গ্রহণ করেছি যতো
২ মে ২০১৮ ১২:২০
।।কিযী তাহনিন।।
তাঁর বাড়ির মূল ফটকে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন সময়ের সবুজ মানুষটি আমাকে বলেছিলেন, “২রা মে আবার চলে আসুন, উনার জন্মদিন। উনার পুরো বাড়িটি সেদিন ঘুরে ঘুরে দেখবেন। সেদিন এ বাড়ি সবার জন্য উন্মুক্ত।”
আমি হেসেছিলাম। আর মনে মনে বলেছিলাম, “তার বোধহয় দরকার নেই। উনাকে আমি প্রায় প্রতিদিনই খুঁজে পাই, এখানে ওইখানে, আমার সাথে তাঁর নিত্য দেখাশোনা।”
মহারাজা তিনি। আর আমার কাছে কেমন আলোর মতন। প্রখর কিন্তু নরম। সে আলোতে চিন্তার ফুল ফোটে, বুদ্ধির ডালপালায় সবুজ জাগে, মানবিক আবেগে ছন্দ লাগে।
আমি তাঁকে চিনেছিলাম লেখক হিসেবে আগে, জেনেছিলাম সুকুমার রায়ের ছেলে হিসেবে। এবং তারপর পরিচালক হিসেবে। আর বয়স বাড়তে বাড়তে জেনেছি – তিনি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প বলিয়ে – চলচ্চিত্রে এবং তাঁর লেখনীতে।
আমার প্রথম বিস্ময় ‘অনুকূল’। বেশ ছোটবেলায় পড়েছিলাম তাঁর লেখা ছোটগল্প, ‘অনুকূল’ । একজন রোবট ভৃত্য আর তার মনিবের প্রতিদিনের গল্প। আমি বিস্মিত হতাম, কল্পনার হিসাব নিকাশ বেহিসাবি হয়ে যেত। মনে আছে, অনেক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এমন হয় নাকি? এমন হয়?”
আজ আমি একই রকম বিস্মিত – যখন দেখি আধুনিক তরুণ মেধাবী পরিচালকের নির্মাণ ‘অনুকুল’ নামক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি। আমার বিস্ময় কমেনা। এত বছর পরেও, এতো আধুনিক, এত নতুন এত কালোত্তীর্ণ ভাবনা যার, তিনিই সত্যজিৎ রায়। এই ‘কনটেন্ট সর্বস্ব’ সময়ে আজো আমরা সত্যজিত’কেই খুঁজি।
আমার প্রথম কাল্পনিক বন্ধু দূর্গা, অপু এবং অপুর পিসি। সেই বয়সে অপু-দুর্গাই আমার বন্ধু হবে স্বাভাবিক। কিন্তু আমাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করতো অপুর পিসি। আমি পিসির মায়ার রেখার টানে টানে পথের পাঁচালী’কে খুঁজে বেড়াতাম। সেই থেকে আজ অব্দি তারা আমার বন্ধু, আমার ‘কি করি, কি করি’ মুহূর্তগুলোর বন্ধু।
আমার প্রথম নায়ক, অমল। ‘চারুলতা’র অমল। যে পিয়ানোতে গান গায়, ‘ওগো বিদেশিনী’। আমি জেনেছিলাম, নায়ক এমনি হয়। ভেসে এসে উড়িয়ে নেয়, হেরে গিয়ে জিতিয়ে দেয়। আমি জেনেছিলাম নায়ক আসলে এমনি হয়। আর আমি ‘নায়ক’ দেখে জেনেছিলাম, ‘নায়ক’ ও কেমন মানুষ হয়।
আমার প্রথম চাওয়া, ‘গুপী, বাঘার’ জুতোজোড়া। আমার কল্পনার পথ যতদূর যায়, সেই জাদুর জুতোজোড়া আমাকে ততোদূরই নিয়ে গিয়েছিলো। আমার কল্পনাশক্তিকে শাণিত করেছিল ওই জাদুর জুতোজোড়া। আমি এখনো অমন এক জোড়া জুতোর আশায় থাকি, সামনে তাকাই।
আমার পরিচিত প্রথম শত্রু, মগনলাল মেঘরাজ। আমি জেনেছিলাম, শত্রুরা এমন করেই থাকে, আসে পাশে, মানুষের মতন সাধারণ। তাদের দুটো শিং থাকেনা, তাদের চেহারা মানুষের মতন। তারা আসলে মানুষ। তাদের চিনে নিতে হয় কাজে।
আর ফেলুদা?
তিনিই আমার ফেলুদা। তিনি আমাদের ফেলুদা। পর্দার আড়ালের ফেলুদা, যিনি প্রখর বুদ্ধিমত্তায়, পৃথিবীর সবচেয়ে মানানসই সঠিক শিল্পীকে খুঁজে নিয়েছিলেন পর্দার সামনের ফেলুদা হিসেবে। পর্দার সামনের ফেলুদা আর পেছনের জন – যেন মিলেমিশে এক। এমন ফেলুদা-জুটি আর কখনো আসবেনা।
তিনি আমার রবীন্দ্রনাথকে খুঁজতে থাকা পথের, ল্যাম্পপোস্ট। তিনি সেইজন যিনি রবীন্দ্রনাথকে যথার্থ ভাবে ধারণ করে, কি সহজতায় প্রকাশ করেন আমার মতন সাধারণ জনের কাছে। আমার মতন এক সাধারণ মানুষের কাছে কত সহজ আর সাবলীল করে পৌঁছে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে বাইরে’র সূত্র, খুঁজে দিয়েছিলেন তাঁর ‘তিন কন্যা’কে। এক বৈশাখে জন্ম নেয়া বিশ্বকবি, আরেক বৈশাখে জন্ম নেয়া মহারাজার এক নান্দনিক মিলমিশ আমাদের বৈশাখকে করেছে আলোকময়।
তাঁকে ভাবি, ভাবতে ভাবতে ভালোবাসি। ভালোবাসতে বাসতে মনের সেতারে সুর তুলি, তাঁকেই চিনি প্রথম, তিনিই আসলে বৈশাখ। শুভ জন্মদিন মহারাজা।
সারাবাংলা/এমএম