আইসোলেশান যুগ; কাওরান বাজার টু নিউ মুর
১৫ মে ২০২০ ১৮:২৪
একটু ভবিষ্যৎ থেকে ঘুরে আসি। আজ ২ মার্চ ২১২০ সাল। আগামীকাল ৩ মার্চ ইব্রাহিম মুহাম্মদের একমাত্র ছেলে মূসা আহমদের বিয়ের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের সকল কাজ সামলাবে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। তাই এ বিষয়ে কোন চিন্তা নেই ইব্রাহিম মুহাম্মদের। ছেলের বিয়েতে উত্তেজনা অনুভব করছেন তিনি। কারণ দীর্ঘ দুই বছর পর তিনি কাল বের হবেন প্রাকৃতিক পরিবেশে। যেতে হবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দূরের নিউ মুর। সেখানেই বিয়ের অনুষ্ঠান। নিউ মুর বাংলাদেশের দক্ষিণে ছোট্ট একটি দ্বীপ।
শুধু ইব্রাহিম মুহাম্মদই নয় ৩৫ বছর ধরে প্রায় সবারই একই অবস্থা। দুই বছর/তিন বছর প্রাকৃতিক পরিবেশে বের হননি এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। বের হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। সবাই ঘরে বসেই কাজ করেন। কেবল বের হন উৎপাদন ও সরবরাহ কাজে নিয়োজিত কিছু মানুষ। তাদেরও খুব বেশি বাইরে বের হতে হয়না। কারণ, ডোর টু ডোর সাপ্লাইয়ের কাজ রোবটই বেশি করে। আর অফিস আদালত সবই ঢুকে পড়েছে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ভিতর। নেই কোন রাজনৈতিক প্রোগ্রাম। দাবি আদায়ে কাউকে করতে হয় না বিক্ষোভ। এক কথায় মানুষের যত ধরণের কাজকর্ম তার ৯৯ ভাগই ভার্চুয়াল।
ইব্রাহিম মুহাম্মদ আর্কটেক ইনকর্পোরেশনের সিইও। বাংলাদেশী নাগরিকদের মধ্যে তিনিই প্রথম এ কোম্পানির সিইও হয়েছেন। চার বছর হলো তিনি সিইও হয়েছেন। কোম্পানির বয়স ৩৪। এই অল্প সময়েই শতবর্ষী অ্যাপল, গুগল, মাইক্রোসফট, আইবিএম, অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠানকে পেছনে ফেলেছে এ কোম্পানি।
ব্রুনাইয়ের ক্যাপক শহরের পাশে জাহাজ আকৃতির বিশাল বাড়িতে থাকেন ইব্রাহিম মুহাম্মদ। নাম আর্ক হেইটস। জাহাজ আকৃতির বলেই হয়ত এমন নাম। আর্ক হেইটসকে বাড়ি বললে ভুল হবে। গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে উপরে ২০০ তলা আর নিচে ৬০ তলা। এটি আসলে বিশাল আবাসিক এলাকা। পাঁচ হাজার পরিবারের বসবাস। সেসব পরিবারের কমপক্ষে একজন আর্ক গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরিরত। কোম্পানির পক্ষ থেকেই থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আর্ক গ্রুপের ১৫০ এর মত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ গ্রুপের এমন অনেকগুলো আবাসন আছে কোনটা উড়োজাহাজ আবার কোনটা চন্দ্রের আকৃতির। যেগুলোর একেকটি বাড়ি আগের শতাব্দির একটি আবাসিক এলাকার মত। তবে ওইটার সঙ্গে পার্থক্য হলো তখন সেটা বড় জায়গা জুড়ে ছিল। তখন হরাইজন্টাল দিককে বেশি বিবেচনা করা হতো। আর এখন ভার্টিকাল দিক। অর্থাৎ তখন ওই আবাসিক এরিয়াতে যা ছিল মাটির উপরে খোলা আকাশের খেলার মাঠ এখন তা ছাদের উপর। আর ইনডোর স্পোর্টসগুলোর সুবিধা হাজারগুণ বেড়েছে। যেগুলোর সবই টেকনোলজি নির্ভর। অবশ্য তখনকার মত এখন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল এখন লাগেনা।
অনলাইন আর প্রযুক্তির কারণেই এমন পরিবর্তন। আর্ক হেইটসের সবচেয়ে কাছের হাসপাতালটিও ৭০ কিলোমিটার দূরে। পরিকল্পনা করেই রেসিডেনশিয়াল এরিয়া থেকে হাসপাতালগুলো দূরে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আরেকটি পার্থক্য হলো আগে রেসিডেনশিয়াল এরিয়ার রাস্তাগুলোতে বিকালে লোকে লোকারণ্য থাকলেও এখন রাস্তায় কালেভদ্রে দু’একজন দেখা যায়। ভিক্ষুকরাও বের হয় না। অবশ্য ভিক্ষুক আছে দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.০০১ ভাগ। অর্থাৎ এক হাজার জনে একজন। তারাও কেউ ফিজিক্যালি ভিক্ষা করে না। তাদের সবার নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে সেখানেই ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ ডিটেইলস ইনফরমেশন আছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকলেও কখনো ব্যাংকে যাওয়ার দরকার হয় না তাদের।
ছোট্ট নিউ মুর আইল্যান্ডের পুরোটা জুড়েই অনুষ্ঠানের আয়োজন। এটি একটি ব্যক্তিগত আইল্যান্ড। মুসা আহমদের শ্বশুরের পরিবার ও ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই এখানে থাকেন। বিশ্বের ১১৪ টি দেশ থেকে অতিথিরা এসেছেন। ইব্রাহিম মুহাম্মদ স্বপরিবারে ৬ সিটারের প্রাইভেট জেট বিমান নিজেই ফ্লাই করে এসেছেন। বছর দেড়েক আগে রিপাবলিক অব বারকিনা ফাসো থেকে ৭ মিলিয়ন ডলার দিয়ে লেটেস্ট মডেলের জেটটি কিনেছেন। পাইলটসহ দুজন ক্রুও নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিছুদিন যেতেই চাকরি ছেড়ে দেন দুজনই। তাদের একজন সাদ্দাম সাদিক। তরুণ পাইলট সাদ্দাম সাদিক জানান, আড়াই বছর আগে যখন ইব্রাহিম মুহাম্মদের ব্যক্তিগত পাইলট হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন তখন মাস ছয়েক বেশ ভালই চলছিল। প্রথম ছয়মাসে প্রতি ১৫ দিনে একবার ইব্রাহিম মুহাম্মদ বের হতেন। বিভিন্ন দেশে যেতেন। পরে আর তেমন বের হননি তিনি। ফলে আমারও কোন কাজ করতে হয়নি। অবশ্য নষ্টের হাত থেকে রক্ষার জন্য মাঝে মাঝে হ্যাঙ্গার থেকে বিমানটি বের করে চালু করেছি। সেটাই ছিল তখন আমার একমাত্র কাজ। বসে থাকতে থাকতে মাথা জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে একই বেতনে একটি কার্গো কোম্পানিতে যোগ দিয়েছি। আর অনেকের মত ইব্রাহিম মুহাম্মদের বিমান চালানোর লাইসেন্স আছে তাই প্রয়োজনের সময় নিজেই ফ্লাই করতে পারবেন এটা চিন্তা করেই নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছি।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পড়ন্ত বিকালে সমুদ্রের ধারে বসেছিলেন ইব্রাহিম মুহাম্মদ। মৃদু বাতাসে উড়ছে কাঁচাপাকা চুল। আর হাতে ছোট ছোট পাথরের দানা। সেগুলো সমুদ্রে ফেলছেন আর ঢেউ দেখছেন। হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন তিনি। ফিরলেন অতীতে। যুবক বয়সের স্মৃতি যেন সবকিছু এলোমেলো করে দিল। মনে পড়লো কাওরান বাজারের হাইটেক পার্কের ছোট্ট রুমে নিজের চাকরির সময়ের কথা। নিজের মাতৃভূমির কথা। সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা।
তখন ২০৮৫ সাল। তথ্য প্রযুক্তিতে ব্যাপক এগিয়েছে বাংলাদেশ। একসময়ের বড় ব্যবসা গার্মেন্টস ব্যবসাও ততদিনে ছেড়ে দিয়েছে মানুষ। সৃষ্টি ও আবিস্কারের দিকেই মনোযোগ দেশের তরুণ প্রজন্মের। তাদের মাথায় নানা চিন্তার খেলা। আর সে চিন্তাকে বাস্তবে রুপ দেওয়ারমত অসীম ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা তাদের দিয়েছিলেন। ফলে স্টার্টআপ বিজনেস থেকে শুরু করে হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিতে আকাশছোঁয়া সাফল্য। পৃথিবী পূর্ব পশ্চিম উভয়ই ছোট্ট এ দেশটির দিকে নজর ছিল। বড় দেশগুলোও বাংলাদেশের মত হতে চাইতো। অবশ্য বছর খানিকের মধ্যেই সব দেশ বাংলাদেশের মতই হয়ে গিয়েছিল। উন্নতিতে নয়। পৃথিবীর সব দেশের অবস্থা সমান হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়ায়নি পৃথিবী।
তখন বাংলাদেশের রাজধানী ছিল ঢাকায়। ঢাকার কাওরান বাজারে ছিল বিশাল সবজির বাজার। ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটারের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখানে ট্রাক, ট্রেন ভর্তি করে টাটকা সবজি আসতো। অবশ্য লঞ্চের সুবিধা না থাকায় কয়েকবার কাওরান বাজার থেকে সবজি বাজার সরানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে সেটা রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল। আন্তরিকতা ছিলনা। আর পেছনে ছিল বড় অর্থের লেনদেন। যাহোক এখানকার বাজারে যেমন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সবজি আসতো তেমনি বেচা-বিক্রি শেষে আবার বিভিন্ন অঞ্চলে চলেও যেত। আর দেশের বাইরেও যেত বিশাল একটা অংশ। রপ্তানির সুবিধার্থে পাশে হাতিরঝিলে তৈরি করা হয়েছিল ওভারপোর্ট। উপরে কার্গো বিমানের উঠানামা। নিচে চক্রাকার ট্রেন ও বাস। আর পানিতে চলতো ছোট ছোট নৌযান।
এমনই অবস্থায় যখন চলছিল তখন কাওরান বাজারে সবচেয়ে বড় ও চেইন আড়ৎদার হঠাৎ কথা বলা বন্ধ করে দেয়। কারণ, কথা বলতে তার সমস্যা হচ্ছিল। আস্তে আস্তে হাত-পা অবশ হয়ে যেতে লাগলো তার। আশেপাশের ব্যবসায়ীরা তাকে ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সময় তৈরি বিশাল হাসপাতালে ভর্তি করালো। দু’দিন একই অবস্থায় থেকে ইহকালের মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন। আড়ৎদারের মায়া কাটতে লাগলো তিনদিন। আবার শুরু হলো বাজারের ব্যস্ততা। চতুর্থ দিনে একই উপসর্গ দেখা গেলো আরো কয়েকজন আড়ৎদার ও কর্মচারির মাঝে। উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর দুদিনও পৃথিবীর আলোবাতাস ভোগ করতে পারেনি তারা। এরপর কয়েকজন পাইকারী ও খুচরা ক্রেতাও একই উপসর্গ নিয়ে মারা যান। এভাবে কয়েকজন থেকে কয়েকশ। শ’ থেকে হাজার। কাওরান বাজার থেকে সারাদেশ। এরপর সারাপৃথিবীতে একই উপসর্গ দেখা দেয় আর মানুষের মৃত্যু হতে থাকে। টানা সাত মাস মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়ে। ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরি, কারখানা, শিল্প সব শেষ হয়ে যায়। সাতমাস একটানা না চলার কারণে বিমানগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। টেকনলজি ফ্যাক্টরিগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। কাওরান বাজার থেকে ছড়ানোর কারণে রোগের নামকরণ করা হয় কাওরান বাজার-৮৫ বা সংক্ষেপে কেবি-৮৫।
কোন জায়গা থেকে রোগটা শুরু হয়েছিল সাধারণ মানুষসহ সবারই সেটা জানে। কিন্তু ডাক্তার, বিজ্ঞানী কেউই কূল-কিনারা করতে পারেনি রোগটার কারণ কী, কিভাবে ছড়ায়? ছোঁয়াচে নাকি প্রযুক্তির মাধ্যমে ছড়ায়? ফলে মানুষ ভয়ে আতঙ্কে কাঠ হয়ে যাবার মত অবস্থা। রোগ থেকে বাঁচতে প্রথম দিকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার সময় মানুষ ভালোভালো খাবার রান্না করে খেয়েছে। সেলুলার ফোন থেকে শুরু করে জুম, রওলা, আউস, ফুলকি প্রভৃতিতে অডিও ভিডিওতে কথা বলেছে। করেছে কনফারেন্স।
শেষের দিকে ভীতি এমন পর্যায়ে পৌছায় যে মানুষের ধারণা হয়, প্রযুক্তি পণ্যের মাধ্যম থেকে হয়ত রোগটা ছড়াচ্ছে। সম্ভবত সেটা গুজবও ছিল। ধারণা আর গুজবে কান দিয়ে মানুষ তাদের সেলফোন, ল্যাপটপ, টেলিভিশন সবই ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। বাঁচার জন্য কেউ কেউ ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। সুরক্ষা বলতে এটুকুই। এতে মানুষ প্রকৃতপক্ষেই আইসোলেশনে চলে যায়। নিজের পরিবার ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেনা। অবশ্য এমন কঠিন অবস্থার মধ্যে কেউ না খেয়ে মরেনি। শেষের দিকে সব দেশের সরকার তাদের নাগরিকদের জন্য মাস দুয়েকের জন্য ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় সবার সঠিক সৎকারও হয়েছে।
এরপর থেকে ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হয়। তবে কেউ আর আইসোলেশন থেকে বের হয়নি। ততদিনে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে আইসোলেশনে থাকতে। পরিবেশের কারণেই মানুষ আইসোলেশন থেকে বের হতে পারেনি। এতে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন পড়েনি। সুযোগও ফুরিয়েছে দেশের সঙ্গে দেশের তুলনার। সেই থেকেই পৃথিবীর সবদেশই একই সমান রেখার উপর চলে আসে।
মাগরিবের আযানের শব্দে হঠাৎ যেন ধ্যানভঙ্গ হলেন ইব্রাহিম মুহাম্মদ। নিজের অজান্তেই মুখে উচ্চারণ করলেন আরে অতীতের এসব চিন্তা করে কী লাভ? যাই নামাজে যাই…।