বিজ্ঞাপন

শ্যামল নাথের গল্প ‘কাদামাটির আঙুল’

April 11, 2023 | 7:35 pm

শ্যামল নাথ

কাঁচামাটির গন্ধে চারদিক আচ্ছন্ন হয়ে আছে। পালপাড়ায় এখন বসন্তের সকাল। আদুরে রোদ এসে পড়ছে মীনাক্ষীর চোখে, মুখে ও ঠোঁটে।
কাদামাটির ওপর লাটিম ঘোরার মতন আঙুল বুলিয়ে যাচ্ছে মীনাক্ষী। পাশে তার স্বামী রাজেশ বসে বসে মাটির পাতিল তুলছে একে একে। যেন হাতের প্রতিটি আঙুল হয়ে উঠছে কাদামাটির আঙুল।
পাশে নলাম গ্রাম। সেই গ্রাম থেকে বংশী নদী পাড়ি দিলে ভেসে ওঠে যে পালপাড়া সেই পাড়ায় বসবাস মীনাক্ষী ও রাজেশদের। বাড়ির মাথায় রাস্তার এক কোণে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছের মধ্যে থেকে পাখির কিচিরমিচির শব্দে সকালটাকে আরও আলোকিত করে দিল। বাড়ির ওপাশে একটা গভীর জঙ্গল আছে। সেই জঙ্গলে সন্ধ্যা হয়ে আসার আগে প্রায়শই মীনাক্ষী ও পরেশকে দেখা যায়। ওই জঙ্গলের ভিতর দিনে দুপুরেও কেউ ভয়ে পা বাড়ায় না আর বিকেল বা সন্ধ্যাবেলা তো দূর অস্ত।
বটগাছের পাশেই খাল। খালে এখন জল নেই। শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। ফাগুনের ঝিরিঝিরি দখিনা বাতাসে অল্প অল্প করে উড়ছে ঝরা পাতাগুলো। চারিদিকে ধ্বনিত হচ্ছে পাতা ঝরার গান। ডালে ডালে উঁকি দিচ্ছে নতুন পাতা, নতুন কুঁড়ি। খালের পাশ ঘেঁষে বাগানের ভিতর থেকে একটি মাধবীলতা গাছে ফুটে থাকা ফুলের সুমিষ্ট গন্ধ যেন শুকনো খালের পাশ দিয়ে বয়ে বয়ে যাচ্ছে। পাল বাড়ির দিকে যাওয়ার ঠিক ডান দিকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে একটি শিমুল গাছ।
পরেশ অভদ্র, ক্রোধী, গোঁয়ার, ধনী, চরিত্রহীন ও ক্ষমতাবান লোক। ক্ষমতার এতো মোহ এবং অর্থের এমন লোভ তাকে আঁকড়ে ধরেছে যেন সে চোখে-মুখে এবং আর কাউকে মানুষই মনে করে না। তবে লোকে তাকে সত্যিকার অর্থে সম্মান করে না। এ নিয়ে পরেশের মনে মনে ভীষণ ক্ষোভ জমে আছে। তবে তার সবল ও দীর্ঘকায় লাল সাদা মিশ্রণের দেহ ও অবয়ব যে কোনো নারীর রাতের ঘুম কেড়ে নিতে পারে।

বিজ্ঞাপন

তারা দু’জনে যা যা কামনা করে তা তা পূরণ করে আসে। তবে প্রতিদিন নয়। সপ্তাহে এক কি দু’দিন। কেউ জানতে পারে না। রাজেশ তখন হয়তো কোনো বাজারে বসে বসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করছে।
এখানে পুরোনো ঘর, ঘরের ভিতরটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার। ছোট ছোট টিনের ঘরবাড়ি। দু’একটি দেওয়াল ঘেরা। সরু সরু রাস্তা বয়ে বয়ে গেছে বাড়িতে ঢুকার রাস্তা দিয়ে বাঁ দিকটায়। প্রতিটি বাড়ি যেন সৃষ্টির উল্লাসে কাঁপছে। ছোট ছোট মেশিনে পা চালিয়ে মাটি কেটে যাচ্ছে পালপাড়ার লোকেরা।
সভ্যতার বিকাশ থেকে এই সৃষ্টিশীল কাজ চলে এলেও মীনাক্ষীদের জীবন থেকে ক্রমেই ছোট হচ্ছে এর পরিসর।
‘আগের মতন আর কাজ কাম নাই।’
‘আমাগো বাপ-দাদারা এই কাজ করেন আমাদের বড় করছে।’
‘মানুষজন আমাদের বাসাকে কুমার বাড়ির ছেলে ছাওয়াল বৌ ঝি হিসেবেই চেনে।’
মীনাক্ষী বাড়ির পাশে যায়, কাঁদামাটি সংগ্রহ করে বাঁশের বানানো টুকরিতে করে কাদামাটি ভরে নিয়ে আসে। খুব কষ্ট করে খুঁজতে হয় পরিষ্কার এঁটেল মাটি। এ মাটি খুব আঠালো। এ মাটি পেলেই সূর্যমুখী ফুলের মতন হেসে ওঠে মীনাক্ষীদের মন, হৃদয় ও মুখ।
একদিকে হাঁড়ি হচ্ছে অন্যদিকে মীনাক্ষার মেয়ে সবিতা তৈরি করছে নকশা করা নানান পুতুল। পুতুলের পাশেই ঘোলা চোখে যেন চেয়ে আছে এক চকচকে রূপালি ইলিশ। দেখতে পদ্মার রুপোলি ইলিশের মতন।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। মীনাক্ষী জঙ্গলের ভিতর আম গাছটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মীনাক্ষী যেন পৃথিবীর সকল ভারবহন করে চলেছে। চোখের পলকে সন্ধ্যার অন্ধকারের মতন আকাশটা কালো হয়ে ডাকাডাকি শুরু করল। যেন আকাশের দেবতা ইন্দ্র এখনি নামবে বলে পণ করেছে। বড় আম গাছটার পাতা বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির শব্দ মীনাক্ষীকে হালকা ভেজাতে শুরু করল। পাশে পরেশ এসে মীনাক্ষীকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে শুরু করল। গভীর অশান্ত আদর। মীনাক্ষী না করল। ইন্দ্র দেবের হুংকারে আরও জোরে বৃষ্টি নামল। দু’জনে ভিজে একাকার। তাদের কেউ এখানে আবিষ্কার করে ফেলতে পারে এই সম্ভবনা প্রবল নয় বলেই এই জঙ্গলের ভিতর সন্ধ্যায়ও তাদের মতিভ্রম হলো।
পরেশ তাদের পাড়ারই সবচেয়ে অর্থ-সম্পদ সম্পন্ন পরিবারের ছেলে। বয়সে মীনাক্ষীর চেয়ে অন্তত পনের বছরের ছোট হবে। তাগড়া জোয়ান। পালপাড়ার মানুষেরা এই জঙ্গলকে ভয় করতে ভালোবাসে। আম গাছটার ঠিক বাঁ পাশে একটা পান পাতার মতন বনজুঁই গাছে ফুল ফুটে সৌরভ বিলিয়ে যাচ্ছে মীনাক্ষী ও পরেশের নাকে এবং স্নায়ুতে।
ঝুম বৃষ্টির পর, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামতে থাকে। সন্ধ্যা আরেকটু বাড়ে। পরেশ পুরোপুরি তৃপ্ত হয় না।
কিন্তু মীনাক্ষীর যে আজ ফিরতে হবে। কখন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই না রাজেশ চলে আসে সেই বিষয়েও একটা ভয় কাজ করে। তবে গরিবের সুন্দরী বৌ যে সকলের বৌ হয়ে ওঠে মীনাক্ষীকে না দেখলে পরখ করা যায় না। মীনাক্ষী অনেকবার অনেককে না করে দিলেও পরেশকে না করতে পারি নি তার ক্ষমতা, অর্থ, শারিরীক সৌন্দর্য এবং মীনাক্ষীর প্রতি মানসিক ঔদার্যের জন্য।
‘ছেড়ে দাও, আজ আর না।’
‘আবার আগামী হাঁটবারের দিন পাবো, আরেকটু থাকো।’
‘চলো, চলে যাই। এমনটা করে না পরেশ।’
‘পরেশ আর চুমো দিও না, তিন দিন পর আবার দিও, আবার আদর করো আমাকে, যতটা পারো।’
‘মীনাক্ষী, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। আরেকটু থাকো।’
‘পাগলামী করো না, বুকটা ছাড়ো।’
‘চলো, আজকের জন্য ছেড়ে দিলাম। তিনদিন পর শ্যামের বাজারের দিন আবার হবে।’
‘হবে, চলো এখন।’
রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে গেল বৃষ্টির রেখাপাতে। আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় ধূসর আভাটা দ্রুত গাঢ় অন্ধকার হয়ে ধরা দিচ্ছে। মীনাক্ষী ও পরেশ চোরের মতন চুপিচুপি হাঁটতে থাকলো। মীনাক্ষী সামনে, পিছনে পরেশ। যদিও ভূতের ও সাপের ভয়ে মনের মধ্যে নিয়ে কেবলই এদিক ওদিকে চোখ তুলে তাকায় মীনাক্ষী ও পরেশ। মীনাক্ষীর হাতে একটা ম্যাচ লাইট। আগুন জ্বালাচ্ছে আর এগিয়ে যাচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ওই সামান্য আলোটুকু নিভে যাচ্ছে। তাকে অনুসরণ করছে পরেশ। বৃষ্টিতে হঠাৎ করে থেমে গেলো। গভীর অন্ধকারে ইন্দ্রের হুংকারে বিজলি চমকাতে চমকাতে পালপাড়ার বিদ্যুৎ উধাও হয়ে গেল। ঘরের ভিতর গত দশ বছর আগেও প্রদীপ জ্বলতো। এখন জ্বলছে এলইডি চার্জার বাতি। এখন রাত বিধায় এতো ভয় নেই। দিনের বেলায় পরেশের মা এখানে লাড়কি, কাঠ, বাইল, খোল, ঝরা পাতা কুড়াতে আসে। কালো মেঘাকাশে উড়তে থাকা মস্ত বড় হাতিটি শান্ত হয়ে, লজ্জা পেয়ে রাঙিয়ে দিল আকাশ। বসন্তের সন্ধ্যাটা খানিক দীর্ঘতর ছিল বিধায় পরেশ ও মীনাক্ষীর বাসনা লাভের পরিমাণ ছিল ঈর্ষনীয়।

ভিজে শরীর নিয়ে বাড়ির কাছে আসতেই পরেশ মীনাক্ষীর ঠোঁটে চুমু খায়। চুমু খেয়ে দুজন দুদিকে অন্ধকারের মতন মিলিয়ে যায়। মনে হয় বসন্তের বিল যেমন মাঠের সাথে মিলিয়ে গেছে তেমন করেই মিলিয়ে গেল তারা দু’জন। বৃষ্টিস্নাত বিষন্ন রাতে পালপাড়ার কোনো কোনো ঘরে লন্ঠনের হালকা রঙিন সোনালি আলো জীবনযুদ্ধের, জীবনযাপনের টুকরো টুকরো ঘটনাবলি যেন দৃশ্যমান ছয়াছবির মতন রূপ ধারণ করে চোখ ও হৃদয়ের সামনে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছে।
ভিজা শরীর নিয়ে ঘরে ডুকতেই সবিতা জিজ্ঞাসা করে, ‘কোথায় গেছো মা? তোমাকে নগেন কাকুদের ঘরে খুঁজছি। পাইনি।’
‘আমি একটু অঞ্জনাদের ঘরে গিয়েছিলাম। অঞ্জনা নাকি কালকে আমাদের সাথে যাবে মাটি আনতে।’
‘মা তাড়াতাড়ি গামছাটা নাও, গা মুছে ফেলো।’
‘ দে, তাড়াতাড়ি দে। আমার না আবার জ্বর চলে আসবে।’
খানিক পর ক্লান্ত হয়ে শ্যামের বাজার থেকে পরনে পুরোনো রঙচটা লুঙ্গি ও একটা পুরোনো শার্ট পরে ভেজা শরীর নিয়ে ঘরে ফিরে রাজেশ।
ঘরের সামনে এসেই ডাকতে থাকে, সবিতা, ও সবিতা। সবিতা পড়ার টেবিল থেকে উঠে ঘরের দরজা খুলে দিতেই রাজেশের তাড়াহুড়ো বেড়ে যায়, ওই কগো শুনছো? আমাকে তাড়াতাড়ি গামছা দাও শরীরে ও বুকে জল জমে ঠান্ডা লেগে যাবে তো!
মীনাক্ষী তাড়াতাাড়ি ঘরে থাকা একমাত্র গামছাটি রাজেশের হাতে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। কিন্তু মীনাক্ষীর মনের যে গভীরতা, যে মাপকাঠি সব যেন হারাতে বসা মৃৎশিল্পের মতন হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। রাজেশ তা টের পেলেও কিচ্ছু করার নেই যে তার। শূন্য হয়ে ওঠা স্থান পূরণের চেষ্টা বা অধিকারের রেখাপাত কেমন জানি পানসে হয়ে গেছে। মেয়েটি কলেজে পড়ে। বিয়ে দিতে পারছে না। নিজের অর্থনৈতিক অক্ষমতার জন্য নিজের ভিতর নিজে ভেবেই চোখ দুটো সজল হয়ে ওঠে রাজেশের।

বিজ্ঞাপন

বিকেলে বৃষ্টি হওয়ার আগে বাতাসে ধুলো উড়ে যেমন করে বিবর্ণ করে দিয়েছে পালপাড়ার গাছগুলো তেমন করে বিবর্ণ হয়ে আছে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক। বিয়ে হওয়ার প্রথম এক দুবছরের মতন রঙিন আবেদন নেই, নেই রঙিন চশমার মতন গাঢ় কোনো জানালা। ঘরে রাজেশের পৃথিবী বলতে তার শয্যাশয়ী মা আছেন, ওটাই তার পৃথিবী। মায়ের নাম ঋতু পাল। পাল পাড়ায় নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক নারী উনি। অষ্টানব্বই বছর চলছে। আর দু’বছর হলেই একশো বছর পূর্ণ হবে।
ঘরে ঢুকার পরেই রাজেশ মা ডাকতে শুরু করলো, ‘বাবা, বাবারে কই তুই? এতো দেরি করলি যে আজ আসতে?’
রাজেশ, মায়ের বিছানার পাশে গিয়ে বসে বলে, মা আজ বৃষ্টি হচ্ছিলো তো তাই দেরি হয়েছে।
‘বেচা বিক্রি কেমন হলো রে বাবা?’
‘না, মা বৃষ্টির কারণে তেমন বিক্রি হয় নাই।’
‘দেখ, এর পাশাপাশি অন্য কিছু করতে পারিস কিনা!’
‘কি করবো মা?’
‘ভেবে দেখ। না হলে তো সংসার এভাবে চলবে না। সবিতার বিয়ে দিতে হবে বাবা।’
‘ঠিক আছে মা। দেখি সাথে আর কি করা যায়।’
‘মা, আপনার শরীর কেমন? আগের চেয়ে ভালো লাগছে?’
‘আগের চেয়ে ভালো। মনে হচ্ছে কালকে সকালে উঠে হাঁটতে পারবো। আমাকে সকালে ধরে একটু হাঁটাবি বাবা?’
‘ঠিক আছে মা। কাল সকালে বৃষ্টি না হলেই হলো মা। আমি আপনার সাথে সাথে থাকবো।’
রাত অন্ধকারের বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে যায়। রাজেশ ও মীনাক্ষী অনেকদিন পর একই বিছানায় ঘুমাতে যায়। এতোদিন মেয়ের কাছেই ঘুমাতো মীনাক্ষী। কি যেন কি কারণে মীনাক্ষীর হঠাৎ করে মনে একদিকে বিশাল মায়া আরেকদিকে খানিক অনুশোচনাও তৈরি হলো। সারাদিনের ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতার অনুভূতি শেষে চোখে ঘুম চলে আসে রাজেশের। হঠাৎ ঘুমও ভেঙে যায় রাজেশের। মীনাক্ষী তখনও জেগে আছে আর মনে মনে সন্ধ্যাবেলায় ঘটে যাওয়া স্মৃতিকে চোখের কোণে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে।
‘কি হলো, ঘুম ভেঙে গেছো কেন?’
‘না, কিছু না। তুমিও তো ঘুমাওনি দেখি!
চিন্তার আকাশটা ধীরে ধীরে শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে যেতে লাগলো রাজেশের। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে নিজেকে ও পরিস্থিতিকে বারবার আবিষ্কার করতে থাকে নিজেকে। সে কেবলই দেখতে পায় বহু সম্পর্কে, বহু জটিলতায় জড়িত একেকটি সত্তা, একেকটি জীবন, তিনটে জীবন। যেন প্রত্যেকটি জীবন চিৎ করে বলে ওঠে, ‘বাহির থেকে এভাবে দেখো না, দেখো ভিতর কি আছে?’

একবার ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর চোখে ঘুম আসছে না কোনমতেই। কোথায় যেন রাজেশ এমনভাবে আঘাত পেয়েছে তা সে নিজেও বুঝতে পারে না। হঠাৎ করেই মা, মেয়ে, বৌ থাকার পরেও সমস্ত জীবন যেন তার শূন্য হয়ে গেছে। সে কেবলই ভাবে বিয়ে করাই উচিত হয় নি, নিতান্ত এই সাধারণ জীবনকে এতো দায়িত্বের ঘেরাটোপে বেঁধে চিরদিনের বোঝারূপে বহন করায় কোনো উন্মাদনা নেই। জীবনকে উদযাপন না করার কোনো মানে নেই। কিন্তু এই জগৎ সংসারে উদযাপন করার মতন শান্তি থাকলেও সুখ নেই। পড়ন্ত বিকেলে মাঠে গামছা বিছিয়ে হাতের উপর মাথাকে রেখে শুয়ে থাকার মতন শান্তি পৃথিবীর কোনো কিচ্ছুতে খুঁজে পায় না রাজেশ। সুখটা যেন অধরা, সকলের সকল চাওয়া পাওয়া মিটিয়ে নিজে ভালো থাকার মধ্যে যে আনন্দ, যে সুখ সেই সুখকে বাগে আনতে পারছে না রাজেশ।
আঁধার আরও গাঢ় হতে থাকে। মেঘাকাশে লুকিয়ে থাকো চাঁদটা তখন মাঝআকাশ থেকে পশ্চিমে হেলে পড়েছে সম্ভবত। মেঘের কান্নার শব্দ টিনের চালে বৃষ্টি হয়ে টুপটুপ শব্দে বেয়ে বেয়ে মাটিতে গিয়ে এক মোহনীয় আবহ তৈরি করছে এই চৈতালি রাতে।
সাতপুরুষ ধরে, বিগত হাজার হাজার বছর ধরে মেয়েমানুষ কিবা নারীদের এমন কোনো অপমান বা লাঞ্চনা নেই যা করেনি পুরুষসমাজব্যবস্থা। সেই সব অভিশাপ কোথায় যাবে?
রাজেশ তাই কথায় কথায় সকল দোষ, সকল পাপের উৎপত্তি হিসেবে কেবল মীনাক্ষীকে চোখে দেখে, নিজেকে নয়, ভাগ্যকেও নয়।
‘চুপ করো, কোন কুলক্ষণে যে আমি তোমারে বিয়ে করছি। সংসারে কোনো আয় উন্নতি নেই।’
‘তাহলে বিয়ে কেন করছো আমাকে?’
‘মানুষজন বলেছে বিয়ে করলে নাকি ভাগ্য খুলে। এতো বছরেও ভাগ্য একটুও বদলালো নাহ্!’
‘তোমার ভাগ্য কেন বদলালো না সেটাও কি আমার দোষ?’
‘তুমি অলক্ষী; তাই বদলালো না।’
‘একদম বাজে কথা বলবে না।’
মীনাক্ষী চুপ হয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে চোখের অশ্রু ফেলতে থাকে। রাত তখন বারোটা। রাজেশও ডানকাত হয়ে ফিরে একটু ঘুমোতে চেষ্টা করলো। সেই সব চেষ্টা তাকে ঘুমোতে দিচ্ছে না। ঘুম দূরে সরে যাচ্ছে, দূরের দেশে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। খানিকপর চিন্তা করে এবার বাঁ কাত হয়ে ঘুমোলে হয়তো ঘুম আসবে, ভালো লাগবে, খানিক শান্তি লাগবে। এরপর একটা বাজলো, দুটো বাজলো, পাঁচটে বাজলো ভোর হলো, ঘুম এলো না। এক একটা রাত মাঝেমাঝে এমনও হয়। পাখিরা কিচিরমিচির আওয়াজ তুলে ডাকছে। বাড়ির পাশের ঘরের ওদের মোরগ ডেকে উঠলো, হাঁসগুলো ডেকে উঠলো। আসলে গতকাল বাজারের দিন মাত্র দুশো টাকার মতন বিক্রি হয়েছে। এতেই তার মন খারাপ হয়ে আছে। আসলে পকেটে টাকা না থাকলে, ব্যবসা না হলে অসহ্য লাগে। অন্যদিন হলে ঘুম থেকে উঠে যেতো রাজেশ। আজ উঠছে না। মীনাক্ষী কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে রাজেশ তার বিন্দুমাত্র টের পায় নি।

গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সিএনজির আওয়াজ। রিক্সা ও সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ। ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার দৃশ্য একটার পর একটা বয়ে চলেছে তারই ঘরের পাশ ঘেঁষে। সে হালকা একটা কাঁথা মুখের ওপর পর্যন্ত তুলে শোবার ভান করে আছে। খানিক পর রাজেশ কি যেন ভেবে, সব ভুলে তার বিয়ের সময় পাওয়া একমাত্র সাইকেলটি ঘর থেকে বের করে প্যাডেলে চাপ দিলো।
সাইকেলের সিটটা খানিক বেঁকে গেছে, বেলটা ভালো মতন ক্রিং ক্রিং শব্দ তুলে না, চেইন কভার নেই ফলে যে কোনো সময় লুঙ্গিতে বা প্যান্টে লাগলে লুঙ্গি বা প্যান্ট ছিঁড়ে যেতে পারে। স্ট্যান্ডটাও হালকা নষ্ট। সাইকেলটা ঠিক মতন দাঁড়াতে পারেন না স্ট্যান্ডে ওপর। যেমন করে রাজেশ দাঁড়াতে পারছে না শত চেষ্টা করেও। পালপাড়া পার হয়ে পাশের গ্রামে যেতেই দেখলো গ্রামের ডাক্তার দিলিপ বাবু তার ফনেক্স ব্র্যান্ডের সাইকেল বদলিয়ে একটা হোন্ডা আশি সিসির মোটরসাইকেল নিয়ে রাজেশের কানের পাশ দিয়ে চলে গেল দ্রুত। রাজেশ পিছন ফিরে বাইকটির দিকে উত্তম বাসনা নিয়ে তাকিয়ে আছে। যেন রাজেশের হৃদয় খুড়ে বেদনা ও যন্ত্রণা হাহাকার করে জেগে উঠলো। এ বেদনা ও যন্ত্রণা থামবার নয়।
কি অদ্ভূত চিন্তা মাথায় আসে তার! সে নাকি এখন বাঁশ কিনে বাঁশের তৈরি কুলো, ডালা, ঝুড়ি, চালুন, মাছ ধরার চাঁই, খলই বানাবে রাজেশ। তাতে ইনকামও বাড়বে। সংসারে খানিক স্বচ্ছলতাও আসবে। যেই চিন্তা সেই কাজ। পাশের গ্রামের করিমদের কাছ থেকে দশটি বাঁশ রাজেশ বাকিতে নেয়। সে যখন বাঁশ বাগানে পৌঁছায় তখন দেখে গতবাতের বৃষ্টিতে গাছের পাতাগুলো ভিজে খানিক কুচকে গেছে, কিছু পাতা ঝরে পড়েছে, কিছু পাতা একবার মসৃণ মুখ দেখাচ্ছে আরেকবার অমসৃণ পিঠ দেখাচ্ছে। রাজের বুকের ভিতর দিয়ে বাঁশের পাতার যে অমৃসণ অংশটা তা যেন দোল খেয়ে আরও অমসৃণ করে দিয়ে যাচ্ছে। রাজেশ যেন ব্যথার বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে। মায়ের কথা শুনে মাটির জিনিসপত্রের সাথে আরও নতুন ব্যবসা জুড়ে দিতে চায় রাজেশ। রাজেশের ও মীনাক্ষীর উপর আর কদিন পরেই কাজের চাপ বাড়বে। সামনে বৈশাখ, পহেলা বৈশাখ। তখন তো টেপাপুতুল বানাতে হবে। বউ-জামাই, নথপরা ছোট্ট মেয়ে, মাটির কলস, হাঁড়ি, সরা, বাসন-কোসন, পেয়ালা, সুরাই মটকা, জালা, পিঠে তৈরির ছাঁচ এগুলো না বানিয়ে নিস্তার পাবে না রাজেশ। করিম চাচা এলেন, বললেন;
‘তোমার যে যে বাঁশ গাছ ভালো লাগে ওটাই তুমি কেটে নিও আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বিক্রি শেষে আমার টাকা যেন সময়মত পাই।’
‘ঠিক আছে চাচা, আমি টাকা আপনাকে সময় মতন দিয়ে দেবো।’
‘মনে থাকে যেন, নাহলে আমি আবার সামান্য কটাকার জন্য তোমার কাছে যেতে পারবোও না, চাইতেও পারবো না।’
‘চাচা আপনি তো জানেন আমি গরিব হতে পারে, কিন্তু কথায় ও কাজে এক।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমার বাপও কথায় কাজে এক ছিলেন। তাই আর ভাবলাম না। তুমি বাঁশ কেটে নিয়ে যাও। আমি বাড়ির দিকে গেলাম।’
‘চাচা আপনি চলে যান, আমি ঠিকই বাঁশগুলো আজই কেটে নিয়ে যাবো।’
বাঁশ বাগানে হাতে দা নিয়ে বাঁশ গাছের গোড়ায় কোপ মারছে আর কি সব ভাবছে রাজেশ। কখন যে, পায়েতে কোপ পড়ে এমন করে ভাবতে ভাবতে সেদিকে তার যেন কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। প্রথম যে বাঁশ গাছটি সে নির্বাচন করেছে কাটার জন্য সেটি বাগানের সবচেয়ে লম্বা এবং সোজা। আসলে সোজা ও লম্বা গাছটি কাটতে সুবিধা হবে, দ্বিতীয়ত এতে তার লাভ হবে বেশি। চতুর মানুষেরা যেমন সোজা মানুষকে তার ব্যবহারের মাধ্যম হিসেবে নিয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে তেমনই মনে হচ্ছে। খুব ধারালো দা’য়ের কোপে আস্তে আস্তে বাঁশ গাছটির গোড়াটি আলগা হচ্ছে। প্রথম কোপ দিতেই একটি বাঁশ ঘুঘু পাখি মাথা ওঠা নামা করে হু… হু… হু শব্দ করে দ্রুত উড়ে ঘন বাঁশ ঝাড়ে ঢুকে যায়। কোপ দিতে দিতে দেখা গেলো বাঁশ গাছটি হেলে পড়ছে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে। হঠাৎ করে মুলি বাঁশটি গোড়া থেকে ধপাস করে সরে গিয়ে দক্ষিণের শুকনো গড়ের দিকে গিয়ে পড়েছে। রাজেশ তখন লাফ দিয়ে পূর্ব দিকে সরে গেল।
এভাবে দুটো বাঁশ কাটার পর বাঁশ দু’টোকে কঞ্চি সরিয়ে নিয়ে আরও চার ফালি করে মোট আট খন্ড করার পর পুরাতন সাইকেলে বেঁধে ঠেলে ঠেলে পালপাড়ার দিকে রওনা হয় রাজেশ। এভাবে পাঁচবারে দশটা বাঁশ নিতে তার বিকেল হয়ে যায়। তারপর খানিক বিশ্রাম নিতে যায় রাজেশ। দিনের সূর্য ডুবতে থাকে। সম্মুখে যে তারই সূর্য ডুবার দিন ঘনিয়ে আসছে এটা কোনো মানুষ যেমন গুরুতর অসুস্থ না হলে আন্দাজ করতে পারে না তেমনি রাজেশও অনুমান করতে পারি নি।

বিজ্ঞাপন

বাঁশগুলো দেখে মীনাক্ষী বিরক্ত হয় মনে মনে, কিন্তু প্রকাশ করে না। মনে ক্ষোভ নিয়ে সন্ধ্যার দিকে চা বানাতে বানাতে বলেই ফেলে,
‘মাটির জিনিসপত্রই বিক্রি হয় না। তুমি আবার বাঁশ নিয়ে এসেছো!’
‘মা, বলেছিলো, পাশাপাশি কিছু করতে। কি করবো বলো!’
‘কি করবে বাঁশ দাও আমাকে। কি আর করার!’
‘সংসার চলবে কিভাবে তাহলে?’
‘আমি কি জানি?’
‘তুমি এই সংসারের কেউ না? কি বলছো এসব!’
‘কখনোও ভেবেছো, আমি এই সংসারের কেউ?’
‘চা দাও, চা খাই।’
চা দেওয়ার পর চায়ের কাপে হালকা চুমুক দেওয়ার পর চা ভালো হয় নি বলে চায়ের কাপ ছুঁড়ে মারে রাজেশ। চায়ের কাপটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। যেমন করে টুকরো টুকরো হয়ে আছে দুজনার মন ও মনন। আদতে রাজেশ তার ব্যর্থতা ঢাকতে মীনাক্ষীকে সব সময় এটা না ওটা, ওটা না এটা বলে বলে ভুল ধরার চেষ্টা করে। মীনাক্ষী সবকিছুই বুঝে, কিন্তু মা-বাবাহারা মীনাক্ষীর আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই সে কোথাও চলেও যেতে পারে না। স্বামী ও সন্তান ছেড়ে মরতেও পারে না।
‘আমার তো কেউ নাই, আমি কোথাও যেতেও পারি না। তাই তুমি এমন করো আমার সাথে।’
‘যাওয়ার থাকলে চলে যা, আপদ।’
‘একদিন দেখো সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যাবো।’
‘তো যাস না কেন, ঝাঁড়–মুখে করে চলে যা। আমি বাঁচি।’
‘যামু দেখিস, তখন বুঝবি আমি কি ছিলাম। তুই কি হারালি।’
এই কথার উত্তর আর দেয় না রাজেশ। এতো রাগের মধ্যেও তার কেমন জানি মায়া হয়, মীনাক্ষীর প্রতি হঠাৎ পক্ষপাত তৈরি হয়। রাজেশের হৃদয়ে তালপাতার মতন বাতাস বয়ে যাচ্ছে এখন। মীনাক্ষার বুকে বইছে কেবলি বিছুটিপাতার যন্ত্রণা। এই সংসারের জন্য এতো কিছু করেও মীনাক্ষীর যেন কোনো স্বীকৃতি নেই। নেই স্বস্তি, নেই নিস্তারও।
সে চোখের জল ফেলে। যে জলের মূল্য কেউ টোকাতে চায় না, পারেও না। এক পরেশ ছাড়া।

কিছু কষ্ট কাউকে বলতে পারে না মানুষ। কেবলই বয়ে বেড়াতে হয় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। কিছু কিছু অপমান ভুলেও থাকা যায় না, যায়ওনি কখনোও। তুষের আগুনের মতন কেবলই পোড়ায় আর পোড়ায়।
রাজেশ আর কথা বাড়াতে চায় না নিশ্চুপ হয়ে যায়। সন্ধ্যা নামার মতন করে নেমে পড়ে সন্ধ্যা। বাড়ির পুকুরের জলে বাঁশের খন্ডগুলি ভিজতে থাকে। সন্ধ্যায় এই ভীষণ মহাভারত শেষে পালপাড়ার সামনে সুমনের দোকানে যায় রাজেশ চা খেতে, বিস্কুট খেতে, বিড়ি খেতে এবং আড্ডা দিতে। রাজেশ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় কেবল তার পিছনে তাকিয়ে ছিলো রাজেশের একমাত্র মেয়ে সবিতা। সবিতার চাহনিতে ছিলো ভয়, বিরক্তি ও মায়া। মীনাক্ষীর চাহনিতে কেবলি ক্রোধ ও ঘৃণা।
আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যাচ্ছে রাজেশ। যেন জীবনের প্রতি কোনো মায়া নেই। নেই কোনো ভরসার আকাশ, আছে কেবলই আত্মগ্লানি। পঞ্চাশোর্ধ এই বয়সে এসব ভালো লাগে না। কেবল বাড়ির পাশের আকন্দ গাছের পাতা ও কষ খেয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করে রাজেশের।
মায়ের মুখ ও মেয়ের মুখ তাকে বাঁধা দেয়। সাড়া দেয় না। মৃত্যুমুখ থেকে ফিরিয়ে আনে বারবার। অন্ধকার থেকে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে থাকে রাজেশের হাত পা চোখ ও মুখমন্ডল। যখন খানিক আলোকের দেখা পায় রাস্তার ওপাশে বিলের পাশে বয়ে যাওয়া রাস্তার উপর সুমনের চা দোকান ভেসে ওঠে। সুমনের দোকানে গ্রামের মানুষের ভিড়। রাজেশের ছোটবেলার বন্ধু আব্বাস আলীও এসেছে চা খেতে।
রাজেশকে দেখে, আব্বাস জিজ্ঞেস করে,
‘কিরে রাজেশ দিনকাল কেমন কাটছে তোর?’
‘আর বলিস না বন্ধু, চলে যাচ্ছে কোনরকম।’
‘তুই সারাজীবন কোনোরকম, কোনোরকম বলেই আসছিস। একদিনও শুনি নাই ভালো আছিস বলতে।’
‘না, ভালোই আছি।’
‘থাক বুঝছি, আর বলতে হবে না। ল, চা খাই।’
‘এই সুমন, দুইটা চা দে আমাদের।’ বলে ওঠে রাজেশ।
‘বিস্কুট দিবো সাথে?’
‘দে আনারকুলি বা এলাচি বিস্কুট থাকলে দে।’
হঠাৎ করে পাশ থেকে উঁকি দিয়ে এলাকার সবচে সৃজনশীল লোক ইলিয়াস বলে, ‘ও রাজেশ দাদা এখন তো সকালে তো দেখি না, সন্ধ্যায়ও আপনার দেখা পাই না।’
‘ তো তোমাকেও দেখি না, আজকাল গান বাজনা করতেও দেখি না।’
‘এখন তো আগের মতন সময় নেই।’
‘এখন তো এখনকার মতন গান বাজনা নেই, উঠান নাটক নেই, যাত্রাপালা নেই।’
‘তাই বলে তুমিও কি সব ছেড়ে দিয়েছো?’
‘না ছেড়ে আজকাল উপায় আছে! চারিদিকের পরিবেশটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে!’
‘তোমার তো মনে থাকার কথা আমরা কত গান করেছি একসাথে ইলিয়াস। থাক, সেসব বাদ দাও। মাঠে গিয়ে ফসল দেখো, বাবা মাকে দেখো।’
‘ঠিক বললেন না দাদা। আপনার এ কথা মানতে পারলাম না।’
‘তাহলে তুমিই বলো, কি করতে হবে?’
‘আমরা শিল্পীরা যদি এগিয়ে না আসি কেমনে হবে? সব তো রসাতলে যাবে।’
‘রসাতলে গেলে কি আমরা একা কি করবো?’
‘আমাদেরকেই একা দাঁড়াতে হবে।’
‘কতটা পারবো?’
‘যতটা পারা যায়।’
কথা বলতে বলতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কখন যে চা ফুরিয়ে গেছে দুজনে বলতেই পারেনি। রাত বাড়তে বাড়তে গভীর হতে থাকে সুমনের দোকানে টেলিভিশনে চলছে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের মধ্যেকার কোপা আমেরিকার খেলার হাইলাইটস ম্যাচ। বিগত বর্ষাকালের কথা মনে করে রাজেশ পিছনে চলে যায়।

তখন ছিলো বর্ষাকাল। চতুর্দিকে বৃষ্টি হচ্ছিল তুমুল বৃষ্টি। উদাস করে দেওয়ার মতন অবস্থা। মনের গহীনে লুকানো দুঃখবোধকে জাগিয়ে তুলে আবার ধুয়ে মুছে সাফও করে দেয় যে বর্ষা। যে বর্ষা কদমফুলের সৌন্দর্য নিয়ে আসে সেই বর্ষা। যে বর্ষা বকুল, দোলনচাঁপা, ঘাসফুল, শাপলা, সন্ধ্যামালতি, কামিনী এবং অলকনন্দা ফুলের রাজত্ব নিয়ে আসে সেই বর্ষা। বর্ষা এলেই রাজেশের কষ্ট বাড়ে কিন্তু হৃদয়ে কেমন জানি অনুভূত হয় স্বর্গীয় সুখ। বৃষ্টি ঝরে মাঠে, ঘাটে, বন্দরে, মরুতে, বনতলে, খালে বিলে, পুকুরে, গূঢ় প্রাণে, শিরায়-শিরায়, মনের মাটিতে। বর্ষাই যেন সকল কিছু গ্রাস করে নেয়, গ্রাস করে নেয় মেঘ বালিকা, উচ্ছ্বল যৌবন, উন্মাদনা, সকল অস্তিত্ব; বর্ষাই যেন সকলের প্রাণের ফসল। যখন এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য হাহাকার করে প্রতিটি ধূলিকণা তখনই নামে বাংলার বুকে এক পশলা বৃষ্টি। বৃষ্টির জলরাশি বেয়ে নেমে আসে সোঁদা মাটির গন্ধ।

বৃষ্টি এলে পুকুরে মাছ ধরতে যাওয়া, বিলে মাছ ধরতে যাওয়ার কথা মনে পড়ে রাজেশের। যদিও সেসব গত হয়ে গেছে সময়ের সাথে সাথে। সামনেই আরেক বর্ষা আসন্ন। গত বর্ষায় বিলের জলে কত ধরনের মাছ যে ধরেছিল রাজেশ। বর্ষায় ডুবে যেতো ধান খেত আর নিচু জমিগুলি। বিলের স্বচ্ছ জলে সাঁতার কাটার আনন্দই আলাদা। জাল ফেলে পুকুরের উজান দিয়ে যে পাশটায় জল নামছে বিলের দিকে ঠিক সেই পাশটার কাছেই জাল মেরে কত যে মাছ ধরেছিলো। বর্ষার সময় বাজার থেকে মাছই কিনতে হয়নি রাজেশের। এরপর জল যখন শুকাতো তখন মাঠে, বিলে, পুকুরে, ডোবায়, থালা, বাটি, মগ দিয়ে জল সেচে শুরু হতো মাছ ধরা। রাজেশ, মীনাক্ষী ও তাদের মেয়ে সবিতাসহ পালপাড়ার অগণিত মানুষেরা রীতিমত আনন্দ উল্লাস করে পুকুর- ডোবা, খাল-বিলের কাদার ভিতর হাত ঢুকিয়ে তুলে এনেছিলো একের পর এক মাছ। তারা তখন পেত শোল, বাইম, কৈ, বোয়াল, ফলি, টাকি, পুঁটি, খলসে, মাগুর, সিং, ট্যাংরাসহ নানান প্রজাতির মাছ। রাজেশের শোল মাছ খুব প্রিয়। ওটা পেলে মীনাক্ষীকে বলে, মরিচ দিলে ভুনা করে রান্না করতে। রাজেশ প্রচন্ড রাগী হলেও বর্ষা এলে কেমন জানি শান্ত হয়ে ওঠে।

বিজ্ঞাপন

খানিক বাদে আব্বাসের ধরানো সিগারেটের ধোঁয়া যখন তখন নাকে এসে উপস্থিত হয় তখন সম্বিত ফিরে। তখন আবার খেলা নিয়ে মেতে ওঠে। মনে পড়ে সেইদিন দেখা দেয় টান টান উত্তেজনা। সকলে মিলে খেলা দেখছে। কেউ আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করছে, কেউ ব্রাজিলকে। যদিও আর্জেন্টিনার সমর্থকই বেশি। ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে আটাশ বছর পর কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতলো আর্জেন্টিনা। আদতে আর্জেন্টিনা দলটা ভালো হলেও শিরোপা জিততে পারে না তারা। অনেক ব্রাজিল সমর্থকও হেরে গিয়ে মনে মনে স্বস্তি পেলো এই ভেবে যে, মেসি নামক বিশ্বসেরা ফুটবল জাদুকরের হাতে তো একটা শিরোপা উঠলো ডি মারিয়ার গোলে।
আহা, কি আনন্দ চারিদিকে। বড় বড় পতাকা নিয়ে মিছিল বের হলো। তারপর নানান পটকা বাজি ফুটলো। যেন আর্জেন্টিনাই বাংলাদেশ, বাংলাদেশই আর্জেন্টিনা। কেউ কেউ আবার আনন্দে মিষ্টি ও দোকানে চা বিস্কুট বিনামূল্যে খাইয়েছিলো। রাত গভীর হয়ে আসে সুমনও দোকানের একটি সাটার টেনে দেয়। ওইদিনের মতন রাজেশ আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে বিদায় নেয় বন্ধু আব্বাস ও দোকানদার সুমনের কাছ থেকে।

পরের দিন সকাল হয়ে সূর্যটা পুবের আকাশকে লাল করে দিচ্ছে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা মাথার ওপর বয়ে বেড়াচ্ছে যেন তার নিস্তার নেই। গুড়িগুড়ি বৃষ্টির ফোঁটা কচুপাতায় আটকে আছে রূপালি ইলিশের মতন।
একটা আইসক্রিম ওয়ালা সাইকেলের পিছনে আইসক্রিম নিয়ে এক হাত দিয়ে বাক্সোটার মুখকে আওয়াজ করতে করতে পালপাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে চলা গ্রামীণ সড়ক ধরে সাইকেলকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। বৃষ্টি তখনও তার প্রবল উন্মাদনা শুরু করেনি। গ্রামের বাড়িগুলো পার হতে হতে ‘অ্যাই আইসকিরিম, অ্যাই আইসকিরিম…, দুধ মালাই, নারিকেল মালাই আইসক্রিম’ বলে চলে যাচ্ছে। আর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে পালা পালার ছোট ছোট শিশু ও অল্প বয়স্ক সন্তানেরা দৌঁড়ে চলে যায় আইসক্রিম নিয়ে ফিরে আসে তারা। গ্রীষ্মেও কাঠফাটা রোদে আইসক্রিমওয়ালার সমস্ত শরীর দিন শেষে ব্যথা করে ওঠে। এখন তো সবে সক্কাল। আজ গুড়িগুড়ি বৃষ্টি, তাই হয়তো খানিকস নিস্তার পাবে কামাল উদ্দিন। রাজেশ ছোটবেলায় কামাল উদ্দিনের মতন আইসক্রিমওয়ালা হতে চেয়েছিল। সে ভাবে, সে হয়তো ভুলবসত হয়ে গেলে মৃৎশিল্পী।

গত বছর গ্রীষ্মকালে সকলের চোখের আড়ালে পরেশের ছোট ভাই নরেশকে একটা বিষাক্ত সাপ পালপাড়ার উত্তর দিকটার জাম গাছের নিচে একা একা ছোবল মেরে চলে গিয়েছিলো। মা মনসার আরাধনাও তাকে বাঁচাতে পারলো না। তা মনে ওঠায় বুকের মধ্যে কেমন জানি একবার ঢিপঢিপ করছে তো আরেকবার চিনচিন করে যাচ্ছে। ভাইয়ের কথা যে এতোদিন ধরে এতোটা আলোড়ন করে চমকাইতে পারেনি তা ভেবেই পরেশ অবাক হয়ে যাচ্ছে। স্রোতের টানের মতন পরেশের মন এখনও অস্থির হয়ে আছে। পরেশের ঘর থেকে বিলের এক প্রান্ত দেখা যায় যেখানে গিয়ে গ্রামের বাজার দেখা যায়। পালপাড়ার সবচে ধনী ব্যক্তি তারা। মাটির পুতুল, জিনিসপত্র এগুলোতে তাদের নজর নেই। তারা বুড়িগঙ্গার পাশ ঘেঁষে গড়া ওঠা পুরান ঢাকার নয়াবাজারে কাগজের ব্যবসা করে। বড় ব্যবসায়ী। একনামে সবাই চেনে তাদের। পরেশের জন্য এদিকে পাত্রী খুঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে। পরেশের বাবা যোগেন পাল পুরাতন ঢাকার পাত্রী খুঁজছে। গ্রামে বিয়ে করাবে না ছেলেকে। পরেশকে তার বাবার দোকানে বসিয়ে দিবে বিয়ের পরপররই। এটা শুনে পরেশের একটু খারাপই লাগলো মীনাক্ষীর জন্য।
মনে মনে আওড়ে উঠে বলছে, ‘ওকে দেখবে কে, কে খেয়াল রাখবে? ও কি মাটির পুতুলের মতন আমার দৃষ্টির অগোচরে চলে যাবে?’
‘তখন তো আমার সংসার হবে, ঘর হবে, ওকে কিভাবে পাবো ওমন করে, যেমন করে লোকচক্ষুর আড়ালে ওকে পেয়ে এসেছি?’
মনে মনে একটা দুরন্ত ক্রোধ, মনে মনে একটা হারানোর ভয় তাকে জেঁকে বসেছে যেন সে কোনো নিস্তার পাচ্ছে না।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখে চোখের সামনে মীনাক্ষী। একটি পুরাতন শাড়ি জড়ানো শরীরে চোখে হালকা ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে এগিয়ে হাসছে। ও কাকি ও কাকি মা বলে পরেশের মাকে ডাকছে আর পরেশদের বিল্ডিংয়ের সামনের দরজা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকছে মীনাক্ষী। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে আগেই ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে পরেশ। ওকে দেখার জন্য পরেশ তার মায়ের কাছে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যায়। দোতলা থেকে নামতে নামতে মীনাক্ষীকে পরেশ বলে,
‘ও বৌদি, বৌদি কেমন আছো? কেন আসছো মায়ের কাছে?’
মীনাক্ষী বলে, ‘পরেশ আমি তোমার মায়ের কাছে কিছু টাকা ধার নিতে এসেছি।’
‘পেয়েছো, মা দিয়েছে?’
এই বলে নিচ তলায় নামার পরপরই যাওয়ার সময় হাতটে টেনে বুকের কাছে নিয়ে আস্তে আস্তে বলে,
‘জানো, আমার বিয়ের জন্য পাত্রী ঠিক করেছে বাবা।’
‘শুনেছি তো।’ নির্বিকার নির্মোহভাবে উত্তর দেয় মীনাক্ষী।
‘আমি পারবো না থাকতে।’
‘পারবো না বললে হবে?’
‘গ্রামেই তো থাকবো না আমি।’
‘কি বলো পরেশ?’
‘মাঝেমাঝে আসবো, তখন যদি সকল চোখকে আড়ালে রেখে তোমার দেখা পাই।’
‘পাবে, পাবে। চিন্তা করার কিচ্ছু নেই।’
‘তোমার তো বয়েস হয়েছে বিয়ে করে নাও। আর দেরি করো না।’
‘কথা দিলেম আমাকে যখনই ডাকবে আমি হাজির হওয়ার চেষ্টা করবো পরেশ।’
কথার পিঠে কথা বলতে বলতে পা বাড়লো মীনাক্ষী। গত রাতের তুমুল বৃষ্টির পরে পালপাড়ার প্রত্যেক ঘরের সামনের উঠোন পিচ্ছিল হয়ে আছে পুকুরে জমে থাকা শেওলার মতন। মীনাক্ষীর হাতে বানানো মাটির হাঁড়ি, পাতিল, কলসি, পুতুলের মতন জীবন এগোয় না তাদের। যেটা ইচ্ছে করলে যেমন করে মনের মতন বানাতে পারে, আঁকতে পারে নিজের মনের কল্পনাকে সঙ্গী করে। জীবন এমন নয়, এখানে ঘাত আছে, অভিঘাত আছে, পড়ে যাওয়ার বেদনা আছে, উঠে দাঁড়াবার সাহস আছে।
কিন্তু উঠে দাঁড়াবার মতন দাঁড়াতে পারে না একচালা টিনের ঘরে থাকা মীনাক্ষীরা।
বসন্তের মেঘাকাশে সূর্য উঁকি দিয়ে যাচ্ছে যেমন করে হাতের মুঠের মধ্যে টাকার নোট উঁকি দিচ্ছে অমন করে। যেন অর্থই জীবন, জীবনই অর্থ।
ঘরের বারান্দায় থাকা মৃৎশিল্প যেন কান্না করছে রোদকে পাওয়ার অপেক্ষায়। তেমনি এই ঝিরিঝিরি সকাল পরেশকে দূরে সরে যেতে হচ্ছে ভেবে মনে হলো এই পালপাড়ায় কখনো আসেনি ফাগুন। তখন গোধুলি সময়। স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ এবং মেয়েকে বিয়ে দিতে না পারার যন্ত্রণার দহনে, মৃৎ শিল্পের নিদারুণ সংকট তাকে কুকড়ে কুকড়ে খাচ্ছে।

বিকেলে বাজার থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসে খানিক অসুস্থ বোধ করায়। যেন বুকের মধ্যে কিছু একটা ধরেছে। দুই, আড়াই ঘন্টার মতন ছিল বাজারে। সকালে কত কষ্ট করে এঁটেল মাটি জোগাড় করলো, জ্বালানি কাঠ দিয়ে পোড়ালো মাটির তৈরি জিনিসপত্র। সাথে লাগলো শুকনো ঘাস, খড় ও বালি। দুপুরে যখন সূর্যটা হেলে পড়ল পশ্চিম আকাশে তখনই তড়িঘড়ি করে বাজারে রওনা দিলো রাজেশ। আসার আগে মাটির কলসি, ফুলের টব, সরা, বাসন, সাজের হাঁড়ি, মাটির ব্যাংক বিক্রি করে এসেছে রাজেশ। ঘরে এসে দেখে মীনাক্ষী নেই ঘরে।
সহজ ও সরল কিন্তু প্রচন্ড রাগী মানুষটি বাড়ির পাশের জঙ্গলে ভরা বাগানের ভিতর তেঁতুল গাছের পাশে যায়। খানিক এগোলেই রাজেশ এক নারীর অট্টহাসির আওয়াজ পায়। লুকিয়ে লুকিয়ে দূর থেকে দেখে বুঝে ফেলে মীনাক্ষীর আওয়াজ, মীনাক্ষীর শাড়ির দৃশ্য তখন জঙ্গলের ভিতর পুকুরের ওপাশে ভেসে উঠছে। শাড়ির সাথে একটি শার্ট ভেসে ওঠে পুকুরের জলে হালকা বাতাসে খানিক দোল খাচ্ছে। শার্ট পরা ছেলেটি যে পরেশ রাজেশ বুঝতে পারে। অনেকদিন ধরে রাজেশের মা রাজেশকে বলে এসেছে মীনাক্ষী ও পরেশের গভীর সম্পর্কের কথা। রাজেশ কিছুই বিশ্বাস করেনি। বলতে গেলে ওসবে কান দেয়নি।
সে আর সামনে বাড়লো না। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলো। হঠাৎ সমাপতনের মতন মনে হলো। শেষমেষ জঙ্গলের ভিতর পুকুরের এপাড়ে যেখানে দাঁড়ালো রাজেশ ঠিক সেখানে তেঁতুল গাছ। তেঁতুল গাছের পাশে আকন্দ গাছ। আকন্দ গাছের পাশে সবচেয়ে উঁচু যে আমগাছটি ওর গোড়া থেকে খানিক উপরের সবচেয়ে মজবুত একটি ডালে গামছা গলায় দিয়ে ঝুলে গেল। মানুষের জীবন কখন যে কার কাছে অর্থহীন হয়ে ধরা দেয় সে নিজেও টের পায় না!
খানিক বাদে সন্ধ্যা হয়ে এলে মীনাক্ষী ও পরেশ এপাশ দিয়ে বাড়ির দিকে যাওয়ার মূহুর্তে দেখে আম গাছে কে যেন ঝুলে আছে! প্রথম ভূত ভেবে ভয় পেয়ে গেছে মীনাক্ষী ও পরেশ। পরে যখন পরেশ বুকপকেট থেকে গ্যাসলাইট বের করে দেখে কে যেন! মুখে গ্যাসলাইট মেরে দেখে
এগিয়ে যেতে মীনাক্ষী ও পরেশ দেখে। এ মা! একি! এতো রাজেশ ঝুলে আছে গলায় গামছা পেঁচিয়ে। সম্ভবত প্রাণ নেই!
পরেশ গাছের ডালে উঠে গামছার বাঁধটা ছাড়িয়ে দেয়। মাটিতে যখন মৃতদেহটি নামে ততক্ষণে কান্নার রোল পড়ে মীনাক্ষীর বুক চিরে।
একটা দমকা হাওয়া এসে সন্ধ্যার আকাশকে কোমল ও রুক্ষ করে দিচ্ছে। পাল পাড়ায় আজ শোকের মাতম নামছে। বাতাস বইতে শুরু করে। বৃষ্টি হবে। হচ্ছে না।
মানুষ জড়ো হতে শুরু করে। মীনাক্ষীর তখন কেবলই আকন্দ পাতা খেতে ইচ্ছে করে। কেবলই রাজেশের হাত ধরে কাঁদতে থাকে। মৃত হাত দুটি তখন নিঃষ্প্রাণ কাদামাটির আঙুল।

বৈশাখী আয়োজনের আরও গল্প পড়তে: 

রবিউল কমলের ছোটদের গল্প ‘তুতু’

মাসুম মাহমুদের গল্প ‘পরস্পর বোঝাপড়া’

জুঁই মনি দাশের গল্প ‘নীহারিকার বানপ্রস্থ’

জহিরুল ইসলামের গল্প ‘একজন হোসেন আলী’

রয় অঞ্জনের গল্প ‘বিজিতের বিজয়রথ’

অর্ণব সান্যালের গল্প ‘জানালায় পরকীয়া’

রোখসানা ইয়াসমিন মণির গল্প ‘দূরত্বের জলে রঙিন ফুল’

গৌতম বিশ্বাসের গল্প ‘নতুন জীবন’

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন