পছন্দপতন!
৩০ মে ২০১৯ ২২:২২
মানুষের জীবনে নানা কারণে বা অকারণে ‘ছন্দপতন’ হয়। আমাদের ক্ষেত্রে প্রায়ই যা হয়, সেটা পছন্দপতন!
আমরা, মানে আমি আর আমার সাবেক প্রেমিকা ও বর্তমানে বউ, মিতা পরস্পরকে পছন্দ করে বিয়ে করেছি। তাই সংসারে যত ক্যাও-ম্যাওই হোক তৃতীয় কাউকে দোষারোপ করতে পারি না। (স্যাড ইমো!)
মনে পড়ে, বিয়ের প্রথম বর্ষপূর্তির দিন বিকালে, অফিস শেষে, মাথার ঘাম পায়ে এবং মানিব্যাগের টাকা মিরপুর বেনারশী পল্লীতে ফেলে, ঘুরে ঘুরে একটা শাড়ি কিনেছিলাম (শাড়ি পছন্দ করতে গিয়ে মাথাটাই ঘুরে উঠেছিল কয়েকবার)। টকটকে হলুদ শাড়ি। লাল পাড়। রাতে বাসায় ফিরে কলিংবেল দেওয়ার পর দরজা খুলতেই, নাটক-সিনেমার বিবাহিত নায়কের মতো ‘সা-র-প্রা-ই-জ…’ বলে মিতার হাতে শাড়ির প্যাকেটটি দিলাম। আনন্দে ঝলমল করতে করতে সে ঝটপট প্যাকেটটি খুলল। দেখলাম, শুধু বিদ্যুত-লাইনেই নয়, চেহারায়ও কীভাবে ঝট করে লোডশেডিং হতে পারে। শাড়িটা আমার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে মিতা বলল, ‘এইটা কী আনছো? এইটা ক্যামন রঙ? এহ্! হিমু হইছে। তোমার পছন্দ পুরাই ক্ষ্যাতমার্কা।’ (অ্যাংরি ইমো!)
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘একদম ঠিক বলেছ, না হলে কি দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে তোমাকে পছন্দ করে বিয়ে করতাম?’ (লাভ ইমো!)
এরপর থেকে মিতা আমার পছন্দ-বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করে না। (হাহা ইমো!)
তবে মন্তব্য থামলেও গন্তব্য চেনা এবং নির্ধারিত। সেটা টিটকারির; উপহাসের।
তাই বিয়ের বছর না-গড়াতেই পছন্দ নিয়ে দ্বন্দ্ব বাধলেই সেটা বন্ধ হওয়ার বদলে গোপন ষড়যন্ত্রের গন্ধ ছড়ায়। এভাবেই চলছে। মনে হয় চলবেও…!
কথায় বলে, অহংকার পতনের মূল। মিতার কাছে আমি হয়ে উঠলাম : প-ছন্দপতনের মূল!
অবাক কাণ্ড!
২.
‘পছন্দ’ শব্দটা নিয়ে টানা-হ্যাচড়ার শুরু মিতার সঙ্গে পরিচয়ের প্রায় দেড় বছর পর। আমরা তখন ‘প্রেম হয়-হয়’ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু দুজনেরই ‘বলতে পারি না মুখে তওবা তওবা…’ অবস্থা। কথার চেয়ে এসএমএস চালাচালিই হতো বেশি।
একদিন লিখলাম : মিতা, তুমি কি আমাকে পছন্দ করো?
উত্তর এলো : !
আমি লিখলাম : আশ্চর্যবোধক চিহ্ন পাঠাচ্ছ ক্যানো? মোবাইলে টাকা নেই? বিরাম চিহ্ন পাঠালে কি টাকা কম কাটে?
উত্তর এলো : ?
আমি লিখলাম : প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্নবোধক চিহ্ন পাঠাচ্ছ ক্যানো? তোমার কি আগামীকাল বাংলা ব্যাকরণ পরীক্ষা-টরীক্ষা আছে?
উত্তর এলো : .
আমার ধৈর্য্যরে বাধ ভেঙে খানখান হয়ে গেল। লম্বা একটা শ্বাস নিলাম। ওর পাঠানো অবিরাম বিরাম চিহ্নের কবল থেকে বাঁচতে দিলাম ফোন।
বললাম : এসব কী?
উত্তর এলো : হুঁ…
খাইছে! এখন দেখি কথার মধ্যে ‘বিরাম শব্দ’ ব্যবহার শুরু করেছে। এ তো সাড়ে সাংঘাতিক ব্যাপার।
বললাম : শোনো মেয়ে, তুমি আমাকে পছন্দ করো কি না স্পষ্ট করে বলো। স্পষ্টভাষী শত্রু নির্বাক মিত্র অপেক্ষা উত্তম…। তুমি উত্তম তা-ই বলিয়া আমি অধম না হইব ক্যানো…। অধম নিশ্চিন্তে চলে মধ্যমের সাথে, সে-ই উত্তম যে চলে তফাতে…
উত্তর এলো : হা হা… হি হি…
ওর হাসি শুনে আমার সম্বিত ফিরল। গড়বড় করে উল্টা-পাল্টা কী সব বলছি। হালকা লজ্জা লাগল। লজ্জা পাওয়ার দৃশ্য মোবাইল ফোনের ওপাশ থেকে দেখা যায় না ভাগ্যিস!
বললাম : শোনো, তোমাকে বিষয়টা আরও সহজ করে দিচ্ছি। তুমি যদি আমাকে পছন্দ করো তাহলে ‘তুমি’ সম্বোধন করে একটা বাক্য লিখে এসএমএস পাঠাও। আর যদি পছন্দ না করো, বরাবরের মতো ‘আপনি’ সম্বোধন করেই একটা বাক্য লিখে পাঠাও।
এই বলে লাইন কাটলাম। মাথাটা ‘কানামাছি ভোঁ-ভোঁ’ করে ঘুরছে। দুই কান দিয়ে রীতিমতো গরম ভাপ বেরোচ্ছে যেন। উফ্, এমন ক্যানো হয়? আগে তো হয়নি কখনো…।
টুং করে শব্দ হলো। এসএমএস এসেছে। পড়ে আমি তব্দা খেয়ে গেলাম।
মিতা লিখেছে : তুমি কেমন আছেন?
সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটা নিয়ে বাথরুমে গেলাম। উদ্দেশ্য বালতি-ভর্তি পানিতে মোবাইলটা ডুবিয়ে দেব। কিন্তু তাতে সমাধান মিলবে না বুঝতে পেরে মাথাটাই বালতিতে ডুবালাম। একটু ঠাণ্ডা হলো। মিনিট দশেক ভাবলাম বিষয়টা নিয়ে। নতুন একটা বুদ্ধিও পেলাম।
মিতাকে এসএমএস পাঠালাম : আচ্ছা, তুমি যদি আমাকে পছন্দ না করো তাহলে শুধু এসএমএসে লিখে পাঠাও : ১৩। আর যদি পছন্দ করো তাহলে লেখো : ৭।
প্রায় ৪৫ মিনিট পর এসএমএস এলো। লেখা : ২০!
মিতার বুদ্ধির প্যাঁচে পড়ে আমি জিলাপি ইংরেজি ভুলে গেলাম। আর জিলাপিতে যে আড়াই প্যাঁচ থাকে ভুলে গেলাম সেটাও!
এই মেয়েকে পছন্দ না করে উপায় আছে?
অতএব মিতার সঙ্গে সংসারে মিতালি পাতালাম।
কীভাবে? সে আরেক প্যাঁচালো গল্প। আজ থাক।
৩.
সংসার-জীবনে ঢোকার পর মিতার কথার প্যাঁচ খুলে গেল। সে এখন ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কোনো কথা বলে না। কিছু পছন্দ না হলে ডাইরেক্ট অ্যাকশন!
আমার বন্ধু শাহীনের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। খোঁজ দ্য সার্চ কমিটির আহ্বায়ক মিতা। আমি যুগ্ম-আহ্বায়ক।
পাত্রী পছন্দ করতে গিয়ে আহ্বায়ক আর যুগ্ম-আহ্বায়কের মধ্যকার সম্পর্ক ক্রমশ ঘুর্ণিঝড়ে রূপ নিতে থাকে।
কলাবাগানে এক পাত্রী দেখতে গেলাম। পাশে থাকা মিতাকে ফিসফিসিয়ে বলি, বাহ, মেয়েটা তো দারুণ কিউট! এ-রকম মেয়ে আমি আগে কখনো দেখিনি। আমার পছন্দ হয়েছে!
মিতা আমার দিকে শীতল চোখে তাকায়। গলা নামিয়ে বলে কি! আগে কখনো দেখো নি? তাহলে আমাকে যে ঠিক এই কথাগুলোই বলতে? মিথ্যাবাদী…
দ্রুত আমরা পাত্রীপক্ষের বাড়ি থেকে প্রস্থান করি। বাসায় এসে ‘ধরি মাছ না-ছুঁই পানি’ স্টাইলে আমাদের কথোপকথন চলতে থাকে।
যেমন, আমি বলি মোজাগুলো খুঁজে পাচ্ছি না, কেউ কি দেখেছে?
কিংবা, মিতা বলে চিনি শেষ হয়ে গেছে। অফিস থেকে ফেরার সময় যেন দুই কেজি চিনি নিয়ে আসা হয়।
এভাবেই, দিন কয়েক ভাববাচ্যে অভাবের সংসার চলল আমাদের।
পরবর্তী সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ঘটকের দেওয়া ঠিকানায় আরেক পাত্রী দেখতে যাই। মিরপুরে। এই পাত্রীটাও আমার পছন্দ হয়। এমবিএ করা এই মেয়েকেই শাহীনকে বিয়ে করাব মনে মনে পণ করি। কিন্তু আমার পছন্দ তো মিতার পতনের কারণ! অতএব, আঙুল বাঁকা করলাম। পাত্রীদের বাড়ির ড্রইংরুম থেকে মিতাকে পাশের রুমে ডেকে নিলাম।
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললাম, ‘আসা-যাওয়ার ভাড়া আর ফল-মিষ্টির টাকা নষ্ট হয়েছে হোক, মূল্যবান সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। চলো চলো, এই মেয়ে আমার একদমই পছন্দ হয় নি। খাটো। গায়ের রংও কেমন ময়লা। আর চুল দেখেছো, মনে হয় এই বাড়িতে কখনো চিরুনি অভিযান হয় না…!’ ব্যস, বিরোধী দল মানে মিতা সঙ্গে সঙ্গে রাজি, যে করেই হোক এই পাত্রীকেই সে বানাবে ভাবী।
‘শোনো, আমি শাহীন ভাইয়ের জন্য মনে মনে ঠিক এ-রকম একজন মেয়েই খুঁজছিলাম। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এটাই ফাইনাল। তুমি কথা পাকা করে ফেলো। শাহীন ভাইকে আমি ম্যানেজ করব।’
আহ্বায়কের পছন্দের পর যুগ্ম-আহ্বায়কের কথা থাকতে পারে না। আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘ওকে, তোমার পছন্দই আমার পছন্দ!’
৪.
ধুমধামের সঙ্গে শাহীন-সুজানার বিয়ে হয়ে গেল। ধুমধাম এত বেশিই হয়েছিল যে, বিয়ের তিন মাস যেতে না-যেতেই তাদের সংসারে ধুম-ধাড়াক্কা শুরু হয়ে যায়।
বিয়ের পর থেকে শাহীন ও সুজানা দুজনেই ফেইসবুকে আমার ছবি, স্ট্যাটাসে নিয়মিত লাইক দিত। এখন শাহীন নিয়ম করে দিনে তিন বেলা আমাকে ফোন দেয়। বলে, ‘দোস্ত, তোদের ওপর কত ভরসা করেছিলাম। অথচ তুই আর ভাবী মিলে এ কোন না-পছন্দওয়ালীকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলি…।’
প্রথম দিকে আমি শাহীনের কথাগুলো হেসে উড়িয়ে দিতাম। বলতাম, ‘আরে, ব্যাপার না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। মানিয়ে নেওয়ার জন্য তো একটু সময় লাগে, নাকি?’
শাহীন হুঁ-হ্যাঁ কিছুই বলতো না। একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে মোবাইলের লাইন কেটে দিতো। ইদানীং সে ফোন দিয়ে বলে, ‘দোস্ত, বছর পার হয়ে গেল। কিছুই তো ঠিক হয় নাই। আমার কোনো কিছুই সুজানার পছন্দ না। সংসারে আমি যেন যত দোষ শাহীন বোস!’
শাহীনের কথা শুনে এখন আমি নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। মনে মনে বলি, তুই তাও তৃতীয় পক্ষকে দোষারোপ করতে পারছিস, আমার তো সে সুযোগও নেই বন্ধু।
এখন ফেইসবুকে শাহীনের ছবি-স্ট্যাটাস দেখলেই আমি দ্রুত এড়িয়ে যাই। লাইক করি না। শাহীনও যে আমাকে এড়িয়ে যায় সেটা বুঝতে পারি সহজেই।
এভাবেই স্ত্রীগণের পছন্দপতনের লাইন ধরে শাহীন আর আমার মধ্যে লাইক-পতন হলো। কে জানে, সেটা বন্ধুত্ব-পতন পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে কি না! (একটা আনলাইক ইমোর দরকার ছিল খুউব!)