পিপিই শপিং
২৪ মে ২০২০ ১৮:২১
সাতসকালে গিন্নিকে পত্রিকার খবর দেখিয়ে বললাম, দ্যাখো, দ্যাখো, এই মহামারির মধ্যে শপিংয়ে গিয়ে এক প্রবাসীর স্ত্রী তার মেয়েকে হারিয়ে ফেলেছেন। এই খবর ঘটা করে গিন্নিকে অবগত করার উদ্দেশ্য হলো, সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একজন নারী একটা শিশুকে নিয়ে শপিংয়ে গিয়ে অন্যায় করেছেন সেটা বোঝানো। যদিও একজন মা কতটা শপিংয়ে মজে গেলে তার বাচ্চা হারিয়ে যেতে পারে, সেটা বোঝাতে যাইনি!
গিন্নি সব শুনে বললেন, বোকা মহিলা ঈদ শপিংয়ের ভীড়ে বাচ্চাকে বাসায় রেখে গেলেই পারতো। বেঁচে থাকলে শপিং যে পরেও করা যাবে কিংবা দুর্যোগকালে শপিংয়ে যাওয়া আদৗ ঠিক হলো কি হয়নি সেদিকটা তিনি এড়িয়ে গেলেন। প্রথম খবরে ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয় খবরের শিরোনাম শোনাই, হাসপাতাল থেকে পালিয়ে করোনা রোগী শপিং করছেন।
এক্ষেত্রেও যুক্তি খাড়া, গিন্নি বললেন, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, উপসর্গযুক্ত রোগীর চেয়ে উপসর্গবিহীন রোগীর সংখ্যাই বেশি। সেই হিসেবে অনেক রোগীই তো এদিক-সেদিক ঘুরছে। আমি যে উদ্দেশ্য নিয়ে গিন্নিকে পত্রিকার খবর দেখাতে গিয়েছিলাম তা একেবারেই মাঠে মারা। বুঝলাম, কোনোকিছুতেই মার্কেট গমন আটকানো যাবে না।
গিন্নির সঙ্গে পত্রিকার খবর নিয়ে যখন কথা চলছিল ঠিক সেই সময় শোনা গেল পাশের ফ্লাটে পূর্বাভাসবিহীন কালবৈশাখী শুরু হয়েছে। কান খাড়া করে বুঝতে পারলাম পাশের ভেন্যুরও আলোচ্য বিষয় ঈদ শপিং। একপর্যায়ে পাশের ফ্লাটের ভাবি হুঙ্কার শোনা গেল, আবার যদি শপিংয়ের ব্যাপারে না বলো তো ঘরে রান্না বন্ধ।
এই কথার উত্তরে প্রতিপক্ষ হতে কোনো বাক্য বিনিময় না হওয়াই উত্তম, কিন্তু কিছু একটা বলতে শোনা গেল। ভাইজান মিনমিনিয়ে বলছেন, যাক, রান্নার কাজটা পেলে তো লকডাউনের অলস সময়টা আর একটু ভালো কাটানো যাবে। ভাগ্যিস পাশের ফ্লাটের এই তর্কযুদ্ধ আমি একা শুনেছি। গিন্নি শুনে ফেললে দীর্ঘ দুইমাস যাবত তিনকাজ মানে ঘরঝাড়ু-ঘরমোছা-কাপড় কাচার যে অভিজ্ঞতার মধ্যে আছি, সেখানে আরেক কাজ মানে রান্নাবান্নাটা অনায়াসে যুক্ত হয়ে যেতো।
বোকারা ঠেকে শিখে আর জ্ঞানীরা দেখে। আমি শুনে শিখলাম। এ পর্যায়ে নিজের উদ্ভাবনী জ্ঞান খাটিয়ে গিন্নিকে ডেকে বললাম, শোনো ঈদে কার কী লাগবে তার একটা তালিকা তৈরি করো, তারপর মার্কেটে যাও, আমি ঘরকন্যার কাজগুলো শেষ করি।
এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। গিন্নি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। তোমাদের পুরুষ মানুষের ফন্দি আমি বুঝি, একা একা মার্কেটে যাবো তা হবে না।
এতে চালাকির কী হলো, আমি বাসার তিনকাজ করি আর এই ফাঁকে শপিংটা সেরে আসো। আমি বোঝানের চেষ্টা করি।
গিন্নি তার মোবাইলটা আমার দিয়ে বলে, দ্যেখো! ভাইরাল হওয়া একটা ষ্ট্যাটাস দেখান তিনি, ‘এবার ঈদে টাকা দিয়ে গিন্নিকে একা শপিংয়ে পাঠান, আগামি বছর ঈদে আর পুরোনো বউ নিয়ে বাজারে যেতে হবে না।”
পড়েছি মোঘলের হাতে এবার শপিংয়ে যেতে হবে সাথে। আমার সমস্যা অন্য জায়গায়, আমি আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার বিষয়ে ব্যাপক সোচ্চার। মুহুর্তে মুহুর্তে ঘরে থাকার বিষয়ে ষ্ট্যাটাস দিই।
মহাজ্ঞানীরা মুখে যা বলেন বাস্তবে তা করেন না, আর বাস্তবে যা করেন তা বলেন না। মহাজ্ঞানীর অবস্থাই যদি এই হয়, তবে আমি কিছুটা বরখেলাপ করলে দোষ কী। দোষ নাই, তবে একটু নৈতিক বিপত্তি আছে। আমার প্রিয়তম বন্ধুকে কথা দিয়েছি এবার ঈদে শপিংয়ে যাব না, বেঁচে থাকলে অনেক ঈদ পাব, তখন শপিং করব। বন্ধুও আমাকে একই কথা দিয়েছে।
গরুর খাঁটি দুধ নাকি খাঁটি গরুর দুধ তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, তবে আমি আর আমার বন্ধুর খাঁটিত্ব নিয়ে বিতর্ক নেই। করোনা এ যাবত কয়েকশবার চরিত্র বদল করেছে কিন্তু আমাদের চরিত্রে বিন্দুমাত্র হেরফের হয়নি। লকডাউনের আগে যা ছিলাম এখনও তাই।
আমার বন্ধু দিনে যদি তিনবার #ষ্টে-এ্যাট-হোম ফ্রেমে প্রোফাইল চেঞ্জ করলে আমি করি চারবার। এভাবেই চলে আমাদের ঘরে থাকার অনলাইন প্রতিযোগিতা।
অলস মানুষের কাজ থাকে দুইটা- খাই আর শুই। আর লকডাউনের সময়ে ঘরে ঘরে এখন কাজ একটা বেশি- খাই, শুই আর কই। কই মানে অন্যের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটানো। অবশ্য কেউ কেউ খাই, শুই বাদ রেখে ‘কই’ দিয়েই সময় পাড়ি দেয়।
খাই, শুইয়ের মাঝখানে ওইদিন ‘কই’ হলো বন্ধুর সঙ্গে। একথা সেকথা আজাইরা কথা। কথা প্রসঙ্গে জানতে চাই, সারাদিন ঘরে থাকিস, তো বাজার সদাই কিভাবে চলে? বন্ধু উত্তর দেয়, এই অনলাইনে সব সারি। তোর ভাবি যা যা বলে সেটা অর্ডার করি, ডেলিভারিম্যানের মাধ্যমে অনায়াসে বাসায় চলে আসে।
ও আমার খবর জানতে চায়। আমি বলি, সব তো এখন ভ্যানেই আসে। একেবারে টাটকা শাক-সবজি। ব্যালকনিতে দাড়িয়ে অর্ডার করি। দারোয়ান বাসায় দিয়ে যায়।
বন্ধু অবাক হয়, ভ্যানে সব পাওয়া যায়?
যায় মানে ফলমূল মাছ মাংস সব এখন ভ্যানে পাওয়া যায়। আর কয়দিন পর জামদানি শাড়ি আর আমিন জুয়েলার্সের গহনাও বাসার সামনে ভ্যানে আসবে। সকাল না হতেই ডাক শোনা যাবে, এ্যাই মুরগি, এ্যাই মুরগি, এ্যাই জামদানি, এ্যাই জামদানি। তারপর কেউ বলবে, এ্যাই গহনা, এ্যাই গহনা, খাঁটি গহনা, বাইশ ক্যারেট গহনা।
অনলাইন প্রিয় বন্ধু আগ্রহী হয়ে সেদিন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা অনলাইনে কি সাঁতার শেখা যায়? আমি বললাম অনলাইনে অফিস করা গেলে সাঁতার কেন নয়? আর অনলাইনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে এক সময় ধান চাষও ঘরে বসে অনলাইনে করা যাবে।
ওপাশ থেকে বন্ধুর কথা শোনা যায় না। সম্ভবত অনলাইনে সাঁতারের বিষয়ে ঘাঁটাঘাটি শুরু করেছে।
গিন্নি রেডি হয়েছেন, কিন্তু আমার তো কাজ বাকি। শপিংয়ের যাওয়ার বিষয়ে বন্ধুর কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে, না জানিয়ে গেলে বিশ্বাসভঙ্গের দায় ওঠবে আমার মাথায়।
কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দিলাম। বললাম, তোর ভাবির চাপে কথা তো আর রাখতে পারছি না, শপিংয়ের জন্য একটু বের হতেই হচ্ছে। ওপাশ থেকে ফিসফিসিয়ে উত্তর এল, পরে ফাঁন দে, আমি তোর ভাবির সঙ্গে শপিংয়ে।
আমার আর বাধা নাই। গিন্নি আর আমি পিপিই পরে শপিংয়ের উদ্দেশে বের হলাম।
আমাদের মতো ছিঁচকে সচেতন অনেকেই পিপিই পরে শপিংয়ে এসেছে। ভীড়ের মধ্যে আমি গিন্নির হাত ধরতে গেলাম যাতে হারিয়ে হারিয়ে না যায়, অমনি গালে এসে পড়ল এক কষানো চড়। ভুলটা কোথায়- সেটা বুঝে ওঠার আগেই পাশ থেকে গিন্নি বলল, ঠিকই আছে, খুব অন্য মানুষের হাত ধরতে ইচ্ছে করছে, তাই না?
পিপিইর এই এক সমস্যা। কাউকে চেনা যায় না।
যাই হোক, পকেট খালি হয়ে যাওয়ায় এক পর্যায়ে শপিংয়ের ইতি টানলাম। পিপিইর কারণে শরীর ঘামে ভিজে গেছে। শপিংব্যাগগুলো গিন্নির কাছে রেখে গেলাম ওয়াশরুমে। মিনিট পাঁচেক পরে এসে দেখি গিন্নি নেই। পাশে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, সে জানালো, ওয়াশরুম থেকে এক পিপিই পরা ভদ্রলোক বেরিয়ে শপিংব্যাগগুলো নিয়ে হাঁটা শুরু করল আর এখানে দাড়ানো ভদ্রমহিলা তার পেছনে পেছনে গেলেন।
সর্বনাশ হয়ে গেছে, আবারও সেই পিপিই বিভ্রাট। তাড়াতাড়ি ফোন দিলাম। গিন্নি ফোন পেয়ে তাড়াতাড়ি যথাস্থানে এলেন, কিন্তু শপিংব্যাগ বহনকারীর পাত্তা নাই। কোথায় কাকে খুঁজব? চীন দেশের মানুষের মতো পিপিই পরা সবার চেহারাই এক।
যা হয়েছে হয়েছে, সিদ্ধান্ত হলো বাসায় ফিরব। মার্কেটের গেটেও ব্যাপক ভীড়। ঠেলেঠুলে কোনমতে একটা সিএনজিতে উঠলাম। শপিংব্যাগ হারানোর দুঃখে পথে একটা কথাও বললাম না।
কিন্তু এ কি! কোথায় এসেছি? এ তো যাত্রাবাড়ী!
গিন্নিকে জিজ্ঞেস করতে গেলাম, এখানে কেন?
গিন্নি নয়, অন্য এক ভদ্রমহিলা বললেন, এ্যাঁ, আপনি কে?