Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হাসান আজিজুল হক- এক নন্দিত গদ্যশিল্পী

সাহিত্য ডেস্ক
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:২৩

না, কখনও কেন্দ্রে না থেকেও তিনি সবসময়ই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্রস্থলে। কেন্দ্র বলতে আসলে রাজধানী ঢাকাকে বোঝানো হচ্ছে যেখান থেকেই সমসাময়িক বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্য বিকশিত নানা মাত্রায়। কিন্তু রাজশাহী কলেজ ও পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে করতে সেখানেই জীবন কাটিয়ে দিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই ‘উজান’ নামের বিখ্যাত বাড়িতে তার বাস। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সবুজে ঘেরা পদ্মার তীরের এই শহরেই বিকশিত হয়েছে তার সাহিত্য জীবন। তিনি আর কেউ নন। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। বেঁচে থাকলে ‘আগুনপাখি’র স্রষ্টা আজ পা দিতেন ৮৪ বছরে।

বিজ্ঞাপন

১৯৬০ সালে ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায় ‘একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে’ গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। একই বছর সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় ‘শকুন’ শীর্ষক গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাহিত্যসমাজের দৃষ্টি কেড়ে নেন তিনি। এর আগে স্কুলজীবন থেকেই টুকটাক লিখলেও ১৯৬০ সালকেই তার সাহিত্যিক জীবনের উন্মোচনের সময় বলে উল্লেখ করা যায়। পূর্বমেঘের পরবর্তী পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল প্রায় সবগুলো পত্রিকায় একাধারে লিখেছেন। ‘পূবালী’, ‘কালবেলা’, ‘গণসাহিত্য’, ‘ছোটগল্প’, ‘নাগরিক’, ‘পরিক্রম’, ‘কণ্ঠস্বর’, ‘পূর্বমেঘ’ প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি প্রায় নিয়মিত লিখেছেন।

বিজ্ঞাপন

১৯৬৩ সালে খুলনায় সুহৃদ নাজিম মাহমুদের সহযোগিতায় ‘সন্দীপন গোষ্ঠী’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে হাসান আজিজুল হক যুক্ত হন। তারা যুগ্মভাবে এই নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ততদিনে অবশ্য হাসান আজিজুল হক রীতিমত বিখ্যাত।

পাঠকপ্রিয় এই কথাসাহিত্যিকের জন্ম ১৯৩৯ সালে, ভারতভাগের আগেই। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে। কৈশোরেই চলে আসতে হয় বাংলাদেশে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা নিজের গ্রামেই করেছেন। ১৯৫৪ সালে যবগ্রাম মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৬ সালে খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। যৌবনের শুরুতেই প্রগতিশীল রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন হাসান আজিজুল হক। রাজনীতি করার কারণে পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়তে হয় তাকে। পরে তিনি ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। ১৯৫৮ সালে এই কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ১৯৭৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে অধ্যাপনা করেন।

দেশভাগের যন্ত্রণা আরও কোটি সংবেদনশীল মানুষের মতো বিদ্ধ করেছিল তাকেও। দর্শনশাস্ত্রে পড়ালেখা ও শিক্ষকতা করলেও মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল অন্তরজুড়ে। সেই কথা বলতেই বেছে নেন কলমকে। একের পর গল্প লিখে রীতিমতো বাংলা ছোটগল্পের এক অনন্য কারিগরে পরিণত হয়েছিলেন। দীর্ঘ সাড়ে দশক পর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসটিও রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয় সাহিত্য অঙ্গনে। এক উপন্যাসেই জয় করে নেন লাখো পাঠকের মন, সমালোচকদের স্তুতি। আর পেশা হিসেবে শিক্ষকতা করতে গিয়েও হাজারও শিক্ষার্থীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন।

দর্শনের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হওয়ার সুবাদে জীবনকে ভিন্নভাবে দেখার এক অনন্য কৌশলের অধিকারী ছিলেন হাসান আজিজুল হক। গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠার সুবাদে প্রান্তিক মানুষের জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সাধারণ মানুষদের সঙ্গে অবলীলায় মিশে যেতেন বলে তাদের ভাব-ভাষা-ভঙ্গি-ভাবনা সবই ছিল তার নখদর্পণে। দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, দাঙ্গা, পাকিস্তানি জান্তার অপশাসনের মতো সব অভিজ্ঞতাও জীবন দিয়ে বুঝে নিয়েছিলেন। তাই হাতে যখন কলম তুলে নিয়েছিলেন হাসান আজিজুল হক, জীবনের সেই অভিজ্ঞতাই হয়ে দাঁড়াল তার লেখনির শক্তি। মানুষের জীবন, ধর্ম, রাজনীতি, ক্লান্তিকর যাপন, বিভক্তি, দেশ, রাষ্ট্র, মনোজগত— সবকিছুরই স্ফূরণ ঘটতে থাকল। নিজস্ব ভঙ্গির ভাষা আর গদ্যরীতিতে হয়ে উঠলেন ছোটগল্পের জাদুকর।

তবে সেই যে প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে সখ্য, সেটিই বোধহয় হাসান আজিজুল হকের অন্তর্কথা, একান্ত নিজস্ব অনুভূতি। সে কারণেই ঢাকা নয়, প্রকৃতিঘেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসই ছিল তার চিরআপন। অধ্যাপনার পর অবসরেও ঢাকার নাগরিকতায় মানিয়ে নিতে আসেননি। নিভৃতেই পাঠক-ভক্ত-শিক্ষার্থী-সহকর্মীদের ভালোবাসা নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থেকে গেছেন রাজশাহী শহরেই। তবে তার লেখনি দিয়ে বরাবরই ঝড় তুলেছেন সাহিত্যাঙ্গনে। কোলাহল থেকে দূরে তার নিজ নিবাসে প্রয়াত হয়েছেন ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর।

হাসান আজিজুল হকের উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, পাতালে হাসপাতালে, নামহীন গোত্রহীন, চলচিত্রের খুঁটিনাটি, মা মেয়ের সংসার, বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প, সক্রেটিস, বৃত্তায়ন, শিউলি, আগুনপাখি, ফিরে যাই ফিরে আসি, উঁকি দিয়ে দিগন্ত প্রভৃতি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইয়ের মধ্যে রয়েছে একাত্তর: করতলে ছিন্নমাথা, লাল ঘোড়া আমি, ফুটবল থেকে সাবধান ইত্যাদি। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে গোবিন্দচন্দ্র দেব রচনাবলী, একুশে ফেব্রুয়ারি গল্প সংকলন, জন্ম যদি তব বঙ্গে ইত্যাদি।

কথাসাহিত্যে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা। এর মধ্যে রয়েছে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭), বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), কাজী মাহবুব উল্লাহ ও বেগম জেবুন্নিসা পুরস্কার। এছাড়া ১৯৯৯ সালে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন হাসান আজিজুল হক। ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার। ২০১২ সালে তিনি ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি পান।

সারাবাংলা/এসবিডিই

হাসান আজিজুল হক- এক নন্দিত গদ্যশিল্পী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর