কবি আল মুজাহিদী, ডালপালা মেলেছেন দুই বাংলায়
২৭ আগস্ট ২০২১ ১০:০০
বাংলা ভাষায় আমার পছন্দের লেখকদের একজন কবি আল মুজাহিদী। তিনি একজন বিশুদ্ধ লেখক ও গবেষক। শিল্প-সাহিত্যের সর্বঅঙ্গ স্পর্শ করেছেন সমান দক্ষতায়। কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ। তার লেখা আমাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করে। তিন দশকেরও অধিককাল তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। পরে সহকারী সম্পাদক হলেন। বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হয়েছেন।
দশক বিবেচনায় আল মুজাহিদী ষাটের দশকের কবি। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি ও কথাশিল্পী আল মাহমুদের পর কবি আল মুজাহিদী ও কবি আসাদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। এই সৌভাগ্য কবি শামসুর রাহমানসহ সমকালীন অনেকের হয়নি।
আল মুজাহিদী সমাজ বিকাশে সামনের কাতারের সৈনিক। কাল ও সমাজ সচেতন বিশ্ববীক্ষণের কবি। স্বভূমি, স্বদেশ এই সমতটের লোকায়িত ঐতিহ্য বন্দিশে আত্মমগ্ন তিনি। ৬০ এর দশকে ছিলেন ছাত্র রাজনীতির অন্যতম পুরোধা পুরুষ। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে রাজবন্দী হয়েছেন। সশস্ত্র এবং বুদ্ধিভিত্তিক সংগ্রাম করেছেন। নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাজ্ঞ তাত্ত্বিক হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়।
আমাদের ভাষা আন্দোলনের চেতনা, স্বাধীনতা ও মানবিকতা আল মুজাহিদীর কবিতায় নানাভাবে উচ্চারিত, উচ্চকিত হয়েছে। প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল এই কবির চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা স্বতন্ত্র ধারায় বহমান। বিস্ময়কর জাগরণের, আবিস্কারের, উদ্ভাবনের জন্য তিনি অগ্রসর পাঠকের হৃদয় ছুঁয়েছেন।
সমাজমনস্ক ও স্বদেশ-আত্মার মানুষ আল মুজাহিদী লেখক হিসেবে ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়েছেন উভয় বাংলায়। অসম্ভব শক্তিশালি তার কল্পনার জগৎ। পৃথিবীর শুভতর, অধুনাতন বার্তা বয়ে বেড়ান তিনি। মানব সম্প্রীতির সমুজ্জ্বল সম্ভাষে স্ফুর্ত। যুদ্ধবিরোধী, ভালোবাসা, জীবন ও মৃত্তিকা তার কবিতার মূল বিষয়। নির্মাণ শৈলীর দিক থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্রমবিবর্তন ধারায় এক উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছেন। কলকাতায় কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে তার জনপ্রিয়তা আমি প্রগাঢ় ভাবে লক্ষ করেছি। এমনকি বিলেতেও পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের মধ্যে তার বইয়ের কদর রয়েছে।
কবি আল মুজাহিদী সর্ব অঙ্গে কবি। তার শ্রেষ্ঠ কবিতাগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের প্রাগ্রসর পাঠকের কাছে আনন্দের সংবাদ। মৃত্তিকা এবং মৃত্তিকার মর্মন্তলে চলে যান সাবধানী সন্ধানীর মতো। কবিতার পঙ্ক্তি মালা যেন তার জীবনেরই অঙ্গ। ‘হেমলকের পেয়ালা’, ’ধ্রুপদ ও টেরাকোটা’, ’দূত পারাবত’, ’মৃত্তিকা অতিমৃত্তিকা’, ’সমুদ্র মেখলা’, ’কালের বন্দিশে’, ’কাঁদো হিরোশিমা কাঁদো নাগাসাকি’, ’যুদ্ধ নাস্তি’, ’ঈভের হ্যামলেট’, ’সহস্র দিবস সহস্র রজনী’ ’যুদ্ধ বিরোধী কবিতা ও অন্যন্য’ ইত্যাদি গ্রন্থের মাধ্যমে স্পর্শ করেছেন উজ্জ্বল কাব্য রবি। ’ইস্টিশানে হুইসেল’, ’সোনার মাটি রূপোর মাটি’, ’পালকি চলে দুলকি তালে’ কিশোর কবিতার পাশাপাশি ’হালুম হুলুম’ ও ’তালপাতার সেপাই’ ছড়ার বই পাঠকমন জয় করেছে।
‘অন্ধকার হয়ে গেল পৃথিবীটা‘ কবিতাটি আল মুজাহিদীর সেই শক্তিশালী জ্যোতির্ময় কাব্যসত্তার প্রতিনিধিত্ব করছে। ’অন্ধকার হয়ে গেলো/ অন্ধকার হয়ে গেলো পৃথিবীটা/ এই গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেলো মানুষের মুখ/ তবুও উন্মুখ আলোকণা জন্ম নেয়- এই মৃত ভস্মাধারে।/ আগুনের ঝাঁজরা পোড়া মানুষের করোটি-রা/ পড়ে থাকে প্রদোষের নিচে/ এখনো দিগন্ত লাল/ বেলাভূমে ছায়া নামে/ ‘নিসিকি’ সী-বীচে।/ হিরোশিমা কাঁপে। কেঁপে ওঠে/ বারবার। সভ্যতাও ফ্যালে অশ্রুজল;/ নায়াগ্রার প্রপাতের/ চেয়ে, আহা! আরো বেশি অবিশ্রান্ত/ এ শোক প্রবাহি!/ তবু থেমে নেই গান-/ মানুষের পদপাতে/ প্রগতির পথের নির্মাণ;/ তুমি কি আসবে কাল?/ হেসে ক্ষণকাল?/ ভাঙবে এ অন্তরাল?/ দিনের প্রথম আলো হাতে/ দাঁড়াবে উঠোনে/ ধ্বংস্তূপ পড়ে থাক দূরে, বহুদূরে/ আলোকণা আছে আরও এই অন্তপুরে/ প্রিয় প্রকৃতিকা,/ কোথাও যেও না আর ‘অসুর-সংঘাতে’।/ আমি জানি, পৃথিবীতে/ প্রতিদিন সূর্যমুখী ফোটে/ তোমার সূর্যও আশায় আশায়/ জাগে। শুধু জেগে ওঠে। ’
‘আগুন নেভেনি, আগুন নেভেনা ‘ আল মুজাহিদীর হৃদয়স্পর্শী কালজয়ী কবিতা। ’শান্তিবাদী বললেন, ‘শান্তিই যুদ্ধ থামাতে পারে।’/ যুদ্ধংদেহী দানব বললে, ‘শান্তি নিস্ক্রিয় নিদানপত্র।’/ কবি বললেন, ‘শান্তি একটা ইমেজ।’/ তুমি বললে, ‘শান্তি একটি প্রতিমা।’/ আমরা সকলে ভাঙতে ও গড়তে পারি।/ শিশুরা বললে, ‘তোমরা আগুন নেভাও,/ আমরা ভুল করে আগুনে হাত দিতে পারি।’/ কতিপয় কাপালিক ভীষণ দ্রংষ্টাঘাত করলো/ শিশুটির কোমল শরীরে।/ ঘরে-ঘরে, ভেতর-বাইরে, পৃথিবীর প্রতিটি উনুনে/ হিরোশিমায়, ফিলিস্তিন, কসোভায় আগুন জ্বলছে। / আগুন নেভেনি ব্যাবিলনে।/ আগুন নেভেনা। / আণবিক চুল্লি জ্বলে দিনরাত / ধিকিধিকি।’
‘নাগাসাকি সভ্যতার শেষকৃত্যে’ আল মুজাহিদী অসাধারণ সৃজনশীলতা দেখিয়েছেন। ‘আমরা কি সূর্যকে আবার বলতে পারবো, ‘আমরা এখনও সেই নরকের জ্বলন্ত অঙ্গারে জেগে আছি।’/ মানুষের মড়ার খুলিতে ধ্বংসের আগুন/ আমাদের করোটিতে দজ্জালের খড়গ তুলে ধরা/ আমাদের হৃৎপিণ্ডে দানব বাজাচ্ছে যুদ্ধের দামামা/ তুমি কিন্তু এখনও জ্বলছো মাথার উপর আগের মতোই/ সভ্যতার শেষকৃত্যে তুমি এখনও জ্বলছো।/ প্রেয়সীর পোড়ানো শরীরে কিংবা স্তনবৃন্তে ঝরে পড়েছিলো/ তোমার শেষ রশ্মি। আমি শুধু তোমার আলোর চিহ্ন থেকে চিনে নিতে/ পেরেছিলাম আমার প্রিয়তমার আদল। সূর্য, আমরা কি তোমাকে আবার বলতে পারবো, ‘আমরা এখনও/ সেই নরকের জ্বলন্ত অঙ্গারে জেগে আছি।’/ আমাদের নির্বাক করোটি/ আমাদের অসহায় হৃৎপিণ্ড/ আমাদের নির্বাসিত স্বাধীনতা/ পৃথিবীর ঘরে ঘরে নিসর্গের লোকালয়ে/ একেকটি মমির মতো জেগে আছে। নাগাসাকি,/ তুমি আমার আত্মার ফলক চিহ্নিত সেনোটাফ/ আমাদের শোক আমাদের দুঃখ জেগে থাকে এখানেই/ শোকের মর্মরে নির্মিত এ ম্যুসলিয়াম।/ পৃথিবী, আজ দেখছি তোমার নিজের মঙ্গল চেতনায় তুমি মগ্ন/ আর আমি? প্রেয়সীর জন্য বিলাপ করছি/ আর আমার পিতৃপুরুষের ফসিলের জন্য।/ নাগাসাকি, তুমি বাংলার মৃত্তিকা থেকে কুড়িয়ে নাও/ শতাব্দীর ঝরাপাতা/ এলিজিগুচ্ছ।’
সাম্য ও মানবতার জয়গানে বিদ্রোহী কবি নজরুলের চেতনায় আল মুজাহিদী নতুন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। যুদ্ধ বিগ্রহের বিরুদ্ধে তিনি এবং আধুনিক বাংলা কবিতার আরেক দিকপাল শহীদ কাদরী ছিলেন বজ্রকন্ঠ। আল মুজাহিদী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রক্তঝরা সংঘাতের সহৃদয় ব্যাখ্যাদাতাও। তার কবিতা পাঠকের মানস দিগন্তে নতুন আলোর উদ্ভাস। মানবপ্রেমীদের হৃদয়ে তার এই পঙিক্তিমালা বেঁচে থাকবে অনন্তকাল।
যুদ্ধবিরোধী কবিতা প্রসঙ্গে কবি আল মুজাহিদী বলেন, হিরোশিমা নাগাসাকি এই শব্দযুগল আমার কৈশোর স্মৃতির অন্তর্গত। ষাটের দশকের ফেরারি সময় থেকেই বিশ্বযুদ্ধের বর্বরোচিত ধ্বংস ও রক্তযজ্ঞ সম্পর্কে আমি সচেতন হয়ে উঠতে থাকি। ঐ সময় রাজনৈতিক কারাবাসের মূহুর্তে ‘কাঁদো হিরোশিমা কাঁদো নাগাসাকি’ কবিতাটি রচনা করি। কারামুক্তির পর যুদ্ধের ইমেজের ওপর আরও কবিতা লিখতে শুরু করি। এমনি করে অনেক ক’টা বছরে অনেক ক’টা কবিতা লেখা হয়ে গেলো। ঐ যে বলছিলাম, রাজনৈতিক ফেরারি সময়ে লেখাগুলো খোয়া যায়। আবারও প্রচেষ্টা করি একটি পূর্ণাঙ্গ পান্ডুলিপি তৈরি করতে। উনিশশ’ একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী আমার টাঙ্গাইলের বাসভবন তছনছ করে দেয়। আর পান্ডুলিপিটি আবার পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। ধ্বংস্তুপ থেকে আর কোনো কিছুই উদ্ধার করা সম্ভবপর হয়নি তখন। এ সহস্রাব্দের শুরুতেই পান্ডুলিপিটির কাজ শেষ করতে সমর্থ হই। আগেই বলেছি, হিরোশিমা নাগাসাকি আমার মানসপটভূমিতে আলোড়ন তোলে। জীবনের প্রায় প্রতি পদক্ষেপেই। বাইরের বস্তুবিশ্বের থেকে কবির জগত কি আলাদা? কখনোই নয়। চেতনা, অবচেতনা নিয়েই কবির জগত। আত্মার অনন্ত নির্দেশেই কবির জীবনযাত্রা। কবি এই পৃথিবীর ভিতরই আরেক পৃথিবী নির্মাণ করেন। নান্দনিক, সুন্দরতর, শুভতর পৃথিবীলোক। কবি সে উজ্জ্বল প্রজ্বল পটদিগন্তলোকের বাসিন্দা করতে চান পৃথিবীবাসিদেরও। প্রতিটি মানুষই যেন নিজ নিজ পৃথিবীর সৃষ্টির স্রষ্টা। আর সেই সঙ্গে এর বাসিন্দাও।
জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, এই মনের ও মহাপ্রাণনের পৃথিবীর অস্তিত্ব তাদের কাব্যের ভিতর। আমরা বাস্তব বিশ্ব ও সমাজ পরিসর থেকে বিমুখ হতে পারিনা। বস্তুপুঞ্জ ও সময়ের মুখোমুখি আমরা সকলেই নিরন্তর। পৃথিবীর অন্ধকার যেমন আচ্ছন্ন করে, পৃথিবীর আলো আভা, উজ্জ্বলতাও তেমনি উচ্চকিত করে আমাদের। দৈশিক ও বৈশ্বিক অবক্ষয়, ধ্বংস, বিনাশ আক্রান্ত করে। এ গ্রহে, এ মর্ত্যজীবনে সুন্দর ও শুভতাই তো প্রার্থিত, আকাঙ্খিত।
পৃথিবীর ঘনঘটাঘোর অন্ধকার ও অশুভ অসুরের বিরোধাভাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়- অখন্ড, অবিভাজ্য মানবতার রক্ষা করার তাগিদে। অসমাপ্ত সুদীর্ঘ বর্বরতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হয়। দাঁড়াতেই হবে শান্তি, সভ্যতা ও প্রগতির নামে। অনিঃশেষ উজ্জ্বল মানবতা ও মানবিকতার স্পন্দন তুলতে হবে। পৃথিবীর মানুষের শিরায় শিরায়, অস্থি মজ্জায়, রক্ত মাংসে। এই অখণ্ড অনুভব থেকেই আমার এই বিনীত প্রয়াস। হিরোশিমা নাগাসাকি ধ্বংসের নৃশংসতায় এ আমার প্রতিবাদ।
সাম্রাজ্যবাদীদের বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা ও বর্বরতার বিবর কোটর থেকে মনুষ্যত্বকে রক্ষা করার অনুভব মাত্র এটা। এ আমার কাব্যিক অনুভূতি ও অভিব্যক্তি। পারমানবিক বোমা ফাটানোর বিরুদ্ধে অসন্তোষবহ্নি। ভিতরের কৃষ্ণাগ্নি বলা যেতে পারে। পারমাণবিক, আণবিক অনিশ্চয়তার বিপরীত মেরুতে আমরা দাঁড়াবো চিরদিন, চিরকাল। হিরোশিমার অন্ধকার নাগাসাকির অভ্রভেদী আর্তির পুনরাবৃত্তি যেন আর কখনো হয়না। পৃথিবী ও পৃথিবীবাসীর স্থায়ী শান্তি ও অবস্থানের আকাঙ্খায় আবার প্রাণিত হবো আমরা। যুদ্ধের বর্বরতা বন্ধ করতে অটল হিমাচল হবো আমরা। আমরা মা শিশু সহোদর সহোদররা স্বপ্ন ও সান্নিধ্য অনুভব করবো। মনুষ্যত্বের অমরতার জয়গান গাইবো। একত্রে, একই কন্ঠে।
আল মুজাহিদী একজন সফল কথাসাহিত্যিক। ’প্রপঞ্চের পাখ’ ও ’বাতাবরণ’ গল্প গ্রন্থে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছেন। ‘মানব বসতি’, ’সনেট’, ’আর্কিওপটেরিক্স’, ’সোনাটা স্যোনাটা ও সিলুএট’ এবং ’কালমিতি’ উপন্যাস লিখে কথা সাহিত্যের সব পথই করেছেন মসৃণ। ‘লালবাড়ির হরিণ’ আর টু’পুনের ডায়েরি’র মত কিশোর উপন্যাস নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করেছে। ’কালের করোটি’, ’মেরুমৈত্রী’, ’যুগান্তরের যাত্রী’, ’নৈতিকতা ও নান্দনিকতা’ প্রবন্ধ গ্রন্থের মাধ্যমে পাঠককে অনায়াসে চেতনার গভীরে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন।
যৌবন ও পৌরুষ শাসিত অভিজ্ঞতার কথা সমুদ্র শঙ্খের মত বেজে ওঠে আল মুজাহিদীর কাব্যে এবং গদ্য রচনার পরতে পরতে। ’নৈতিকতা ও নান্দনিকতা’ প্রবন্ধ গন্থে সেই স্বাক্ষর ভাস্বর। বাংলা গদ্য সাহিত্যে এসবই অনন্য সংযোজন।
কবি ও কথাসাহিত্যিক আল মুজাহিদী সাহিত্যের সব শাখাতেই অঘোষিত সম্রাট। সব্যসাচী লেখক হিসেবে সময়কে ধারণ করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে লিখেছেন। দলবাজি তার লেখায় প্রাধান্য পায়নি কখনো। ইতিহাস-নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। বরং বোধের জগতে নাড়া দিয়েছে।
কবি আল মুজাহিদী রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তার দীপ্ত তারুণ্যেই। ১৯৬৯ সালের প্রাদেশিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগকে বাংলা ছাত্রলীগে রূপান্তরিত করেন। বাংলা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব আল মুজাহিদী আইয়ুবের কালো দশকে কারাবরণ করেন বহুবার। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।
ভ্রমণপ্রিয় আল মুজাহিদী পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরেছেন। তিনি যুদ্ধ বিরোধী শান্তি সম্মেলন ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। যদিও দেশভ্রমণও তার প্রিয় বিষয়। বহু ভাষায় অভিজ্ঞ আল মুজাহিদীর ব্যক্তিগত শখ বিভিন্ন ভাষা শেখা। উর্দু, ফার্সি, হিন্দি, নেপালি এসব ভাষা তিনি চর্চা করেন নিয়মিত।
কবি আল মুজাহিদী জাতীয়ভাবে বহু পুরষ্কার অর্জন করেছেন। ২০০৩ সালে একুশে পদক ও ২০১৮ সালে বাসাসপ কাব্যরত্ন পদক লাভ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পেয়েছেন, জীবনানন্দ দাশ একাডেমী পুরস্কার, কবি জসীমউদ্দীন একাডেমী পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন একাডেমী পুরস্কার, শেরে বাংলা সংসদ পুরস্কার, জয়বাংলা সাহিত্য পুরস্কার।
কবি আল মুজাহিদী ১৯৪৩ সালের ১ জানুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর নারুচি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আব্দুল হালিম জামালী ও মাতা সাখিনা খান জামালী।
আল মুজাহিদী ১৯৭৩ সালের ২২ জুলাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী পলিন পারভীন। পুত্র শাবিব জামালী আল মুজাহিদী ও কন্যা মারিয়ামা জীবান আল মুজাহিদীকে নিয়ে তাদের সুখী দাম্পত্য জীবন।
ছাত্র জীবনে কবি আল মুজাহিদী নারুচি ফ্রি বোর্ড প্রাইমারী স্কুলে পড়েছেন। তারপর টাংগাইল বিন্দুবাসিনী গভর্নমেন্ট হাই স্কুল ও সিরাজগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাইস্কুলে। কলেজ জীবনে করটিয়া সাদৎ কলেজ, ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজে অধ্যয়ন করেছেন। সমাজবিজ্ঞান এবং বাংলা ও সাহিত্যে মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কবি আল মুজাহিদী বর্তমানে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত দৈনিক আ্যডর পত্রিকার আঞ্চলিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অংশগ্রহণকারী কবিদের মতামতের ভিত্তিতে কবিতা বাংলাদেশের সভাপতি মনোনীত হয়েছেন।
কবি আল মুজাহিদী লিখে যাচ্ছেন অবিরাম। তার ভাষায়, আমি লিখছি আর ভাবছি। পৃথিবীজুড়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে এতো নির্যাতন কেন? কী তাদের অপরাধ? আমি লিখছি আর জেগে উঠছি বারবার। হে নবীন, জেগে উঠার সময় এসেছে, নাও হাতে কলম, লিখো মানবতার গান।
লেখক: কবি ও কথা সাহিত্যিক
সারাবাংলা/এসবিডিই