ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস : উড়াও শতাবতী (পর্ব-০১)
৯ জানুয়ারি ২০১৮ ১৫:০৩
ঘড়ির কাঁটায় বেলা আড়াইটা। ম্যাকেচনির বইদোকানের পেছনে ছোট্ট কোঠায় আড়াআড়ি পাতা টেবিলে লম্বালম্বি শুয়ে গর্ডন। গর্ডন কমস্টক। কমস্টক পরিবারের সবশেষ সদস্য। ঊনত্রিশে পড়েছে। হাতে চারপেনি দরের প্লেয়ার্স ওয়েটস সিগারেটের প্যাকেটটা বুড়ো আঙুলের চাপে খুলছে আর আটকাচ্ছে। দূরের আরেকটা ঘড়ি- রাস্তার উল্টোদিকে প্রিন্স অব ওয়েলস থেকে ডিংডং শব্দে থমকে থাকা ইথার কাঁপিয়ে সময়ের জানান দিচ্ছে।
কষ্টে নিজেকে টেনে তুললো গর্ডন। সিগারেটের প্যাকেটটা শার্টের বুক পকেটে চালান করে দিয়ে বুকটান করে বসলো। নিকোটিনের জন্য প্রাণটা আনচান করছে। চারটে মোটে শলাকা রয়েছে প্যাকেটে। আজ বুধবার। শুক্রবারের আগে পকেটে কানা-কড়িও ঢুকবে না। আজকের রাত আর আগামীকালের পুরোটা দিন সিগারেটহীন কাটাতে হবে, এর চেয়ে জঘন্য বিষয় জগৎ সংসারে আর কিচ্ছুটি হতে পারে না!
গোটা এক দিনের তামাকহীন জীবনের কথা ভেবে ত্যক্ত গর্ডন এবার পুরোপুরি গাত্রোত্থান করলো। পা বাড়ালো দরজার দিকে। লিকলিকে শরীর, হাঁটার ধরণে লাফিয়ে চলার একটা ভঙ্গি আছে। কোটের ডান হাতায় কনুইয়ের কাছে ছিদ্রটা বাড়ছে, মাঝের বোতামটি হাওয়া সেই কবে। ফ্লানেলের রেডিমেড ট্রাউজারটি নানা জায়গায় কুচকে স্বাভাবিকতা হারিয়েছে। পায়ের তলায় শুকতলি দুটো কতখানি ক্ষয়ে গেছে তা উপর থেকে তাকিয়েও দিব্যি ঠাওর করতে পারে গর্ডন।
পা ফেলতেই পকেটে ক’টি কয়েন ঝনঝনিয়ে উঠলো। তা যতই ঝনঝনাক, সে ভালো করেই জানে ওই মুদ্রায় মোট অংকের দৌড় কত! পাঁচপেন্সের হাফপেনি, দুইপেন্সে আরও আধা আর একটা জোইমুদ্রা। এইই সম্বল।
একটু থমকালো। পকেট থেকে তিনপেনির বেচারা কয়েনটিরে তুলে এনে হিংস্র দৃষ্টি ফেললো। ফালতু, অকম্মা! স্রেফ তার মতো অথর্বের হাতেই এমন একটি কয়েন গছিয়ে দেওয়া সম্ভব! গতকালই কয়েনটি তাকে ধরিয়ে দিলো দোকানি মেয়েটি। গিয়েছিলো সিগারেট কিনতে। বাকি পয়সা ফেরত দিতে গিয়ে বিগলিত কণ্ঠে ছুকরি বললো, একটা থ্রিপেনি-বিট কয়েন দেই, স্যর! আর তাতেই বর্তে গেলো সে! হ্যাঁ! দাও দাও! ক্ষতি কি! কিন্তু এখন নিজেকে বোকার হদ্দ ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছে না। ভাবতে গিয়ে হৃদয়খানি যেন মুষড়ে যাচ্ছে – এই ধরাধামে এইক্ষণে তার কাছে স্রেফ পাঁচপেন্সের হাফপেনি বৈ আর কিছু নেই। তার মধ্যে তিনপেনির বিট কয়েনখানা দিয়েতো কিচ্ছুটি হবে না!
এটি বস্তুত কোনো মুদ্রা নয়! স্রেফ এক হেঁয়ালি! পকেট থেকে এমন একটি কয়েন বের করলে আপনাকে বোকা বনে যেতে হবে যখন তখন। অন্য কিছু কয়েনের সঙ্গে থাকলে অবশ্য কিছুটা দাম থাকে।
কিছু একটা কিনে হয়তো বললেন, কত হলো? আর দোকানি মেয়েটি যদি বলে বসে- তিনপেন্স। তবেই পকেট হাতড়ে কয়েনটি বের করে আনতে পারবেন। তখন দুই আঙুলের ডগায় ওটি আলগোছে চেপে ধরে এগিয়ে দিয়ে হাপ ছেড়ে বাঁচবেন।
কিন্তু এতেও রক্ষা নেই। দোকানের মেয়েটি ভ্রু কুচকাবে। আর নিঃসন্দেহে ধরে ফেলবে এটিই আপনার কাছে থাকা জগতের শেষ সম্বল। তখন ওকে জিনিষটার দিকে এমনভাবে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখবেন, যেন মুদ্রাটির ওপর খোদাই করা ক্রিসমাস পুডিংটুকু স্পষ্ট দেখা যায় কিনা তাই পরীক্ষা করছে। এরপর কোনোরকম নাক বাঁচিয়ে বের হয়ে আসতে পারলে শিগগির আর ওমুখো হবেন না।
নাহ! জোইমুদ্রাতো কোনো কাজেই আসবে না। তাহলে বাঁচলো মোটে দুইপেন্স হাফপেনি। এই দুইপেন্স হাফপেনিতে শুক্রবার অবধি চলতে হবে।
ডিনারের আগে একাকিত্বের সময়। এসময় খদ্দের খুব কমই আসে। কিংবা আসেই না। সাত হাজার বইয়ের সঙ্গে স্রেফ একা সে। ছোট্ট অন্ধকার কক্ষ, ধুলো আর নষ্ট কাগজের গন্ধ। বেশিরভাগই পুরোনো, ছেঁড়াখোঁড়া বইয়ে ঠাসা। ছাদছোঁয়া উপরের তাকে বিলুপ্ত বিশ্বকোষের আটখণ্ডের ভলিউমগুলোর দশা কবরস্থানে ভচকে যাওয়া কফিনের মতো। দরজায় নীল রঙা ধুলিমাখা পর্দাটি সামান্য ঠেলে উঁকি মারল গর্ডন। ওপাশটায় আলো একটু বেশি। বই ধার দেওয়া-নেওয়া চলে এখান থেকেই। প্রতিটি বই দুইপেনিতে ধার হয়। বইপ্রেমীদের কাছে লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে ম্যাকেচনির বই দোকানটিই বেশি পছন্দের। এখানে যা কিছু বই, তার সবই প্রায় উপন্যাস, এছাড়াও রয়েছে কিছু, তবে অল্প। উপন্যাসগুলো কেমন ধাচের তা একটা বিষয় বটে! তিন ধারের দেয়ালে মাচান অবধি উঁচু করে আট শত বই থরে থরে সাজানো। দেখে মনে হবে নানারঙের ইটের একটা দেয়াল উপর থেকে নেমে এসেছে। লেখকদের নামের আদ্যাক্ষরক্রমে সাজানো। আরলেন, বোরোস, ডিপিং, ডেল, ফ্র্যাকো, গ্লাসওর্থি, গিবস, প্রিস্টলি, স্যাপার, ওয়ালপোল। ঠিক এইক্ষণে বইয়ের ওপর বিশেষ করে এইসব উপন্যাসের ওপর স্রেফ ঘৃণাই হচ্ছে গর্ডনের। অন্তর থেকে উৎসারিত একটা ঘৃণার দৃষ্টি ওগুলোর উপর ফেললো গর্ডন। এইসব অখাদ্য, বস্তাপচা রদ্দি মালগুলো একসঙ্গে এক ঘরে তাকে দেখতে হচ্ছে। চর্বি, দলা দলা চর্বি, আট শ’ খণ্ড চর্বির মাঝে যেন ডুবে আছে সে।
অভ্যাসবসত চুলে আঙুলের চিরুনি চালিয়ে আলগোছে দরজা গলিয়ে সামনের অংশে ঢুকলো। কে জানে দোকানের সামনে কাচের ওপারে এসে যেতে পারে কোনো নারী খদ্দের! গর্ডনকে দেখে মজে যাওয়ার কোনো কারণ নেই বটে! পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি লম্বা, বড় বড় চুলের কারণে মাথাটিকে শরীরের তুলনায় খানিকটা বেঢপই লাগে। তবু লম্বাটে গড়নের তনুখানা নিয়ে একেবারে অসচেতন সে কখনোই থাকে না। কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে বুঝে ফেললে একটু টানটান হয়ে যায়, বুকটাকে সামান্য চিতিয়ে দেয়। তাতে কিছুটা ভাবের উদ্রেক হয় বৈকি।
থাক সে কথা! আপাতত বাইরে কেউ নেই।…
পরের পর্ব>>