Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনাকালের অণুগল্প


১৯ এপ্রিল ২০২০ ১৭:২৯

চাল

নিউমার্কেটের চালের বাজার। জনশূন্য। দু’তিনটা দোকান খোলা। সামনে কয়েকটা গাড়ি। সেসবে চালের বস্তা তোলা হচ্ছে। চালের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। এক ভদ্রলোক দেখলাম মিনমিনে গলায় আড়তদারের সঙ্গে কথা বলছেন। আড়তদার বেশ উত্তেজিত। পাত্তা দিচ্ছে না। কৌতুহল হলো।

: ভাই, এরকম করেন ক্যান। আমরা তো বান্ধা কাস্টমার।

: পাঁচশ মিনিমাম বাড়াইয়া দিতে হইব, নইলে কোন কথা নাই।

: আমাদের তো ধরেন বেতন বাড়ে নাই। বাড়াইব কি বেতনই ত হয় নাই এ মাসে-

: তাইলে মোটাটা নেন। আগে কিন্যা নিবেন না! এখন তো বাড়তি হইবোই –

: কিন্তু আপনারাই ত বললেন…

 

ভাষান্তর

কাঁচের জানালার ওপার থেকে কথা হচ্ছে ওয়ার্লেসে।

: কিছু বলবা বাবা?

মাথা নাড়ায় বৃদ্ধ। চোখের কোল বেয়ে অঝরে পড়ে জল।

যুবকও কাঁদছে

: সব ঠিক হয়ে যাবে। মনে জোর রাখ বাবা। ঈশ্বরকে ডাক।

বৃদ্ধ কাঁদে। কান্নার গমকে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে বিড়বিড় করে বলে

: আফসোস, এতদিন যা জেনেছি সব ভুল।

আর যুবক শুনে তার পিতা পরমেশ্বরের নাম জপছে। পিতার স্বর্গযাত্রা দেখে সে প্রীত হয়।

 

পুরস্কার

করোনায় মৃত প্রথম ব্যক্তিটি স্বর্গে গেছেন।

১৪ দিন আইসোলেশনের পর তাকে চিত্রগুপ্তের দপ্তরে ডাকা হলো।

চিত্রগুপ্ত পিপিআই পরে জানালার ওপার থেকে কথা বলছেন,

: বিরাট কাজ করেছেন আপনি। অন্তত দশ হাজার যমদূতের কাজ একাই করেছেন। এতে আমরা যারপরনাই খুশি।

: ধন্যবাদ বড় বাবু।

: আপনাকে আমরা এই দপ্তরের সেরা পুরস্কার দূতশ্রেষ্ঠ দিতে চাই।

: দারুণ খবর। ভদ্রলোক উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন। তা কবে দেবেন?

: প্রতি বছর তো সালপয়লায় দেয়া হয়, এবারের অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন, আপাতত পোস্টপোনড আছে। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে ঘটা করে দেয়া হবে।

বিজ্ঞাপন

ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ততদিন বাঁচলে…

 

ধন্বন্তরি

ইয়াংচু চিৎকার দিয়ে উঠল।

বিশাল ল্যাবরেটারি। যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। কিন্তু কোন মানুষ নেই। তাই প্রতিধ্বনি হল। তিনমাসের মধ্যে প্রথম মানুষের কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল। ভাইরাসে গিজগিজে এ ল্যাবে এতোদিন স্বেচ্ছাবন্দি ছিল। সে চায়নি দ্বিতীয় কোন মানুষের জীবন বিপন্ন হোক।

তার কষ্ট সার্থক। সে আজ ধন্বন্তরি। যে ভাইরাস মারতে পুরো পৃথিবী ব্যর্থ, তার টিংচারে তা কুপোকাত।

বহুদিন পর সে রোদের আলোয় বের হল।

বসন্ত এসে গেছে। শহরের রাস্তাগুলোতে গজিয়ে উঠেছে আগাছা। তাতে লাল নীল সব ফুল ফুটেছে। রকগুলো ঢেকে গেছে আগ্রাসী লতায়। গাছে গাছে ফল। পাখির কিচিরমিচির। ঝিঁঝিঁর ডাক। ঝিমঝিমে একটা আদিম পরিবেশ।

একটা হরিণ দৌড়ে আসছে। আপ্লুত হয়ে উঠল ইয়াংচু। টোকিও শহরের রাস্তায় হরিণ! পেছন পেছন একটা প্যানথার ছুটে এলো। একটা গরিলা বড়ো একটা কলার ছড়া নিয়ে হেলেদুলে এলো একটু পরে।

ঝিরঝিরে বাতাস দিচ্ছে।

লকডাউন শহর। বিরাণ রাস্তা। ইয়াংচু হাঁটতে লাগল। উঁকি দিল বাসা বাড়িতে। কেউ নেই। উঁকি দিল অফিস আদালতে। কেউ নেই। উঁকি দিল থিয়েটারে, শপিং মলে। কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই।

একটা গাছের নিচে গিয়ে বসল। টুপ করে একটা আপেল পড়ল। আপেলটা কুড়িয়ে নেবে বলে যেই উঠেছে ওমনি একটা বানর এসে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল।

মানুষ ছাড়া ত দিব্যিই আছে সবুজ গ্রহটি। শুধু শুধু বিরক্ত করে লাভ কি!

টিংচারটা রাস্তায় ঢেলে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল ইয়াংচু।

 

ঘরে ফেরার ডাক

একটা ট্যুর ছিল।

ট্যুর না ঘোড়ার ডিম। কোম্পানির পাওনাদারদের থেকে টাকা তুলতে গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম। কঞ্জুস মার্কেটিং ম্যানেজার। গুনে গুনে তিনটা ৫০০ টাকার নোট ধরিয়ে দিল। এতেই যাওয়া আসা। হোটেলে থাকা। খাওয়া।

বিজ্ঞাপন

করার কিছু নাই। দুর্মূল্যের বাজার। গরম দেখালে পর দিন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে। বাসায় ৪ বছরের একটা মেয়ে। কোলে আরেকটা। বউ আছে, বৃদ্ধা মা। শিং বাঁকিয়ে কিছু বলার সুযোগ নেই।

খালি, খোদারে বলি, তোমার কাছে বিচার রইলো। চট্টগ্রাম যাওয়ার বাসের ভাড়াই পাঁচশো টাকা। হোটেল জামানে মুরগী দিয়ে একবেলা খেলে দেড়’শ।

মার্কেটিংয়ে চাকরি করি। সবকিছু ম্যানেজ করে চলতে জানি। যাওয়ার সময় গেলাম চট্টগ্রাম মেইলে। তের টাকার একটা প্লাটফর্ম টিকেট কেটে সেকেন্ড ক্লাসে। নামার পর চেকার ধরেছিল। টিকেটের টিকিটা দেখিয়ে দ্রুত সটকে পড়েছিলাম। বুঝতে পারেনি। দুটো টিকেটই একই রকম দেখতে।

সারাদিন খাতুনগঞ্জে ছুটে কিছু কালেকশন হলো। আইসফ্যাক্টরি রোডের একটা ছালার দোকানে রুই মাছের সালুন দিয়ে পেট ভরে খেয়ে নটায় হাজির হলাম পুরনো স্টেশনে। লোকে লোকারণ্য। হঠাৎ নাকি সরকার লম্বা একটা ছুটি দিয়েছে। লোকজন বাড়ি যাচ্ছে। মনে মনে ভাবি, এরা সব সরকারি চাকরি করে। প্রত্যেকটা মানুষ আমার চেয়ে সুখি। ভাগ্যবান। এতো ভাগ্যবানের ভিড়ে না খেই হারিয়ে ফেলি।

কামরায় গাদাই ভিড়। আমার সম্বল বলতে একটা র‌্যাক্সিনের ব্যাগ। সেটা নিয়ে কলাগাছ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। এর মধ্যে ধরা পড়ল একটা পকেটমারা। একদল হিজড়া চাইল কামরায় উঠতে। ভিড়ের চাপে সুবিধা করতে পারল না। লাকসাম আসার পর ভিড় কমতে থাকে। লোকজনের চোখে ঘুম নেই। বাড়ি ফেরার আনন্দ। খলবলিয়ে শুধু কথা বলে।

– আল্লা তার মিলিটারি ছাড়ছে।

– হ হ সব ইহুদি নাসারা শ্যাষ।

– ভাই সাবধান। হাজার হাজার মানুষ মরতেছেৃ খুব ডেঞ্জারাস ভাইরাস।

– আরে রাখেন তো, এ দেশে কিছু হইব না ট্যাম্পেরেচার একটা বিষয়।

– হ হ পাঁচ অক্ত অজু করেন আর নামাজ… এ্যাই ব্যাটা ডিমে আঙুল লাগাছ ক্যান, ভালো করে ছিল…

– ব্যবসা বুঝছেন সব ব্যবসা। চাইনাগো ব্যবসা।

– ভালা অইছে লম্বা এগগা বন্ধ পাইছি ভাই উডি শশীদল আই গেছে

জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। কাঁচ ভাঙা। সরে বসার জায়গা নেই। ঠাণ্ডা বাতাসে তন্দ্রা লেগে যায়। কথা চলছে। একটা ভিক্ষুক উঠেছে। সেও ঘ্যানঘ্যান করে গান ধরেছে। কয়েকজন তাস খেলছে। সঙ্গে সিগারেট। গন্ধ ও আওয়াজ দুটোই বিরক্তিকর। এর মধ্যে শুরু হলো খুশখুশ কাশি। গুটিসুটি মেরে বসে রইলাম। অল্পকিছুক্ষণের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই। একটা বিশাল মাঠের মধ্যে আমি একা হাঁটছি। দূর থেকে বাচ্চা দুটোর কান্না বউয়ের অভিযোগ মায়ের আকুতি শোনা যায়। আমি হাসি মুখে তাদের টাটা দেই। ঘুমের মধ্যে নিজেকেই বলছি, এই আমি তো হারিয়ে যাচ্ছি। আর দেখা হবে না। আমি কেন হাসছি।

একটা লাঠির গুঁতোয় ঘুম ভাঙে। পুরো কামরা খালি। আমার সামনে মাস্কপরা দুজন পুলিশ। একজনের হাতে লাঠি। একটা কাশি দিতে তারাও ছিটকে গেল। কি তামশার ব্যাপার!

 

চালাকি

সুস্থ-সবল মানুষ। কোনো সমস্যা নেই। ১২ দিন ধরে ঘরে আটকা আছি। দোষের মধ্যে দোষ, ব্যবসার কাজে থাইল্যান্ড গিয়েছিলাম কিছুদিন আগে। তাই হোম কোয়ারেন্টিন।

পুলিশের বাড়াবাড়ি ভাল্লাগে না। বউকে বললাম, একটা কাজ করি, শুধু শুধু বাসায় থেকে লাভ কী, একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। বউ ফোঁচ ফোঁচ করে কাঁদে। এসব নাকি কান্না দেখার টাইম নাই।

পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে চোরাসিঁড়ি ধরে নেমে পড়ি রাস্তায়। মতিঝিল এসে একটা কুরিয়ার সার্ভিসের ভ্যানে উঠি। পথে মায়ের জন্য এক বয়াম হরলিকস আর প্রেশারের ওষুধ নিলাম।

বাড়ির গেটে গিয়ে দেখি একটা ফ্রিজার ভ্যান। ঘটনা কী? ঘরে ঢুকেই দেখি বউ ফোঁচ ফোঁচ করে কাঁদছে। আরে, আমার বউ তো দেখি আমার চেয়ে চালু। আমার আগে এসে পড়েছে!

দূরে মা কপালে চাপড়াচ্ছে, রঞ্জুরে তুই কই গেলিৃ

মা, এই তো এই তো আমি…

কিন্তু কেউ আমার কথা শোনে না। কেউ আমার চালাকি ধরতে পারে না। শুধু কাঁদে। ফ্রিজার ভ্যানে আমার লাশটা ঠাণ্ডা হয়।

 

সংযম

: শুকুর আলি, তোমার গরুর ডাকে তো সারারাত এক ফোঁটা ঘুমাতে পারলাম না। কি ব্যাপার বলো তো।

: স্যার আর কয়টা দিন ধৈর্য্য ধরেন। গরু আপনার অভ্যাস হইয়া যাইব।

: ফাইজলামি করো!

: কি যে বলেন স্যার, সেই স্পর্ধা আমাদের আছে। বাসায় বাসায় দুধ সাপ্লাই দিতে পারতেছি না। খৈল ভুষির যোগান দেব কি করে। তাই গরুরে ডায়েট করাইতেছি। আশা করি দুয়েকদিনের মধ্যে তার অভ্যাস হয়ে যাইব।

হাসান ভাবে কয়েকদিন পর তাকেও হয়ত শুকুর আলির সিস্টেমে যেতে হবে।

 

পুঁজিবাদ

: সারাদিন তো পুঁজিবাদের শ্রদ্ধা করো। জিনিসটা আসলে কি একটু বুঝাই বল তো ছুডু ভাই।

: আচ্ছা বলেন ত, এই মহামারিতে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি লস হবে কোন কোম্পানিগুলোর?

: এইটা ত জানি না।

: লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানীগুলোর।

: তাই তো। মানুষ মরলেই তো টাকা দিতে হইব।

: এখন বলেন এদের লস কাটানোর উপায় কি?

: জানি না।

: আরো বেশি মানুষের মৃত্যু চাওয়া। তাহলে টাকা দাবি করার মানুষ থাকবে না। কোন দাবি পরিশোধ করা লাগবে না।

: সাংঘাতিক!

: এটাই হলো পুঁজিবাদ। এদের ওয়েলফেয়ারের একটা লিমিট আছে। সেটা এক্সিট করলেই তারা হন্তারক।

করোনাকালের অণুগল্প জয়দীপ দে

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর