Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উড়াও শতাবতী (১৬) || মূল: জর্জ অরওয়েল || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন


১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৩:২৬

<< শুরু থেকে পড়ুন

গর্ডন শুনতে পাচ্ছে মিসেস উইসবিচ উপরের তলার দিকেই আসছেন।তবে সে পদশব্দ দ্বিতীয় তলা বরাবর এসে থেমে গেলো। তাহলে- চিঠিটা ছিলো ফ্ল্যাক্সম্যানের, মনে মনে আন্দাজ করে নিলো সে। এরপর আবার সিঁড়ি ভাঙার শব্দ। আশা জাগলো বটে। তবে তা বেশি স্থায়ী হলো না। তৃতীয় তলায় উঠে খানিকটা এগিয়ে আবার থামলো পায়ের শব্দ। নিঃসন্দেহে এবারের চিঠি সেই প্রকৌশলীর। গর্ডনের হৃদযন্ত্রে তখন তীব্র বেদনার ধুকপুকানি। একটা চিঠি, হা ইশ্বর, একটা চিঠি আসুক! ফের পদশব্দ। এদিকে আসছে, নাকি ওদিকে যাচ্ছে! মনেতো হয়, কাছের দিকেই আসছে! আহা, নাহ! আর আশা নেই। পদশব্দ ক্রমেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে। মিসেস উইসবিচ নিচের তলায় ফিরে যাচ্ছেন। এরপর একসময় পায়ের শব্দ পুরোটাই মিইয়ে গেলো। আজো কোনো চিঠি নেই তার জন্য। ফের কলম তুলে নিলো গর্ডন। এটা বড্ড বাড়াবাড়ি। ভীষণ ফালতু। চার দিনে একটা চিঠিও না লিখে পারলো মেয়েটা! বড়ই নিষ্ঠুরতা। কাজ করার সামান্য ইচ্ছাটুকুও আর অবশিষ্ট থাকলো না। বস্তুত কাজ করতেই পারছে না সে। হতাশার বোধটি তার শরীর থেকে হৃদয়টাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

মোটে পাঁচ মিনিট আগেও কবিতা তার কাছে মনে হচ্ছিলো একটা জীবন্ত কিছু। কিন্ত এখন তার কাছে কবিতাকে স্রেফ গরুর জাবরকাটা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। চরম বিরক্তি আর বিতৃষ্ণা নিয়ে টেবিলের ওপর কাগজের দঙ্গল একসাথে করে পেচিয়ে আঁটি বাঁধলো আর সেগুলো টেবিলের পাশে শতাবতীর নিচে ফেলে রাখলো। ওগুলোর দিকে এখন আর তাকাতেও পারছে না সে।

উঠে দাঁড়ালো গর্ডন। ঘুমুতে যাওয়ার জন্য সময়টা একটু বেশিই আগেভাগে হয়ে যায়। আর বিছানা তাকে টানছেও না মোটেই। বরং মনটা চাইছে একটু আমুদে হয়ে উঠতে। সস্তা গোছের কোনো ফূর্তি-ফার্তা। এই যেমন- সিনেমা হলে ঢুকে পড়া, নয়তো সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বিয়ারের গ্লাসে চুমুক এইসব। কিন্তু সেসব ভাবনাও অকারণ! কারণ ওসব করতে পয়সা লাগে, যা তার পকেটে নেই। বরং কিং লিয়ারে মুখ ডুবিয়ে এই নোংরা শতাব্দীটিকেই ভুলে থাকবে বলে মনোস্থির করলো সে। তবে শেষ পর্যন্ত হাতে তুলে নিলো শার্লক হোমসের দ্য অ্যাডভেঞ্চারস। বইগুলোর মধ্যে শার্লক হোমসই তার সবচেয়ে প্রিয়। কারণ এগুলোকে সে হৃদয় দিয়ে চেনে। কুপির তেল ফুরিয়ে আসছে… আর ঠান্ডাটাও বেশ জেঁকে বসছে। বিছানা থেকে লেপটা টেনে নিলো গর্ডন। পা দুটো পেঁচিয়ে নিলো আর পড়তে শুরু করলো। ডান হাতের কনুই টেবিলের ওপর রেখে দুটো হাতই চালান করে দিলো কোটের ভেতরে। ঠান্ডা এড়াতেই এই ব্যবস্থা। পড়া এগুচ্ছে দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য স্পেকল্ড ব্যান্ড। গ্যাসের বাতিটি ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগলো। তেলের কুপির আলো কমতে কমতে একটি চিকন বন্ধনীতে রূপ নিয়েছে। ওটি এখন মোমবাতিসম তাপও আর ছড়াচ্ছে না। নিচে মিসেস উইসবিচের তলায় ঘড়ি সাড়ে দশটার ঘণ্টা পেটাচ্ছে। এই ঘণ্টা কেবল রাত্রিকালেই কানে আসে। পিং-পিং, পিং-পিং- একটা ভাঙনের শব্দ! অগ্নিচুল্লির ওপর রাখা অ্যালার্ম ক্লকের টিক-টক এখন ফের শুনতে পাচ্ছে গর্ডন। যে শব্দ মনে জাগিয়ে তুললো সময়ের অবিরাম বয়ে চলার এক অশেষ ভাবনা। নিজের কথাই ভাবলো গর্ডন। আরও একটি সন্ধ্যা বিনষ্ট হলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এভাবে গত হয়ে যাচ্ছে। রাতের পর রাত তার কেটে যাচ্ছে একই ধারায়। একই একাকী কামরা, রমনীবিহীন বিছানা, ধুলো-ময়লা, সিগারেটের ছাই, শতাবতীর পাতা। আর তার বয়স এখন ত্রিশ প্রায়। নিজেকে সাজা দেওয়ার তীব্র ইচ্ছায় সেই দুমড়ে ফেলা লন্ডনানন্দের একদলা কাগজ ফের তুলে আনলো আর কোচকানো পাতাগুলো ছড়িয়ে দিলো টেবিলের ওপর। সেগুলোর দিকে নিনির্মেশ তাকিয়ে থাকলো ঠিক যেভাবে- মনে রেখো মরতে তোমায় হবেই (মোমেন্টো মরি) প্রতীকের খুলিটির দিকে কেউ তাকিয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপন

লন্ডনানন্দ, লিখেছেন- গর্ডন কমস্টক, মাইস’র লেখক। এটি তার সবচেয়ে সেরা সাহিত্যকর্ম। দুই বছর কাজের ফসল। হ্যাঁ ফসলই বটে! শব্দের এক অগোছালো সম্ভার। আর আজ রাতের অর্জন- দুটি লাইন কেটে বাদ দেওয়া। মানে হচ্ছে- সামনে এগুনোর চেয়ে বরং দুই লাইন পিছিয়ে যাওয়া। কুপিটা নিভু নিভু করছে। কসরত করেই গাত্রোত্থান করলো গর্ডন আর লেপটিকে বিছানায় ছড়িয়ে দিলো। ঠান্ডা আরও বেড়েছে। আগেভাগে শুয়ে পড়াই উত্তম। কাল কাজ আছে। বিছানার দিকে যেতে ধরেও আবার থমকালো। ঘড়িটি তুলে নিয়ে অ্যালার্ম ঠিক করলো। কোনো কিছুই সমাপ্ত করা হলো না, কোন কিছু করা হলো না। কিন্তু রাতের ঘুম তাকে ঘুমোতে যেতেই হচ্ছে।

এখন কাপড় ছাড়তেও মন চাইছে না। প্রায় ১৫ মিনিট কাপড়-জুতো নিয়েই শুয়ে থাকলো। হাত দুটি মাথার নিচে। উপরের সিলিংয়ে একটা কিসের শব্দ হলো। সিলিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার মানচিত্র। শুয়ে শুয়েই পায়ের জুতো-মোজা খুলে নিলো গর্ডন। উপরের দিকে একটি পা তুলে আনলো আর সেদিকে তাকালো। ছোট ধাঁচের দুটি পা। হাত দুটির মতোই অকর্মা। তবে পা দুটি বেশ নোংরা। শেষ গোসল করেছে দশ দিন হতে চলেছে। নিজের নোংরামিতে নিজেই লজ্জিত হয়ে পা দুটো গুটিয়ে এনে কাপড়গুলো খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে দিলো। পুরোই ন্যাংটো এখন সে। আসলে ন্যাংটোই ঘুমোয়। তার সবশেষ পায়জামাটি ফেলে দিতে হয়েছে তাও এক বছর।

নিচের তলায় ঘড়ি ১১টার ঘণ্টা বাজালো। বিছানার ঠান্ডা ভাবটা ততক্ষণে দূর হয়েছে, গর্ডনের মন জুড়ে তখন আবার ফিরে এসেছে কবিতা। সেই কবিতাটি যেটি বিকেলে সে আওড়াচ্ছিলো। যে একটি অনুচ্ছেদ শেষ করতে পেরেছে সেটেই বারবার আওড়াতে থাকলো।

শার্পলি দ্য মেনাসিং উইন্ড সুইপস ওভার দ্য বেন্ডিং পপলার্স, নিউলি বেয়ার
অ্যান্ড ডার্ক রিবনস অব দ্য চিমনিস ভির ডাউনওয়ার্ড; ফ্লিকড বাই হুইপস অব এয়ার, টর্ন পোস্টারস ফ্লাটার।

আট সেলেবেলের শব্দগুলো বেশি বেশি আসছে। টিক-টক, টিক-টক! এক বিশ্রী যান্ত্রিক শূন্যতা তার মনযোগ বিগড়ে দিলো। প্রতিটি ছন্দ মার খাচ্ছে এই যন্ত্রের টিক-টক টিক-টক শব্দে। কবিতা! সেতো কোনো কাজেরই নয়।! আর সে নিজেও যে এক অকম্মা, বয়স ত্রিশ, জীবনের এক অন্ধ গলিতে তার বাস, সেসব ভাবনা মাথায় নিয়ে জেগেই শুয়ে থাকলো সে। ঘড়ি রাত ১২টার ঘণ্টা পেটালো। পা দুটো সোজা বিছিয়ে দিলো গর্ডন। বিছানা ততক্ষণে উষ্ণ ও আরামদায়ক হয়ে উঠেছে। ওদিকে, উইলো রোডের সমান্তরালে অপর কোনো সড়কের কোথাও উল্টে যাওয়া গাড়ির ধাক্কায় অন্ধ লোকটি ছিটকে পড়লো আগামেমননের তরবারির মতো দেখতে একটি শতাবতী পাতার ওপর।

পরের অংশ>>

সারাবাংলা/এমএম

উড়াও শতাবতী গর্ডন কমস্টক জর্জ অরওয়েল মাহমুদ মেনন শতাবতী

বিজ্ঞাপন

খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমলো
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২১:০৮

আরো

সম্পর্কিত খবর