মাহবুব রেজা-এর গল্প ‘কুসুম ফুলের ঘ্রাণ’
৩ মে ২০২২ ১৩:১৮
১
সন্ধ্যা নামার আগে আগে বাবা বাড়ি ফিরলেন। সাধারণত বাবা বাড়ি ফেরেন আরও রাত করে। অফিস শেষে বাবা গেণ্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডে দুটো টিউশনি করেন। আজ আর সেখানে গেলেন না। বাবা যখন বিকেলের মধ্যভাগে বাড়ি ফিরলেন তখন আমাদের বসুবাজার লেনের রাস্তায় মহল্লার ছেলেপেলেরা ইট দিয়ে গোলবার বানিয়ে তুমুল ফুটবল খেলছে। ছেলেপেলেদের ফুটবল খেলায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে, সেদিকে খেয়াল আছে বাবার। দূরের তিন গলির মাথার মোড়ে যেখানে মিউনিসিপ্যালিটির পানির কল, বাবা সেখান থেকে বিদায় করে দিলেন রিকশাওলাকে। তারপর বাকিটা পথ হেঁটে হেঁটে বাড়ি পর্যন্ত এলেন। হেঁটে আসার সময় বাবা রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ফুটবল খেলা দেখলেন। আচ্ছা, বাবা যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেপেলেদের ফুটবল খেলা দেখছিলেন, তখন কি বাবার বল খেলতে ইচ্ছে করেছিল! বাবার বল খেলতে ইচ্ছে হয়েছিল কি না জানি না। আমার কিন্তু খেলতে ইচ্ছে করে।
আমার ইচ্ছে করলে কী হবে, ডাক্তারের কড়া নির্দেশ, কষ্ট হবে— এমন কিছু করা যাবে না! অল্পতেই আমি ক্লান্ত হয়ে উঠি। আমার শ্বাসকষ্ট হয়। দম বন্ধ হয়ে যায়। চোখ বুঁজে আসে। আর চোখ বুঝে এলেই আমি রাজ্যির সানফ্লাওয়ার দেখি। বিস্তৃত জমির যতদূর দৃষ্টি যায়— হলুদ আর হলুদ ফুল। বাতাসেও ভেসে বেড়ায় সেই ফুলের ঝাঁঝালো গন্ধ। আশপাশের জলাজংলায় থির হয়ে থাকা পানি আর ভেষজ লতাগুল্ম থেকে থেকে উঠে আসা কেমন ধরনের একটা ঘ্রাণও পাই। সেই ঘ্রাণ আমার মাথার ভেতরে ঝমঝম করে রেলগাড়ির মতো ঘুরতে থাকে। একসময় মাথার ভেতরটা কেমন ঝিমঝিমও করতে থাকে। আর মাথার ভেতরটা ওরকম ঝিমঝিম করলে আমি রাজ্যের স্বপ্ন দেখতে থাকি— স্বপ্নের মধ্যে নিমজ্জিত হয় আমার সব।
২
বাবা অফিস থেকে আসার অনেক পরে নরেশ কাকা তার রিকশা নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন। বাবার সব কাজে নরেশ কাকা ছায়ার মতো লেগে থাকেন। কখনো কখনো বাবা বাজারে যেতে না পারলে নরেশ বাসায় এসে মায়ের কাছ থেকে ফর্দ নিয়ে রিকশা চালাতে চালাতে বাজারের দিকে রওনা দেন। বাজার শেষে সব জিনিস মাকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান। বাজার থেকে ফিরলে মা নিজের হাতে নরেশ কাকুকে খেতে দেন। মায়ের হাতে বানানো দুধের চা নরেশ কাকার খুব পছন্দ। হলুদ টিনের আংটাঅলা চায়ের কাপের ভেতর মুড়ি ফেলে চা খেতে খেতে নরেশ কাকা মাকে বলেন, কত জায়গায় চা খাইলাম। কিন্তু দিদির বানাইনা চায়ের স্বাদই আলাদা। বলতে বলতে নরেশ কাকা চায়ের কাপে মুড়ি ফেলেন।
বাবা চা খেতে খেতে মাকে বললেন, সাবুর কী খবর?
আগের মতো— বাবার কথায় মা ছোট্ট করে উত্তর দিলেন।
আমি তখন আমাদের বাড়ির পেছনে টানা লম্বা বারান্দায় মোড়ার ওপর বসে বসে প্রতিদিনকার মতো সন্ধ্যা নামা দেখছি। পাশের বাড়ির নির্মলা দিদি কয়েকদিন আগে আমার পাশে বসে কথা বলছিলেন, শোন সাবু, সবকিছু দেখতে হয়। এই যে তুই দিনের বেশিরভাগ সময় এখানে বসে থাকিস, থাকিস না? বলে নির্মলা দিদি আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালেন, বসে বসে কী দেখিস তুই!
বসে বসে দেখার কী আছে! আমি মনে মনে নির্মলা দিদির কথার কী উত্তর দেওয়া যায়, তা ভাবি। কী বলব নির্মলাদিকে!
আমি চুপ আছি দেখে নির্মলা দি এক গাল হেসে বললেন, শোন, চারদিকের সব কিছুকে দেখবি। দেখবি কতকিছু যে তোর সামনে দিয়ে ঘটে যাচ্ছে। তুই খালি চোখ দুটোকে খোলা রাখবি। এই যে তোর সামনে এতকিছু ঘটে যাচ্ছে, সেসব দেখবি। বলে নির্মলা দি নিজের মতো করে বলে যাচ্ছেন, এই যে একটা সুন্দর রঙের বিকেল পোষা বেড়ালের মতো হেলেদুলে কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে আর তার বদলে দেখ— বলে দিদি আমার ঘাড়ে হাত রাখলেন। একটা শীতল স্পর্শ আমার ঘাড়ে লেগে থাকল। নির্মলা দি’র কাছে আমি মায়ের স্পর্শ পেলাম যেন।
দিদি আমার আমার খুব কাছে ঘেঁষে এসে বললেন, খুব ভালো করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবি এই চলে যাওয়া বিকেল। বিকেলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় দেখবি— কী দেখবি? বলে দিদি বলে যাচ্ছেন— দেখবি, আস্তে আস্তে এই চলে যাওয়া বিকেলের ভেতর দিয়ে আশ্চর্য সুন্দর আর স্নিগ্ধ মায়ার একটা সন্ধ্যা কিভাবে পৃথিবীতে ধীরে, অতি ধীরে নেমে আসছে। আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে থাকলে দেখবি এরকম কতকিছু যে তোর চোখে পড়ছে…
নির্মলা দিদি খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারেন। মা যেমন আলমারিতে সুন্দর করে, ভাঁজ করে করে কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখেন, নির্মলাদিও সেরকম গুছিয়ে গুছিয়ে, ভাঁজ করে করে কথা বলেন।
আমি বারান্দায় বসে বসে নির্মলা দি’র কথামতো বিকেল চলে যাওয়া দেখি, সন্ধ্যা নামা দেখি। আজও তাই করছিলাম।
বাবা মাকে বললেন, সাবুর দিকে খেয়াল রেখো। ও যেন দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে!
তুমি এইভাবে কথা বলছ কেন? সব কি আমার একার দায়িত্ব নাকি! আমি আর পারব না— মায়ের গলা চওড়া হয়ে উঠল।
বারান্দায় বসে থেকে আর সাড়াশব্দ পেলাম না। মা-বাবা চুপ হয়ে আছেন। এদিকে বিকেল শেষে আমাদের এলাকায় ধীরে, অতি ধীরে সন্ধ্যা নামছে। আমি বারান্দায় বেতের মোড়ায় বসে সন্ধ্যা নামা দেখছি।
৩
সন্ধ্যার পর বাবা আমাকে নিয়ে রিকশায় উঠলেন। নরেশ কাকা বাবাকে বললেন, কই যামু?
নন্দী ডাক্তারের চেম্বারে রওনা কর।
বসুবাজার লেনের গলি পেরিয়ে শরতগুপ্ত রোড পেছনে ফেলে ঢিমেতালে রিকশা চলছে নারিন্দার দিকে। সন্ধ্যারাত বলে রাস্তায় মানুষজনের দেখা মিলছে কম। নারিন্দার মোড়ে লক্ষ্মী কনফেকশনারির ওপরে ঝুলছে বাতিঅলা বড় সাইনবোর্ড। আর বাতিগুলো থেকে আলোর নহর এমনভাবে সাইনবোর্ডের চারদিকে উপচে পড়ছে যে সেই আলোতে দেখা যাচ্ছে— সাইনবোর্ডের দুই দিকে দু’জন অপূর্ব সুন্দরের পরী মিষ্টির থালা হাতে নিয়ে উড়ে আসছেন যেন আমাদের দিকে। তাদের পিঠে ধবধবে সাদা ভাঁজ দেওয়া পাখা। আমি উড়ে আসা পরীদের ঘন কালো চুল দেখি। পরীদের চুলগুলো আমার মা আর নির্মলা দি’র মতোই।
রিকশা নারিন্দা মোড় অতিক্রম করে খ্রিষ্টান কবরস্থান ডান দিকে রেখে বাঁয়ে মোড় নিয়ে খানিক এগিয়ে ওয়ারি, র্যাংকিন স্ট্রিটের বড় রাস্তা উজিয়ে এসে থামল একটা সরু গলির ভেতরে। দু’পাশে বাড়িঘর, বেশিরভাগ বাড়িঘরই একতলা-দোতলা। বাড়িগুলো পুরনো আমলের। প্রতিটি বাড়ির সামনে খোলা জায়গায় বাগান মতো। ফুলের গন্ধ সন্ধ্যারাতকে ভরিয়ে তুলছে।
নরেশ কাকার রিকশা থামল। বাবা রিকশা থেকে নেমে নরেশ কাকাকে ধমকের স্বরে বললেন, সারা রাস্তায় তোমার রিকশার এই ক্যাঁচক্যাঁচ বাজনা আমার কান দুইটারে ঝালাপালা কইরা দিলো। এত জং ধরা রিকশা ক্যামনে চালাও! রিকশায় তো একটু তেল পানি দিতে পারো…
বাবার কথায় নরেশ কাকা কিছু বললেন না। আমি রিকশার সিটে চুপচাপ বসে আছি দেখে বাবা আবারও নরেশ কাকাকে ধমক দিয়ে বললেন, কিরে নরেশ, পোলাডারে একটু ধইরা নামাইতে পারস না!
বাবার ধমক খেয়ে নরেশ কাকা তড়িঘড়ি করে রিকশায় জড়সড় হয়ে বসে থাকা আমাকে ধরে নামালেন। নরেশ কাকা যখন আমাকে ধরে নামালেন, তার শরীর থেকে ভুড়ভুড় করে তামাকের গন্ধ বের হচ্ছিল। আর সেই গন্ধে আমার নাক বন্ধ হয়ে আসছিল। কি তীব্র গন্ধরে বাবা! এই গন্ধ কৃষ্ণ কীভাবে সহ্য করে!
নরেশ কাকা আমাদের মহল্লার শেষ মাথায় দয়াগঞ্জ বলে জলা-জংলা মতো যে জায়গা আছে, সেখানে থাকেন। নরেশ কাকার বাড়ির চারদিক জলে ডোবায় ছাওয়া। বর্ষাকালে দয়াগঞ্জের প্রায় পুরোটাই পানিতে ভেসে না গেলেও তলিয়ে যায়।
আমরা বর্ষায় নরেশ কাকার বাড়ির আশপাশ দিয়ে মাছ ধরি, গোসল করি। নরেশ কাকার ছেলে কৃষ্ণ আমার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে বল খেলি ঋষি পাড়ার মাঠে, সাধু জোসেফের স্কুলের বাগানে কখনো কখনো লাল মাটির ধুলোয় ছেয়ে থাকা মেথরপট্টি ছাড়িয়ে হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির সামনের মাঠেও পড়ন্ত দুপুরে, বিকেলে ডাংগুলি, হাডুডু, মোরগ লড়াই খেলি। কৃষ্ণকে সবাই যেরকম কাইল্যা কৃষ্ণ বলে, আমার কাছে কিন্তু কৃষ্ণকে সেরকম কালো মনে হয় না। আমি নিজে শ্যামলা বলে কৃষ্ণের প্রতি আমার একটা আলাদা পক্ষপাতিত্ব আছে।
৪
নন্দী ডাক্তারের চেম্বার থেকে বাবা বের হলেন অন্ধকার মুখ নিয়ে। নন্দী ডাক্তার আমার সঙ্গে কথা বললেন। আমাকে দেখলেন। বুকে চাপ দিয়ে বললেন, সাবু, তোমার কেমন লাগে? জোরে জোরে শ্বাস নিতে বললেন আমাকে। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দেখে নন্দী ডাক্তার বললেন, থাক, তোমার শ্বাস নিতে হবে না। তোমার কিচ্ছু হয়নি। বলেই বাবার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে দিলেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে তিনি আমার দিকে বার কয়েক তাকালেন। আমি তার তাকানো খেয়াল করলাম। আমার তখন নির্মলা দিদির কথা মনে পড়ে গেল— শোন, চারদিকের সব কিছুকে দেখবি। দেখবি, কতকিছু যে তোর সামনে দিয়ে ঘটে যাচ্ছে। তুই খালি চোখ দুটোকে খোলা রাখবি।
নন্দী ডাক্তারের তাকানোর মধ্যে আমি কিছু দেখতে পেলাম না। কথাবার্তার এক ফাঁকে বাবা আমাকে বললেন, সাবু, তুই নরেশের রিকশায় গিয়ে বস। আমি আসছি।
আমি নন্দী ডাক্তারকে আদাব দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ পর বাবা যখন নন্দী ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন বাবার মুখে রাজ্যের অন্ধকার। বাবাকে দেখে নরেশ কাকা কিছু বললেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি রিকশার সিটে বসে আছি।
ফেরার পথে নরেশ কাকা বাবাকে বললেন, দাদা, বাড়ি ফিরা যামু!
তাইলে আর কই যাইবি? যাওনের তো জায়গা দেখতাছি না। বলে বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বাবার দীর্ঘশ্বাসে চারপাশের পরিবেশ জমাট বেঁধে গেল। ভারী হয়ে উঠল।
৫
খুব ছোটবেলায় একবার আমার খুব জ্বর হয়েছিল। ডাক্তাররা রিউমেটিক ফিভার ভেবে বছরের পর বছর ভুল চিকিৎসা করেছিল। পাওয়ার ফুল ইনজেকশন দিয়েছিল কয়েকবছর। তারপর থেকে আমার শরীর বছরের বেশিরভাগ সময় খারাপ থাকে। সারাবছর আমার শরীরজুড়ে গেছো সাপের মতো জ্বর লেগে থাকে। হাত-পা অবশ হয়ে থাকে। কিছুই ভালো লাগে না আমার। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটানোর ফলে সারাদিন আমার মাথা চরকির মতো ঘোরে।
আমার পড়তে ভালো লাগে না। খেলাধুলা করতে ভালো লাগে না। আমার কিছুই করতে ভালো লাগে না। আমার শুধু বারান্দায় বসে বসে সবকিছু দেখতে ভালো লাগে। এমনি করে করে একদিন আমার স্কুলে যাওয়াটাও বন্ধ হয়ে গেল।
রাস্তা লাগোয়া বৈঠকখানার ঘরে রুমি, তনু আর কাজল পড়ছে প্রিয়লাল শিং স্যারের কাছে। আগে আমিও ওদের সঙ্গে পড়তাম। কয়েকদিন ধরে আমি আর পড়ছি না। সন্ধ্যার পর স্যার যখন পড়াতে আসেন, আমি আমাদের বাড়ির পেছনে রান্না ঘরের সামনের লম্বা বারান্দার হয় জলচৌকি আর না হয় বেতের মোড়ার ওপর বসে থাকি। মা চাদর দিয়ে আমাকে পেঁচিয়ে রাখেন। তাতেও আমার জ্বরের কাঁপন থামে না। আমি কাঁপতে থাকি। বারান্দায় বসে বসে বৈঠকখানা থেকে ওদের পড়ার শব্দ পাই।
এক সন্ধ্যায় বাবা বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে মাকে বললেন, শোনো মুকুল, সাবুর আর স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। এখন থেকে ও বাসায় থেকেই স্কুলের পড়ালেখা করবে। বছর শেষে শুধু পরীক্ষাটা দেবে। আমি ওর হেড মাস্টারের সঙ্গে কথা বলেছি। ডাক্তাররাও বলে দিয়েছেন, সাবুর ওপর আর প্রেশার দেওয়া যাবে না। এখন থেকে সাবুকে ওর মতো থাকতে দাও।
বাবার কথায় মা বললেন, এখন থেকে সাবুকে ওর মতো থাকতে দেবো? রুমির বাবা তুমি এসব কী বলছ!
কত ডাক্তার কবিরাজ দেখালাম, কেউ তো কিছু বলতে পারছে না। তুমিই বলো, আমি আর কী করতে পারি?
বাবার কথার প্রতি উত্তরে মায়ের আর কোনোরকমের সাড়াশব্দ বের হলো না।
ঘরজুড়ে একটা নিস্তব্ধতা খেলা করছে। সেই নিস্তব্ধতার ভেতর মায়ের নিঃশব্দ কান্নার সুর যে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমি বারান্দায় বসে বসে তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
৬
নানী বিক্রমপুর থেকে এসেছেন আমাকে দেখতে। আমাকে দেখে কাছে ডেকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমার বগলে আহো। তুমার বলে শইলটা খারাপ?
নানীর কথায় আমি ‘হ্যাঁ’ বলে চুপ করে থাকলাম।
নানী বললেন, তুমার কিচ্ছু হয় নাই। এই যুগের ডাক্তাররা আবার ডাক্তার নাকি! সব কসাই হয়া গেছে। রোগীরে ভালো কইরা দেখেও না। না দেইখাই পেশকিপশন লেইখা হাতে ধরায়া দিয়া এই টেস্ট সেই টেস্ট করতে দিয়া রোগীর জান পেরেশান কইরা ফালায়।
নানীর কথায় মা হেসে দিয়ে বলেন, মা পেশকিপশন না প্রেসক্রিপশন।
ওই হইল। পেশকিপশন আর প্রেসক্রিপশন একই জিনিস।
নানীর কথায় মা আবার হেসে ওঠেন।
রাতের বেলা আমার ঘুম আসছিল না। আমি মায়ের পাশে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলাম। মা ভেবেছিলেন আমি বুঝি ঘুমিয়ে আছি। নানী এসে মায়ের পাশে এসে বসলেন। বাবা তখনো ফেরেননি, কী একটা কাজে মিরপুরের দিকে গেছেন। ফিরতে অনেক রাত হবে। তাই মা জেগে আছেন।
নানী মাকে বললেন, তুই চিন্তা করিছ না।
চিন্তা না কইরা কী করুম মা!
দেখবি একটা না একটা কিছু হইবই হইব। আরে কথা আছে না, বারো মুশকিল তেরো আসান। তুই চিন্তা করিছ না তো।
চিন্তা করি না মা, চিন্তা আইসা পড়ে। ওর একটা কিছু হইলে আমার কী হইব? বলে মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
নানী মাকে জড়িয়ে ধরে রইলেন— এত ভাইঙ্গা পড়লে হইব! আল্লার মাল আল্লাই দেইখাই দেইখা রাখব।
আমি ঘুমের মতো করে শুয়ে থেকে থেকে মা আর নানীর কথা শুনছি। মা ফিসফিস করে নানীকে বললেন, ডাক্তাররা আশা ছাইড়া দিয়া ওর বাপেরে কয়া দিছে— আপনার এই পোলা আর বেশিদিন বাঁচবে না।
মার কথা শুনে নানী ধরে আসা গলায় বললেন, আলাই-বালাই কথা কইছ না। হায়াত-মউত সব উপরঅলার হাতে।
নানীর কথায় মায়ের কান্নার শব্দ আরও দীর্ঘ হয়ে উঠল। তোমার উপরআলার আমারে এত পছন্দ কেন? উনি কি আর কেউ দেখতে পায় না? সব মুশকিল খালি আমার উপর দিয়াই যাইব! সাবুর কিছু হলে আমি নিঃশেষ হয়ে যাব। বলে মায়ের কান্নার শব্দ ঘরের মেঝে গড়িয়ে পাশের ঘরেও ধাবমান হতে থাকে। কান্নার শব্দ খুব ধীর লয়ে গড়ায়।
সেই রাত থেকে আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমি লক্ষ করতে থাকি— আমি খুব ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছি। আমি আসলে মারা যাচ্ছি। দিন দিন মৃত্যু আমার খুব নিকটবর্তী হচ্ছে।
আমি বুঝতে পারি আমার প্রতি বাসার সবার আলাদা রকম নজর। আলাদা আদর-যত্ন। এখন রুমি, তনু কিংবা কাজল আগের মতো অল্পতেই আমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে না। ঝগড়া করে না। আমি যা বলি ওরা শোনে, সেভাবে চলে। যেহেতু আমি মারা যাচ্ছি সেহেতু আমি যা বলি সবাই তা-ই করে, করার চেষ্টা করে।
মা, বাবা, নানীর মতো ওরাও হয়তো ধরে নিয়েছে— আমার বেঁচে থাকার সময়কাল খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
৭
বেশ কয়েকদিন ধরে আমি ব্যাপারটা খেয়াল করছি। ব্যাপারটা ঘটতে থাকে বিকেলের মধ্যভাগের দিকে। না, না, বিকেলের মধ্যভাগের দিকে না, ব্যাপারটা আসলে ঘটতে থাকে শেষ বিকেলের দিকে, ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে আগে। প্রথমে ব্যাপারটা আস্তে আস্তে ঘটতে থাকে, পরে তা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে আমার মাথার পুরোটা দখল করে নেয়। একদিন ঘুমের ভেতর আমি সেই ফুল দেখেছি। সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ানো ছোট ছোট গাছের পাতায় হলুদ, কমলা রঙের ফুল। সেই ফুল থেকে অবিরত মাথা ঝিম ধরানো গন্ধ আসছে।
কয়েকদিন ধরে আমি এই গন্ধটা পাচ্ছি। নাকের ভেতর সূক্ষ্ম মসলিনের মতো গন্ধটা ঢুকতে থাকে। বৈশাখের মাঝামাঝি যখন শিমুলের ফল ফেটে এর ভেতর থেকে পাতলা তুলোর দল বাতাসে ভেসে ছড়িয়ে পড়ে, চারদিকে তেমনি ফুলের এই গন্ধটাও আমার ভেতরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আমি চোখ বন্ধ করলে শুধু দেখতে পাই সেই হলুদ ফুল। আমার চারদিকে তখন রাজ্যের হলুদ আর হলুদ ফুল।
সন্ধ্যার দিকে আমি বারান্দার জলচৌকিতে বসে আছি। সেদিন আমার গায়ে অনেক জ্বর। জ্বরের ঘোরে আমি হু হু করে কাঁপছি। অ্যানাকোন্ডা সাপ যেমন শত্রুকে আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে মেরে ফেলে, জ্বরটাও তেমন করে আমাকে পেঁচিয়ে ধরেছে।
আমি বারান্দায় বসে থাকি। ভেতরের ঘরে রুমিরা পড়ছে। রুমিদের পড়ার শব্দ বারান্দা থেকে শোনা যাচ্ছে। মা রান্নাঘরে রান্না করছেন। নানী রান্নাঘরে মায়ের পাশে বসে বসে কথা বলছেন।
আমার নাকে সেই ফুলের গন্ধটা লেগে থাকে। আমি চুপচাপ বসে থাকি।
রান্নাঘর থেকে রান্নার টুকটাক জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য মা বারবার ভেতরের ঘরে যাচ্ছিলেন আর আসছিলেন। বাবা কতবার মাকে বলেছেন, রান্নার সময় এভাবে দৌড়াদৌড়ি না করে সব জিনিসপত্র রান্নাঘরে রাখলেই পারো! কিন্তু বাবার কথা মা শোনেন না। রান্না করার সময় এভাবে দৌড়ঝাঁপ করতে পছন্দ করেন মা।
আমি বসে বসে মাকে দেখছি। এদিকে আমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
মা বুঝতে পারলেন কি না জানি না, একবার আমার পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে আমার কপালে হাত রেখে ভয়ে আঁতকে উঠলেন। ওরে মাবুদ! জ্বরে তো তর শইল পুইড়া যাইতাছে। বলেই মা চিৎকার করে নানীকে ডাকলেন, মা, দেইখা যাও।
মার ডাকে নানীও এলেন আমার কাছে।
আমি মার দিকে তাকিয়ে বললাম, মা, কয়দিন ধইরা আমি কুসুম ফুলের ঘ্রাণ পাইতাছি।
আমার কথায় মা আর নানী চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালেন। নানী বললেন, এইসব কী কথা! এই সন্ধ্যারাইতে তুই কইত্থে পাইবি এই ফুলের বাসনা…
বিকাল থিকা সারারাইত আমি এই ফুলের গন্ধ পাই।
নানীর দিকে মা অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কুসুম ফুল! আমি তো কখনো এই ফুল দেখি নাই। মা, তুমি কি এই ফুল চিনো?
হ, চিনি। এই ফুলের চাষ আগে হইত। অহন আর কেউ চাষ করে না। এই ফুলের অনেক ঔষধি গুণ আছে। কুসুম ফুল অহনো ঝোপেঝাড়ে অল্প বিস্তর হয়। তয় এই ফুলের বাসনা অনেক সুন্দর।
মা, এই ফুল কি ভালো?
মায়ের কথায় নানী আমার দিকে তাকালেন, কিন্তু কিছু বললেন না।
৮
প্রিয়লাল শিং স্যার আমাকে পড়ার ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক হলেন। সাবু, তুমি! কেমন আছো?
আমি স্যারের কথায় মাথা দোলালাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, স্যার, আপনি কুসুম ফুল চেনেন!
চিনি, ভালো করে চিনি। হঠাৎ করে তুমি কেন কুসুম ফুলের কথা বলছ?
আমার কথায় স্যার চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন। আমার মুখে কুসুম ফুলের কথা শুনে রুমি, তনু আর কাজল আমার দিকে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে থাকল। কাজল একবার ভাবল সাবুকে বলবে, দেখো বোকার হদ্দ বোকা বলে কী! কুসুম মানেই তো ফুল। কুসুম নামে আবার আলাদা কোনো ফুল হয় নাকি! কাজল কিছু বলল না।
আমি স্যারকে বললাম, কয়েকদিন ধরে আমি এই ফুলের গন্ধটা পাই। স্বপ্নেও এই ফুল দেখি।
বলো কী!
প্রিয়লাল শিং এই সন্ধ্যাবেলায় তার ছাত্রের মুখে কুসুম ফুলের কথা শুনে ফিরে গেলেন নিজের মাতৃহীন শৈশবে। একবার এরকম অসুখ হয়েছিল তার। তার তখন বয়স দশ-এগারো হবে। শহরে নিয়েও ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। কেউ কিছু বলতে পারছিল না। গ্রামের কবিরাজ ভূদেব এষ বাবাকে বলে দিয়েছিলেন, সুখলাল, তুমার প্রিয়’র কালা জ্বর হইছে। অয় আর বেশিদিন বাঁচব না।
তারপর থেকে বেশ কিছুকাল প্রিয়লাল শিংয়ের কেটেছে দুঃসহ যন্ত্রণায়। আশেপাশের কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না। খেলাধুলা করে না। তাকে দিনের বেশিরভাগ সময় একা একা থাকতে হয়। সারাদিন একা থাকার সময়গুলোতে প্রিয়কে অনেক কষ্টে কাটাতে হয়। সেই একা থাকার সময় একদিন গভীর রাতে প্রিয় স্বপ্নের ভেতর এই ফুল দেখলেন। আর কী আশ্চর্য, পরদিন থেকে অনবরত এই ফুলের গন্ধও পেতে থাকলেন!
এরপর বাবাকে কুসুম ফুলের কথাটা বললেন প্রিয়লাল। পরদিন বাবা ছাতিয়ানতলি বাজারের দিলিপ নারায়ণ সাধুকে নিয়ে গেলেন কুসুম ফুলের খোঁজে। প্রিয়’র জন্য সেই ফুল তাদের গ্রামের শেষ প্রান্তে চিতল মাছের পেটের মতো ধবধবে সাদা জইনা বিলের ধার থেকে তুলে নিয়ে এলেন। ফুল নিয়ে ফেরার পথে দিলিপ সাধু সুখলালকে শুধু বলেছিল, এই ফুলের অনেক কুদরত। এই ফুল মানুষের হায়াত বাড়ায়।
সুখলাল ফিরে এসেছিলেন কুসুম ফুল নিয়ে। সেই ফুল পেয়ে প্রিয়’র সে কী আনন্দ!
কুসুম ফুলের ঘ্রাণ প্রিয়কে এরপর এতটা বছর, এতটাকাল বাঁচিয়ে রেখেছে।
প্রিয়লাল শিং সাবুর কথার বিপরীতে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। তিনি মনে মনে অনেক খুশি হলেন। তিনি সাবুকে তার পাশের চেয়ারে বসালেন। সাবুকে ওভাবে স্যার তার পাশের চেয়ারে বসালেন দেখে রুমি, তনু আর কাজল অবাক হলো। ওরা ভয়ে স্যারের আশেপাশে ঘেঁষে না। আর স্যার সেখানে সাবুকে ডেকে নিয়ে নিজের পাশে আদর যত্ন করে বসালেন!
এমন সময় মা স্যারের জন্য চা আর টোস্ট বিস্কিট নিয়ে এলেন। স্যারের পাশে সাবুকে বসে থাকতে দেখে মা বললেন, তুই এখানে! আমি আরও তোর চা বারান্দায় রেখে এলাম।
দিদি আপনারা সাবুর জন্য চিন্তা করবেন না। ওর কিছু হয়নি। সাবুর চা এখানে নিয়ে আসেন। আজ সাবু আর আমি এক সঙ্গে চা খাব।
স্যারের কথা শুনে রুমি, তনু, কাজলদের মতো মাও অবাক হয়ে গেলেন। তিনি প্রিয়লাল শিংয়ের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলেন না। শুধু তাকিয়ে থাকলেন তার অসুস্থ ছেলের দিকে।
৯
প্রিয়লাল শিং সাবুদের বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে এলেন। তখন সন্ধ্যারাত পেরিয়ে রাতের আঁধার নামতে শুরু করেছে বসুবাজার লেনের গলিতে। আজ তার অনেক আনন্দের দিন। শৈশবে দেখা কুসুম ফুলের দেখা পাওয়া আর এর অপার সুন্দর ঘ্রাণের কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। আজ কত বছর পরে তিনি তার ছাত্রের মাধ্যমে আবার ফিরে পেলেন সেই ফুল।
তার খুব প্রিয় ছাত্র কয়েকদিনের মধ্যে ভালো হয়ে উঠবে। আজ তার খুব আনন্দের দিন।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ইদ ২০২২ ইদ আয়োজন ২০২২ ইদ সংখ্যা ২০২২ ইদুল ফিতর ২০২২ কুসুম ফুলের ঘ্রাণ গল্প মাহবুব রেজা মাহবুব রেজা-এর গল্প ‘কুসুম ফুলের ঘ্রাণ’ সারাবাংলা ইদ আয়োজন ২০২২