Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গৌতম বিশ্বাসের গল্প ‘নতুন জীবন’

গৌতম বিশ্বাস
১১ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:১৫

‘কই গো, গেলা কুনঠে?’
‘হলো কী? ডাকো ক্যান?’
‘অহনও হয় নাই? বাইর হবো কহন?’
‘হইচে গো হইচে। এট্টু দেরি সয় না।’
বলতে বলতে গামছায় বাঁধা ভাতের গামলা আর প্লাস্টিকের খালি বোতল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো পারুলবালা।
হাতে কাস্তে, কাঁধে গামছা নিয়ে দাওয়ার গা ঘেঁষে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে বুড়ো অবিনাশ। বয়স তার সত্তরের কোঠায়। সেই কবে যে শেষ সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা তার নিজেরও মনে নেই। খাটাখাটনির শরীর বয়সের ভার বইতে না পেরে ধনুকের মত সামনের দিকে বেঁকে গেছে অনেকখানি। নামের আগে কে যেন তাই ‘বাঁকা’ শব্দটা বসিয়ে দিয়েছে। লোকের মুখে মুখে সে এখন ‘বাঁকা অবিনাশ’। কেউ কেউ আবার বলে ‘ব্যাঁকা অবিনাশ’।

বিজ্ঞাপন

এখনও সূর্য ওঠেনি। তবে পূবের আকাশে বেশ রঙ ধরেছে। যখন তখন সে লাফ মেরে উঠে আসবে। চারদিক ফর্সা হয়ে এসেছে পুরোপুরি। রাতের জড়তাও কেটে গেছে এরই মধ্যে। গাছের ডালে, ঝোপের আড়ালে অসংখ্য পাখির ডাকাডাকি। সেই সাথে হাঁস-মুরগি ডাকছে। ছাগল ডাকছে। রাতের নীরবতা পুরোপুরি উধাও। ঘুমজড়ানো চোখ জল দিয়ে ধুয়ে এরই মধ্যে মাঠে নেমে পড়েছে কেউ কেউ। কেউ আবার নামার অপেক্ষায়। অপেক্ষায় বুড়ো অবিনাশও। সে যাবে পাশের গাঁ লক্ষ্মীপুর। সেখানে রাইচরণ বিশ্বাসের খেতে দিনকয়েক হলো ধান কাটার কাজ করছে সে। এখন বৈশাখের মাঝামাঝি। চারদিকে ধান কাটা মরশুম শুরু হয়ে গেছে। ছোট বড়ো সব চাষিদেরই এখন ব্যস্ততা। বৃষ্টি বর্ষা শুরু হওয়ার আগে খেতের ধান ঘরে তোলার জন্য যে যার সাধ্যমতো চেষ্টা শুরু করেছে। যাকে পাচ্ছে তাকে ধরেই লাগিয়ে দিচ্ছে কাজে।

বিজ্ঞাপন

অবিনাশের ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা। এমনিতেই তার যা বয়স তাতে কেউ তাকে কাজে নিতে ভরসা পায় না। তার ওপর শরীরটা বেঁকেচুরে এমন চেহারা নিয়েছে যে কাজে নেওয়ার কথা ভাবলে অনেকেই আঁতকে ওঠে। কতটুকু কাজ যে সে করতে পারবে তাই নিয়ে সন্দেহ হয়। সন্দেহ হয়েছিল রাইচরণেরও। ভালো করে একবার অবিনাশের বুড়োটে শরীরটাকে দেখেটেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি কী পারবা?’
আজকাল অবিনাশের অবস্থা এমন- ‘যা পাই আঁকড়ে ধরি।’ একমাত্র ছেলে ফুলচাঁদ বৌ নিয়ে বাড়ি ছাড়তেই ‘আজ খাই কাল নাই’ অবস্থা। একদিন কাজ না করলে পরদিন উপোস দিতে হয়। বৌ পারুলবালাকে নিয়ে দু’দুটো পেট তার। খাওয়া পরা সব চালাতে হয় এই অবিনাশকেই। না বাপ তার জন্যে এক ছটাক জমি রেখে গেছে, না সে নিজে এক ছটাক বানাতে পেরেছে। লোকের জমিতে খেটেখুটে তবেই বেঁচে আছে অবিনাশ। একে অবশ্য বেঁচে থাকা বলে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে অবিনাশেরও কিন্তু পেট তো আর তার কথা শোনে না। তার খিদে পায়। আর সেই খিদে মেটাতেই এই বয়েসেও লোকের জমিতে কাজ করে অবিনাশ।
তো রাইচরণ বিশ্বাসের কথা শেষ হতে না হতেই অবিনাশ বলেছিল, ‘ইজ্ঞে, ভালোই পারবো। সারা জেবন এইই তো কইরে আলাম।’
‘তা করিছো। কিন্তু বয়েস বলে তো এট্টা কথা আছে। তা কত যেন বয়েস হলো তোমার?’
‘সে বাবু অনেক।’
‘তা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু এই বয়েসে…’
‘না কইরে কি করবো। কত আশা নে ছেল্যেডার বে দিলাম। ভাবলাম নতুন বৌ এস্যে সোংসার বুঝ্যে নেবে। আমরা বুড়োবুড়ি সারাজেবন কম তো খাটলাম না। অহন শ্যাষ বয়াসে এট্টু শুয়ে বস্যে খাবো। তা না, বৌ নে ছেল্যে আমার ভেন্ন হইয়ে গেল। গেল কুনঠে? না শ্বউরবাড়ির গাঁয়। যাতে আমাগের চোক্ষের দেহাও না লাগে।’
বলতে বলতে চোখ দু’টো বুঝি ভিজে এসেছিল অবিনাশের। আর তা দেখেই রাইচরণ বলেছিল, ‘ঠিক আছে, তালে যদ্দিন পারো আমার এখানেই করো। সারাবছরই কাজ থাকে আমার।’
তা সেই থেকে রাইচরণ বিশ্বাসের খেতেই কাজ করছে অবিনাশ। সূর্য ওঠার আগেই উঠে পড়ে সে। তারপর ভাত তরকারি গুছিয়ে নিয়ে পশ্চিমের ডাঙা মাঠ পেরিয়ে সোজা চলে যায় লক্ষ্মীপুর। ততক্ষণে সূর্যটাও উঠে পড়ে আকাশে। ফকফকে একটা আলোটে ভাব ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। অন্যদের সাথে কাজে লেগে যায় অবিনাশও। বয়েস হয়েছে বলে সে কাজে একটু কমা। তা বলে অন্য মুনিষরা কেউ তাকে হিংসে করে না। কেউ দুকথা শুনিয়ে খোটা দেয় না। বরং সবাই বলে, ‘তা তুমার বয়াস হইচে খুড়ো। এট্টু রয়ে সয়ে কোরো। মালিক আমাদের মানুষ বেশ ভালো। কাজ নিয়ে কুনও জোরাজুরি নাই তার।’
অবিনাশ অবশ্য যতটা পারে করে। এমনিতেই সে জানে এই কাজটা চলে গেলে বেজায় আতান্তরেই পড়তে হবে তাকে। ফের নতুন কাজ খুঁজতে বেরোতে হবে। কোনোদিন পাবে, কোনওদিন নয়। সে এক বেজায় ঝামেলার ব্যাপার। নিত্যদিন কাজ খুঁজে বেড়ানো এই বয়সে সম্ভব?
সম্ভব তো নয় নিত্যদিন এভাবে খাটাও। কিন্তু উপায় কী? ছেলেটা সেই যে বৌ নিয়ে বেরিয়ে গেল, আর তো বাড়িমুখোই হলো না। কত করে পারুলবালা তাকে বুঝিয়েছিল, ‘যাসনি বাপ। তুই চল্যে গেলি আমরা বাঁচপো ক্যামনে? তাছাড়া এই বাড়িঘর তো তোগেরই। আমরা আর কয়দিন আছি ক?’
সেকথা কানেই নেয়নি ফুলচাঁদ। উল্টে তার বৌ পারুলবালা কে শুনিয়ে শুনিয়ে ফুলচাঁদকে বলেছিল, ‘আমাগের ভালো দেকলি তুমার বাপ-মার চোখ টাঁটায়। তুমি যে ওখেনে গে বলরামপুর বাজারে সিদু মন্ডলের ত্যালকলে কাজ নিবা, বৌ-ছেল্যে নে ভালো থাকপা, তা এগের সহ্য হচ্ছে না।’

ধস্ত শরীরটাকে দাওয়ার খুঁটিতে এলিয়ে দিয়ে বসে ছিল অবিনাশ। তার তখন দুচোখ জুড়ে অতীত। ফুলচাঁদের ছোটবেলা। কিছু বলতে গিয়েও সামলে নিয়েছিল সে। বরং পারুলবালা কে ডেকে বলেছিল, ‘ওগের যাতি দেও। ভিন জাগায় গে ওরা যদি ভালো থায়ে, থাক। আমাগের কী? কপালে খাটনি আছে। খাটপো। যদ্দিন পারি নিজেগের ভাত নিজিরাই জোগাড় করবো। যেদিন শরীল কুলোবে না সেইদিন পড়্যে থাকপো।’
তো নিজেদের খাবার নিজেরাই জোগাড় করে তারা। অবিনাশ অন্যের জমিতে জন খাটে। পারুলবালা ছাগল, হাঁস-মুরগি পোষে। ঘুঁটে দেয়। আর এর ওর কাছ থেকে চেয়েচিন্তে খেতের কলাটা, মুলোটা নিয়ে আসে। ভোর হতে না হতেই বেরিয়ে যায় অবিনাশ। আড়াআড়ি মাঠ পেরিয়ে সোজা গিয়ে ওঠে লক্ষ্মীপুর। ফেরার পথেও সেই মাঠ পেরিয়ে ফেরে। রাস্তা ধরে গেলে অনেকটাই ঘুরপথ। দ্বিগুন সময় যেমন লাগে, তেমন হাঁটতেও হয় বেশি। ওই পথটা পারতপক্ষে এড়িয়েই চলে তাই। মাঠে নামলেই সামনে দেখা যায় লক্ষ্মীপুর। মনে হয় এই তো এতটুকু পথ। তো এটাই ভাবে আর হাঁটে। ফেরার পথেও এমনই মনে হয় তার। হোক সে মেঘ বাদলার দিন। কিংবা তপ্ত রোদে ভরাদুপুর। নিত্যদিন এই মাঠের পথটাই ধরে অবিনাশ।
আজও সে এই পথটাই ধরবে বলে ঠিকই করে নিয়েছিল। আর তাড়াতাড়ি গুছিয়ে দেওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিলো পারুলবালাকে। পারুলবালা ব্যস্ত হাতে ভাতের গামলা আর জলের বোতল এগিয়ে দিতে আর দাঁড়ালো না অবিনাশ। যথাসম্ভব দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলো সে।

পূবের আকাশে রং ধরেছে। যখন তখন সূর্যটা লাফ মেরে উঠে আসবে। সেই দৃশ্যটা অবশ্য বেশ। কিন্তু তা দেখার মত অতখানি সময় নেই অবিনাশের। বুড়ো শরীরে এমনিতেই তার হাঁটার গতি যথেষ্ট শ্লথ হয়ে এসেছে। তার ওপর ঘুম ভাঙতে আজ খানিক দেরিই হয়ে গেছে তার। নিত্যদিন মোরগের প্রথম ডাকেই ঘুম ভাঙা অভ্যেস। আজ আর সেটা হয়নি। অন্যদিন মোরগের ডাকে ঘুম ভেঙে দরজার আগল খুলে সে যখন দাওয়ায় পা রাখে তখনও চারপাশের ঝোপঝাড়ে, গাছের পাতায় বলতে গেলে পুরোপুরিই আঁধার। সেই আঁধারেই সে দাঁতন করে। চোখমুখ ধোয়। তারপর নাকে মুখে নুন পানতা যা হোক চাট্টি দিতে না দিতেই বেরোনোর সময় হয়ে যায়। আজ উঠতে দেরি হওয়ায় বড্ডো তাড়াহুড়ো বেঁধেছে তার। মালিক রাইচরণ মানুষটা বেশ ভালো। তাকে আড়ালে ডেকে বলে দিয়েছে, ‘শোনো হে, এই বয়েসে কাজ যে তুমি অন্যদের মত পারবা না সে আমি জানি। কিন্তু তা বলে আসতে কোনোওদিন দেরি কোরো না। বোঝোই তো দশজনা নিয়ে আমার কাজ। কখন কে কি বলে বসে।’
কথা দিয়েছে অবিনাশ, ‘না বাবু, তা হবে না।’
ঘুম ভাঙা থেকে শুরু করে সেই বাড়ি না পৌঁছানো পর্যন্ত একটা তাড়া ভেতরে ভেতরে থেকেই যায় অবিনাশের। সত্যিই তো, দশজনার কাজ। তার যদি দেরি হয় তাহলে অন্যেরাই বা শুনবে কেন? তারা তো আর অবিনাশের থেকে বেশি টাকা পাচ্ছে না।
আজ ঘুম ভাঙতে দেরি হওয়ায় ভেতরে ভেতরে একটা খচখচানি কেবলই খোঁচাচ্ছে অবিনাশকে। যত দ্রুতই পা চালাচ্ছে সে তাতেই মনে হচ্ছে, ‘না, ঠিক হচ্ছে না। আরেট্টু তাড়াতাড়ি চালাতি হবে।’
তা বেশ দ্রুতই পা চালিয়ে হাঁটছে অবিনাশ। পশ্চিমের এই মাঠটা বেশ বড়ো। এই মাঠ আসলে উঁচু ডাঙাজমি। ধান থেকে বেশি তিল, পাটের চাষ। তিলখেতে এখন ভরা যৌবন। পাটখেত ভর্তি কচি চারা। দুই চোখে রাজ্যের স্বপ্ন নিয়ে আকাশের দিকে দল বেঁধে চেয়ে আছে সবাই। জন্ম নেওয়া ইস্তক একফোঁটা বৃষ্টির ছোঁয়া কেউ পায়নি। একফালি মেঘও জমতে দ্যাখেনি এতবড়ো আকাশটার কোথাও। অথচ এখন বৈশাখের মাঝামাঝি। এতদিনে খানকতক কালবৈশাখী হয়ে যাওয়ার কথা। কোথায় কি, ঝকঝকে আকাশটা শূন্য গা নিয়ে দিনরাত পৃথিবীর দিকে চেয়ে আছে। এত কি দেখছে কে জানে। হয়তো দেখতে দেখতে ভাবছে, ‘দেখি কত সইতে পারিস।’
তা দায়ে পড়ে সইতেই হচ্ছে সবাইকে। সইছে আর বারে বারে আকাশ দেখছে। সে মাঠের ফসল থেকে গাছপালা, মানুষজন, হাঁস-মুরগি, পোকামাকড়- সবাই।
হাঁটতে হাঁটতে অবিনাশও আকাশের দিজে তাকালো। ক’দিন ধরে দিনান্তে শরীর আর চলতে চাইছে না তার। সারাবেলা রাইচরণ বিশ্বাসের ধানখেতে রোদভাজা হতে হতে গা মাথা বুঝি ঝলসে গেছে তার সারা শরীর জুড়ে তীব্র এক দহনের আঁচ। এ থেকে শান্তি পেতে দরকার ঝমঝম বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিফোটা গায়ে পড়লে তবে যদি গা জুড়োয়। এই যে কাজ থেকে ফিরে নন্দ ঢালির পুকুরে নেমে নিজেকে যে ঘন্টাখানেক চুবিয়ে রাখে সে তাতে সাময়িক জুড়োয় বটে গা টা তবে মন জুড়োয় না। মন কেবল মেঘ চায়। বৃষ্টি চায়। আকাশ ভাঙা বৃষ্টিতে খাল, বিল, নদী, নালা সব একাকার হয়ে যাক তাই চায়। চাইতে চাইতে সে অপেক্ষা করে। নিত্যদিন কেবলই ভাবে আজ ঠিকই মেঘ হবে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা আজও ভেঙে গেল অবিনাশের। না, একফোঁটা মেঘের দেখা নেই কোথাও। ‘সপ ম্যাঘ কুথায় যে শালা পলালো’ মনে মনে বলতে বলতেই চোখ নামিয়ে নিল অবিনাশ। আর তখনই পাশের খেত থেকে কেউ বলে উঠলো, ‘তা খুড়োর যে আজ দেরি হইয়ে গেল।’
দাঁড়িয়ে পড়ল অবিনাশ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল খানিক তফাতে একা একাই বসে ধান কাটছে দক্ষিণ পাড়ার নেপাল। মাত্রই বিঘেখানেক জমিতে ধান লাগিয়েছে সে। জন টন নেয়নি একেবারেই। যা কাজ সব গায়ে খেটে একাই করেছে। এখনও এই কাটার সময়েও তাইই করছে।
নেপালকে দেখে অবিনাশ বলল, ‘হ বাপ, তা হইচে। আসলে সপ দোষ হলো বয়াসের। এই বয়াসে সপ কী আর আগের মতো থায়ে?’
মুঠো করা কাটা ধান একপাশে নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো নেপাল, ‘আসলে তুমার কপালডাই খারাপ খুড়ো। না হলি প্যাট চালাতি এই বয়াসেও কারুর জন খাটতি হয়? ফুলচাঁদ যদি…’
নেপালকে থামিয়ে দিল অবিনাশ, ‘তার কথা থাক বাপ। মেইয়ে বৌ নে আমাগের ছাড়া যদি সে শান্তিতি থায়ে…’
কথাটা পুরো বাক্যে শেষ করলো না অবিনাশ। ঈষৎ থেমে গিয়ে বলল, ‘যাই রে বাপ, না হলি আরও দেরি হইয়ে যাবে।’
‘হ খুড়ো, যাও।’
ফুলচাঁদের কথায় ভেতরটা ভিজে গেল বুঝি অবিনাশের। চোখের কোনায় জমে ওঠা এক বিন্দু জলের দেখা আর কেউ না পেলেও বুড়ো অবিনাশ ঠিকই দেখতে পেল। আর তাতেই যেন পায়ে গতি বাড়লো তার। লক্ষ্মীপুর গাঁয়ের বড়ো লম্বু গাছটার আকাশ ছোঁয়া মাথার দিকে তাকিয়ে ফের হাঁটতে লাগলো সে।

অবিনাশ যখন পৌঁছেছিল ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে। আকাশজোড়া রোদ ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসছে পৃথিবীর ওপর। গাছের ডালে, ঝোপের আড়ালে অসংখ্য পাখির কিচিরমিচির। অনেকেই কাজে বেরিয়ে পড়েছে। আবার বেরোবো বেরোবো করছে অনেকেই। অবিনাশ যাদের সঙ্গে কাজ করে হাতে কাস্তে, কাঁধে গামছা নিয়ে তারা তৈরি। আর তা দেখে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল অবিনাশ। কিন্তু তাকে আশ্বস্ত করে রাইচরন বলেছিল, ‘আরে অত তাড়া কিসের? এসে পারলে না, তার মধ্যেই…’
নিজেকে যেন অপরাধী মনে হচ্ছিলো অবিনাশের। গলার স্বর ঈষৎ নামিয়ে বলেছিল, ‘এমনিতিই আজ দেরি হইয়ে গেছে। তাই…’
‘আরে এক আধদিন দেরি তো হতেই পারে। রক্ত মাংসের শরীর। তার ওপর এতখানি পথ আসা। এই বয়সে এতখানি পথ যে আসতে পারছো এই তো অনেক।’
এমনও মানুষ হয়! ভেবে যেন খানিক অবাকই হয়েছিল অবিনাশ। সারাজীবন কম মানুষ তো আর দ্যাখেনি সে। কম মানুষের খেতেও কাজ করেনি। সামান্য এদিক ওদিক হলে কতই না কথা শুনতে হয়েছে কতদিন। একবার তো সুফল ঢালি তাকে প্রায় ধরেই মারে অবস্থা। এত এত মানুষের খেতে সে কাজ করলো, কেউ তাকে বুঝতেই চায়নি কোনোওদিন। অথচ এই মানুষটা…
‘কী হলো? ভাবো কী?’
কী সব যেন ভাবতে শুরু করেছিল অবিনাশ। রাইচরনের কথায় ঘোরটা কেটে গিয়েছিল তার। একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে খেতমুখো হাঁটা দিয়েছিল অন্যদের সঙ্গে।
সে অবশ্য সেই ভোর সকালের কথা। রোদের গা তখন অনেকটাই মোলায়েম। পূবের হাওয়ায় বেশ একটা নরম শরম অনুভূতি। চারদিকে অনেকটাই ছায়া ছায়া ভাব।
কিন্তু এখন? সকালবেলার সেই নরম কোমল ভাবটা একেবারেই আর নেই। রোদ ভাজা হতে হতে ক্লান্ত হয়ে সবকিছু কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। সতেজ যা, তা কেবল আকাশের রোদ। ক্ষণে ক্ষণে কেবল তেজ বাড়ছে তার। দুপুর গড়াতে চললো তবু তার তেজের খামতি নেই। রোদ তো নয় যেন গনগনে আগুন। হা করা উনুনের মত মনে হচ্ছে আকাশটাকে। কাজ থেকে ফিরে ঘরের দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছে অবিনাশ। এমনিতেই অত বেলা অব্দি রোদ মাথায় ধান কাটা। তার ওপর খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে অতখানি পথ সে হেঁটে এসেছে। সারা গায়ে তার আগুনে জ্বলন। আর খানিক জিরিয়ে নন্দ ঢালির পুকুরে গিয়ে নামবে সে। তারপর ঘষে ঘষে সেই আগুন ঝরাবে।

অবিনাশের উঠোনের ওপর একফালি আকাশ। দাওয়ায় বসেও সেই আকাশের অনেকখানি দেখা যায়। ঘাড়টা ঈষৎ কাত করে সেদিকে তাকাতে অবিনাশ দেখল ছোট্ট একফালি ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ যেতে যেতে বোধকরি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সেই মেঘের নিচে দুই ডানা প্রসারিত করে উড়ছে বেশ বড়োসড়ো একটা চিল। দৃশ্যটা বেশ লাগলো অবিনাশের। এতদিন পরে একখন্ড মেঘ দেখে মনের ভেতর উঁকি দিল একটা খুশি খুশি ভাব। যাক, আর মাত্র দিনকতক। সবে একফালি মেঘ দেখা দিয়েছে। এরপরে আরও মেঘ আসবে। মেঘের পরে মেঘ জমবে। সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি হবে। আর সেই বৃষ্টিধারায় ধুয়ে যাবে চারিপাশ।
কি যেন একটা ভাবতে যাচ্ছিলো অবিনাশ। বুড়োটে চোখ আর তাকিয়ে থাকতে পারল না সেদিকে। অগত্যা চোখ নামিয়ে নিল সে। আর ঠিক তখনই চোখে পড়ল দৃশ্যটা। চমকে উঠে পিঠটাকে সোজা করে বসলো অবিনাশ। একবার মনে হলো ভুল দেখছে। পরক্ষণেই মনে হলো, না, ঠিকই তো দেখছে সে। সেই চোখ, মুখ, নাক, কান। কতদিন পরে ফুলচাঁদকে দেখল সে। তীব্র একটা ভালোলাগার সঙ্গে সঙ্গে বেজায় অবাকও হলো সে। যে ছেলে একদিন বাপ-মাকে ছেড়ে, বাড়িঘর, উঠোন ছেড়ে চলে গিয়েছিল, সেই ছেলেই কিনা এতদিন পরে এসেছে।
উঠোন পেরিয়ে ফুলচাঁদ ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে অবিনাশের খুব কাছে। পথ হাঁটার ক্লান্তিতে শরীরটা বুঝি এলিয়ে পড়েছে তার। দাঁড়িয়ে থাকার মত শক্তি সে বুঝি পথেই হারিয়ে এসেছে।
ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে আঁৎকে উঠলো অবিনাশ, ‘কী হইচে রে বাপ? তোর চোক্ষে জল ক্যান?’
একরাশ কান্না আছড়ে পড়ল ফুলচাঁদের দুই চোখে। হাঁটু মুড়ে অবিনাশের পায়ের কাছে বসে পড়ল সে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমারে মাপ কইরে দেও।’
ছেলের চোখের জলে অবিনাশের দুটো চোখও ভিজে এলো। জড়ানো গলায় সে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হইচে? অমন করছিস ক্যান?’
বুড়ো বাপের ধুলোমাখা পায়ের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ল ফুলচাঁদ, ‘যার জন্যি আমি তুমাগের ছেড়্যে গেলাম সে…’
‘কী? কী করছে সে? আমারে খুল্যে ক বাপ।’
‘সে আমারে ছেড়্যে আমার ছেল্যেরে নে অন্যের সাথে…’
‘আর কস নে বাপ। বুঝিচি। সপ বুঝিচি আমি। কান্দিস নে। সে গেছে তো কী, এই আমি আছি। তোর মা আছে। এই বাড়িঘর, উঠোন- সপ আছে। আবার আমরা আগের মতো থাকবো।’
‘কিন্তুক আমার ছেল্যে…’
‘তারে আনার ক্ষ্যমতা যে আমার নাই বাপ। যদি তা থাকতো…’
কথায় কথা বাড়ে। আকাশের গায়ে সূর্য গড়ায়। দিনান্তের সব আলো মুছে গিয়ে এক সময় সন্ধ্যা নামে। সন্ধ্যা উতরে রাত। ঘরের দাওয়ায় ছেঁড়া ফাটা খেঁজুর পাতার মাদুরটা পেতে বসে থাকে তিনজন মানুষ। অতীতকে সাজাতে সাজাতে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দ্যাখে। নতুন করে সাজানো বাড়িঘর। নতুন দিনযাপন। আর নতুন করে বেঁচে ওঠা।

বৈশাখী আয়োজনের আরও গল্প পড়তে: 

রবিউল কমলের ছোটদের গল্প ‘তুতু’

মাসুম মাহমুদের গল্প ‘পরস্পর বোঝাপড়া’

জুঁই মনি দাশের গল্প ‘নীহারিকার বানপ্রস্থ’

জহিরুল ইসলামের গল্প ‘একজন হোসেন আলী’

রয় অঞ্জনের গল্প ‘বিজিতের বিজয়রথ’

অর্ণব সান্যালের গল্প ‘জানালায় পরকীয়া’

রোখসানা ইয়াসমিন মণির গল্প ‘দূরত্বের জলে রঙিন ফুল’

শ্যামল নাথের গল্প ‘কাদামাটির আঙুল’

সারাবাংলা/এসবিডিই

গল্প গল্প-উপন্যাস নতুন জীবন বৈশাখী আয়োজন বৈশাখী আয়োজন ১৪৩০ সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর