Tuesday 06 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: একটি সাক্ষাৎকার ও কিছু কথা

সোহেল রহমান
৬ মে ২০২৫ ১৩:৫৭

ঠিক কবে থেকে সুনীলদা’র লেখার ভক্ত হয়ে গেলাম, আজ আর ঠিক তা মনে পড়ে না। সম্ভবত সেটা আশির দশকের মাঝামাঝি আমার কলেজে পড়ার সময় থেকে হবে।

উপন্যাস পড়ার ঝোঁক ছিল খুব। খুব দ্রুতই পড়ে ফেললাম সুনীলের আলোচিত বইগুলো।

সম্ভবত ১৯৮৭ সালের দিকে সুনীল তার ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখতে থাকেন। ‘দেশ’ তখন সাপ্তাহিক ছিল। দেশ বিভাগ থেকে শুরু করে তৎকালীন দুই বাংলার মানুষের জীবন ও সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং রাজনৈতিক ঘটনাবলী ও চরিত্র ছিল বিশাল এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। উপন্যাসটির দ্বিতীয় খণ্ডের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাঙালিদের কথা। তো উপন্যাসটির প্রতিটি পর্ব পড়ার জন্য হা করে বসে থাকতাম কখন দেশ-এর নতুন সংখ্যা ঢাকায় আসবে।

১৯৯০ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ‘বাংলা সাহিত্য সম্মেলন’-এ সুনীল প্রথম বলেন, ‘আগামীতে ঢাকা-ই হবে বাংলা সাহিত্যের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু’। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি এখানকার সাহিত্য নিয়ে অনেক উচ্চাশাও পোষণ করেন তিনি।

তার এ বক্তব্যের পর দেখলাম, ঢাকার যেসব কাগজ কলকাতার লেখকদের সুযোগ পেলেই তুলোধুনো করতো, তারাও বেশ ফলাও করে এ নিয়ে উপ-সম্পাদকীয় লিখছে।

এমনিতেই আমি সুনীলদা’র লেখার ভক্ত, এর ওপর বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে তার বিভিন্ন আন্তরিকতাপূর্ণ মন্তব্য ও লেখার মাধ্যমে আমার অনেক কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন তিনি। এর অনেক পর সাংবাদিকতা পেশায় যখন এলাম, তখন থেকেই সুনীলদা’র একটা ইন্টারভিউ নেওয়ার একটা ইচ্ছে মনের ভেতর যেন গেঁথে গেল।

বিজ্ঞাপন

সালটা ১৯৯৮ না ’৯৯ ঠিক মনে পড়ছে না। আমাদের কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন (২৩ অক্টোবর) উপলক্ষে ঢাকায় এসেছিলেন সুনীল। সুনীল ও শামসুর রাহমান দুজনেই পরস্পরের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। সেবারই প্রথম ঘটা করে টিএসসি মিলনায়তনে শামসুর রাহমানের জন্মদিন পালন করা হয়। আমি তখন ‘দৈনিক প্রভাত’ নামক একটি পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি। শামসুর রাহমানের জন্মদিনের অনুষ্ঠানটি কভার করার দায়িত্ব আমার ওপরেই পড়েছিল।

অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন মঞ্চ থেকে নামছিলেন, আমি তখন একদৌঁড়ে সুনীলদা’র কাছে গিয়ে বললাম, ‘সুনীলদা আমি আপনার একটি ইন্টারভিউ করতে চাই’।

আমি ভাবছিলাম, হয়তো তিনি রাজি হবেন না। আবার তিনি চাইলেও আয়োজকরা বাগড়া দিতে পারে। এ দোটানার ভেতর সুনীলদা’ মুহুর্তের জন্য আমার মুখের দিকে একবার তাকালেন। তারপর বললেন, ‘বেশ তো, কী নাম তোমার পত্রিকার?’

আমি বললাম, ‘দৈনিক প্রভাত। চরমপত্র খ্যাত এম আর আখতার মুকুল ভাই আমাদের পত্রিকার সম্পাদক।’

সুনীলদা বললেন, ‘তাই নাকি? বেশ তো।’

আমি বললাম, ‘তাহলে দাদা, কখন কোথায় আসবো?

তিনি বললেন, ‘কাল ভোরেই চলে এসো ৬টার দিকে। আমি হোয়াইট হাউজ হোটেলে উঠেছি।’

এত সহজেই সুনীলদা’র ইন্টারভিউ করার সুযোগ পাবো ভাবি নি। কীভাবে শুরু করবো, কী কী প্রশ্ন করবো, এসব চিন্তায় ঘুম এলো না সারারাত। মনে হচ্ছিল, একটা দিন সময় পেলে বিষয়গুলো একটু গুছিয়ে নিতে পারতাম।

যাহোক, ঢাকা-কলকাতার বহু পত্রিকায় সুনীলদা এ পর্যন্ত বহু সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় আমি একটা বিষয়টা মাথায় রেখেছিলাম, সেটা হচ্ছে- আগে একাধিকবার উত্তর দিয়েছেন, এমন প্রশ্ন যতটা সম্ভব এড়িয়ে তার কাছ থেকে নতুন কিছু বের করা যায় কি না।

বিজ্ঞাপন

সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে

সকালে ৬টার একটু আগেই শান্তিনগরের ‘হোয়াইট হাউজ’ হোটেলে পৌঁছুলাম। রাতেই একটি রেকর্ডার যোগাড় করে রেখেছিলাম। আমার সঙ্গে সাহিত্যপ্রেমী আমার একজন বাল্যবন্ধুও ছিল।

হোটেলে পৌঁছে রিসিপশনে বলতেই তারা ইন্টারকমে সুনীলদা’র সঙ্গে কথা বলার পর আমাকে বললো, আপনি বসুন উনি আসছেন। হোটেল লবির সোফায় বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচে নেমে এলেন সুনীলদা। আমাদের তিনজনকে চা দেওয়া হলো। চায়ের চুমুকের ফাঁকে ফাঁকেই আমাদের কথা শুরু হলো। ঠিক সাক্ষাৎকার নয়, অনেকটা আলাপচারিতা বলা যায়।

কথাপ্রসঙ্গে সুনীল জানান, তরুণ বয়সে পাশের বাড়ির একটি মেয়েকে ভালবেসেছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে কিছুতেই তার ভালবাসার কথা বলতে পারছিলেন না। পরে সেই মেয়েটিকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেন তিনি। মেয়েটিদের বাসায় ‘দেশ’ পত্রিকা রাখা হতো। সুনীল তার কবিতাটি ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন এবং একদিন ছাপাও হয় কবিতাটি।

তিনি বলেন, “তখন ‘দেশ’ পত্রিকায় মাঝে মাঝে একদম নতুনদের লেখা ছাপা হতো। সে হিসেবে লেখাটি তখন ছাপা হয়েছিল।” হাসতে হাসতে তিনি বলেন, “কিন্তু কবিতা ছাপা হলে কী হবে? মেয়েটি তখন কিছুতেই বিশ্বাস করেনি যে, এটি আমার লেখা কবিতা। সে বলতো, এ নামের অন্য কেউ এ কবিতাটি লিখেছে।”

সুনীল বলেন, “আমি লেখক কিংবা কবি হওয়ার পেছনে ওই মেয়েটির কাছে ঋণী। সে কবিতা পছন্দ করতো বলেই আমি কবিতা লিখেছিলাম। সে যদি খেলাধূলা বা অন্যকিছু পছন্দ করতো, তাহলে আমি হয়তো তা-ই হতে চাইতাম।”

‘এ মেয়েটিই কি আপনার কবিতার নীরা’- জানতে চাইলে হ্যাঁ সূচক জবাব দেন সুনীল। তবে মেয়েটির প্রকৃত নাম বা পরিচয় তিনি কখনোই প্রকাশ করেন নি।

সাক্ষাৎকারের শেষ দিকে আমি সুনীলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম ‘নীরার বিষয়ে তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় কখনো ঈর্ষা বোধ করেন কি না?’

এ ধরনের প্রশ্নের জন্য আমার মনে হয়েছে যে, তিনি আদৌ প্রস্তত ছিলেন না। একটু অপ্রস্তত ভঙ্গিতে কিছুটা থমকে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “আরে স্বাতী তো তাকে কখনো দেখেইনি, দেখলে নিশ্চই আপত্তি করতো।” কথাটা বলেই হাসতে লাগলেন তিনি।

কথা বলতে বলতে কখন যে ৮টা বেজে গেছে বলতে পারবো না। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সুনীলদা আমাকে বারবার বলছিলেন ‘তুমি আমার সম্পর্কে এতো জানো!’

বলতে দ্বিধা নেই যে, তার এ কথাটা আমার খুব ভাল লেগেছিল।

ইতোমধ্যে হোটেল ম্যানেজার থেকে শুরু করে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী আমাদের ঘিরে ফেলেছে। তারা আমার ও সুনীলদা’র কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। এর মধ্যে বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকরা এসে পড়েছেন। আমি দেখলাম যে, আমার ও সুনীলদা’র কথোপকথন তারাও টুকছে। অগত্যা আমি শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। ফেরার সময় সুনীলদা’কে বেশ উৎফুল্লই লাগছিল।

সাক্ষাৎকার ছাপাতে গিয়ে বিপত্তি

আমার খুব ইচ্ছে ছিল সুনীলদা’র এ সাক্ষাৎকারটি ‘দৈনিক মুক্তকন্ঠে’ ছাপা হোক। শুরুতে এর প্রকাশক ছিল বেক্সিমকো মিডিয়া লিমিটেড এবং সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক কেজি মুস্তফা (বর্তমানে প্রয়াত)। মুক্তকন্ঠের সাহিত্য সাময়িকী ‘খোলা জানালা’ তখন ছিল খুবই জনপ্রিয় ও আলোচিত। আমার বিশ্বাস ছিল যে, এরকম একটি সাক্ষাৎকার পত্রিকাটি অবশ্যই ছাপবে। তো অনেক যত্ন করে সাক্ষাৎকারটি লিখে সেটা নিয়ে গেলাম কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের কাছে। তিনি ছিলেন মুক্তকন্ঠের সাহিত্য সম্পাদক। সাক্ষাৎকারের কথাটা শুনে তিনি না দেখে এবং না পড়েই ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘সুনীলের সাক্ষাৎকার আমরা ছাপবো না।’

অগত্যা গেলাম একই মালিকানাধীন সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক পাক্ষিক ম্যাগাজিন ‘শৈলী’ সম্পাদক কবি কায়সুল হক (বর্তমানে প্রয়াত) এর কাছে। কায়সুল হক সাক্ষাৎকারটি বেশ পছন্দ করলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন, অনেকটা সময় কথা হলো। বেশকিছু প্রশ্নও করলেন আমাকে। পরে বললেন, ‘ঠিক আছে আমি রাখছি। দেখি আগামী কোনো সংখ্যায় দেওয়া যায় কি না।’

দিন দুয়েক পর কায়সুল হক আমাকে ফোন করে ডাকলেন। যাওয়ার পর বললেন যে, শৈলীতে এটি ছাপা হতে বেশ দেরি হবে। ততোদিনে এর আমেজটা থাকবে না। ভালো হয় যদি অন্য কোথাও দ্রুত এটা ছাপানো যায়।

এতটা আগ্রহ দেখিয়েও না ছাপানোর কারণের বিষয়ে পরে আমার যেটা মনে হয়েছে, আমার কাছে সাক্ষাৎকার গ্রহণকালের কোনো ছবি ছিল না। শুধু ভয়েস রেকর্ডটা ছিল। অন্যদিকে ছবির জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছিলেন কায়সুল হক। তবে তার যুক্তিটাও কিন্তু সঠিক। হয়তো শৈলী-তে বিভিন্ন ধরণের লেখার চাপ ছিল ওই সময়। পত্রিকার নিজস্ব পরিকল্পনার বাইরে এ রকম একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার … তা-ও একজন নবিশ সাংবাদিকের নেওয়া।

এরপর টেলিফোনে কথা বললাম, ‘পাক্ষিক’ অন্যদিন ম্যাগাজিনে কর্মরত সে সময়ের সদ্য আলোচিত সাহিত্যিক নাসরীন জাহানের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমি এ বিষয়টি দেখি না।’ স্মৃতি হাতরে যতদূর মনে পড়ে, বিষয়টি নিয়ে তিনি আমাকে কথা সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমি আর যোগাযোগ করিনি।

কোথাও ছাপা হওয়ার আশা যখন প্রায় নিভু নিভু, তখন আমার একজন সহকর্মী সাংবাদিক রাশেদ হোসেন (বর্তমানে প্রয়াত) আমাকে পাঠালেন ইত্তেফাক গ্রুপের পাক্ষিক ম্যাগাজিন ‘অনন্যা’র তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক দিল মনোয়ারা মনু (বর্তমানে প্রয়াত) এর কাছে। অবশেষে সাক্ষাৎকারটি ছাপা হলো সেখানে।

লেখক: সাংবাদিক

সারাবাংলা/এএসজি

প্রবন্ধ সাক্ষাৎকার সাহিত্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সোহেল রহমান