Wednesday 15 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হাসান হাফিজ: কবিতার শাহজাদা

গাউসুর রহমান
১৫ অক্টোবর ২০২৫ ১৯:০৮ | আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৫ ১৯:২৫

তিনি আমাদের কবিতার শাহজাদা। হাসান হাফিজ তাঁর নাম। সমকালীন বাংলাদেশের প্রধান শরিদের একজন। দশকওয়ারি বিভাজনে তিনি সত্তর দশকের কবি। এই কবির চেতনা অভিজ্ঞতা থেকে অভিজ্ঞানে, অনুভব থেকে অনুভাবে পৌঁছায়। এই কবিতায় চেতনায় আছে মানবধর্মের জাগরণ, আছে ইতিবাচক প্রত্যয়। এই ইতিবাচক প্রত্যয়ই তাঁর কবিতার শুভ্র অনুষঙ্গ, লাবণ্যের দীপ্তি, প্রাণের উজ্জ্বলতা। বিশ্ববিভুর অনুরাগের বৈচিত্র্যময় লীলা আছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় রয়েছে আকরিক বর্তমানতা, সত্য, সুন্দর, কল্যাণ আকাঙ্ক্ষা। তিনি সন্নিহিত হয়েছেন স্বচ্ছ চৈতন্যের আয়নায়। মানুষের ধমনীতে প্রবাহিত ক্ষিপ্রতা এবং পঙ্ককে তিনিও মনে করতে চান ‘The lion and virgin’ বলে। স্বচ্ছ চৈতন্যের আয়নায় প্রতিফলিত যে কবিতা, তা যেন ‘becoming, and gaunter seeking greater hardness of outline.’ দ্বন্দ্বের চেহারাকে তিনি শুদ্ধতায়, ভাবাবেগবর্জিত স্পষ্টতায় দেখাতে চেয়েছেন কবিতায়।

বিজ্ঞাপন

প্রেম ও রোমান্সে হাসান হাফিজ স্থূল বা উন্মত্ত নন। এক্ষেত্রে তিনি অনেকটাই লাজুক নম্র, মধুর স্বপ্নে নিমজ্জিত। হার্দ্য প্রেমই তাঁর কাম্য। তিনি রোমান্টিক স্বপ্নপ্রয়াণের কবি । পিউরিটান কবি নন কিছুতেই। তাঁর প্রেমের কবিতা গড়ে উঠেছে রক্ত-মাংসের সংরাগসহ। বিরহ, বিচ্ছেদের তীব্র বেদনার চাপে তিনি আক্রান্ত। প্রেমের ক্ষেত্রে লিবিডোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও তিনি সচেতন। বেদনাবোধের অনিবার্য অগ্রাস তাঁর কবিতাকে করেছে তীর-তীব্র বেদনার অমোঘ আলোড়ন।

ইন্দ্রিয় সংবেদনের মধ্য দিয়ে হাসান হাফিজের প্রস্বর মাঝে-মধ্যে জেগে ওঠে। তখন তাঁর কবিতা স্বাভাবিক ভাবেই হয়ে যায় জীবনচর্যার সংকেতলেখ, তন্নিষ্ঠতাই তখন কবিতার জন্যে পুঁজি হয়ে ওঠে। তাঁর কবিসত্তা তখন জায়মান হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি তখন আতৃজাগৃতির প্রদিক্ষণময়তায় অভাবনীয়ভাবে গতিশীল, বিচিত্র ও বহু বর্নিল হয়ে ওঠেন।

জৈবনিক অসঙ্গতি ও অনিশ্চিতির বিষাদ, কালসন্ধির সংস্পর্শ, কালচক্রে প্রোথিত মানব জীবনলীলার নিত্যতা, সমাজ ও স্বদেশের অভিযাত্রায় অগ্নিসংস্কার, ক্রান্তিকালের পরিপ্রেক্ষিত হাসান হাফিজের কবিতায় কথা বলে ওঠে। বিরুদ্ধতার বিপরীত এক আশ্চর্যজগতের বোধে হাসান হাফিজের কাব্যিক স্বরগ্রাম অস্থিরতায়, চাঞ্চল্যে ক্ষুব্ধ। কিন্তু কোনো ভাবেই বিক্ষিপ্ত নয়। তাঁর কিছু কিছু কবিতায় স্মৃতির আকর হিসেবে আর্কেটাইপের অন্তলীন তাৎপর্য চোখে পড়ে। সামাজিক অস্তিত্বের অর্থহীনতা (meaninglessness), বিচ্ছিন্নতা (alienation), মানব অস্তিত্বের হতাশা নঞর্থকতা (existential despair and absurdity),আত্মবিরোধ (conflict) প্রকাশে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হাসান হাফিজ।

সময় ও সমাজের বৈরী এবং নষ্ট পরিবেশে ব্যর্থ মানুষের অন্তর্গত ট্র্যাজেডি উন্মোচন- হাসান হাফিজের আরাধ্য। পাখার জ্বালায় মৈনাক যেমন জলে আত্মগোপন করে, কবিও তেমনি মন ও মস্তিষ্কের, হৃদয়ের চিকিৎসাহীন যন্ত্রণায় বিক্ষুব্ধ স্বদেশে নিজের অস্তিত্ব যেন গোপন করতে চান।

স্বদেশ সাধনা, জীবন সাধনা ও প্রণয়-সাধনার তেমাথায় দাঁড়িয়ে হাসান হাফিজের কবিতা। তাঁর মানসলোকের ভিত্তিভূমিতে অবস্থিত ঐতিহ্যের ও গৌরবের প্রত্নপ্রতিমাসমূহ (archetype) দাঁড়িয়ে থাকে। এর মধ্য দিয়ে তাঁর আত্মআবিষ্কার স্পৃহা হয়ে ওঠে হার্দিক ও বাসনামদির। সামাজিক ক্ষমতার উৎসসমূহ অনুসন্ধান করে, কবিতায় তিনি আত্মহনন, আত্মখনন ও আত্ম-উন্মোচনে বেদনার্ত হয়েছেন, রক্তাক্ত ও অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেন।

জীবন সংগ্রামের দুরন্ত ঢেউ হাসান হাফিজের কবিতায় শক্তিপ্রাণতায় অন্বিত হয়েছে। ব্যক্তির নিজস্ব বস্তু-বিশ্ব, পরিপার্শ্বকে জয় বা নিয়ন্ত্রণের অসহায়ত্ব, তাপদগ্ধ হৃদয়ার্তির ভয় ও ভাষা পেয়েছে তাঁর কবিতায়। জীবন জয়ের অভিলাষ প্রত্যয়ীভূত হয় হাসান হাফিজের কবিতায়। মানুষকে তিনি আলোকতীর্থের পথিক হিসেবেই বিবেচনা করেন।অন্ধকার ও আলো তাঁর চেতনায় বিচিত্র দ্যোতনায় স্পন্দিত। অগ্নিসংস্কারের মতো আধুনিকতাকে তিনি নিজের সত্তায় ও সম্ভাবনায় বিশুদ্ধ করে নিয়েছেন। মানুষের মন ও তিনি স্মৃতিকে বৃহৎচিত্ত এবং একটি সুবিপুল স্মৃতির অংশস্বরূপ বিবেচনা করেছেন এই কবি।

আত্মআবিষ্কারের প্রয়োজনে, নিজের মনের অনেক গভীরে নেমে যান হাসান হাফিজ। মাটি খুঁড়ে পৌঁছে যান সেই গহনে, যেখানে থরে থরে সাজানো আছে অভিজ্ঞতা- যেখানে ভাব বা চিন্তার সঙ্গে ভাষার, ভাষার সঙ্গে ছন্দের, ছন্দের সঙ্গে অর্থের একটি সাযুজ্য আবিষ্কার- সেখানে কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। প্রগাঢ়তম উপলব্ধিতে হাসান হাফিজের পাঠক যখন বোধের আয়ত্তে আনেন, তখন পাঠক অনুধাবন করতে সক্ষম হন যে, তাঁদের অনুভূতি নতুন চেহারায় জারিত হয়েছে। তাঁর কবিতায় উদযাপান কিংবা শব্দের সীমাবদ্ধতা নেই।

হাসান হাফিজ কবিতায় একটি মৌলিক উপলব্ধির, একটি মৌলিক ধারণার বা চেতনার উন্মোচন করেছেন। তিনি জানেন যে, বোধের সামগ্রিকতা একটি পূর্ণ উপলব্ধিকে নির্মাণ করে। বোধের করতলে মজ্জাগত স্বয়ংসম্পূর্ণতায়, পূর্ণতায় যা প্রকাশ পায়; তা সমষ্টিগত চৈতন্যকে শাণিত করলেও এর স্বাতন্ত্র‍্য আবিষ্কারও স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব।

দৃষ্টিগ্রাহ্যতায় কবিতার চিত্রকল্প নির্মাণ করেন হাসান হাফিজ। ভাবানুভূতি ও ইন্দ্রিয়বৃত্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি কাব্যে , শব্দ, অলংকার ও দৃশ্যপট রচনা করেন। রূপকের মাধ্যমে জীবনের অনুভূতি প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তিনি পূর্বাপর সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। কবি যে সময়ে বসবাস করেন, সে সময়ের ইতিহাসেও আক্রান্ত হন তিনি।

জীবন, সত্য, অস্তিত্ব, চৈতন্য হাসান হাফিজের কবিতায় মানুষের যন্ত্রণা ও মহত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে। পাশাপাশি মহিমান্বিত স্বপ্ন তাঁর কবিতায় বিশেষ তাৎপর্য লাভ করেছে। তাঁর কবিতায় স্বপ্ন, সৌন্দর্য, প্রেম-কল্পনামন্ডিত। জ্যোতিকণার মতো সঙ্গোপনে তাঁর কবিতায় স্বপ্ন এসে হাজির হয়। অন্ধকার ও বিষাদ তাঁর কবিতায় বিশেষ বোধ সঞ্চারিত করে।

মোহমুক্ত, স্থির, অচলপ্রেমে বিশ্বাসী নন হাসান হাফিজ। রূপ-লাবণ্যের স্থাবকতায় বুদ্ধির চেয়ে হৃদয়ের ভূমিকাই প্রবল। এ সত্যটি কবি তাঁর কবিসত্তা দিয়েই অনুভব করেন। তিনি জানেন যে, হৃদয়ের অটল বেদীর উপরই কবিতা দাঁড়িয়ে থাকে। বাহির কোনোভাবেই ভিতরকে পরাজিত করতে পারে না।

প্রেমিকার প্রণয়িনী, প্রেয়সী, উর্বশী, লক্ষ্মীমূর্তি-এমন কি তার দেবীমহিমাও বাদ যায় না হাফিজের কবিতায়। কোনোভাবেই মাত্রা ছাড়িয়ে যায় না ভোগবৈরাগ্য। প্রেয়সীর সৌন্দর্যের ইন্দ্রজাল, অভূতপূর্ব মহিমা ভাষা পায় তাঁর কবিতায়।

প্রেমিকার লাবণ্যদীপ্ত সত্তা ব্যক্তিত্বপূর্ণ সত্তার সঙ্গে বিরোধ বাধায় না হাসান হাফিজের কবিতায়। হৃদয়-সংসারে কর্মের যে আবেষ্টনী প্রেমিকার, তা আর্তপ্রাণের সঙ্গে ব্যতিব্যস্ত। এরই সূত্র ধরে হৃদয়ের প্রতিবিম্ব দেহের শোভায় প্রকাশ পায় হাসান হাফিজের কবিতায়।

সৌন্দর্য ও প্রেমের সহজ মিলনে পরিপূর্ণতা খুঁজেন হাসান হাফিজ। এ মিলনেই জীবন আনন্দময় ও সার্থক হয়ে ওঠে। তারপরও বঞ্চিত হৃদয়কে কাঁটার মতো বিদ্ধ করে প্রণয়িনীর মান-অভিমান, অবহেলা। প্রাণের সহজ লীলায় কঠিনের সাথে মধুর, বজ্র ও মেঘের সম্মিলিত শব্দ-নৃত্যে যে পরিবেশ রচিত হয়, তার নাম সুন্দর ভাবে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা, অনির্বচনীয় হৃদয়-ব্যঞ্জনা।

সত্তর দশক ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এক অস্থির সময়—স্বপ্নভঙ্গ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক নৈরাশ্যের কাল। এই পরিস্থিতিতে কবিতাঙ্গনে একঝাঁক তরুণ কবি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের ছাপ রাখতে শুরু করেছিলেন । এই দশকের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল দ্রোহ, উচ্চকিত রাজনৈতিক বক্তব্য, এবং প্রচলিত আঙ্গিক ভেঙে নতুন পথ তৈরির প্রচেষ্টা। অনেক কবিই তীব্র আবেগ ও সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছিলেন।

তবে, হাসান হাফিজের কাব্যস্বরে এক সুস্পষ্ট স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তাঁর সমসাময়িক অনেক কবির মতো তিনি উচ্চকিত দ্রোহের পথে যাননি। বরং তাঁর কবিতায় “প্রেম, দ্রোহ কোনোটাই উচ্চকিত নয়,” যা তাঁকে প্রকৃত কবির অভিধায় ভূষিত করেছে তাঁর পরিমিতিবোধ-এর কারণে । এই নিয়ন্ত্রণ উচ্চকিত আবেগের ব্যর্থতার গভীর উপলব্ধির ফলাফল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মের একজন কবি হিসেবে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে স্লোগান বা তীব্র আবেগের বিস্ফোরণ দীর্ঘমেয়াদী মননশীলতার পথ নয়। ফলস্বরূপ, তাঁর পরিমিতিবোধ কাব্যিকতা আসলে এক ধরনের আত্ম-সমালোচনামূলক ভঙ্গিমা, যেখানে নৈরাশ্যকে সরাসরি রাজনৈতিক স্লোগানে রূপান্তরিত না করে, বরং গভীর দার্শনিক জিজ্ঞাসা এবং নিয়ন্ত্রিত শৈলীর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ এখন যৌবন যার ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়, যা সত্তরের দশকের শেষ দিকের এই স্বরটিকে বহন করে । এই পরিমিতি তাঁর কাব্যে আবেগমথিত আহ্বানের পাশাপাশি এনেছে মনন ও কল্পনার রোমাঞ্চকর সমন্বয় ।

হাসান হাফিজের কাব্যসত্তার কেন্দ্রে রয়েছে এক সচেতন মননশীলতা এবং পরিমিতিবাদের দর্শন। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রকৃত মনের মানুষ না হলে প্রকৃত কবি হওয়া যায় না । কবির অহঙ্কার তার অন্বিষ্টের জন্য ভয়ঙ্কর হতে পারে, তাই প্রকৃত কবিকে শিষ্টাচার চর্চা করতে হয় । এই নৈতিক বিশ্বাসই তাঁর কবিতার শৈলীকে প্রভাবিত করেছে।

হাসান হাফিজ তাঁর কবিতা চর্চায় বেশ আত্মসচেতন এবং প্রচলিত তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে নিজস্ব ধারা ও আঙ্গিক চর্চায় মগ্ন থাকেন । তিনি নিবিড় অভিলাষে যেন একা জেগে আছেন কবিতার জন্য । এই কাব্যিক শৃঙ্খলা শুধুমাত্র তাঁর বহুপ্রজ লেখক হওয়ার কারণ নয়, বরং তাঁর শিল্পের গভীরতার চাবিকাঠি। পরিমিতিবোধের কারণে তাঁর দ্রোহ উচ্চকিত না হয়ে একটি স্থির, দায়িত্বশীল কণ্ঠস্বর প্রদান করে, যা সমাজের রুগ্ন বিবেক সম্পর্কে উচ্চকিত নীরবতা দান করে ।

তাঁর এই নিয়ন্ত্রণ কবির নিজস্ব জগৎ ও বাহিরের সমাজের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করে। তিনি জীবনের সঙ্গে স্বপ্নের রঙিন আলোকরশ্মি সমীকরণের নান্দনিক ব্যবহার ঘটিয়ে পাঠকচিত্তকে মুগ্ধ করেন । এই সমীকরণ কেবল চিত্রকল্পের সমাহার নয়, বরং জীবনের দ্বান্দ্বিকতাকে মেনে নিয়েও সৌন্দর্যের অনুসন্ধান। আব্দুল মান্নান সৈয়দ তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন,

“হাসান হাফিজ তাঁর কবিতার পর কবিতায় অনির্ণেয় অন্য কোনো মানে খুঁজে চলেছেন। এটাই কবিতার কাজ। কবির কাজ।”

এই অনির্ণেয় অর্থ বা অন্য মানে খোঁজার প্রক্রিয়াটিই তাঁর পরিমিতিবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, কারণ তিনি জানেন আবেগের উচ্ছ্বাস এই গভীর অনুসন্ধানের পথে বাধা হতে পারে।

হাসান হাফিজের কাব্যিক যাত্রা তিনটি স্পষ্ট পর্বে বিভক্ত, যেখানে তাঁর শৈলীর বিবর্তন লক্ষ্যণীয়-
তাঁর কাব্যিক যাত্রার শুরু হয় সত্তর দশকের শেষপ্রান্তে, যার স্ফুরণ দেখা যায় আশির দশকে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ এখন যৌবন যার প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে । এর পরে প্রকাশিত হয় অবাধ্য অর্জুন (১৯৮৬) । এই সময়ে তাঁর কবিতায় তারুণ্যস্নাত আবেগ এবং স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের দ্রোহের এক প্রাথমিক স্ফুলিঙ্গ দেখা যায়। এই দ্রোহ উচ্চকিত বা অনিয়ন্ত্রিত ছিল না, বরং তা শুরু থেকেই এক ধরনের পরিমিতিবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল । এই পর্বের কবিতায় তিনি ‘ছন্দস্নাত পঙ্‌ক্তি’ ব্যবহার করে তারুণ্যস্নাত আবেগ এবং দরদি উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন ।

৯০ এর দশকে তিনি রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর পর্যবেক্ষণকে তাঁর কাব্যে স্থান দেন। সত্তর দশকের স্বপ্নভঙ্গ নব্বই দশকে এসে গভীর সামাজিক নৈরাশ্য রূপে প্রকাশিত হয়। এই পর্বে তাঁর কবিতায় আত্মসচেতনতা ও মননশীলতার স্পষ্ট ছাপ পড়ে। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কাজগুলির মধ্যে রয়েছে অপমানে বেজে উঠি, জলরেখায় শব্দজোড়, এবং সত্যি সেলুকাস । তিনি সমাজের মূল্যবোধের পচন প্রত্যক্ষ করেন, যা তাঁর কবিতায় নৈতিক ক্ষয়ের চিত্র হিসেবে ফিরে আসে। তিনি লেখেন—’বেআব্রু অহং- রুগ্ন এক ওতপ্রোত নৈরাশায় ধুঁকছে আর লজ্জায় লুকোচ্ছে মুখ মূল্যবোধ, পচা-গলা বিশ্বের বিবেক’ ।

এই কাব্যিক যাত্রা প্রমাণ করে যে তাঁর কাব্যিক বিবর্তন হলো উচ্চকিত দ্রোহ থেকে নিয়ন্ত্রিত জিজ্ঞাসার দিকে যাত্রা।

২০০০ সালের পর থেকে তাঁর কাব্যে দার্শনিকতা এবং মননশীলতার গভীরতা পরিলক্ষিত হয়। এই পর্বের কাজগুলিতে জীবনের জটিল সমীকরণ, মৃত্যু এবং পরম্পরার ধারণা গুরুত্ব পায়। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর ৪৩তম কাব্যগ্রন্থ পিপাসা ও পরম্পরা ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় । এই অন্বেষণ তাঁর সাম্প্রতিক পর্বের মননশীলতাকে দৃঢ়ভাবে নির্দেশ করে, যেখানে তিনি প্রেম ও শিল্পের দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়ে সৃষ্টির মধ্যে বিনাশের অনিবার্য সত্যকে খুঁজে ফেরেন ।

স্বাধীনতা তাঁর কবিতায় এক দূরবর্তী এবং জটিল প্রত্যয় হিসেবে উপস্থাপিত। কবি প্রশ্ন তোলেন:

“স্বাধীনতা কোথায় বসতি করো কতোদূর কোন গ্রহচূড়ে?”

তিনি স্বাধীনতার সহজলভ্যতাকে প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ স্বাধীনতা রক্তস্রোতে অর্জিত “মৃত্যুর পেয়ালা পান” করার মাধ্যমে পাওয়া “জীবনেরই সে অর্জন” । তাঁর কাব্যের এই অবস্থান তাঁর প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী চেতনার দিকটি তুলে ধরে, যেখানে দেশের মানুষের প্রতি বিশাল দায়িত্ববোধ কাজ করে ।

তবে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় তাঁকে পীড়িত করেছে। তিনি তীব্রভাবে সামাজিক নৈরাশ্য ফুটিয়ে তোলেন, যেখানে সামাজিক নৈতিকতা ও বিবেক “লজ্জায় লুকোচ্ছে মুখ” । এটি প্রমাণ করে, তাঁর কাছে স্বাধীনতার অর্জন যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে অর্জিত মূল্যবোধের সুরক্ষা। তিনি এই সংকটে চারিত্র্যে দৃঢ়তা এবং পতাকায় রক্তলাল চিহ্ন ফোঁটার গুরুত্ব আরোপ করেন, নাহলে পিপাসা ও ক্ষুধা অনিবৃত্ত থেকে যায় ।

প্রেম হাসান হাফিজের কাব্যের একটি প্রধান বিষয়। তবে তাঁর প্রেম নিছক মানব-মানবীর সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি প্রায়শই এক আধ্যাত্মিক বা সৃষ্টিশীল সংগ্রাম রূপে আবির্ভূত হয় । তিনি প্রেমকে সৃষ্টি এবং বিনাশের এক জটিল সমীকরণ হিসেবে দেখেন। এই ভাবনা তাঁর কবিতায় ব্যক্তিগত ভোগের ঊর্ধ্বে উঠে শিল্প সৃষ্টির এক জটিল প্রক্রিয়ায় উন্নীত হয়।

উদাহরণস্বরূপ, ‘তোমাকে সৃজন করি’ কবিতায় এই দ্বান্দ্বিকতা সুস্পষ্ট:

“তোমাকে সৃজন করি, প্রতিমায় গড়ি।
গড়তে গড়তে নিজেই নিঃশেষ।
তুমি পাও চিরবাঞ্ছিতার কৃতিবহুল বন্দনা।
এই প্রাপ্তি অন্তরালে আমারই মরণ।”

এখানে প্রেমিকা/সৃষ্টি আসলে এক ফিনিক্স পাখির মতো, যা কবির বারবার নিঃশেষ হয়ে যাওয়া ছাইয়ের পুঞ্জ ফুঁড়ে আবির্ভূত হয় । কবি তাঁর সৃষ্টির নৈপুণ্য প্রকাশের জন্য এই রহস্যের ভেতরবৃত্তে প্রবেশ করেছেন । বিরহ তাঁর কবিতায় অলক্ষ্য সংশয় এবং দূরত্বের জন্ম দেয়। তিনি লেখেন,

“মিলন কেন যে এত বিরহকে বেহুদা ডরায় বুঝি না সে কেন ছোটে অন্য দিকে ভিন্ন ঠিকানায়” ।

এই দ্বান্দ্বিকতা প্রমাণ করে যে তাঁর প্রেমের কবিতাও তাঁর দার্শনিক অনুসন্ধানের অংশ, যেখানে প্রেম কেবল হৃদয়ের বিষয় নয়, বরং সৃষ্টির অনির্ণেয় অন্য মানে খোঁজার প্রক্রিয়া ।
​হাসান হাফিজের কাব্যে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের যন্ত্রণা, ভয় (ডর লাগে), এবং লোকলজ্জা (শরম) এক গভীর দার্শনিক মাত্রা লাভ করে। কবিতাংশ ‘গন্ধমের আবিষ্ট পতনে’-তে তিনি লেখেন:

“মরমে শরমে মরি, ওলো প্রিয়ে চন্দ্রাবলী সহচরী বিষপাত্র কানায় কানায় ভরো…”

​এই শরম বা লজ্জা তাঁর কবিতায় একটি কেন্দ্রীয় রূপক (Central Metaphor) হিসেবে কাজ করে। এই লজ্জা শুধু ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং বৃহত্তর সামাজিক ও নৈতিক ক্ষয়ের নীরব ফলাফল । যখন সমাজের মূল্যবোধ ধ্বংস হয়, তখন মানুষ এক ধরনের লজ্জিত নীরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে (“মুখ ফুটে বলা যায় না সে তথ্য বারতা”) । এই শরম তত্ত্বটি সত্তরের দশকের কবিদের উচ্চকিত দ্রোহের বিপরীতে এক স্থির, দায়িত্বশীল কণ্ঠস্বর প্রদান করে। এটি সমাজের রুগ্ন বিবেক সম্পর্কে এক উচ্চকিত নীরবতা দান করে, যেখানে মূল্যবোধের পচনই মানুষের এই লজ্জিত নীরবতার মূল কারণ ।

তাঁর কাব্যে প্রকৃতির দুটি প্রধান রূপ—নিসর্গ এবং মানব-প্রকৃতি—উভয়কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে । তাঁর প্রকৃতি চেতনা নিছক সৌন্দর্যের বর্ণনা নয়, বরং পরিবেশ রক্ষার এক গভীর উদ্বেগের প্রকাশ। তিনি উপলব্ধি করেন যে প্রকৃতি ধ্বংসের মূলে রয়েছে মানব-প্রকৃতির পরিবর্তন । মানুষ যখন অতিরিক্ত ভোগবাদী হয়, তখন প্রকৃতি বিপন্ন হয়, যার প্রতিফলন তাঁর কাব্যগ্রন্থ ফুল পাখি নদীও বিপদে-তেও রয়েছে ।

তিনি প্রকৃতিকে মানুষের নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখেন। যখন মানব-প্রকৃতির পরিবর্তন হয় (ভোগবাদ), তখন প্রকৃতি ধ্বংস হতে শুরু করে । তাঁর প্রকৃতি-দর্শনে শৈলমালা শিক্ষা দেয় অহিংস নির্বাণ । তাঁর প্রকৃতি বিষয়ক কবিতায় এক ধরনের উদ্বেগ বা তিয়াসা কাজ করে—যা আমাদের অন্তর্জগৎ থেকে প্রকৃতির হারিয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে। নদী, নক্ষত্র এবং শৈলমালা তাঁর কবিতায় সেই সব প্রতীক, যা সভ্যতার আগ্রাসনে বিলীয়মান ।

হাসান হাফিজের কাব্যশৈলীর মূল ভিত্তি হলো পরিমিতিবোধ । তাঁর এই পরিমিত শৈলী তাঁকে সত্তর দশকের অন্যান্য উচ্চকিত স্বর থেকে আলাদা করে। এই শৈলীগত নিয়ন্ত্রণ কেবল আলংকারিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি তাঁর গভীর নৈতিক বিশ্বাসের প্রতিফলন । তাঁর দ্রোহ নিয়ন্ত্রিত এবং তাঁর আবেগ আবেগমথিত হলেও, তা কখনও সীমা ছাড়িয়ে যায় না।

শব্দ নির্বাচন এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত যত্নবান । তাঁর কাব্যে ‘সংবেদনশীল কারুকাজ’ (sensitive craftsmanship) এবং ‘মার্জিত চিত্রপ্রণালি’ পরিলক্ষিত হয় । কবি ফারুক মাহমুদ তাঁর “সরল বয়ান, কিন্তু ভাবনা উৎসাহিত করার মতো কবিতা” লেখার দক্ষতার প্রশংসা করেছেন ।

তবে, তাঁর শৈলীতে একটি কৌতূহলোদ্দীপক দ্বৈততা দেখা যায়—একটি ক্লারিটি-কমপ্লেক্সিটি প্যারাডক্স। একদিকে গদ্যের কাঠামোর প্রভাবে তাঁর ভাষায় স্বচ্ছতা ও সরলতা আসে, যা পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করে । অন্যদিকে, যখন তিনি প্রেম বা অস্তিত্বের বিমূর্ত অনুভূতি রূপায়ণে যান, তখন ভাষায় এক ধরনের স্থিতিস্থাপকতা বা জটিলতা (elusiveness) দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে তাঁর শব্দচয়ন উল্লেখযোগ্য, যেমন: সংশয় দুলুনি, করুণ কপিশ মৃত্যু । এই প্রচেষ্টা প্রমাণ করে, তিনি সহজ ভাষায় গভীরতম জটিলতাকে ধরতে চান, যা তাঁর কবিতাকে অনন্যতা দান করে। তিনি রহস্যের ভেতরবৃত্তে প্রবেশ করেও কবিতার নৈপুণ্য প্রকাশ করেন ।

দীর্ঘ সাহিত্য-অভিজ্ঞতা তাঁর কাব্যিক ভাষায় একটি নির্দিষ্ট স্বচ্ছতা এনেছে। গদ্যের কাঠামোগত শৃঙ্খলা তাঁকে স্পষ্ট ও সরাসরি প্রশ্ন তুলতে সাহায্য করেছে, বিশেষ করে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলিতে ।

কিন্তু যখন তিনি আব্দুল মান্নান সৈয়দের ভাষায় ‘অনির্ণেয় অন্য মানে’ খুঁজতে থাকেন , তখন তাঁর কবিতায় স্থিতিস্থাপকতা (elasticity) আসে । এই স্থিতিস্থাপকতা সচেতনভাবে তৈরি করা, যাতে পাঠক শুধুমাত্র আখ্যান বা অর্থের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে ‘বন্ধনহীন আবেগ’ দ্বারা উৎফুল্ল হতে পারে । তাঁর কবিতায় ছন্দ এবং সুরের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছন্দস্নাত পঙ্‌ক্তি ব্যবহার করে তারুণ্যস্নাত আবেগ এবং উপলব্ধি প্রকাশ করেন । তাঁর ‘সপ্তসুরের আলো’ কবিতায় তিনি ছন্দের সুগন্ধে বিনিসুতো মালা গাঁথার কথা বলেন, যেখানে সুর ও ছন্দে একটি মগ্ন ঐকতান তৈরি হয় । এই আবেগ এবং মনন, সরলতা এবং জটিলতার সহাবস্থানই হাসান হাফিজের কবিতার আঙ্গিককে বিশেষ করে তুলেছে। তিনি লোকঐতিহ্যকে যত্ন করে তাঁর কবিতার বিষয় করেছেন ।

হাসান হাফিজ বাংলা কবিতার সত্তরের দশকে আবির্ভূত হওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর । তাঁর সাহিত্যিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মননশীল কাব্যের সংবেদনশীলতার মাধ্যমে। তাঁর কাব্যের স্বতন্ত্র স্বরটি পরিমিতিবোধ , গভীর নৈতিক উদ্বেগ, এবং স্বাধীনতা-উত্তর সামাজিক নৈরাশ্যের প্রতি দার্শনিক জিজ্ঞাসার মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে । তিনি তারুণ্যের আবেগ, সামাজিক বৈকল্য এবং প্রকৃতির প্রতি উদ্বেগ—সবকিছুকেই এক নিপুণ সংবেদনশীল কারুকাজে তুলে ধরেছেন, যা তাঁকে সমসাময়িক উচ্চকিত কবিদের থেকে ভিন্ন এক স্থির ও দায়িত্বশীল অবস্থানে স্থাপন করেছে ।

লেখক: কবি, সাহিত্যিক

সারাবাংলা/জিজি
বিজ্ঞাপন

হাসান হাফিজ: কবিতার শাহজাদা
১৫ অক্টোবর ২০২৫ ১৯:০৮

আরো

সম্পর্কিত খবর