Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উড়াও শতাবতী (৪) মূল: জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: মাহমুদ মেনন


২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৮:২৫

শুরু থেকে পড়তে>>

টাকাই সংস্কৃতি! ইংল্যান্ডের মতো দেশে পকেটে পয়সা না থাকলে সংস্কৃতিবান হওয়ার জো নেই। টাকা না হলে এই লন্ডনে ভদ্দরলোকদের ক্যাভার্লি ক্লাবের সদস্যপদ জোটে না যে! দাঁতপড়া শিশুরা যেমন মাথা দোলাতে থাকে তেমনই একটি ভঙ্গিমায় ওইসব উন্নাসিক মার্কা রচনার একটা বই সে তুলে নিলো- সাম অ্যাসপেক্টস অব ইটালিয়ান বারোক- পাতা ওল্টালো, মাঝখান দিয়ে একটি অনুচ্ছেদ পড়ে ফেললো আর ঘৃণা ও ইর্ষা মিশ্রিত একটি অনুভূতিতে সেটি আবার তাকের ভেতর দ্রুত ঠেলেও দিলো। ধ্বংসাত্মক এক সর্বজ্ঞান! ক্ষতিকর পরিমার্জন! আর এই পরিমার্জন মানেই অর্থ! এর পেছনে আর কীই থাকবে, অর্থ ছাড়া? সঠিক শিক্ষার জন্য অর্থ, প্রভাবশালী বন্ধুর জন্য অর্থ, অবসর আর মনের শান্তির জন্য অর্থ, ইতালি ভ্রমণের জন্য অর্থ। অর্থেই বই হয়, অর্থেই সেগুলো বিকোয়। আমার ন্যয়নিষ্ঠার দরকার নেই,

বিজ্ঞাপন

হা! ঈশ্বর! আমাকে অর্থ দাও, শুধুই অর্থ চাই।

 

পকেটের মধ্যেই কয়েনগুলো নাড়াচাড়া করছিলো সে। বয়স ত্রিশ হয়ে গেলো আর এখনও কিছুই হলো না তার; কেবল এই অতি নগণ্য কবিতার বইখানি ছাড়া। প্যানকেকের চাইতে আকারে একটু বড়ই হবে। এরপর পুরো দুটি বছর গত হলো, একটি ভয়ানক কিছু করেই ছাড়বে এমন গোলকধাঁধার চক্করে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে, কিন্তু কিছুই এগুচ্ছে না, আর মাথাটা যখন পরিষ্কার কাজ করে তখন সে স্পষ্টই বুঝে ফেলে, এর বেশি কিছু তাকে দিয়ে হবেও না।

অর্থাভাব, স্রেফ অর্থাভাবই তার লেখার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে; এই বোধ তার কাছে বিশ্বাসের মতোই। অর্থ, অর্থ! অর্থই সব! এক পেনি দরের একটি উপন্যাসিকাও কি অর্থ ছাড়া হয়? উদ্ভাবন, শক্তি, রস, কৌশল, আকর্ষণ- এর সব কিছুর জন্যই নগদ অর্থ চাই।

বিজ্ঞাপন

 

নিচের তাকগুলোতে তাকিয়ে একটু স্বস্তি লাগছে। অনেক বইয়ের লেখাই এখন ঝাপসা হয়ে পাঠের অযোগ্য হয়ে গেছে। মোটের ওপর, আমাদের সবারই গন্তব্য এক। অন্তে এমন সবারই বিলীন। তোমার, আমার আর ক্যামব্রিজের ওইসব উন্নাসিক যুবাদের, সবারই বিস্মরিত হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা- তবে সন্দেহ নেই ক্যামব্রিজের যুবাদের অপেক্ষাটি অপেক্ষাকৃত একটু বেশিই লম্বা হবে। পায়ের কাছে সময়ের ব্যবধানে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ধ্রুপদী সাহিত্যকর্মগুলোর দিকে তাকালো সে। কার্লাইল, রাসকিন, মেরেডিথ আর স্টিভেনসন সবাই এখন মৃত, ঈশ্বরই তাদের পচিয়েছে। হা, হা! সেই ভালো! রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের কালেক্টেড লেটারস। উপরটা ধুলো জমে কালচে রূপ নিয়েছে। মৃত্তিকা থেকেই তোমার সৃষ্টি আবার মৃত্তিকাতেই বিলীন। স্টিভেনসনের বইটির পীঠে হালকা লাথি লাগালো গর্ডন। সাহিত্যকলা না মাই ফুট? মুখ থেকে বেরিয়ে এলো তার।

পিং! দোকানের ঘণ্টি বাজলো। ঘুরলো গর্ডন। লাইব্রেরির জন্য বই কেনে এমন দুই নিয়মিত ক্রেতা দরজায়। উঁচানো স্কন্ধের এক নিম্নমুখী নিম্নবিত্তা। ভিলভিলে পাতিহাঁস যেমন গর্দান উঁচিয়ে ঠোঁটখানা গুঁজে দিয়ে ময়লা-কাদা ঘাঁটে তেমনই ভঙ্গিমায় মাল-মাত্তায় ঠাসা একটা ঝুড়ির ভেতরটা হাতড়াতে হাতড়াতে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। আরজন ঢুকলেন চড়ুইনাচন নাচতে নাচতে। রাঙামুখো মধ্য-মধ্যবিত্তা ইনি। বগলে দ্য ফরসিট সাগা’র একটি কপি চেপে ধরা, নামটা বাইরের দিকে অনেকখানি বাড়িয়ে রাখা যাতে পথে যেতে পথিকরা তাকে বুদ্ধিজীবী ঠাওড়াতে ভুল না করে। অম্ল অভিব্যক্তিটা মুখ থেকে ঝেড়ে ফেললো গর্ডন। পারিবারিক চিকিৎসকের মতো বন্ধুত্বমাখা সুখোষ্ণ অভিবাদন জানালো তাদের। এই ভাবখানা লাইব্রেরির ক্রেতাদের জন্যই তুলে রাখে সে।

‘শুভ অপরাহ্ন মিসেস উইভার। শুভ অপরাহ্ন মিসেস পেন। কী দুঃসহ আবহাওয়া।’

‘হুম! একদম যাচ্ছেতাই!’ বললেন মিসেস পেন।

একটু পাশে সরে দাঁড়ালো গর্ডন আর ভদ্রমহিলাদ্বয়কে এগিয়ে যেতে দিলো। মিসেস উইভার তার মাল-মাত্তায় ঠাসা ঝুড়িটি হাতড়িয়ে এটা সেটা মেঝেতে ফেলে অবশেষে এথেল এম ডেল’র সিলভার ওয়েডিং-এর বহুলব্যবহৃত একটি কপি বের করে আনলেন। আর মিসেস পেন পক্ষীর চকচকে দুই দর্শনেন্দ্রীয় দিয়ে সেটির দিকে নিক্ষেপ করে রাখলেন।

চোখ দুটির ভাষা স্পষ্ট, ডেল! স্রেফ নিম্নরুচির! নিম্নশ্রেণির মানুষগুলোই এর পাঠক!

বুঝতে পেরে মুচকি হাসি দেখিয়ে দিলে গর্ডনও। আর তারা দুজনই বুদ্ধিজীবীর স্মিতহাসি মুখে নিয়ে লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকে পড়লো।

ফোরসাইট সাগার কপিটি বগলমুক্ত করলেন মিসেস পেন ও আর চড়ুইয়ের ভঙ্গিমায় গর্ডনের দিকে ফিরলেন। গর্ডনের প্রতি অমায়িক ভাবটা তার বরাবরের। দোকানদার হলেও তাকে মিস্টার কমস্টক বলেই সম্বোধন করেন, আর তাদের মধ্যে সাহিত্যধর্মী কথাবার্তাও বেশ হয়। দুজনের মধ্যে বুদ্ধিজীবী বুদ্ধিজীবী ভাবের মিলটা প্রকট।

‘আশা করি দ্য ফোরসাইট সাগা ভালো লেগেছে, মিসেস পেন?’

‘অসাধারণ একটা বই মি. কমস্টক। জানেন এ নিয়ে চতূর্থবার পড়লাম। একটি মহান গ্রন্থ, সত্যিকারের মহান!’

ওদিকে মিসেস উইভার বইয়ের তাকে নাক গুজিয়েছেন, বর্ণানুসারে সাজানো বইগুলো মন দিয়ে দেখছেন।

‘মোটে বুঝতেই পারছি না এসপ্তার জন্য কোন বইটা নেবো,’ অবিন্যস্ত দুটি ঠোঁট থেকে বিরবির শব্দ বেরুলো তার। ‘আমার মেয়ে বলছিলো একবার ডিপিং পড়ে দেখতে। সে আবার ডিপিংয়ের খুব ভক্ত। কিন্ত মেয়ে জামাই আজকাল বরোজ খুব পড়ছে। তাই বুঝতে পারছি না, কি করি!’

বরোজের নাম উচ্চারণে মিসেস পেনের মুখমণ্ডলের ওপর দিয়ে একটা খিচুনি বয়ে গেলো। বেশ বুঝিয়ে দিয়ে মিসেস উইভারের দিকে পশ্চাত ফিরলেন তিনি।

‘আমার কি মনে হয় মি. কমস্টক, আসলে গ্লাসওয়র্থির চেয়ে বড় কেউ এখন আর নেই। তার লেখায় এত ব্যাপ্তি, এত বিশ্বজনীনতা, আর একই সাথে ইংরেজিটা এতটা চেতনাবহ, এত মানবিক। ওর বইগুলো সত্যিকারের মানবতার দলিল।’

‘আর প্রিস্টলি, সে-ও, বললো গর্ডন।’ আমি মনে করি প্রিস্টলি অসাধারণ এক ভালো লেখক, তাই না!’

‘ওহ, সেতো বটেই। সে-ও অনেক বড় মাপের, উদার আর মানবিক! আর একই সঙ্গে ইংরেজিটাও কিন্তু অসাধারণ!’
মিসেস উইভার এবার ঠোঁট খুললেন। ওগুলোর পেছনে তিনটি হলদে দাঁত গোচরে পড়লো গর্ডনের।

‘আমার মনে হয় আরেকটা ডেলই নিয়ে নেবো,’ বললেন তিনি। তোমার কাছে নিশ্চয়ই ডেলের আরও বই আছে, নাকি নেই? ডেলের লেখা পড়তে বেশ ভালো লাগে। মেয়েকেও সে কথাই বলেছি। তুমি তোমার ডিপিংস আর বরোস রেখে দাও আর আমাকে একটা ডেলই দাও। ডিং ডং ডেল! ডিউকস অ্যান্ড ডগহুইপস! মিসেস পেনের চোখে অবজ্ঞার অভিব্যক্তি। গর্ডনও তেমনই একটা অভিব্যক্তি ফিরিয়ে দিলো। মিসেস পেনের সঙ্গে ভাবটা বজায় রাখতেই হবে। শত হলেও একটা নিয়মিত ভালো খদ্দের তার।

পরের পর্ব>>

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর