‘সাংবাদিক’ জীবনানন্দ
৩০ মে ২০১৯ ২২:২৮
কর্মজীবনের বড় অংশ শিক্ষকতায় কাটানো জীবনানন্দ দাশ জীবদ্দশায় মূলত কবি হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। যদিও মৃত্যুর পরে অনেক উপন্যাস আর গল্পও বেরিয়ে আসে তার সোনার খনি থেকে। শিক্ষকতা করলেও এই পেশার প্রতি তার খেদ, অভিমান ও বিরক্তিও তিনি নানা সময়ে প্রকাশ করেছেন। যে কারণে বিকল্প পেশায় যাওয়ার তাড়না ছিল তীব্র। সেই বিকল্প অন্বেষণের তাগিদে কাজ নেন একটি দৈনিক সংবাদপত্রের নাম ‘স্বরাজ’। কিন্তু এখান থেকে তার চাকরিটা যায় এক অদ্ভুত কারণে। তার সমসাময়িক (একই বছরে জন্ম) কবি কাজী নজরুল ইসলামের (তিনি তখন তুমুল জনপ্রিয়) ‘সমালোচনা’ করে। ‘স্বরাজ’ মানে স্বাধীনতা। ১৯২৯-৩০ সালের ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে লাহোরে জওহরলাল নেহরুর সভাপতিত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভায় স্বাধীনতা প্রস্তাব গৃহীত হয়। নেহরু তখন ওই মাসের ২৬ তারিখকে পূর্ণ স্বরাজ দিবস ঘোষণা করেন। সেই স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ১৯৪৭ সালের ২৬ জানুয়ারি হুমায়ুন কবিরসহ আরও কয়েকজনের উদোগে প্রতিষ্ঠিত এবং সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের সম্পাদনায় ‘দৈনিক স্বরাজ’ পত্রিকার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। এখনও প্রতি বছরের ২৬ জানুয়ারি ভারতে স্বরাজ বা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা সংবাদপত্রে রোববারের সংখ্যায় একটি সাহিত্যপাতা রাখার রেওয়াজ বহু পুরনো। বাংলাদেশে যেমন এখনও শুক্রবার দৈনিক পত্রিকায় একটি সাহিত্য পাতা থাকে। দৈনিক স্বরাজের রোববারের সাময়িকী তথা সাহিত্যপাতার দায়িত্ব দেওয়া হয় জীবনানন্দকে। মূলত ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং প্রকাশক সত্যপ্রসন্ন দত্তর ঐকান্তিক ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় তিনি এই চাকরিটা পান। অর্থাৎ তিনি ছিলেন স্বরাজের রবিবাসরীয় সম্পাদক। বিশ্বের অনেক নামকরা লেখকই একসময় সরাসরি সাংবাদিকতা অথবা পত্রিকার সাহিত্য বা সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেছেন। এখনও এই চর্চা আছে।
কলকাতা শহরের শিয়ালদহ স্টেশনের অদূরে ১০ ক্রিক রোতে ছিল ‘স্বরাজ’ পত্রিকার অফিস। হরিশংকর জলদাসের (জীবনানন্দ ও তাঁর কাল, পৃষ্ঠা ১৫১) তথ্য অনুযায়ী, জীবনানন্দ এখানে সাত মাস কাজ করেছেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে এটা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ১৯৪৭ সালের জানুয়ারির শেষ অথবা ফেব্রুয়ারি থেকে ওই বছরের জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকায় কাজ করেছেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বরাতে ক্লিন্টন বি সিলিও (অনন্য জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ২৪৩) জানাচ্ছেন, জীবনানন্দ সম্ভবত ১৯৪৭ সালের মাঝামাঝি চাকরিটা ছেড়ে দেন।
১৯৪৭ সালের ৩০ জুলাইও যে তিনি এই পত্রিকায় ছিলেন তা জানা যাচ্ছে ওই তারিখে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে লেখা একটি চিঠিতে যেখানে তিনি স্বরাজের কাজ ভালো লাগছে না বলে তাকে জানান এবং সেইসাথে স্বরাজের পূজো সংখ্যার জন্য অচিন্ত্যকে একটি গল্প পাঠানোরও অনুরোধ করেন। এই লেখার জন্য অচিন্ত্যকে ৫০ টাকার কম সম্মানী দেয়া হবে না বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেন জীবনানন্দ।
স্বরাজের কাজ সেরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পশ্চিম দিকের রাস্তা ধরে কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ হিন্দ সিনেমা হলের পাশে ৫৪ গণেশ চন্দ্র এভিনিউয়ে যেতেন তিনি। এই সড়কের একটি দোতলা বাড়িতে ছিল সুহৃদ সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার অফিস। অর্থাৎ স্বরাজের কাজ সেরে বেরিয়ে সঞ্জয় ও অন্যদের সঙ্গে আড্ডা দেয়া ছিল জীবনানন্দের মোটামুটি নিয়মিত রুটিন। যার সাক্ষ্য আছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর লেখায়ও।
শিক্ষকতা ছেড়ে জীবনানন্দের পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পেছনে প্রধানত যে কারণটিকে চিহ্নিত করা হয় তা হলো, শিক্ষকতার প্রতি তিনি ক্রমেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন। যে কথা তিনি বিভিন্ন সময়ে তার সুহৃদদের কাছে লেখা চিঠিতেও স্পষ্ট করেছেন। এর মধ্যে দেশভাগের ডামাডোল শুরু হলে পূর্ববাংলার হিন্দুরা নিজেদের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন যা থেকে খোদ জীবনানন্দও মুক্ত থাকতে পারেননি। অথচ একসময় বরিশাল শহরে তাদের পরিবার ছিল অন্যতম সম্ভ্রান্ত এবং প্রভাবশালী। এমনকি আধুনিক বরিশালের রূপকার বলা হয় যে অশ্বিনীকুমার দত্তকে, তিনিও মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন জীবনানন্দের দাদা সর্বানন্দ দাশের কাছে। অথচ সাতচল্লিশের আগে দেশভাগ ইস্যুতে সেই জীবনানন্দকেও জন্মস্থান ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।
বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের স্থায়ী ও সম্মানজনক চাকরি ফেলে কলকাতায় গিয়ে কী করবেন তা নিয়েও জীবনানন্দের দুশ্চিন্তা ছিল। অন্যদিকে শিক্ষকতায়ও মন দিতে পারছিলেন না। এসব নিয়ে তার সুহৃদদের সাথে তার একাধিক চিঠি চালাচালি হয়েছে। এ অবস্থায় সুহৃদ সঞ্জয় ভট্টাচার্যের প্রচেষ্টায় ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় তার চাকরির ব্যবস্থা হয়। বরিশালে থাকতেই তাকে এই প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল যে, যতদিন স্বরাজ থাকবে ততদিন তার চাকরি থাকবে। সঞ্জয়-সত্যপ্রসন্ন ও হুমায়ুন কবিরের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি পেয়েই তিনি বরিশাল থেকে কলকাতায় আসেন।
বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে জীবনানন্দের ছাত্র এবং পরবর্তীকালে প্রখ্যাত উপন্যাসিক শামসুদ্দিন আবুল কালাম জানাচ্ছেন, বরিশাল থেকে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় আসার পরেই (১৯৪৭) জীবনানন্দ ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় কাজ নেন। জীবনানন্দের আগ্রহে তিনি (শামসুদ্দিন) নিজেও এই পত্রিকায় কয়েকটি গল্প লিখেছিলেন। ওই সময়ের বড় লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘পদক’ গল্পটিও সম্ভবত এই পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল (কবি জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গে, বিভাব, জীবনানন্দ জন্মশতবর্ষ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ১১৬) ।
জীবনানন্দ স্বরাজ পত্রিকার রবিবাসরীয়তে ‘মনমর্মর’ নামে একটি বিভাগ খুলেছিলেন। যেখানে অনেক সাহিত্যিক বন্ধু তাদের ব্যক্তিগত গদ্য লিখেছেন জীবনানন্দের অনুরোধে। ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ এই পত্রিকায় জীবনানন্দ নিজেই একটি গদ্য লিখেছিলেন ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে। তারই দায়িত্বে সে বছর প্রথম পূজাসংখ্যাও প্রকাশের পরিকল্পনা নেয়া হয়।
অরুণ মিত্রর (তিনদিনের পরিচয়েই আমরা ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম, কোরক, শারদ, ১৯৯৪) ভাষ্য: সেটা সম্ভবত ছিল ১৯৫২ সাল (তারিখটি ভুল। কারণ গবেষণা বলছে জীবনানন্দ এই পত্রিকায় ছিলেন ১৯৪৭ সালে। জীবনানন্দের জীবনের অনেক তারিখ নিয়েই এরকম বিভ্রান্তি আছে। যেমন স্বয়ং তার স্ত্রী লাবণ্য দাশও লিখেছেন, ১৯৪৬ সালের শেষদিকে জীবনানন্দ স্বরাজ পত্রিকায় ছিলেন। অথচ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে)। জীবনানন্দের সঙ্গে তার আলাপের একটা সুযোগ হলো। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক এবং তার আত্মীয় ও গুরুজন সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার ‘স্বরাজ’ এর সম্পাদক হয়েছিলেন। একদিন লেখাসম্পর্কিত কোনো কাজে অরুন মিত্র ওই পত্রিকার কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ তখন জানান যে পত্রিকার রবিবারের পাতাটা দেখছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। শুনে তিনি আগ্রহসহকারে জীবনানন্দের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেন। নিভৃত অফিস ঘরে স্বল্পভাষী কবিকে অনেকক্ষণ কাছে পেয়েছিলেন বলে অরুণ মিত্র স্মরণ করতে পারেন।
লিখেছেন, ‘তাকে সহমর্মী বলে অনুভব করার জন্যই হয়তো আমার মুখে বাক্যের জোয়ার এসে গেল। আমি কথা বলেই চলেছি, উনি নির্বাক শ্রোতা। কোনো অবস্থাতেই বাচাল হন না তিনি। তবে শ্রবণে তার তন্ময়তোটা টের পাচ্ছিলাম বেশ।’ এই ঘটনার পরে অরুণ মিত্র আরও একদিন স্বরাজের অফিসে গিয়েছিলেন। তবে সেদিন বেশি কথা হয়নি। ব্যস্ততা থাকায় শুধু সহাস্য কুশল বিনিময় করে ফিরে এসেছেন।
অরুন মিত্রের মতো নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীও জীবনানন্দকে এই পত্রিকাতেই আবিষ্কার করেন। যদিও তাকে প্রথম দেখে তিনি কিছুটা নিরাস হয়েছিলেন। কারণ ধূসর পা-ুলিপি পড়ে কবির যে চেহারা তিনি কল্পনা করে রেখেছিলেন, রক্তমাংসের মানুষটির সাথে তার কোনো মিল পাননি মি. চক্রবর্তী। তিনি লিখছেন, মধ্য বয়সী আর পাঁচজন ছাপোষা বাঙালির যেমন হয়ে থাকে নেহাতই সেরকমই চেহারা।
ক্রিক রো দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওয়েলিংটন স্কয়ার। ভেতরের পথ দিয়ে পার্ক পেরিয়ে ওয়েলিংটন স্ট্রিট। ট্রাম রাস্তা পেরিয়ে আরও খানিক হাঁটলে, বাঁ থেকে পূর্বাশা পত্রিকার অফিস। সারা পথ কথা বলতেন। বরিশালের কথা। বংলার ভূপ্রকৃতি আর গাছপালার কথা। নদীর কথা। পাখির কথা। মানুষের কথা। কবিতার কথা। এতক্ষণ তো জেলখানায় বন্দি হয়েছিলেন। পারতপক্ষে কথা বলেননি। বুঝতে পারতাম যে সেই না বলা কথাগুলোই এবারে বেরিয়ে আসছে। পূর্বাশা অফিসে কথা বলতে বলতে সন্ধ্যায় হয়ে যেতো। তারপর যখন কথা যে হত, তখন সঞ্জয়দা বলতেন, যাও নীরেন, ওকে বালিগঞ্জের বাসে তুলে দিয়ে এসো।
যদিও কয়েক মাসেই এখানেও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। ১৯৪৭ সালের ৩০ জুলাই বন্ধু অচিন্ত্য কুমারকে লেখা চিঠিতে পত্রিকার কাজের প্রতি অনীহার কথা জানিয়েছেন। লিখেছেন, স্বরাজের কাজ মন্দ ছিল না। কিন্ত কোনো কারণে ভালো লাগছে না। অন্য কিছু পেলেই কিংবা আগেই চলে যেতে হবে।
কলেজ থেকে তার চাকরিচ্যুতির পেছনে অসুস্থতাজনিত দীর্ঘ ছুটি, কলেজের আর্থিক সংকটসহ নানা কারণ থাকলেও স্বরাজ পত্রিকা থেকে তার চাকরিটা যায় এক অদ্ভুত কারণে। ভূমেন্দ্র গুহর ভাষ্য অনুযায়ী: ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে, পূজার আগে দৈনিক স্বরাজ পত্রিকা কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা বের করে কোনো এক রোববার। জীবনানন্দ তখন এই পত্রিকারই রবিবাসরীয় সম্পাদক। নজরুল তখন স্মৃতিশক্তিরহিত। কিন্তু জনপ্রিয়তায় আকাশছোঁয়া, কিংবদন্তিতুল্য। সুতরাং জীবনানন্দ নিজে না চাইলেও রবিবাসরীয় সম্পাদক হিসেবে নজরুল সংখ্যায় কিছু একটা তাকে লিখতে হতো। তাই ‘নজরুল ইসলাম’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। কিন্তু এটি প্রুফ অবস্থাতেই থেকে যায়। ভূমেন্দ্র গুহ মনে করেন, অন্যান্য কারণের সাথে নজরুলকে নিয়ে এই প্রবন্ধের ইস্যুটাও স্বরাজ পত্রিকা থেকে জীবনানন্দের চাকরিচ্যুতির উপলক্ষ হয়ে ওঠে।
প্রবন্ধে নজরুল সম্পর্কে জীবনানন্দ কী লিখেছিলেন? ‘নজরুল ইসলামের কবিতায় মহাকাব্যিক গভীর প্রসাদ নেই, তার প্রতিশ্রুতিও কম। কিন্তু কোনো এক যুগে কজনের কবিতায়ই বা তা থাকে?’ জীবনানন্দ মনে করেন, কাব্যের সুর কি এক আশ্চর্য বৈদেহী পবিত্রতায় নিজের ধ্রুবলোকে পৌঁছেছে; এরকম দাবি নজরুল ইসলামের কবিতা সম্পর্কে করা যায় না। জীবনানন্দ উল্লেখ করেন, ‘কাজীর কবিতা বিশেষ একটা মাত্রার দেশে তার অতীতের ভিতরে পরিসমাপ্ত। আজও তা পড়বার জিনিস হয়তো আবৃত্তির জিনিস; পড়া শেষ করে সময় কেটে গেলে মানস কর্ণ তৃপ্ত হতে চায় না মন বিষয়ান্তর খোঁজে দিকনির্ণনীয় মহৎ কবিদের।’ যদিও এই প্রবন্ধটি পত্রিকায় ছাপা হয়নি। কারণ সম্পাদকের টেবিলে লেখাটি যেতেই তোলপাড় শুরু হয়।
প্রসঙ্গত, নজরুলের কবিতা বিষয়ে জীবনানন্দ আগেও একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ‘নজরুলের কবিতা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ ছাপা হয় ১৩৫১ সালে ‘কবিতা’ পত্রিকার নজরুল সংখ্যায়। যেখানেও নজরুলের কবিতা সম্পর্কে জীবনানন্দ তার নিজস্ব ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন অকপটেই। এই প্রবন্ধে তিনি লেখেন, ‘নজরুলের কবিতা চমৎকার কিন্তু মানোত্তীর্ণ নয়। তিনি অনেক সফল কবিতা উৎসারিত করতে পেরেছিলেন। কোনো কোনো কবিতায় এত বেশি সফলতা যে কঠিন সমলোচকও বলতে পারেন যে নজরুলি সাধনা এইখানে এইখানে সার্থক হয়েছে;- তবুও মহৎ মন এড়িয়ে গিয়েছে।’ আধুনিক অনেক কবিতা থেকে নজরুলের কোনো কোনো কবিতার অঙ্গীকার বেশি হলেও নিজেকে বিশোধিত করে নেবার প্রতিভা কিংবা এসব কবিতার বিধানে শেষ রক্ষার কোনো সন্ধান নেই বলেও মনে করেন জীবনানন্দ।
তবে বিপত্তি বাঁধে স্বরাজের প্রবন্ধের বেলায়। কাজী নজরুলের জনপ্রিয়তা যেহেতু তখন আকাশচুম্বি, ফলে তার সমালোচনামূলক এই লেখাটি ছাপার ঝুঁকি নিতে চায়নি কর্তৃপক্ষ। পত্রিকার অন্যতম স্বত্বাধিকারী রমেশ বসু তাকে ডেকে নিয়ে ভৎসনা করেন এই বলে যে, ‘জার্নালিজম তো জানেন না আপনি। কিছু জানেন না শোনেন না। আমার কথার ওপর কথা বলবেন না। এটা সাহিত্য না, প্রফেসরি না।’
স্বরাজে জীবনানন্দ কেন চাকরিটা করতে পারলেন না তার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যিনি শুরু থেকেই এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মূলত জীবনানন্দের ঘনিষ্ঠ সঞ্জয় ভট্টাচার্য তাকে এই পত্রিকার বার্তা বিভাগে ঢুকিয়ে দেন। নীরেন্দ্রনাথের ভাষায়: জীবনানন্দ ছিলেন ষোলআনা শুদ্ধ কবি। তার মানসিক গঠনের যে যৎসামান্য পরিচয় আমরা পেয়েছিলুম, তাতে মনে হতো, তিনি যে কবিতা লেখেন, এটাই ছিল তার একমাত্র পরিচয়। বরিশালে যে অধ্যাপনার কাজ করতেন, তাও হয়তো তার কাছে খুব স্বস্তিকর ঠেকেনি। সেক্ষেত্রে সাংবাদিকতা নামক বৃত্তিটি যে তার কাছে আরও অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। তাছাড়া খবরের কাগজের জগতে সফল হওয়ার জন্য যে ‘এখনি করে দিচ্ছি’ গোছের চটপটে ভাব ও লোক দেখানো স্মার্টনেসের দরকার হয়, তাঁর মতো ধীরস্থির ও চিন্তাশীল মানুষের চরিত্রে তা থাকা সম্ভব নয়, ছিলও না। ফলে দুচারদিনের মধ্যেই রটে যায় যে রবিবাসরীয় বিভাগের সম্পাদক হিসাবে তিনি একেবারেই অযোগ্য। মি. চক্রবর্তী মনে করেন, সব অফিসেই কিছু না কিছু স্থূল প্রকৃতির মানুষ থাকে, স্বরাজেও ছিল, সম্ভবত তারাই সেখানে ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ যারা জীবনানন্দের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলেন (ধূসর পা-ুলিপি, কোরক, শারদ, ১৯৯৪)।’ প্রভাতকুমার দাসও মনে করেন, সংবাদপত্রে কাজের জন্য যে মানসিক গঠন দরকার তা তাঁর ছিল না। ফলে শেষ পর্যন্ত মানিয়ে নিতে পারেননি (জীবনানন্দ দাশ, তৃতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১০৩)।
তাহলে এরকম একটি কাজের জন্য কেন শিক্ষকতা ছেড়ে দিলেন? নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এমন প্রশ্নের জবাবে জীবনানন্দ বেতনের কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু জীবনানন্দকে স্বরাজ পত্রিকা কত টাকা বেতন দিত? সেই বেতন কি বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের চেয়ে বেশি ছিল?
শামসুদ্দিন জানাচ্ছেন, স্বরাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি, জীবনানন্দ ও নির্মল চট্টোপাধ্যায় মিলে একটা মাসিক পত্রিকা বের করার চিন্তা করছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞাপন সংগ্রহে তিনজনই অপটু ছিলেন বলে আর এগোননি।
এই চাকরিটা যাওয়ার পর ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বরে খড়্গপুর কলেজে যোগ দেয়ার আগ পর্যন্ত জীবনানন্দের কোনো চাকরি ছিল না। অর্থাৎ বেকার ছিলেন।
উল্লেখ্য, নিজে যে পত্রিকার রবিবাসরীয় সম্পাদক ছিলেন সেই পত্রিকায় জীবনানন্দ মাত্র একটি কবিতা লিখেছেন। তাও তিনি যখন এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সংখ্যায়, কবিতার শিরোনাম ‘যে কোনো আকাশে’। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন তাঁর প্রয়াণের পাঁচ-ছয় বছর পরে যেটি স্বরাজের ২৪ শ্রাবণ ১৩৫৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
‘স্বরাজ’ পত্রিকায় জীবনানন্দ খুব বেশিদিন ছিলেন না। আবার স্বল্পায়ু জীবনের সামান্য যে সময় তিনি এই প্রতিষ্ঠানে কাটিয়েছেন, তা খুব স্বস্তিরও ছিল না। অথচ জীবনানন্দের মতো একজন মানুষ সামান্য কিছুদিন এই পত্রিকায় কাজ করেছিলেন বলেই আজও পত্রিকাটির নাম মানুষ মনে রেখেছে। গবেষকরা এখনও এই পত্রিকার সংখ্যা খুঁজে বের করেন; এর ঠিকানা খুঁজে বেড়ান।
দ্বন্দ্ব
স্বরাজের পরে ১৯৫০ সালে দ্বন্দ্ব নামে আরেকটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন জীবনানন্দ। পত্রিকাটি ছিল ‘সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র’ নামে একটি সংগঠনের মুখপত্র। চতুর্থ বর্ষ থেকে এর অন্যতম সম্পাদক ছিলেন জীবনানন্দ। অন্য দুই সম্পাদক ছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব ও নরেন্দ্রনাথ মিত্র।
এই পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৫৪ সালে। সম্পাদক ছিলেন বিশ্বনাথ ভট্টচার্য ও সুহৃদ রুদ্র। পরে এটি সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্রের মুখপত্রে পরিণত হয় এবং সম্পাদনা পরিষদ ঢেলে সাজানো হয় যেখানে অন্তর্ভুক্ত হন জীবনানন্দ দাশ। ১৯৫০ সালের জুন থেকে তিনি এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
নতুনভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকার প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যায় সম্পাদকদের নামের বিন্যাস ছিল এরকম- আবু সয়ীদ আইয়ুব, জীবনানন্দ দাশ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র। আইয়ুবের জবানিতে ক্লিন্টন বি সিলি (অনন্য জীবনানন্দ, পৃষ্ঠা ৩২৩) জানাচ্ছেন, নিজের নাম দ্বিতীয় স্থানে থাকায় জীবনানন্দ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তবে তৃতীয় সংখ্যা থেকে নামের বিন্যাস পরিবর্তন হয়- জীবনানন্দ দাশ, আবু সয়ীদ আইয়ুব, নরেন্দ্রনাথ মিত্র।
এই পত্রিকাটি ছিল একটি সাহিত্য আন্দোলনের অংশ। ফলে ধরে নেয়া সঙ্গত যে, এখানে জীবনানন্দ যে কয়দিন কাজ করেছেন, তাতে এটি তার আয়ের কোনো উৎস ছিল না। তিনি এখানের নিয়মিত বেতনভুক্তও ছিলেন না।
‘দ্বন্দ্ব’ পত্রিকাটিয় সম্পাদক হিসেবে নিজের নাম ছাপা হলেও জীবনানন্দ এখানে লিখেছেন খুবই কম। ‘আশা-ভরসা’ নামে একটি কবিতা লেখেন আষাঢ় ১৩৫৭ সংখ্যায় আর সেপ্টেম্বর ১৯৫০ চতুর্থ (পূজা) সংখ্যায় লিখেছিলেন প্রবন্ধ ‘আধুনিক কবিতা’ যেখানে কবিতা তিনি নিজের ভাবনা প্রকাশ করেন। ‘মাঘসংক্রান্তির রাতে’ কবিতাও এই পত্রিকায় ছাপা হয়। কিন্তু কোন সংখ্যায় সেটি কোথাও উল্লেখ নেই।
১৯৫০ সালের ২২ জানুয়ারি কলকাতার সিনেট হলে সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্রর আনুষ্ঠানকি উদ্বোধন করেন সোশ্যালিস্ট নেতা আচার্য নরেন্দ্র দে’ও। জীবনানন্দের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু কোনো কারণে উপস্থিত থাকতে পারেননি। কিন্তু একটি অভিনন্দন-বাণী পাঠিয়ে দেন। যেখানে লেখেন ‘সাহিত্যের উচিত-স্বাধীনতায় স্টেট বিপদগ্রস্ত হবে। আমার মনে হয় যে, বাংলাদেশ এভাবে এখনও ভাবতে শুরু করেনি। কিন্তু শিগগিরই করতে পারে। সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র একদিকে সমাজ ও জনতার বিমূঢ় উপেক্ষা ও অন্যদিকে রাষ্ট্র ইত্যাদির অন্যায় ও অবোধ কর্তৃত্বের হাত থেকে সাহিত্যকে যথাসম্ভব মুক্ত রাখবার কাজে ধৈর্য, জ্ঞান ও বিনয়ের সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছেন অনুভব করে আমি আনন্দিত হয়েছি। সাহিত্যের উন্নতি ও সার্থকতার জন্য আপনারা মিলিত হয়েছেন, আপনাদের পরিপূর্ণ সাফল্য কামরা করি।’ (দ্বন্দ্ব, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৫০)
ওই সভায় ১২ জনকে নিয়ে সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্রের কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়। সভাপতি আবু সয়ীদ আইয়ুব, সহসভাপতি জীবনানন্দ দাশ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, দীনেশ দাশ, অম্লান দত্ত, প্রভরঞ্জন সেন, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, গোপাল ভৌমিক, নারায়ণ চৌধুরী, সন্তোষকুমার ঘোষ, যুগ্মসম্পাদক অনিল চক্রবর্তী, সংগঠন সম্পাদক আনন্দগোপাল সেনগুপ্ত। প্রসঙ্গত, কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট দলের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে যুক্ত কয়েকজন এই সাহিত্যকেন্দ্র গড়ে ওঠার পেছনে কাজ করলেও সেই রাজনীতির প্রচারে এই সংগঠনটি ব্যবহৃত হয়নি।
ক্লিন্টন লিখছেন সমকালীন সাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য হওয়ার অর্থ ছিল নির্জনতম একান্তচারী এই কবির কোনো রাজনৈতিক ব্যাপারে ঘনিষ্ঠ হয়ে সক্রিয় ভূমিকাগ্রহণ করা। জীবনানন্দ নিশ্চয়ই ১৯৫০ সালে সমাজতান্ত্রিক পার্টি কিংবা সমাজতন্ত্রের আগ্রহী সমর্থক হয়ে যাননি। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের পত্রিকায় লিখতেন। যেমন ১৯৫০ সালের অক্টোবরে তার কবিতা ‘আজ’ (এই শিরোনামে তিনি চারটি কবিতা লিখেছিলেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ শিরোনামেতার কবিতার সংখ্যা ৫) ছাপা হয় নির্ণয় নামে একটি পত্রিকায়। এটি ছিল পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কিত। তার অর্থ এই নয় যে, জীবনানন্দ কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। বরং তিনি এখানে লিখেছিলেন এর সম্পাদক অমিয়কুমার গঙ্গোপাধ্যায়কে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন বলে।
প্রসঙ্গত, দ্বন্দ্ব পত্রিকার তিন-চারটি সংখ্যা প্রকাশের পর তিন সম্পাদকের মধ্যে দুজনই কলকাতা ছাড়েন। আবু সয়ীদ আইয়ুব যান শান্তিনিকেতনে আর জীবনানন্দ দাশ কলকাতা থেকে ৭৫ মাইল দূরে মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুরে। অর্থাৎ এই পত্রিকার সঙ্গেও তার সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।