মহামারি, মহাজন ও মহাদেব
২৯ এপ্রিল ২০২০ ১৫:৪৫
দেশে মহামারি দেখা দিয়েছে। মানুষ রোগে মরছে, শোকে মরছে, না খেয়ে মরছে। এক অসৎ মহাজন পড়ল মহাবিপদে। রোগে ভুগে তার স্ত্রী-সন্তান সবাই মারা গেলো। ওদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ। সে এমনই পাপী ছিল যে কোনো দিন ভগবানের নামও উচ্চারণ করেনি। কিন্তু মহামারীর কারণে সে এমন বিপাকে পড়লো যে, ভগবানের শরণাপন্ন না হয়ে তার উপায় রইলো না। মহামারি রোধে সে ভগবানকে ঘুষ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
ভগবানকে কোথায় পাওয়া যায়? মন্দিরে। সে ভগবানের সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে পড়লো। হনহন করে হাঁটছে তো হাঁটছেই। কিন্তু মন্দির কোথায়—সে তো জানে না। কোনোদিন মন্দিরে যাওয়াও হয়নি। যেতে যেতে পথের ধারে সে এক বৃদ্ধাকে পেলো। কঙ্কালসার বৃদ্ধা পথের ধারে শুয়ে আছে, দেখেই যে কারো মন গলে যাবে। কিন্তু মহাজনের মন গলানোর সময় কই! সে বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘এই বুড়ি, মন্দিরটা কোনদিকে বলতে পারো?’ বুড়ি বললো, ‘বাবা, দুদিন ধরে পেটে একটি দানাও পড়েনি, দুটো খেতে দাও।’ মহাজন ক্ষেপে গেলো। ‘যত্তসব!’ বলে সে আবার দ্রুতপায় হাঁটা শুরু করলো। কিছু দূর যেতেই সে একটি শিশুকে পেলো। শিশুটি ক্ষুধার জ্বালায় চিৎকার করে কাঁদছে, পাশে তার মা মরে পড়ে আছে। সেদিকে মহাজনের নজর যায়নি। সে শিশুটিকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘এই খোকা, মন্দিরটা কোনদিকে জানিস?’ শিশুটি একথা শুনে আরো জোরসে কাঁদতে লাগলো। মহাজন মহাবিরক্ত হয়ে ‘ধেৎ’ বলে, আবার হাঁটতে লাগলো। সে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।
অনেক দূর গিয়ে সে এক কৃষককে পেল। কৃষক নিজের ক্ষেতে বসে কাঁদছে। ধান পেকে ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে, কেনার কেউ নেই। আমাদের মহাজন কৃষককে জিজ্ঞাসা করলো, ‘এই, তুই কি জানিস—মন্দিরটা কোন পথে?’ কৃষক খপ করে মহাজনের হাত ধরে ফেললো। বললো, ‘বাবু, আপনি হামার ধান কটা কিনুন। অল্প কিছু পয়সা দিলেই হবি।’ মহাজন জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, ‘রাখ বেটা! আমি নিজের যন্ত্রণায় বাঁচি না। সে এসেছে ধান বেচতে! মরণ!’ এই বলে মহাজন ফের চলা শুরু করলো।
অবশেষে সন্ধ্যা নাগাদ মহাজন নিজেই একটি জঙ্গলে মন্দিরটি আবিষ্কার করলো। মন্দিরের কোথাও কেউ নেই। জরাজীর্ণ মন্দিরে রয়েছে ধুলায় ঢাকা একটি শিবমূর্তি। মহাজন জুতো খুলে, ভক্তিভরে মহাদেবের সামনে হাতজোড় করে বসলো। চোখ বন্ধ। মহাজনের সময়ের দাম আছে। ভগবানও তো তার জন্য বসে থাকবেন না। তারওপর সে মন্ত্র-তন্ত্রও জানে না। তাই সে সরাসরি মোদ্দা কথায় এলো, ‘ভগবান, তুমি যদি এই মহামারি উঠিয়ে নাও, তাহলে আমি প্রতিবছর তোমার নামে পুজো দেবো।’ কোনো উত্তর নেই। মহাদেব কিছুই বলেন না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মহাজন একটি চোখ একটু খুলে দেখে, না—কেউ তো নেই। আবার বলে, ‘হে প্রভু, মহামারি শেষ করো। আমি তোমার মন্দির গড়ে দেবো।’ নাহ! এবারও কোনো সাড়া-শব্দ নেই। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করার পর, সে কয়েকবার মহাদেবকে ডাকে, ‘প্রভু!’ ‘ভগবান!’ ‘হে মহাদেব!’ কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর নেই। মহাজন অনেকটা হতাশ হয়েই চোখ মেলে মন্দিরের চারদিকটা ভালো করে দেখে। নেই—কেউ নেই। আশাহত মহাজন উঠলো। বাড়ি ফিরতে যেই পেছনে ফিরলো, দেখলো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক জটাধারী ঋষি। গায়ে গেরুয়া রঙের ধুতি ছাড়া আর কোনো পোশাক নেই। সারা গায়ে ছাই মাখা। পায়ে খড়ম, গলায় রুদ্রাক্ষের অসংখ্য মালা। ডান হাতে একটি লাঠি, বাঁহাতে পিতলের একটি লোটা। ঋষির কপালে সিঁদুরের তিলক। লোকটি বেশ লম্বা। তার চোখেমুখে দীপ্তি। মহাজন প্রথমে একটু ভড়কে যায়। তারপর ভাবলো, ইনিই মহাদেব নন তো? বেশভূষা দেখে শেষে বুঝলো—ইনি একজন ঋষি। ঋষিই প্রথমে কথা বললেন, ‘তুই এতো উদ্বিগ্ন কেন?’ মহাজন ঋষিকে সব খুলে বলল। তখন ঋষি জানতে চাইলেন, এখানে আসতে গিয়ে পথে কারো সঙ্গে তার দেখা হয়েছে কিনা। মহাজন বললো, ‘হ্যাঁ, হয়েছে বৈকি!’ সে ঋষিকে বিস্তারিত বললো, সেই বৃদ্ধার কথা, মা হারা শিশুটির কথা এবং অসহায় কৃষকের কথা।
সব শুনে ঋষি বললেন, ‘ওরে অন্ধ! তুই এই ভাঙা মন্দিরে ভগবানকে খুঁজছিস, তোর ভগবান তো তোর পথেই ছিল।’ মহাজন তো ভীষণ অবাক! কি বলে এই লোক! ঋষি আরো বললেন, ‘তোর পথে থাকা ও বৃদ্ধাই মহামায়া, সেই শিশুটিই গজানন, আর ওই কৃষকই তোর মহাদেব। তুই তাদের ফেলে—এসেছিস এই বনে! এই প্রাণহীন ভাঙা মন্দিরে!’
এই কথা শুনে মহাজনের তো মাথায় হাত, ‘তাই নাকি!’ ঋষি মুচকি হেসে সায় দিলেন। মহাজন ঋষিকে কোনো রকমে প্রণাম করে ছুটলো ফেলে আসা পথে।
মহাজন দৌঁড়াচ্ছে তো দৌঁড়াচ্ছেই। পথ যেন শেষই হয় না। অনুমান করে সে প্রথমে এলো কৃষকটি যেখানে ছিল—সেখানে। কিন্তু একি! এখানেই না ধানক্ষেত ছিল! এখন যে নেই! কোথাও সেই কৃষককেও দেখা গেলো না। মহাজন কয়েকবার ডাকলোও, ‘ভগবান! ও ভগবান!’ কিন্তু এই ডাকের প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। একইভাবে মহাজন শিশুটি এবং তার মার মৃতদেহ যেখানে ছিল—সেখানে এলো। সেখানেও কেউ নেই। পথের ধারের সেই মুমূর্ষু বৃদ্ধাটিকেও সে পেলো না।
মহাজন নিরাশ হয়ে সেই জঙ্গলে ফিরে এলো। ফিরে তো এলো, কিন্তু কোনোভাবেই সে আর সেই মন্দিরটি খুঁজে পেলো না। ঋষির দেখাও মিললো না।