কবিতার সাথে দিনযাপন…
১২ মার্চ ২০২০ ১২:২০
ব্রাসেলসে পোস্টিংকালে যে কজন ইউরোপিয়ান সহকর্মীর সাথে আমার খানিকটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, জেনোভেভা তাদের মধ্যে অন্যতম। ডক্টর জেনোভেভা হারনান্ডেয ইউরিয। ইউরোপিয়ান কমিশনের অধীন ইউরোপিয়ান এক্সটারনাল অ্যাকশন সার্ভিস অফিসে বাংলাদেশ ডেস্কের দায়িত্বে ছিল সে। কয়েক বছর ধরে। কাজের সূত্রে তার সাথে পরিচয়। কথা বলতে বলতে একে অপরের ভালো লাগার বিষয়গুলি ভাগ করে নেওয়া।
তার সাথে আমার পরিচয় হবার আগেই সে দু’বার বাংলাদেশ ঘুরে গেছে বলে জানলাম যেদিন প্রথম তার অফিস রুমে গেলাম। রুমে ঢুকেই চমকে যাবার পালা। যে সমস্ত ছবির পেপারপ্রিন্ট সে তার রুমের সারা দেওয়াল জুড়ে সেঁটে রেখেছে, তার বেশিরভাগ শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর। শিল্পীর স্বাক্ষর দেখে জিজ্ঞাসা না করেই বুঝতে পারি। আমার মুগ্ধ দৃষ্টি তাকেও আপ্লুত করলো। বাংলাদেশ, বাংলা ভাষার প্রতি তার বিশেষ ভালোবাসার কথা জানালো। এর আগেরবার ঢাকায় গিয়ে সে কয়েকটি বাংলা শব্দ শিখেছে। যেমন, শুভ সকাল, শুভ নববর্ষ ইত্যাদি। তার মুখে শব্দগুলো যেনো অন্যরকম ব্যঞ্জনা পেলো।
জেনোভিয়েভ বললো তাকে আমি সংক্ষেপে জেনো ডাকতে পারি। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি লম্বা স্প্যানিশ সুন্দরী জেনোর সাথে এরপর কাজের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় দু’জনের অফিসে দেখা হয়েছে, হয়েছে কথা বিনিময়। তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তার বদলি হয়ে গেলো ইউরোপিয়ান ডেলিগেশনের কাঠমাণ্ডু কার্যালয়ে। ব্রাসেলসে সে এর মধ্যে পাঁচ বছর কাটিয়ে ফেলেছে।
২০১৩ সালের ২২ মার্চ। দু’দিন আগে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে দূতাবাসে শোকবই খোলা হয়েছে। জেনো আসবে ইউরোপিয়ান কমিশনের পক্ষ থেকে শোকবার্তা লিখতে। ওর নেপাল যাবার আগে এই শেষ দেখা। এরপর আর দেখা হবার সময় মিলবে না বোধ হয়। আমরা ঠিক করলাম, সে লাঞ্চের আগে এসে শোকবইয়ে স্বাক্ষর করবে। তারপর আমরা দূতাবাসের কাছে হাঁটা দূরুত্বে শংকর নামের ভারতীয় রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাবো। জেনোর সম্মানে আমার বিদায়ী লাঞ্চ।
সবকিছু পরিকল্পনামতো হলো। খাবার টেবিলে খেতে খেতে আমরা দু’জন অনেক গল্প করলাম। জেনো খুবই মিষ্টভাষী। দারুণ সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে। তার কথা চুপচাপ শুনে যেতে ভালো লাগে। রান্নার রেসিপি থেকে কবিতার বই কোনকিছুই আমাদের সেই শেষ আড্ডা থেকে বাদ গেলোনা। জেনো একটা কাগজে ওর পছন্দের একটা রেসিপি লিখে দিলো। স্যুভেনির হিসেবে তা রেখে দিয়েছিলাম।
আমার কবিতা প্রীতির কথা শুনে জানালো, সেও কবিতা ভালোবাসে ভীষণ। প্রিয় কবির কথা বলতে গিয়ে জানালো উরুগুয়ের কবি মারিও বেনেদেতির কথা। জেনোর মুখে বেনেদেতির ‘অনলি ইন দ্য মিনটাইম এন্ড অফিস পোয়েমস’ বইটির নাম শুনেই চমকে উঠলাম। এরকম নামের কবিতার বই আছে, অথচ আমার জানা নেই!
জেনোর সাথে সেই শেষ দেখা। এর পরে এপ্রিল মাসে আমি ছুটিতে ঢাকায় যাই। সে কারণে তার বিদায় উপলক্ষে সে যে ফেয়ারওয়েল ককটেইল এর আয়োজন করেছিল তাতে উপস্থিত থাকতে পারিনি। ইমেইলে নিমন্ত্রণের জবাবে অপারগতা জানিয়েছিলাম। নেপালে যাবার পরপর, বিশেষ করে ২০১৪ সালের এপ্রিলে সেখানে ভয়াবহ ভুমিকম্পের পরে জেনোর কুশল জানতে চেয়ে মেইল করেছিলাম। ওর নিরাপদ থাকার উত্তর পেয়েছিলাম। সর্বশেষ ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় হলি আরটিজান ট্রাজেডির পর জেনোর সহানুভুতিজ্ঞাপক মেইল পেয়েছিলাম। তারপর দু’জনই কাজের চাপে পারস্পরিক ভালোবাসার কথা মনের তলে স্মৃতি চাপা দিয়ে রেখেছি। বেঁচে থাকলে আবার হয়তো আমাদের দেখা হয়ে যেতে পারে পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে।
তবে জেনো আমাকে যে কবির সন্ধান দিয়ে বিদায় নিয়েছিল, তিনি এখন আমার সাথেই থাকেন। আমার চেতন-অবচেতন এর নানা স্তরে। জেনোকে বিদায় জানাবার পরপরই জীবনে প্রথমবারের মতো আমাজনডটকমে ব্যক্তিগত একাউন্ট খুলে অনলাইনে বইয়ের অর্ডার করে বসলাম। বেনেদেতির কবিতার বইটির নাম শোনার পর থেকেই অস্থির হয়ে উঠেছিলাম সেটি পড়বার জন্য। যেদিন হালকা গড়নের বইটি হাতে পাই, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে অনলাইনে কেনা প্রথম বই সংগ্রহের প্রাথমিক উত্তেজনা ছাড়াও, এক নামহীন ভালো লাগায় অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।
পাতা উল্টাতেই আরেক বিস্ময়। একদিকে স্প্যানিশ ভাষায় লেখা মূল কবিতা,অন্যদিকে হ্যারি মোরালেস এর স্প্যানিশ থেকে করা ইংরেজি অনুবাদসহ দ্বিভাষিক প্রকাশনা। হাতে নিয়েই প্রথমে সূচিতে চোখ বুলিয়ে নেওয়া। তারপর একটির পর আরেকটি মন ভালো করে দেওয়া অভিজ্ঞতা। একেকটি কবিতার নামই যেন বলে দেয় এর ভেতরের মর্মবাণী। অনলি ইন দ্য মিনটাইম, নাউ অন দ্য আদার হ্যান্ড, হাউএভার, স্যালারি, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট, মানডে, বোর্ড অফ ডিরেক্টরস, টাইপিস্ট নামের কবিতাগুলো পড়ে যথারীতি মনে হয়, এগুলো তো আমার লেখার কথা ছিল। একই অনুভূতি যেমন হয় যখন পড়ি কবিগুরুর কোন লেখা, জীবনানন্দ বা ডেরেক ওয়ালকোট এর কোন কবিতা।
ল্যাটিন অ্যামেরিকার অন্যতম পঠিত লেখক উরুগুয়ের মারিও বেনেদেতি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, সাংবাদিক, নাট্যকার, সঙ্গীতকার, স্ক্রীনলেখক হিসেবে ল্যাটিন সাহিত্যের দুনিয়াকে আলোড়িত করলেও ‘অনলি ইন দ্য মিনটাইম এন্ড অফিস পোয়েমস’ বইটির দ্বিভাষিক প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠক তাঁর অসাধারণ সব কবিতার স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ লাভ করে। বইটির কবিতাগুলো আপাতদৃষ্টিতে মন্টিভিডিও এর প্রাত্যহিক জীবনের ওপর আলোকপাত করলেও পাশাপাশি এমন এক অভূতপূর্ব শৈল্পিক সৌন্দর্য এর আধার যে সেগুলো দেশ-কাল-পাত্র ভেদে প্রত্যেকের কাছে আবেদন তৈরি করে। ফলে কবিতাগুলো অর্জন করে সর্বজনীন গুণ।
ধীরে ধীরে কবিতাগুলোর মন্ত্রজালে আটকে যেতে থাকি। মারিও বেনেদেতিকে আরও ভালো করে পড়বার, জানবার জন্য অনুপ্রাণিত বোধ করি। সেই সাথে জেনোর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন দ্রবীভূত হয়ে ওঠে। একজন ভালো বন্ধু সবসময় এমন কিছুর খোঁজ দিয়ে যায় যা বন্ধুর অনুপস্থিতিতেও বারবার তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। জেনোর সাথে এই জীবনে যদি আর দেখা নাও হয়, যতবার আমি বেনেদেতির কবিতা পড়বো, তাঁর কবিতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এরকম কিছু লেখার চেষ্টা করবো, ততবার আমার জেনোর কথা মনে হবে। আমার প্রিয় বেনেদেতির কিছু কবিতা বাংলায় অনুবাদ করবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছি, যদিও অনুবাদ করতে আমার বড় ভয়। এভাবেই হয়তো জেনোর প্রতি আমার নীরব ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে পারবো। হয়তো জেনো একদিন আমার অনুবাদে করা বাংলাতে বেনেদেতির কবিতা পড়ে একইরকম মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হবে।
আর সেদিন অফিস পরিবেশকেন্দ্রিক যে কবিতাটি মাথায় ঘুরঘুর করার পর থেকে বারবার কেবল বেনেদেতির কথা মনে পড়ছিল, সেটিও এখানে দিয়ে দিলাম-
(লোকটা কথা বলে অহেতুক…)
কাউকে কিছু বলতে দেয়না লোকটা,সবজান্তা শমসের তিনি,
কেউ কথা বলতে চাইলেই থামিয়ে দেয় নির্লজ্জ হঠকারিতায়,
সেই সব জানে আর কেউ জানেনা কিছুই এভাবে
গায়ের জোরে কথা বলে, থুতু ছিটায়, অকারণে লোমশ ভ্রুগুলো কুঁচকায়
যেন পা-চাপা-পড়া কেঁচো এক জোড়া লটকে আছে ললাট লালিমায়।
এভাবে সেদিন এক জরুরি আলোচনা সভায়
লোকটার অহেতুক কথার জ্বালায় প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে
কিছুই বলতে না পেরে বিরক্ত হয়ে এঁটে দিলাম মুখে কঠিন কুলুপ।
লোকটা ভাবলো, কাজের কাজ করেছে খুব।
আমি আর বলিনা কিছু, কিছুই আর বলিনা আমি।
এভাবে কিছু না বলে একেবারে চুপচাপ থাকা আমার ধাতে আছে বেশ।
ওদিকে অন্যদের অস্বস্তি দেখি-অস্বস্তি দেখি চোখের তারায়,
স্পষ্ট বিরক্তি মুখের চামড়ায়, নাসিকার কুঞ্চনে
আর কামড়ে ধরা শুষ্ক পুরু অথবা রঙ্গিন ঠোঁটের কোনায়।
লোকটা তারপরও বুঝতেই পারেনা তার সমস্যাটা কোথায়।
বলতেই থাকে একটানা তার আবোলতাবোল উচ্চারণ
জিবে জড়িয়ে যাওয়া আঞ্চলিকতায় ছাওয়া।
আর আমরা, বিশেষ করে আমি, শুনতে থাকি
তার অন্তঃসারশূন্য গালগল্প আর ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া
আরেকজনের যেকোন ধরণের ভালো-মন্দ প্রস্তাবনা।
এরকম হালকা কথার ফাতরা লোক উঁচু পদ দখল করে
সবসময় থাকে সবকালে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পৌঁছাতে
সভার কার্যক্রমে সেদিনের মতো মুলতুবি ঘটে যায়।