প্রসঙ্গ ইংরেজি ভাষা: বিদেশি থেকে দেশী ভাষায় রূপান্তর পরিক্রমা
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৬:৫৭
১. ভূমিকা
মানব কথিত বুলি ভাষা-পরিস্থিতিভেদে নানান অভিধা লাভ করে। বিশেষায়িত ভাষা বিজ্ঞানে এসব অভিধার পরিচয় পাওয়া যায়। ইন্দোআর্য ভাষা বিজ্ঞানে যেমন কোনো মানব বুলি সংস্কৃত, প্রাকৃত, পালি, অপভ্রংশ, অবহটঠ ও প্রাচীন বাংলা ইত্যাদি অভিধা লাভ করে। তেমনিভাবে শিক্ষাশ্রয়ী ভাষাবিজ্ঞানে কোনো মানব বুলি মাতৃভাষা, প্রথম ভাষা, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাষা ইত্যাদি অভিধা লাভ করে। আবার সামাজিক ভাষা বিজ্ঞানে কোনো মানব বুলি দেশি ভাষা ও অন্যটি বিদেশি অভিধা লাভ করতে পারে। তেমনিভাবে রাজনৈতিক ভাষাবিজ্ঞানে একটি মানব বুলি জাতীয় ভাষা, দাপ্তরিক ভাষা ও রাষ্ট্রভাষা ইত্যাদি মর্যাদা লাভ করে।
ভাষা-পরিস্থিতিভেদে এক একটি ভাষা তার নিজস্ব মর্যাদা লাভ করে। ঠিক একই কারণে আবার ভাষানীতি পরিবর্তনের কারণে মর্যাদা বদলায়। উদাহরণস্বরূপ এক সময় (১২০৩-১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ) বাঙ্গলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা ও দাপ্তরিক ভাষা ছিলো ফার্সি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলে (১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে) ইংরেজিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসবে চালু করাতে ফার্সি এখন এ দেশে বিদেশি ভাষা। তেমনিভাবে এক সময় ভারতীয় যুক্তরাজ্যের দাপ্তরিক ভাষা ছিলো ফার্সি। কিন্তু বর্তমানে এর দাপ্তরিক ভাষা হলো ইংরেজি ও হিন্দি। কাজেই ভারতীয় যুক্তরাজ্যের ফার্সি ভাষার মর্যাদার পরির্তন ঘটেছে। অনুরূপভাবে, বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে যে ইংরেজি ভাষা এক সময় ‘বিদেশি ভাষা’ ছিলো, সে ইংরেজি ভাষার মর্যাদা পরিবর্তিত হয়ে, এখন তা দেশী ভাষা হিসাবে মর্যাদা লাভের ধারায় রয়েছে।
২. বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে বিদেশি ভাষা
এ পর্যায়ে জানা প্রয়োজন যে, বিদেশি ভাষা বলতে কী বুঝায়। ভিন্নদেশে কথিত ও ব্যবহৃত কোনো ভাষা, যার সে দেশে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র ভাষা বা জাতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি রয়েছে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে বিদেশি কথিত ভাষার মধ্যে ইংরেজি বিদেশি ভাষা কি-না তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। এই ধন্দটির সমাধান খুঁজতে আমাদেরকে জানতে হবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কালীন সময় থেকে শুরু করে প্রণীত আইন, ভাষানীতি ও শিক্ষানীতি সম্পর্কে। আমাদের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা ও দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ভাষানীতি নেই, তাই কোনো বুলির বিদেশি ভাষা হিসাবে সর্বশেষ মর্যাদা নিরূপণের কোনো দলিল আমাদের হাতে নেই। তবে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে প্রণীত ও গৃহীত শিক্ষানীতিগুলোতে ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কিত নির্দেশনাগুলো পর্যালোচনা করলে, বিদেশি ভাষার মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে। আলোচনার সুবিধার্থে এখানে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ৮ই জুন প্রণীত ও ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে গৃহীত শিক্ষানীতির ১৪ নম্বর পৃষ্টার ৪.৬ অনুচ্ছেদটি এখানে উদ্ধৃত করা হলো:
শিক্ষানীতির এই অনুচ্ছেদে যে কয়টি বিদেশি ভাষার উল্লেখ আছে, সেগুলো হলো ইংরেজি, আরবি, ফার্সি রুশ, গ্রীক, জাপানি ও চীনা। অর্থ্যাৎ এই শিক্ষানীতি ইংরেজি ভাষাকে অন্যান্য বিদেশি ভাষার সাথে এক কাতারে রেখে বিদেশি ভাষা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই একই অনুচ্ছেদে ইংরেজিকে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই শিক্ষানীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্ হলো এই যে, পঞ্চম শ্রেণির পূর্বে কোনো বিদেশি ভাষা শেখার প্রয়োজন নেই বলে বিবৃত করা হয়েছে। কিন্তু দেশের শিক্ষানীতিতে পরিমার্জন ও বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে কেবলমাত্র ইংরেজি ভাষাকে অধিকতর মর্যাদা দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় তা প্রচলনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই শিক্ষানীতিতে বিদেশি ভাষার পক্ষে একমাত্র ব্যতিক্রমী ধারা হলো এই যে কর্মোদ্দেশ্যে বিদেশ গমনেচ্ছুদের সুবিধার্থে কারিগরী বিদ্যালয়সমূহে বিদেশি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছে।
ইতোমধ্যে বিশ্বায়ন শুরু হয়েছে। এই বিশ্বায়নের প্রভাবে বিদেশি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রয়োজন অনুসারে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রস্তুত না হলেও, বিকল্প অনেক বিদেশি ও দেশি প্রতিষ্ঠানে বিদেশি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে ইংরেজি ভাষাকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা এবং এই ভাষাকে অন্যান্য সকল বিদেশি ভাষার বিকল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে প্রকৃত বিদেশি ভাষাগুলো বিদেশি ভাষা হিসাবে প্রায়োগিকতা হারিয়ে চলেছে।
৩. ইংরেজি ভাষাকে বিদেশি ভাষা অভিধা আরোপণ সমস্যা
ইংরেজি বিদেশি ভাষা হয়েও অন্যান্য বিদেশি ভাষার চেয়ে ভিন্নতর। কারণ পয়াক্রমিকভাবে বিভিন্ন কালপর্বে শিক্ষানীতিতে পরিবর্তনের ফলে ইংরেজি ভাষার প্রায়োগিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ফলশ্রুতিতে বিদেশি ভাষা হিসাবে এর মর্যাদার পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে আত্ম প্রকাশের পর, এ পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষানীতি বা জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ছয় বার। কালক্রমে এই ছয় ধাপে ইংরেজি ভাষার মর্যাদা বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ২০ বছর পর ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কারিক্যুলাম কমিটি কর্তৃক প্রণীত শিক্ষানীতিতে প্রথমবারের মতো প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি ভাষাকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসাবে চালু করার বিধান দেওয়া হয় এবং ২০০০ খ্রিস্টাব্দ ও ২০১০ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত শিক্ষানীতিতে English medium School, English version School এবং English medium বিশ্ববিদ্যালয় চালুর অনুমোদন দেওয়া হয়।
২০০০ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত শিক্ষানীতির ৩নং পৃষ্টায় শিক্ষার্থীদের জন্য একই সাথে মাতৃভাষায় শিক্ষা ও ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিধান দেওয়া হয়। শিক্ষানীতির এই পৃষ্টায় মাতৃভাষা ও ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার বিধানটি যেভাবে বিবৃত করা হয়েছে, তা আমাদের নিকট ধন্দ হিসাবে উপস্থিত হয়। কেননা মাতৃভাষার মাধ্যমে একই শিক্ষা দেওয়ার বিধান দেওয়া হলে, সেখানে ইংরেজি ভাষা মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কোনো সুযোগ থাকে না।
৪. ইংরেজি ভাষার দেশীয়করণ
এভাবে শিক্ষানীতিতে পুন: পুন: পরিবর্তনের ফলে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তনগুলো সূচীত হয় তা নিম্নরূপ:
১) দ্বি-ভাষিক সাক্ষরতা বিশিষ্ট জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন
২) প্রথম শ্রেণি থেকে ত্রয়োদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্বাক্ষরতা ইংরেজি কোর্সের প্রবর্তন
৩) ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড ও জিইডি ইত্যাদি বিদেশি কারিক্যুলামে শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন
৪) শিক্ষার সকল স্তরে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন
এসব পরিবর্তনের ছাপ দেশের গণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই (public university) দৃষ্ট হচ্ছে। অর্থ্যাৎ দেশে এখন জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই শিক্ষাব্যবস্থার পৃষ্টপোষকগণ হলেন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক অভিজাত বর্গ। এমনকি যারা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্বে আছেন, তাঁরাও মূলত দেশে বিকল্প ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট রয়েছেন।
দেশে এখন বাংলা ও ইংরেজি- এই দু’টি শিক্ষাব্যবস্থা সমান্তরালভাবে চালু রয়েছে। এই দুই মাধ্যমের শিক্ষা থেকে মানুষের কাছে এখন উত্তমটি বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু মানুষের এই বাছাইয়ের প্রক্রিয়াটি নির্ধারিত হয় জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও আর্থিক সামর্থ্য নামক নিয়ামক দ্বারা। কিন্তু অর্থনীতির কাছে জাতীয়তাবাদ সর্বদা পিছু হটে। সবাই এখন ছুটছে ইংরেজি শিক্ষার পিছনে। কাজেই এখন বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার মধ্যে মানুষ ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাকেই বেছে নিতে চায়, কিন্তু এই উদ্দেশ্য থেকে বিরত থাকে শুধু তখন, যখন আর্থিক সামর্থ্য থাকে না। কাজেই ইংরেজি শিক্ষা বেছে নেওয়ার ব্যাপারটি এখন আর্থিক সামর্থ্যের সাথে সম্পর্কিত।
৫. উপসংহার
সবশেষে বলা যায় যে, ইংরেজি ভাষা তার বিদেশি ভাষার মর্যাদা হারিয়ে এবং দেশীয় ভাষার মর্যাদা লাভের প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং এর ফলশ্রুতিততে এই শিক্ষা অর্থনৈতিক সামর্থ্য ভিত্তিক বিভেদের দেওয়াল টানতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
লেখক: পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভূতপূর্ব অভ্যাগত অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়, ভূতপূর্ব অতিথি শিক্ষক, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়, ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট
সারাবাংলা/এসবিডিই
অধ্যাপক ডক্টর এ.বি.এম.রেজাউল করিম ফকির প্রবন্ধ প্রসঙ্গ ইংরেজি ভাষা: বিদেশি থেকে দেশী ভাষায় রূপান্তর পরিক্রমা