সিনিয়র আর্টিস্ট
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১২:৫৯
হঠাৎ করে যখন সেটে তন্দ্রার মা আসতে শুরু করে পরিবর্তনের শুরু তখন থেকে।
আগে তন্দ্রা একাই শুটিংয়ে আসত। ঠিকঠাক শুটিং করত। সকাল কিংবা বিকালের নাস্তায় গলা নরম করে পাউরুটির জায়গায় বড়জোর বার্গার কিংবা স্যান্ডউইচ চাইত।
মুরগির লেগ পিস তার পছন্দ। দুপুর অথবা রাতের খাবারের প্লেটে শিনা কিংবা পাজরের মাংস পড়লে সে রানের মাংসের আবদার করত। মুরগির লেগ পিস থাকলে পেত। না হলে যা দেয়া হয়েছে সেটাই খেতো। এ নিয়ে কখনো বাড়তি কথা হতো না।
কিন্তু যখন থেকে তন্দ্রার সাথে তার মা যুক্ত হলো তখন আর পরিস্থিতি আগের মতো থাকে না।
মুরগির জায়গায় কঁচি কবুতরের ঝোল ঢোকে। সকাল-বিকাল ফ্রেশ ফলের জুস যুক্ত হয়েছে তারও আগে। ফলের মধ্যে ফরমালিন আছে কি নেই তা পরীক্ষা করার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়েছেন তন্দ্রার মা।
তন্দ্রা সিনেমায় এসেছে খুব বেশিদিন হয়নি। বছর আড়াই হবে। এর আগে টুকটাক মডেলিং করেছে। দু-একটা টিভিতে উপস্থাপনার কাজও পেয়েছিলো। তেমন উল্লেখ করার মতো কিছু না।
প্রথমদিকে হাতে তেমন কাজ না থাকলেও এখন তার চাহিদা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে গেলো বছরের মাঝামাঝি মুক্তি পাওয়া ‘প্রেমের চেয়ে জ্বালা বেশি’ ছবিটা সুপারহিট হওয়ায় নায়িকা তন্দ্রার ক্যারিয়ার ঘুরে যায়। এখন তার হাতে অনেক কাজ।
চাহিদা বেশি হলে জোগান কমে যায়। অর্থনীতির ছাত্রী না হয়েও তন্দ্রা এটা ভালো বোঝে। অবশ্য তন্দ্রা ঠিক কিসের ছাত্রী এটা কেউ জানে না। শোনা যায় একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় তার নাম আছে। তবে যে মেয়ের ঘুম-ই ভাঙে দুপুর বারোটার পরে সে কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ে সে এক রহস্য বটে। নাইট কলেজের মতো রাত্রিকালীন বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য থাকতে পারে। কিন্তু রাতে তো তন্দ্রা থাকে শুটিংয়ে!
একদিন এই লেখাপড়া নিয়ে অন্য এক নায়িকার মায়ের সাথে তন্দ্রার মায়ের লেগে গেলো। মার্কেটে সেই নায়িকা আর তন্দ্রার চাহিদা কাছাকাছি পর্যায়ের। দুজনের মধ্যে বেশ টক্কর। দুই নায়িকার মায়েদের ভাব এবং স্বভাব প্রায় একই ধাঁচের।
শুটিং স্পটে তাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল। নানা বিষয় ঘুরে আসে নিজেদের মেয়েদের ব্যস্ততা প্রসঙ্গ।
তন্দ্রার মা বললেন, আমার তন্দ্রা মামনির শিডিউল খাতায় দিন তো দূরের কথা ঘন্টার ঘরও খালি নাই। কয়েকটা টেলিভিশন ঈদের টক শো’র জন্য খুব করে ধরেছে। কথা নাই বার্তা নাই একদম বাসায় এসে হাজির। বলে, এক-দেড় ঘন্টার মামলা। টাকা-পয়সা কোনও ঘটনা না। কিন্তু ওদের কিভাবে বুঝাই ওই এক ঘন্টাই পাই কোথায়? শেষে শিডিউল বুক দেখাইলাম। দেখো, আগামি দেড় মাস সুইও ঢোকানো যাবে না। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শেষে বিদেয় করেছি।
অ। তাই বুঝি। কিন্তু আমার মেয়ের বিষয়টা আবার আলাদা। তার কাছে পড়ালেখা হলো সবার আগে। মাসের অর্ধেকটা সে পড়ালেখার জন্য রেখে তারপর শিডিউল দেয়। জানেনই তো আমার মেয়ে খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। এইচএসসিতে একটুর জন্য এ প্লাস মিস হয়েছে। তাও হতো না লাস্টের কয়েকটা পরীক্ষার সময় একশ দুইয়ের ওপরে জ্বর ছিলো। মাথা তোলার অবস্থা ছিল না।
এখন তো পরীক্ষা দিলেই এ প্লাস পাওয়া যায়। কেমন ব্রিলিয়ান্ট সে তো বোঝাই যাচ্ছে। তন্দ্রার মা চাপা স্বরে কথাটা বললেও তা ঠিক চাপা থাকে না।
তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন প্রতিদ্বন্দী নায়িকার মা। চাপা কথার জবাবে সেই নায়িকার মা বিস্ফোরিত কন্ঠে বলেন, বিনোদন লাইনটা আর আগের মতো নাই। আগে লেখাপড়ার ইজ্জত ছিলো। আমার মেয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। হাজার জনে একজন চান্স পায়। আর প্রাইভেটে তো টাকার খেলা। মেধার দাম কতদূর সে তো জানাই আছে। আগের দিন হইলে আমার মেয়ের সম্মান হইতো অন্যরকম। এখন লেখাপড়ার ইজ্জত নাই তাই শিক্ষিত-অর্ধ শিক্ষিত-মূর্খ সব এক কাতারে। এজন্যই তো সিনেমার এই দশা।
তন্দ্রার মা ও ছেড়ে দেবার মানুষ না। কথায় যুক্তি থাকুক কি না থাকুক। কাউকে বিনে কথায় তিনি ছেড়ে দিয়েছেন অতীতে এমন হয়নি। এবারও হলো না।
তিনিও ফুল ভলিউমে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আপনার মেয়ে যেখানে পড়ে সেখানে কেউ তার খবর রাখে? আর আমার মেয়ে যেখানে পড়ে সেই ইউনিভার্সিটির চাইতেও আমার মামনি বেশি বিখ্যাত। এটা আমার কথা না ইউনিভার্সিটির স্যারেরাই বলে। ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট বাড়ানোর জন্য তন্দ্রাকে দিয়া তারা এড বানাইছে। কার সাথে কার তুলনা! হাহ।
দুই নায়িকার মায়ের বাহাসের সূত্র ধরে তন্দ্রার লেখাপড়ার রহস্যের কিছুটা উন্মোচিত হলেও এ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলে না। শত হলেও তন্দ্রার এখন বাজার চাহিদা আছে।
অভিনয়টা পুরোপুরি শিখতে না পারলেও সিডিউল ফাঁসানোটা সে ঠিকঠাক শিখে ফেলেছে।
কল টাইম তা সে সকাল আটটা হোক কিংবা দশটা।
এখন আর দুপুরের আগে শুটিংয়ে আসতে পারে না তন্দ্রা।
২.
প্রথমদিন শুটিং স্পটে এসেই তিনি গরম করে ফেললেন।
তিনি মানে তন্দ্রার মা।
সবাই টের পেলো কেউ একজন এসেছেন। নতুন। তবে তিনি হেজিপেজি টাইপ কেউ নন।
মধ্যবয়েসি এ মহিলা দেখতে খারাপ না। কিন্তু সব সময় একটা বিরক্তির ভাব চেহারায় ফুটিয়ে রাখেন। দেখলে মনে হয় সবার ওপরই তিনি বিরক্ত।
কিন্তু নায়িকার মা বলে কথা।
শুটিংয়ের সেটে তার গুরুত্ব অনেক। মা বিগড়ে গেলে নায়িকাও বিগড়ে যাবে, মহাবিপদ। শুটিং প্যাকআপ হবে।
শুটিং স্পটে এসেই তিনি ধরলেন এক প্রডাকশন বয়কে। তার অপরাধ আন্টি বলা।
এই ছেলে তুমি আমাকে আন্টি বললা কেন!
ফুল ভলিউমে বলতে লাগলেন তিনি।
এই আমি কি তোমার খালাম্মা লাগি? এইসব কি ফাইজলামি। নিয়ম-কানুন বলতে কি কিছু নাই নাকি এখানে! দাঁড়াও ডিরেক্টরকে বলতেছি। এইখানে কি আত্মীয়-স্বজনের হাট বসছে নাকি। একজনে বলবে আন্টি। আরেকজনে আইসা বলবে আপা, ভাবী। ওগো-হ্যাগো এইসব কি! আন্টি-ফান্টি বাদ, আমাকে ম্যাডাম ডাকবা। বুঝলা। আর জানি বলতে না হয়।
প্রডাকশন বয় থতমত খেলো। নায়িকাকে ম্যাডাম বলতে হয় এটা তার জানা ছিল। কিন্তু নায়িকার মাকেও যে ম্যাডাম বলতে হয় এটা সে নতুন জানলো। এই লাইনে তার খুব বেশি দিন হয়নি। তার অনেক শেখার বাকি।
সে কোনও রকমে বলল, জ্বি…ম্যাডাম…আন্টি। ভুল হইছে।
খবর চাউর হতে সময় লাগে না। আন্টির ম্যাডাম হওয়া এবং তার মেজাজ এবং মুখের খবর জেনে গেলো সবাই।
ইউনিটে তার নাম হয়ে গেলো ‘আন্টি ম্যাডাম’।
আন্টি ম্যাডামকে সাইড দিয়ে চলে সবাই। কেউ সামনে পড়তে চায় না।
দ্বিতীয় দফায় তার হাতে পড়লো মেকআপম্যান সোলায়মান। বাইশ বছর ধরে সে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে মেকআপ ম্যানের কাজ করছে।
মেকআপম্যান বললে সে মাইন্ড করে। তাকে বলতে হয় মেকাপ আর্টিস্ট। তার বিশেষত্ব হচ্ছে সে খুব সুন্দর গোঁফ দাঁড়ি লাগাতে পারে। সামনাসামনি দেখেও আসল না নকল বোঝার উপায় থাকে না।
সোলায়মান একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের নমিনেশন পেয়েছিলো। তিনজনের একজন। কিন্তু সোলায়মান সবসময় বলে সে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেকেন্ড প্রাইজ পেয়েছে। পলিটিক্স না হলে ফার্স্ট প্রাইজ সে-ই পেতো।
মেকআপম্যান সোলায়মান তন্দ্রাকে মেকআপ দিচ্ছিল। আন্টি ম্যাডাম এসে ধরলো তাকে।
এই যে ভাই, কি শুরু করছেন আপনি! আরে আস্তে ঘষেন। এমনভাবে ব্রাশ মারতেছেন চামড়া উঠট্যা যাইবো তো। আপনার ভাব দেইখ্যা মনে হইতাছে সিমেন্টের দেওয়ালে ব্রাশ মারতাছেন। হুঁশ-জ্ঞানের অভাব আছে আপনার। আর কি মেকআপ দিতেছেন এইসব। হ্যাঁ? আমার ফর্সা মাইয়াটারে কালাকুলা বানাইয়া ফেলছেন! কি আশ্চর্য কথা। ওই থার্ড হিরোইনরে তো ঠিকই টকটকা বানাইয়া দিছেন। নাক বোঁচা মাইয়টারে তো চেনাই যাইতেছে না।
মেকআপম্যান বিরক্ত হলো, কিন্তু মুখে কিছু বললো না। কারণ সেও ইতিমধ্যে হাওয়া টের পেয়েছে। বাইশ বছরে অভিজ্ঞতা তো কম হয়নি।
তার ঘষার গতি থেমে গেলো। আন্টি ম্যাডামের কথা মতো সে মেকআপে ফেইস পাউডারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু আন্টি ম্যাডাম থামলেন না।
ফাস্ট হিরোইনরে মেকআপ দিতাছেন একটু যত্ন-আত্তি কইরা দিবেন না! নায়িকা হইলো গিয়া ছবির প্রাণ। নায়িকা ফুটলে ছবি ফুটবো। এইটা মাথায় রাখবেন সবসময়। আর কাজ হইলো গিয়া ইবাদত। মনযোগ দিয়া করতে হয়। তাড়াহুড়া কইরা কি ইবাদত হয়! রিজিক নিয়া ছেলেখেলা ঠিক না।
মেকআপম্যান সোলায়মান কোনও কথা বলে না, শুধু মাথা নাড়ে।
নায়িকার মেকআপ নেওয়া শেষ হওয়ার পর আন্টি ম্যাডামও খানিকটা মেকআপ নেন। দেখি আমারেও একটু দেন দেখি। চোখের নিচে কালি পড়লো কিভাবে বুঝলাম না। কয়েক দিন ধইরা ঘুমটা জমতাছে না। ঘুমাবো কিভাবে? লোকজনের যন্ত্রনায় অস্থির। খালি তন্দ্রা ম্যাডামের সিডিউল চায়। মোবাইল বন্ধ রাখলে টিএন্ডটিতে ফোন দেয়। রাত-দিনের ঠিকঠিকানা নাই। সুপারহিট মেয়ে নিয়া বিরাট যন্ত্রনার মধ্যে আছি।
…আরে আস্তে। আপনার হাত একটু বেশি চলে। আচ্ছা, আপনে কি আগে তক্তায় রানতা মারার কাজ করতেন নাকি! যত্ন নিয়া কাজ করেন।
সোলায়মান কিছু বলে না। সে হাতের গতি কমায়।
মাশকারা নাই? ওইটাও একটু লাগান।
নায়িকার পর তার মাকে মেকআপ দিতে গিয়ে অন্যদের মেকআপ দিতে দেরি হয়ে যায়। ফলাফল শুটিংয়ে দেরি।
ছোট চরিত্রের দু-একজন খানিকটা কাই-কুঁই করেছিলো। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এর বেশি কিছু বলার অধিকার তাদের নাই।
খবরটা পরিচালকের কাছে গেলেও সে বেশি কিছু বললো না। পরিচালক লাইনে নতুন। ক্যামেরাম্যান থেকে সদ্য পরিচালক হয়েছে। হাতে জোর থাকলেও গলায় জোর এখনো পুরোপুরি আসেনি।
পরিচালক ঝামেলা বাড়ালো না। দেরি যা হওয়ার তা হয়েছে। এখন কিছু বলতে গেলে আরও দেরি হবে। খুচরা শিল্পীদের মেকআপ ছাড়া অভিনয় করলে কিছু যাবে আসবে না। কিন্তু ছবির জন্য নায়িকা খুব ইম্পর্টেন্ট। সেই সূত্রে নায়িকার মাও।
ক্যামেরম্যান কাম নবাগত পরিচালক বিষয়টা ম্যানেজ করে নেয়।
৩.
আন্টি ম্যাডামের মেজাজ যেমন কড়া তেমনি তার গলাও ভীষণ চড়া।
তিনি নিচু স্বরে কথা বলতে পারেন না। এবং শুটিং চলাকালে জোরে জোরে ফোনে কথা বলা তার স্বভাব। দুটো কাজই করেন ইচ্ছাকৃত।
শট চলার সময় কথা বলার কারণ কেউ না কেউ তাকে বারণ করতে আসবে। এই সুযোগে তাকে তন্দ্রা ম্যাডামের গল্প কিছু শুনিয়ে দেন তিনি।
আরে আস্তে মানে! বলে কি এই ছেলে! জানো কে ফোন করছিলো? কল্পনাও করতে পারবা না। নাম শুনলে ফিট খাইয়া পইড়া যাবা, ওয়াসা ডাইকা চোখে-মুখে পানি দিয়া জ্ঞান ফিরাইতে হইবো। আরে, আমার জায়গায় অন্য কেউ হইলে তো মাইক লাগাইয়া কথা বলত। ঘোষ দাদা ফোন করছিলো মাত্র। নতুন ছবির জন্য তন্দ্রা ম্যাডামের সিডিউল চায়।
ঘোষ দাদা! উনি আবার কে?
প্রশ্নকর্তার এমন প্রশ্নে তার গলা আরও চড়া হয়।
ঘোষ দাদারে চেনো না? তুমি কেমন সিনেমার লোক! তাজ্জব করলা তুমি। আরে গৌতম ঘোষ। বিরাট ডাইরেক্টর। ইন্ডিয়ার। গুইনা গুইনা ছবি করে। তন্দ্রার অভিনয়ের তো বিরাট প্রশংসা। নেক্সট ফিলিমের জন্য সিডিউল চাইলো। কিন্তু দিতে পারবো কিনা বুঝতে পারছি না।
এরপর শিডিউল বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তিনি সামনে আগান।
ও তন্দ্রা মা, মামনি, শুইনা যা কে ফোন দিছিলো . . .। আমার তো বিশ্বাসই হইতেছে না।
তন্দ্রাকে ডাকলেও তিনি আসলে তন্দ্রার কাছে যান না। তিনি ফোনের গল্পটি মাথা নিয়ে পুরো ইউনিট ঘুরে বেড়ান। হাতের কাছে যাকে পান তাকেই আয়োজন করে ফোনের গল্প বলেন। মজার বিষয় হচ্ছে একেক জনের কাছে তিনি একেক পরিচালকের নাম বলেন। তিনি কি করবেন? তার যে ভুলে যাওয়া রোগ।
এতে অবশ্য ইউনিটের কেউ কিছু মনে করে না। কারণ তারাও ইতিমধ্যে আন্টি ম্যাডামকে চিনে ফেলেছে।
প্রথম দিনেই আন্টি ম্যাডাম প্রোডাকশন বয়দের ডেকে একটা তালিকা ধরিয়ে দিয়েছেন। নায়িকাকে কখন কি দিতে হবে।
সকালে ডিমের কুসুম ছাড়া পোস, আগুন ছেঁকা দুটো পাউরুটি আর এক কাপ কফি। শুধু লিকার। আন্টি ম্যাডাম সকালে রুটি, ডিম সবই খান সঙ্গে এক চামচ চিনিসহ হাফ কাপ চা। ডায়েটের জন্য যে নায়িকা দুপুরে করলার জুস খায় সেটা জানাতেও ভোলেননি। সঙ্গে থানকুনি পাতা ভর্তা আর কৈ মাছের ঝোল আর একটা কচি শসা। গাছ কচি শসা হলে ভালো হয়। সঙ্গে হালকা বিট লবন।
গাছ কচি শসা পাওয়া গেছে। মফস্বলের দিকে শুটিং হওয়ায় গাছ থেকে ছিঁড়ে কচি শসা আনা হয়েছে। কিন্তু করলার জুস আর থানকুনি পাতা নিয়ে হলো সমস্যা।
পরিচালক মহা টেনশনে পড়ে গেলো। সে দৌড়ে গেলো প্রোডিউসারের কাছে।
বস, করলার জুস নিয়া তো ঝামেলায় পইরা গেলাম। করলা পাওয়া গেছে কিন্তু জুস বানানোর মেশিন আশপাশে নাই। আর থানকুনি পাতা তো অনেকে চেনেই না। এর নাকি অন্য একটা নাম আছে। নামটা বাইর করতে পারতেছি না। ডিকশনারি থাকলে ভালো হইতো।
কেন? শুটিংয়ে কি করলার জুস লাগবো নাকি? কোন সিন এইটা?
না, আন্টি ম্যাডাম বলছেন, নায়িকা নাকি দুপুরে করলা জুস খাবেন সঙ্গে থানকুনি পাতা ভর্তা। করলা রেডি আছে কিন্তু আশেপাশে জুস বানানোর ব্লেন্ডার মেশিন পাওয়া যাচ্ছে না। থানকুনি পাতাও নাই।
প্রোডিউসার কিঞ্চিত বিরক্ত হলেন।
তন্দ্রা এইসব খাওয়া শুরু করলো কবে থেকে! আগে তো হাত দিয়া চটকাইয়া ভাত খাইতো দুই প্লেট। যা দিতাম তাই খাইতো! থানকুনি পাতা ধরলো কবে! ওই রসে কি অভিনয়ের মাথা খোলে? অভিনয় তো কিছুই হয় না।
বস, আগের সেই দিন তো আর নাই। আর আগে আন্টি ম্যাডামও ছিলো না।
আন্টি ম্যাডাম!
প্রোডিউসার ভুরু কুঁচকে পরিচালকের দিকে তাকায়।
আন্টি ম্যাডামটা আবার কে? তারে তো চিনলাম না!
বস, আন্টি ম্যাডাম হইলো তন্দ্রা ম্যাডামের মা।
ওহ…। সে আসছে কি জন্যে? তোমারে না বলছি এক টিকিটে দুই ছবি আমার পছন্দ না। স্যান্ডোগেঞ্জির আবার বুক পকেট।
ডিরেক্টর কিছু বলে না। সে মাথা চুলকায়।
আচ্ছা, আতাহার, তুমি জানি এই ইউনিটের কি?
প্রোডিউসারের প্রশ্নে ভড়কে যায় পরিচালক। আমি…আমি তো বস, ডিরেক্টর।
তাইলে তুমি করলার জুস নিয়া টেনশন করতাছো ক্যান! তোমারে খেলতে কইছি প্রিমিয়ার লীগ তুমি মিয়া থার্ড ডিভিশন লইয়া অস্থির হইয়া আছো। তোমারে দিয়া তো হইবো না। প্রোডাকশন ম্যানেজার আছে কি জন্য। সে ম্যানেজ করবো। করলা কেন দরকার হইলে নিম পাতার চচ্চরি ভাইজ্জা খাওয়াইবো। তোমার কাজ তুমি করো। সারাদিনে তো সিন করছো মোটে দুইটা। টাকা যাইতেছে আমার। মুখ কিন্তু এমনিতেই তিতা হইয়া আছে। করলার জুস খাইতে হইবো না। আমার মুখের কথা শুনলেই কিন্তু তোমাগো আন্টি ম্যাডাম জেনুইন তিত করলার স্বাদ পাইবো।
৪.
দিনে দিনে তিতার পরিমাণ বেড়েই চলছিলো।
শ্যুটিং ইউনিটে আন্টি ম্যাডাম হয়ে উঠেছিলেন এক আতংকের নাম।
কিন্তু হিট নায়িকার একমাত্র মা যতই হট হোক তা মেনে নেয়ার নিয়ম। সবাই সেভাবে মানিয়ে নিয়েছিলো।
কিন্তু . . .
কিন্তু তন্দ্রাই তার মায়ের যন্ত্রনার হাত থেকে সবাইকে রক্ষা করে। সে ঘটনাও ঘটে এক শুটিং স্পটে। একদম ফিল্মি স্টাইলে।
তন্দ্রা অভিনয় করলেও আন্টি ম্যাডাম সব সময় চাইতেন তার মেয়ের বিয়ে দেবেন কোন উচ্চ শিক্ষিত ছেলের সাথে। তার ভাষায় জজ-ব্যারিস্টারের সাথে। নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি। দুই সন্তানও পড়াশোনায় তেমন ভালো হয়নি। উচ্চ শিক্ষার প্রতি তাই তার এক ধরনের দুর্বলতা ছিল ভেতরে ভেতরে।
কোনও নায়কের সাথে মেয়ে জড়াক সেটা তিনি চাইতেন না। খুচরা প্রেম হতে পারে। এটা তেমন দোষের না।
কিন্তু সিরিয়াস টাইপ কিছু যাতে না ঘটে সেদিকে ছিল তার সজাগ খেয়াল। এজন্য নায়ক আর নায়িকার মাঝে দেয়াল হয়ে থাকতেন। নায়কগুলোর কাছ থেকে দূরে দূরে রাখতেন মেয়েকে। অথবা নিজে সবসময় মেয়ের কাছে কাছে থাকতেন।
নায়কগুলোর বেশিরভাগ বদের বদ। একেতো জিকর গাছে আঁঠা আর মিষ্টি কথার ওস্তাদ। তাদের কুটকুট কথায় মেয়েরা হুট করে প্রেমের সাগরে পড়ে যায়। গলা পানিতে ঢুবে যাওয়ার পর হুঁশ ফেরে। তখন সব শেষ। এ বিষয়ে তাই আন্টি ম্যাডাম ছিলেন সদা জাগ্রত।
কিন্তু তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। মায়ের সব রক্ষনব্যুহ ভেদ করে একদিন শ্যুটিং স্পট থেকে পালিয়ে যায় সুপারস্টার হিরোইন তন্দ্রা। পাত্র উচ্চ শিক্ষিত না হলেও উচ্চ বয়েসি। যে ছবির শুটিং চলছিল সেই ছবির প্রোডিউসার। ডিরেক্টরের বদলে নিজেই শুটিং প্যাকআপ করে নায়িকা নিয়ে হাওয়া হয়ে যান তিনি।
বিয়ের পর মাঝে কিছুদিন বিরতি দিয়ে তন্দ্রা অভিনয়ে ফিরলেও আন্টি ম্যাডামকে আর কখনো শুটিং স্পটে দেখা যায়নি।
অলংকরণ: আবু হাসান।