উড়াও শতাবতী (১৫) || মূল: জর্জ অরওয়েল || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
২৪ নভেম্বর ২০১৮ ২০:২৪
সিগারেটের ধোঁয়া ফুসফুস অবধি পৌঁছাতেই বস্তুগত, নীচ এই পার্থিব জগতটিতে আর থাকলো না সে, বাসিন্দা হয়ে গেলো এক বিমূর্ত জগতের। মনকে চালিত করে নিয়ে গেলো অতল এক ঘূর্ণাবর্তে যেখানটা আসলে কবিতার জগত। মাথার ওপর গ্যাস-জেট শান্ত আলো বিলোচ্ছে আর শব্দরা উৎসারিত হচ্ছে মনের গভীর থেকে। বছর খানেক আগে রচিত একটি কাব্যাংশের ওপর চোখ পড়লো তার। নিজেই নিজেকে পড়ে শোনালো কয়েকবার। এক বছর আগে এই লেখা তার ভালোই লেগেছিলো, মনে হয়েছিলো ঠিক আছে, কিন্তু আজ এই ক্ষণে সেগুলো তার কাছে স্রেফ অশ্লীল ফালতু বলে মনে হতে লাগলো। কাগজগুলোকে এবড়ো-থেবড়ো করে হাতড়াতে লাগলো। একটি পাওয়া গেলো যার পেছনের দিকটায় কিছু লেখা হয়নি, দ্রুত উল্টে নিলো কাগজটি, পুরো কাব্যাংশটি আবার লিখলো। ছন্দে মেলানো দুটি চরণ বার বার লিখলো, ভিন্ন ভিন্নভাবে ডজনখানেক বার। আর প্রতিটি লিখে নিজেই নিজেকে বার বার শুনিয়ে নিলো। আর অবশেষে তার একটিও তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলো না। নাহ! আগের গুলোই থাক। সস্তা আর অশ্লীল। এরই মধ্যে গত রাতে লিখে রাখা কপিটি হাতে পেয়ে গেলো। আর মোটা দাগ কেটে আগের লেখা চরণ ক’টি কেটে দিলো। সেটা করতে পেরে এক ধরনের অর্জনের ভাবনাই কাজ করলো তার মধ্যে, সময়তো নষ্ট হলো না! ভাবলো অনেক পরিশ্রমে তৈরি কিছু ধ্বংস করতে পারার মধ্যেও রয়েছে এক ধরনের সৃষ্টিশীলতা।
হঠাৎ একদম নিচতলার দরজায় দুবার কড়া নাড়ার শব্দ গোটা বাড়িটিকেই জাগিয়ে তুললো। গর্ডনের মন ঘুর্ণাবর্তের অতল থেকে উপরের দিকে উঠে এলো। ডাক হরকরার কড়া নাড়া! নিমিষে লন্ডনানন্দ মন থেকে মিইয়ে গেলো। তার হৃদয় জুড়ে এখন অন্য ভাবনা। হতে পারে রোজমেরির চিঠি। তাছাড়া দুটি ম্যাগাজিনে দুটি কবিতা পাঠানো আছে। তার মধ্যে একটির ব্যাপারে সব ভরসা সে নিজেই বাতিল করেছে। মাসখানেক আগে একটি আমেরিকান পত্রিকায় পাঠায় লেখাটি। নাম ক্যালিফোর্নিয়ান রিভিউ। ভদ্রতা করে কবিতাটি যে ওরা ফেরত পাঠাবে সে আশাও ছেড়ে দিয়েছে গর্ডন। অন্যটি পাঠিয়েছে ইংলিশ একটি পত্রিকায়। ত্রৈমাসিকটির নাম প্রাইমরোজ। এটি নিয়ে তার আশা তীব্র। এই প্রাইমরোজ সেইসব বিষাক্ত সাহিত্যপত্রের একটি যাতে ফ্যাশনদুরস্ত লুতুপুতু বালক আর পেশাদার রোমান ক্যাথলিক উভয়েরই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অবাধ গতায়ত। ইংল্যান্ডের প্রভাবশালী সাহিত্য পত্রিকাগুলোরও একটি এটি। এতে একটা কবিতা ছাপা হয়েছে তো বলতে হবে আপনি বর্তে গেছেন। হৃদয় দিয়ে গর্ডন জানে তার কবিতা প্রাইমরোজ কোয়ার্টারলিতে কখনোই ছাপা হবে না। কারণ তার লেখা ওদের মানেরই নয়। তারপরেও রহস্যজনক কত কিছুই না ঘটে যায়, না হোক রহস্যজনক, দৈবাৎ কিছুওতো ঘটে যেতে পারে। মোটের ওপর, ওরা যে ছয় সপ্তাহ ধরে তার কবিতাটি ধরে রেখেছে তাও কম কীসে! তাতেই অবশ্য আশাটি জেগেছে। ওরা যদি না-ই ছাপবে তো ছয় সপ্তাহ কবিতাটি আটকে রাখবে কেনো? এই প্রত্যাশাকে মানসিক বিকার জ্ঞান করে তা বাদ দিতে চেয়েছে বহুবার কিন্তু চলে যে যায়নি তা বুঝতে পারলো আজ ডাক হরকরার কড়া নাড়ার শব্দে সেই একই ভাবনা কাজ করায়। তবে এই কড়া নাড়ানোয় তার প্রত্যাশার প্রধান অংশটি জুড়ে রয়েছে রোজমেরির চিঠি। পুরো চারদিন গত হয়েছে তার কোনো চিঠি পায় না। মেয়েটি যদি জানতো পত্রহীন চারটি দিন তাকে কতটা হতাশ করে তোলে তাহলে সে এটা কখনোই করতে পারতো না। দীর্ঘ, ভুল-বানানে ভরা, ফালতু কৌতুকপূর্ণ ভালবাসার ঘোষণা দেওয়া চিঠিগুলো তার কাছে রোজমেরি যতটা মনে করে তার চেয়েও অনেক বেশি অর্থবহ হয়ে ধরা দেয়। এগুলো তাকে মনে করিয়ে দেয় এই ধরাধামে এখনো কেউ রয়েছে যে তাকে নিয়ে ভাবে, তাকে পাত্তা দেয়। যখন কোনো কোন পাষণ্ড তার কবিতা ফেরত পাঠায় তখন মনকে মানিয়ে নিতে এই চিঠিগুলোই তার বড় সান্ত্বনা। সতি্য কথা বলতে কি ম্যাগাজিনগুলো তার কবিতা ফেরতই পাঠিয় দেয়। একমাত্র অ্যান্টিক্রাইস্ট ব্যতিক্রম। এর সম্পাদক রেভেলস্টন তার একান্ত বন্ধু।
নিচে সিঁড়ি ভাঙার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। চিঠি হাতে পাওয়ার পর তা উপরে আনতে মিসেস উইচবিচের দেরি করাটা স্বভাব। চিঠিগুলো হাতড়ানো তার পছন্দের একটা কাজ। দুই আঙ্গুলে চেপে দেখে খামগুলো মোটা কেমন, কোথা থেকে এলো, কে পাঠালো সেগুলো খুটে খুটে পড়ে, আলোর বিপরীতে ধরে ভিতরে কি আছে তা দেখার কিংবা বোঝার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যায়, অতপর তা পৌঁছে দেয় বৈধ মালিকের হাতে। চিঠিগুলোর প্রতি তার এই আচরণ অধিকর্তার অধিকারসম। যেন তার বাড়িতে এসেছে, মানেই হচ্ছে অংশত একই চিঠিগুলো তার। কেউ যদি নিজে সম্মুখদ্বারে গিয়ে নিজের চিঠিটি নিয়ে আসেন তাতে তার ঘোর আপত্তি। তবে চিঠিগুলো যে বিনাবাক্যব্যয়ে উপরের তলায় নিয়ে আসেন তাও নয়। সাধারণত টিপে টিপে পা ফেলে সিঁড়ি ভাঙলেও চিঠি বিলির সময় শোনা যাবে তার পায়ের ধপাস ধপাস শব্দ। চিঠি উপরে আনা যে একটা ধকলের কাজ তা বুড়ি বুঝিয়ে দেবে। আর হাসফাস করতে থাকবে যেন চিঠি পৌঁছে দিতে তার শ্বাস ছুটে যাচ্ছে। অবশেষে চরম অধৈর্যে তা ঠেলে দেবে দরজার নিচ দিয়ে।
সারাবাংলা/এমএম