পুঁজিবাদের আগ্রাসনে স্বাধীনতার মূলনীতি
৮ এপ্রিল ২০১৮ ১৩:৫২
বীরেন মুখার্জী
বাঙালি জাতির ‘মহত্তম অর্জন’ স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন স্বদেশভূমি গঠন। আর স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল স্মারক হিসেবে আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি গৃহীত হয়েছিল। বাঙালির সমষ্টিগত সংগ্রামের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি হিসেবেই যে এই মূলনীতিগুলো এসেছিল, তা অস্বীকারের উপায় নেই। যুদ্ধের সময়ে তিনটি নীতির কথা শোনা গেছে; আর জাতীয়তাবাদ যুক্ত হয়েছে যুদ্ধজয়ের পরে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর বহুবারই সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে জাতীয় মূলনীতি থেকে সরে আসার চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। তবে, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন আইন-২০১১ সংসদে পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্রপরিচালনার পূর্বেকার চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে ফিরে এসেছে। এ ঘটনা স্বস্তিকরই বটে।
স্বাধীনতা অর্জনকালে প্রাথমিক প্রয়োজন ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার। যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের শুরুই হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে। ‘দ্বিজাতিতত্ত্বটা ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ওপর নির্ভরশীল’- যা দেখা গেছে ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সময়। আর বাঙালিরা সেটা প্রত্যাখ্যান করেছিল বলেই পাকিস্তানের আঁতে ঘা লেগেছিল। যার কারণেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী উন্মাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালিদের ওপর, ইতিহাসের সাক্ষ্য এমনটিই। আবার পাকিস্তান রাষ্ট্র নায়করা কেউই রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করতে কার্পণ্য করেননি। তবে ধর্মকে তারা ধর্মের স্বার্থে ব্যবহার করেন নি, করেছেন ব্যক্তিগত স্বার্থেই। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূত্রপাত হয়েছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে নাকচ করে দিয়ে। বাঙালি ধারণ করেছিল বাঙালি জাতীয়বাদ।
মূলনীতির আরেকটি ‘গণতন্ত্র’। যা পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থায় কখনো দেখা যায়নি। রাষ্ট্রটির শাসনব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি আমলানির্ভর। কখনো কখনো অসামরিক হলেও, সামরিক শাসনই ছিল বড় একটা সময়জুড়ে। গণতন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে নাগরিকদের অধিকার ও সুযোগের সাম্য, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব। আবার গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তও ধর্মনিরপেক্ষতা। একই রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মীয় বিভাজন দূর করাটা ছিল অত্যাবশ্যকীয়। আর যাকে গণতন্ত্র বলা হয়, তা অর্জন করতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া সম্ভব নয়। তার কারণ, সম্পত্তির সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা না করলে অধিকার ও সুযোগের সাম্য আসে না; ধনবৈষম্য বহুবিধ বৈষম্যের আকর হয়ে দেখা দেয়। পাকিস্তান শাসনামলে সব ক্ষেত্রেই যা ঘটেছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার জন্য যে সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ, তাতে জাতীয়তাবাদীরা যেমন ছিলেন, তেমনইভাবে সমাজতন্ত্রীরাও ছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সমাজতন্ত্রীরাই ছিলেন সম্মুখবর্তী শক্তি। স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত লড়াইয়ে তারা নেতৃত্ব দিতে পারেননি, এটাও সত্য। সমাজতন্ত্রীরা সামনে থাকলে রাষ্ট্রীয় চার নীতির মধ্যে সর্বশেষ ‘সমাজতন্ত্র’, সেটিই হয়ত এককভাবে প্রতিষ্ঠা পেত; অন্য তিনটির আবশ্যকতা থাকত না। স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এসে, বোধকরি এ বিষয়গুলো ফিরে দেখারও আবশ্যকতা আছে।
প্রখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন ‘সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি, যে ব্যবস্থায় প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি তা কুলীনতন্ত্র এবং যেখানে প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে তা গণতন্ত্র।’ অপরদিকে জন আব্রাহাম লিঙ্কন গেটিসবার্গ বক্তৃতায় বলেন- ‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা পরিচালিত সরকার এবং জনগণের স্বার্থে পরিচালিত সরকার পৃথিবী থেকে মুছে যাবে না’। এ ছাড়াও বিশিষ্টজনেরা বিভিন্নভাবে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন। কেউ বলেন ‘গণতন্ত্র সম্মতির সরকার’ কেউবা বলেন ‘গণতন্ত্র জনগণের সার্বভৌমত্ব’। কারো মতে, ‘গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন’, আবার কেউ মনে করেন, ‘গণতন্ত্র সীমিত সরকার’। প্রচলিত এসব সংজ্ঞা থেকে গণতন্ত্র সম্পর্কে অতিসংক্ষেপে সহজেই ধারণা করা যেতে পারে- ‘গণতন্ত্র এমন এক সরকার ব্যবস্থা যেখানে জনগণ নিজেদের শাসন করে।’ কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের এসব সংজ্ঞার কোনটিই কাজে লাগছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আন্দোলন সংগ্রামের পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও গণতন্ত্র চর্চা ও গণতন্ত্রের রূপরেখা অস্পষ্ট হতে শুরু করেছে। গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের কথা স্বীকার্য হলেও আমাদের দেশে শুধু মাত্র জনপ্রতিনিধি নির্বাচন অর্থাৎ ভোট প্রদান ছাড়া সাধারণ মানুষের আর কোনো অধিকার রক্ষিত হচ্ছে কী? রাজনৈতিক বাস্তবতা এই যে, অনেক সময় এদেশের নাগরিকের ভোট প্রদানের ক্ষমতাও কেড়ে নেওয়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের উন্নয়নের কথা বলছে ঠিকই কিন্তু জনতার মাথায় কাঁঠাল রেখে কোষ তুলে নিচ্ছে সপ্তর্পণে। অথচ গণতন্ত্রের সূত্র অনুযায়ী প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এথেন্সের খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ পেরিক্লিস বলেছিলেন ‘আমাদের শাসনকে গণতন্ত্র বলে চিহ্নিত করি এজন্য যে, শাসন ব্যবস্থার দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে বহুজনের উপর, কতিপয় ব্যক্তির উপর নয়’। বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা গণতন্ত্রের এ সংজ্ঞাটিকে বাস্তবিক অর্থে সমর্থন করে কিনা সেটি দেখলেই বোঝা যাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় গণতন্ত্র চর্চা কতটুকু প্রতিফলিত।
বাংলাদেশ বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রাথমিক স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে, বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে গণ্য করছেন বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ। স্বাধীনতার এই দীর্ঘদিনে বাংলাদেশ যেমন উন্নয়ন করেছে, তেমনি অবনতিও ঘটেছে। দুর্নীতিতে আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছি। অস্বীকার করব না যে, দেশে এই সময়ে কমেছে বেকারত্ব, দারিদ্র্য; বেড়েছে স্বাস্থ্যসচেতনতা, শিক্ষা এবং মাথাপিছু আয়, রেমিটেন্স প্রবাহ, রফতানি আয়। এসব উন্নয়নের খবর, আমরা আশান্বিত হই। অথচ সারা বিশ্ব যেখানে গতিশীল সেখানে রাজধানী ঢাকায় মানুষের গতি ক্রমেই থেমে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে, বাড়ছে গাড়ির চাপ; দূষিত নগরী হিসেবে ঢাকা আবারও দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। সারাদেশে বেড়েছে নারী নির্যাতন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। মানুষ এখন আর নিরাপত্তা বোধ করছেন না। জীবিকার জন্য সাধারণ মানুষ দিনান্ত পরিশ্রম করেও সংসারের চাকা সচল রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ইতোমধ্যে দেশে কেউ কেউ এত ধনী হয়েছে যে, বিশ্বমানের অন্তত একজন ধনীর সন্ধান পাওয়া গেছে। যে হারে সেকেন্ড হোম এবং অথর্ পাচারের তথ্য আসছে, তাতে অচিরেই ধনীর সংখ্যা হয়ত বাড়বে। এর বিপরীতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতি অত্যন্ত উজ্জ্বল, কিন্তু নারী নির্যাতনের মাত্রা ক্রমাগত নিষ্ঠুরতর হচ্ছে। শিক্ষিতের হার বাড়ছে; কিন্তু তিন ধারার শিক্ষা তিন দিকে ছুটছে। আধুনিকতা বেপরোয়া হতে চাইছে, আবার ধর্মান্ধরাও বেগে ধেয়ে আসছে। এসবই পুঁজিবাদী উন্নয়নের ফল। আর সামাজিক দুর্দশায় তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো। পক্ষান্তরে অতিশয় উন্নয়নের নিচে চাপা পড়ে নিঃশব্দে ক্রন্দন করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জনগণের প্রকৃত মুক্তি।
দেশের মানুষ উন্নয়ন আশা করে, নিরাপত্তা চায়, সংবিধানের মূলনীতি অনুযায়ী চলতে চায়। কিন্তু দেশের মানুষের বিশেষ একটি অংশ যেখানে ক্ষমতালিপ্সু মানসিকতা পোষণ করেন, সেখানে তাদের হাতে নীতির নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়া অমূলক হতে পারে না। আর এমনটি ঘটলে তা যে পুঁজিবাদের বিস্তারের কারণেই ঘটছে তাতে সন্দেহ পোষণের সুযোগ থাকে না। পুঁজিবাদের প্রথম কাজ সমাজ-রাষ্ট্রে বৈষম্য সৃষ্টি করা; যে কারণে চরিত্রগতভাবেই সে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের বিরোধী। ওই তিনটি নীতি বৈষম্য মানে না, বরং তার অবসান চায়। অস্বীকার করা যাবে না, পুঁজিবাদ আজ বিশ্বব্যাপী তা-ব চালাচ্ছে, রূপ নিয়েছে সে ফ্যাসিবাদের। কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের রূপ যদি দরিদ্রকে প্রান্তিক এবং জনতার ম্যান্ডেট নিয়ে আইন প্রণয়নকারীরা বিলাসী এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগ্রাসী হয়ে ওঠেন তখন বিষয়টি ফ্যাসিবাদের সমার্থক হয়ে ওঠে। পূঁজিবাদের ক্রীড়নক হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে তাদের কর্মকাণ্ড। পুঁজিবাদ দৃশ্যত বেশ ভদ্র, কিন্তু ভেতরে অতিশয় নির্মম। এই নির্মমতার চেহারাটা ভয়াবহ রকমের দানবীয়। পুঁজিবাদের উন্নত ও সভ্যতার নিচে যে দুরাচারীর বসবাস, সে ন্যায়-অন্যায় মানে না, নিজের সুখ ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না, সবকিছু ছারখার করে দেয়। পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্যের কারণেই যে দেশের চারিদিকে হতাশা, আতঙ্ক, চাপা ক্ষোভ ইত্যাদি পাখা মেলেছে, তা অনায়াসেই বোধগম্য হতে পারে।
সার্বিক বিচারে আমরা পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্যের অধীনেই আছি। যে কারণে মুক্তির লালিত স্বপ্ন পদদলিত হচ্ছে। মানবিকতা গুমরে কাঁদছে। স্বাধীনতার স্মারক জাতীয় চার নীতি অটুট রাখতে পুঁজিবাদ তাড়াতে হবে। বায়ান্নো, ঊনসত্তর, একাত্তরে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, কয়েক লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে, মূলনীতিগুলো এরই প্রতিফলন। সুতরাং মূলনীতিগুলোর স্বার্থে, নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থে পুঁজিবাদ না তাড়ালে কিছুতেই মুক্তি নেই। এটা একাত্তরে যেমন সত্য ছিল, তেমনিভাবে এখনও স্পষ্ট।
—
সহায়তা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রবন্ধ ‘রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অগ্রপশ্চাৎ’