<<আগের অংশ || শুরু থেকে পড়ুন>>
পরিবার স্বজনদের ঘিরে তার মনে জমে থাকা ঘৃণাবোধটা ততদিনে কমেছে, কিংবা বলা চলে অতটা আর নেই। বুড়ো বেচারা চাচা-ফুপুদের মধ্যে দু-তিনজন তদ্দিনে গত হয়েছেন, পর্যুদস্ত, চেতনালুপ্ত বাবা, মলিন শিরা-উপশিরা সর্বস্ব ক্ষীণকায় মা (ফুসফুসটাও যার তেমন শক্তিশালী ছিলো না) আর একুশের কোটায় পড়া জুলিয়া, বাড়ির ঝিসম বারোঘণ্টা কর্মব্যস্ততার এক কন্যা, জীবনে একটি মানানসই ফ্রক পরার সৌভাগ্যও যার কপালে জোটেনি। বস্তুতপক্ষে ওদের বিষয়টি যে কী, সেটা এখন সে বুঝতে পারছে। আসলে অর্থাভাব ছাড়া বিষয়টি আর কিছুই নয়। ওদের অর্থ নেই, কিন্তু এখনও মনে মনে তারা অর্থওয়ালা একটা পৃথিবীর বাসিন্দা হয়েই রয়ে গেছে। এ এমন এক পৃথিবী যেখানে অর্থই ধর্ম, আর দারিদ্র স্রেফ এক অধর্ম কিংবা অপরাধ। দরিদ্রও ঠিক নয়, একটি সম্মানজন দরিদ্রদশার থেকেও তারা ছিলেন নিচের স্তরের। অর্থকে তারা জীবনাচারের অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সে জীবনাচারই তাদের ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। নিম্নবর্ণ-শ্রেণির মানুষগুলো অর্থ থাক কি না থাক ওরা জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বাঁচে। এদের পক্ষে সেটাও সম্ভব ছিলো না। কারখানার শ্রমিকটিকেও সেলাম, কারণ তারা পরিবারের মেয়েটিকে একটি পারিবারিক পরিমণ্ডলে বড় হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। আর ওদের ধমনীতে অর্থ নয়, রক্তই প্রবাহিত। বিষয়টি নিয়ে আদ্যপান্ত ভেবেছে গর্ডন। কৈশরে যে একটা স্বার্থপর মনোভাব থাকে সেটা দিয়েই গভীরভাবে সে ভেবেছে। আর ভেবে ভেবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, জীবনে বেঁচে থাকার দুইটিই পথ- হয় ধনী নয়তো স্বেচ্ছাদারিদ্র্য। পকেটে হয় পয়সা থাকবে… নয়তো থাকবে না। তাতে খুব একটা ফারাক কিছু হয় না। কিন্তু ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে তখনই যখন- আপনি পয়সার পুজারি অথচ পয়সা কামাইয়ে পুরোপুরি ব্যর্থ। সেই শৈশবে সে এটাও বুঝে নিয়েছিলো এই পয়সা কামানোটা তাকে দিয়েও খুব একটা হবে না। মেধার জোরে গাঁটে কিছু পয়সা ঢুকবে সেটা তার কদাচই মনে হত। আসলে তার স্কুল শিক্ষকরাই বিষয়টি তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তারাই ঠিক বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সে নিতান্তই এক অপদার্থ… সাফল্য বলে কিছু তার জীবনে কখনোই আসবে না। আর সে নিজেও বিষয়টি সেভাবেই মেনে নিয়েছিল। বিশেষ কিছুতে সফলতা অর্জন হয়তো করা যেতো, কিন্তু সে চেষ্টাটিও না করে বরং সাফল্য নামের শব্দটিকেই সে তার জীবন থেকে বাদ দিয়ে রেখেছে। ভাবখানা এই যে, স্বর্গের চাকর-নোকর হওয়ার চেয়ে নরকের বাদশাহ হবে, সে-ই ভালো। এরই মধ্যে, সেই ষোলোতেই সে জেনে গিয়েছিলো তাকে কী করতে হবে। অর্থ নামের ঈশ্বরের সাথে তার ঘোর বিরোধ। অর্থ কিংবা অর্থ থেকে উৎসারিত তাবৎ বিষয়ের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ, তবে যে যুদ্ধ নিতান্তই নিরব ও নিভৃত।
তারই মাঝে যখন তার বয়স সতেরো তখন তাদের জন্য মোটে দুইশ’ পাউন্ড রেখে বাবা গত হলেন। জুলিয়া ততদিনে বাইরে কাজে যোগ দিয়েছে। ১৯১৮ ও ১৯১৯ এই সময়টাতে সে একটা সরকারি দফতরে চাকুরি গোছের কিছু একটা করত। এরপর রান্নাবান্না বিষয়ক একটা কোর্স করে আর্ল’র কোর্ট আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের কাছে ছোট্ট একটা নোংরা-ঘিনঘিনে চায়ের দোকানে কাজ নিল। সপ্তাহে বাহত্তর ঘণ্টা কাজ। বিনিময়ে দুপুরের খাবার ও চা নাস্তা ছাড়া পেত মোটে ২৫ শিলিং। এর মধ্যে সপ্তাহে ১২ শিলিং কিংবা তার বেশি দিয়ে দিতো বাবা-মায়ের সংসারে। তো এমতাবস্থায় মি. কমস্টক যখন ইহকালের মায়া ছাড়লেন, সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তটিই হতে পারতো- গর্ডনকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে কাজে লাগিয়ে দেয়া আর বাবার রেখে যাওয়া দুইশ’ পাউন্ড দিয়ে জুলিয়াকে একটা চায়ের দোকান খুলে দেয়া। কিন্তু এবারও কমস্টকদের মনোভাব সেই টিপিক্যাল মধ্যবিত্তেরই থেকে গেলো… জুলিয়া ও মা দুজনের কেউই গর্ডনকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনার কথা শুনতেও চাইলেন না। ঠিক করলেন, তারা দুজনে কাজে নেমে পড়বেন। আর গর্ডন অন্তত আঠের বছর বয়স পর্যন্ত স্কুল চালিয়ে যাবে। শ’ দুয়েক পাউন্ডের অর্ধেকেরও বেশিটা, কিংবা বলা চলে পুরোটাই খরচ করা হবে গর্ডনের লেখাপড়ার পেছনে। গর্ডন এতে কোনও আপত্তি করলো না। অর্থের বিরুদ্ধে সে তার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বটে, কিন্তু স্বার্থপরতা তার মজ্জা থেকে তখনও যায়নি। আর কাজে যাওয়া নিয়ে তার যে ভয়- সেতো ছিলোই। কোন বালকেরই বা সে ভয় থাকে না! নোংরা কোনও অফিসে বসে কলম পিষে যাওয়া- জঘন্য! চাচা ফুপুরা অবশ্য ততদিনে বলতে শুরু করেছেন- গর্ডনকে দিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বলতে যা বুঝায় তা কখনোই হয়ে উঠবে না। তাদের কাছে একটা ‘ভালো চাকরি’ পেয়ে যাওয়াই সব কিছু। স্মিথ এরই মধ্যে একটা ব্যাংকে ‘ভালো চাকরি’ পেয়ে গেছে। জোন্স- সেও বীমা অফিসে এখন ভালো চাকরি করে এসবই বলাবলি করতে থাকেন। এসব নিয়ে তাদের ভ্যাজর ভ্যাজর শুনতে শুনতে রীতিমত ক্লান্ত গর্ডন। এদের ভাবখানা এমন- একটা ভাল চাকরি নামের কফিনের সামনে গোটা ইংল্যান্ডের তরুণরা মাথানত করে থাকবে।
অর্থ যে একেবারে ধরা দিলো না তা নয়। গর্ডনের মা বিয়ের আগে ছিলেন গানের শিক্ষক। সংসারের আয় যখন তলানিতে পৌঁছাতো তখন মাঝে মধ্যে দুই-একটা ছাত্র-ছাত্রী তিনি বিয়ের পরেও পড়াতেন। তো এবার সিদ্ধান্ত নিলেন আবারও শুরু করবেন গান শেখানোর কাজ। শহরতলী এলাকায় শিক্ষার্থী পেতে বেগে পেতে হলো না। ওরা তখন অ্যাকটনে বাস করতো। তো মায়ের গান শেখানোর বিনিময়ে পাওয়া অর্থ আর জুলিয়া যতটুকু দিতে পারে তা দিয়ে পরের দুটি বছর তাদের একরকম কেটে গেলো। কিন্ত মিসেস কমস্টকের ফুসফুসের অবস্থা ভালো ছিলো না। আর ততদিনে তা আরও জটিল রূপ নিলো। একদিন স্বামীর অসুস্থতায় যে চিকিৎসক নিয়মিত দেখতেন… তিনিই তার বুকের ওপর স্টেথেসকোপ বসিয়ে কঠিন চোখে তাকালেন। বলে দিলেন, নিজের যত্ন তাকে নিজেকেই নিতে হবে। সবসময় চাঙ্গা থাকতে হবে, ভালো খাবার খেতে হবে, আর সর্বোপরি আর কোনও চাপ নেওয়া যাবে না। তো বড় দমের কাজ গান শেখানো- পিয়ানোর পাঠের মতো ক্লান্তিকর কাজ এগুলো আর করা চলবে না। এদিকে এত কিছু ঘটে গেলো গর্ডনকে তার কিছুই জানানো হলো না। জুলিয়া জানতো। আর দুই নারী মিলে গর্ডনের কাছে সবটাই আড়াল করে রাখলেন। সেভাবে কেটে গেলো আরো একটি বছর। এদিকে স্কুলেও গর্ডন যে খুব ভালো ছিলো- তা নয়। তাকেও সেই নোংরা পুরোনো কুচকে যাওয়া কাপড় পরে, পকেট খরচার অভাবের মধ্য দিয়েই পার করে দিতে হয়েছে বছরটি। এসব কারণেই মেয়েদের কাছেও সে ঘিঁষতো না। বরং মেয়ের প্রতি মনোভাবটি হয়ে উঠলো আতঙ্কের অপর নাম। তার মাঝেই দ্য নিউ এজে তার লেখা একটি কবিতা ছাপা হয়ে গেলো। ওদিকে ডাক্তারের পরামর্শ উপেক্ষা করে মা ঘণ্টায় দুই শিলিংয়ের বিনিময়ে পিয়ানো শেখানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আর অতঃপর গর্ডন তার স্কুল ছাড়লো।
সারাবাংলা/এমএম