়ে রাস্তার ভেতর দিয়ে পাড় হতে পারে না। প্রতিটি রাস্তার মাথায় আলাটা পয়েন্ট আছে। যেখানে রাস্তা পার হওয়ার জন্য একটা বাটনে চাপ দিতে হয়। তারপর সামনের বাতি সবুজ হলেই হেঁটে ঐ রাস্তা পাড় হওয়া যায়। আর সড়কের গাড়ি চালানোর নিয়ম খুব কড়া। কোনো অবস্থাতেই কেউ সড়ক বাতি লঙ্ঘন করতে পারবেন না। করলেই শাস্তি। এতে মোটা অঙ্কোর জরিমানার সাথে থাকে লাইসেন্স হারানোর শঙ্কা। এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়িতে শিশুকে নিয়ে চলার সময় বেবি সিট মাস্ট। এই বেবি সিট ছাড়া চলা একেবারে অসম্ভব। তবে উবার বা অন্য কোন ভাড়ার গাড়িতে চলার সময় বেবি সিট না থাকলেও চলে। কিন্তু সিট বেল্ট বাঁধা একেবারেই আবশ্যক।
অস্ট্রেলিয়া একটি পশুপাখি বান্ধব দেশ। আমরা প্রথমে গ্রিনসোলপস্ এ যে বাড়িতে উঠেছি তার পাশেই দুটি পশু পাখিদের সেবা কেন্দ্র। একটির নাম Brisbane Bird & Exotics Veterinary Service. এখানে বাড়িতে লালন পালন করা পশু পাখির সেবা যত্ন করা হয়। পাওয়া যায় পশু পাখিদের হরেক রকম খাবার। যাই হোক মূল কথায় আসি। অস্ট্রেলিয়াতে পথে চলতে, মাঠে অবকাশ কেন্দ্রে আপনি হাতের কাছেই বিভিন্ন ধরনের পাখি বা পশু পেয়ে যেতে পারেন। এই পশু পাখিদের কোনো অবস্থাতেই কোনো ক্ষতি করা যাবে না। এমনকি মানুষ খায় এমন খাবার যেমন কেক, চিপস্ এ ধরনের কোনো খাবারও দেওয়া যাবে না। কারণ এ ধরনের খাবার ঐ পাখিদের হমজ করতে সমস্যা হতে পারে। অস্ট্রেলিয়াতে একটা পাখি বিভিন্ন মাঠে বা সবুজ প্রান্তরে দেখা যায়। হাঁসের মতো হেঁটে বেড়ায়। নাম ইবিজ। গায়ের পশম সাদা, লম্বা ঠোঁটের এই পাখিটি লোকালয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই পাখি আমরা দেখেছিলাম ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডে। পাখিটি হঠাৎই আমার ছোটছেলে আইজান হকের হাত থেকে চিপস এক ঠোকর দিয়ে কেড়ে খেয়ে ফেলে। আমার ছেলে কান্নাকাটি করলেও পরে আর কিছু ঘটেনি। পাখিটি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণই করেছিল। যাই হোক এই ধরনের পশু পাখির ক্ষতি করা আইনত একেবারেই দণ্ডনীয়। কেনো অবস্থাতেই এ ধরনের পশু পাখির কোনো ক্ষতি করা যাবে যাবে না কুইন্সল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার যে কোন প্রান্তে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে উচ্চশিক্ষার জন্য ব্রিজবেনে অবস্থানরত)
সারাবাংলা/আরএফ/এএসজি