সত্যজিৎ রায় ধরণীতে পা ফেলে ফেলে…
১ জানুয়ারি ২০১৮ ১২:৫৫
কিযী তাহনিন
ঘুম ভাঙে। ঘড়িতে সাতটা বাজাবার আয়োজন। ছুটির দিনে, অন্যদেশে, সকাল সাতটা ভোরবেলাই বটে। আধখোলা চোখে শুয়ে থাকি। হোটেল রুমের অচেনা সিলিং এ পুরোনো দাগ দেখি, কিংবা দেখিনা। কিছু ভাবছি। কিংবা ভাববার চেষ্টা করছি। ভাবনা ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। ভাবনার ঝাঁকুনিতে উঠে বসি। সাইড টেবিলে ব্যাগ রাখা। হাত বাড়িয়ে নেই। ব্যাগের পকেট থেকে কাগজের টুকরো বের করি। গুগল করে, নানা জায়গায় খোঁজ নিয়ে খুঁজে পাওয়া ঠিকানা। আমার খুঁজতে থাকা সেই পথের ঠিকানা, যে পথে আমি কখনো যাইনি।
সকাল দশটা। প্রস্তুত আমি। একটি বড়সড় ঢোক গিলি, একটি দীর্ঘ নিঃস্বাস ও নেই। সাহস সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া। ট্যাক্সি ডেকে গন্তব্যের দিকে রওনা দেই। অবাঙালি ড্রাইভার। জিজ্ঞেস করি, এই ঠিকানা কার বাড়ির, জানেন? মাথা নাড়ে, জানেনা। না জানুক। কি আসে যায়। আমি তো জানি, আমি যাচ্ছি, ঠিক ঠিকানায় যাচ্ছি।
গাড়ি থামে। মূল সড়কে। ঘ্যাচাং শব্দে। ঘোর ভাঙে। আমি জাগি, ভাবনা ঘুম থেকে। রেডিওর ওপার থেকে, ‘রে কবিরা মান যা’র সুর হালকা হয়ে ভেসে ভেসে যায়। এরপর আর যাবেনা গাড়ি। ওয়ান ওয়ে। ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ি। এই সেই রাস্তা। বাকি পথটুকু হেঁটে যাবার। হাতের ব্যাগ কাঁধে নেই, শক্ত করে।
মনকে বলি, চলো মন। মন সুর ভাঁজে, ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’। আমিও তাল মিলিয়ে, মনের পিঠে তবলা বাজাতে বাজাতে পথ হাঁটি।
কে জানে ঠিক কোন বাড়ি? একে তাকে জিজ্ঞেস করি। জানেনা, কেউ জানেনা। তবে? রাস্তার নাম তো ঠিকঠাক। বাড়ি কি এখানে নয়?
পেছনে তাকিয়ে দেখি, অল্প দূর থেকে সুখি সুখি চেহারার এক লোক হেঁটে আসছেন। মাঝ বয়স ফুরিয়ে আরো খানিকটা বেশি বয়স তার। হাতে ব্রিফকেস। বোঝা যায় কাজে বেরিয়েছেন। কিন্তু হেঁটে চলায় একটা শান্ত ছন্দময়তা আছে, দৌঁড়ানোর তাড়া নেই। মন বলে, এই লোক জানতে পারে। মনের পারফরমেন্স আজ ভালো। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। উনি আমাকে অতিক্রম করবার সময়েই বাড়িটির খোঁজ করি। ঠিকই, উনি জানেন, বাড়িটি কোথায়। ওই যে বা দিকের দ্বিতীয় গলি, তার মুখেই বাড়ি।
চলে যাবার আগে প্রশ্ন করেন, ওই বাড়িতে যাবেন? মিটিং আছে?
-নাহ দেখতে এসেছি। বাংলাদেশ থেকে।
আমি হাঁটি। আবার। দ্বিতীয় গলির মুখে এসে দাঁড়াই। গলির মুখের বেঞ্চিতে যে মেয়েটি বসা, সে মন দিয়ে বই পড়ছে। তার দিকে তাকাই। রাস্তার মোড়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে, নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগে বই পড়বার ঘটনাটি আকর্ষণীয়। আজকের দিনটির মতোই। আমি সেই আকর্ষণের টানে এবং আরেকবার নিশ্চিত হতেই তাকে প্রশ্ন করি, ‘বাড়িটি কই?’ বইয়ের পাতায় মুখ রেখে নির্লিপ্ত মানুষটি বলে, পেছন ঘুরে দেখুন, বাড়িটি দেখতে পাবেন।
আমি পেছন ঘুরি। যত সহজে লিখলাম, ততো সহজে কি ঘুরে তাকালাম? মন গান থামিয়েছে, সে কৌতুহলী। আমি ভীত, কি হয়, কি হয়? তাকিয়ে দেখি, ‘অপুর সংসার’। ল্যাম্পপোস্টের ফাঁকে, একটি দন্ডে আটকানো ‘অপুর সংসার’ এর পোস্টার। আর তার পেছন জুড়ে সেই বাড়ি, হলদে রঙের সেই বাড়ি, সবুজ গেটওয়ালা সেই বাড়ি।
যেন সেপিয়া’তে তোলা, এক বিস্তৃত ছবি। কথা বলবে চরিত্রেরা, যেন এখুনি জেগে উঠবে সেই ছবি, শুরু হবে ছায়াছবি।
আমি তাকিয়ে আছি নির্বাক। পুরো রাস্তা জুড়ে ল্যাম্পপোস্টের আদলে পোস্টার বাঁধানো, কোথাও ‘দেবী’, কোথাও ‘সোনার কেল্লা’ কিংবা ‘অভিযান’।
গেটের বামপাশের পাঁচিল জুড়ে সবুজ গাছের ছায়া। সে ছায়ায় সর্বজয়া, অপু, দূর্গার পাঁচালী কি মায়া। ঠিক তার পেছনে সবুজ-সাদায় লেখা সড়কের নাম। সত্যজিৎ রায় সরণি? তাই ভেবেছিলাম। ভুল। দু’তিন বার সড়কের ফলকের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, পুরোনো অভ্যাসে ভুল পড়ছি। রাস্তার নাম তো সরণি ‘ই হয়। কিন্তু না এই রাস্তাটি সরণি নয়।
ধরণী। সত্যজিৎ রায় ধরণী। একটি রাস্তা যখন পথ হয়ে ওঠে, তখন তাকে তো ধরণী’ই বলে। সরণি নয় ধরণী। যে পথে ল্যাম্পপোস্ট নয়, শিল্পীর সৃষ্টি আলোর দূত হয়ে ওঠে, সেই পথকেই তো ধরণী বলে। পুরো রাস্তা জুড়ে সত্যজিৎ রায়ের কোনো ছবি টাঙানো নেই, নেই তার কোনো ভাস্কর্য। তার প্রয়োজনও নেই। কারণ পুরো পথ জুড়ে তার সৃষ্টিরা যেভাবে প্রজাপতি হয়ে উড়ছে, তাতে এ পথ সত্যজিত রায়ের না হয়ে উপায় নেই। এ পথ মহারাজার পথ। এ পথের নাম সত্যজিৎ রায় ধরণী।
‘অপুর সংসারে’র ঠিক পেছন দিকে, যে দুজন গল্পবাজ বুড়ো আড্ডা দিচ্ছিলেন, তাদের একজন আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘আর কতক্ষন এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে, ভেতরে যাও?’
-ভেতরে? ভেতরে তো যাওয়া যায়না।
যেয়ে বোলো, ঠিক যেতে দিবে।
আমার আসলে ঠিক কিছু বলতেও হয়না। গেটের সামনে যেতেই, গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি প্রশ্ন করেন, ‘কোত্থেকে এসেছেন?’
-বাংলাদেশ থেকে।
বাড়ি দেখতে?
আমি হাসি। বাড়ি দেখতেই কি এসেছি শুধু। মনে মনে বলি ধরণী দেখতে। মুখে কিছু বলিনা।
উনি (সন্দীপ রায়) থাকলে হয়তো দেখা হতো। উনি তো শহরে নেই। আপনি আসুন ভেতরে।
-আসবো?
আসুন বাইরে থেকে দেখতে পারবেন, গেটের বাইরে থেকে ছবি তুলুন, ভেতরে ছবি তুলতে পারবেন না।
আমি হলুদ বাড়ির ভেতরের বাগানটির সামনে দাঁড়াই। মাথা উঁচু করে তিনতলার বারান্দায় তাঁকিয়ে থাকি। যেন আকাশ দেখছি। ছবি তুলিনা। ছবি তোলার প্রয়োজন নেই। যে ছবি তোলা যায়না, সে ছবির কথা সবচেয়ে বেশি করে মনে থাকে।
আমি গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে আসি। চলে যাইনা। ‘অপুর সংসার’ ‘দেবী’ আর ‘সোনার কেল্লা’দের সাথে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে, আমিও হলুদ বাড়িটির দিকে তাকিয়ে থাকি।
দুপুর বারোটা। দিনের আলো গতি পাল্টাচ্ছে। হলুদ বাড়ির দেয়াল জুড়ে আলো-ছায়ার লুকোচুরি। অচেনা শহরে এই চেনা সময়ের সামনে দাড়িঁয়ে, মন গুনগুন করছে,আহা ‘পড়েছি আজ রেখার মায়ায়’। আর আমি নিশ্চুপ।