রোখসানা ইয়াসমিন মণির গল্প ‘দূরত্বের জলে রঙিন ফুল’
১১ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:৪৯
মি. স্যামন ক্লাসে চোখ বুলাচ্ছেন। নিউকামার খুঁজছেন। মাত্র দুজন পেয়ে বল্লেন, তোমাদের থেকে একজন আমার কোশ্চেনের এনস করবে। আচ্ছা, জিওসায়েন্সে একটি আবিষ্কার হৈ- চৈ ফেলে দিয়েছে। যেটাকে অনেকটা কম্ব জেলিফিশের সাথে তুলনা করা হয়েছে। সে সম্পর্কে কিছু জানো? অনেকক্ষণ জবাব না পেয়ে তিনি নিউকামার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করেন, মি. রাহুল তুমি কী সে সম্পর্কে কিছু বলবে? আকস্মিক প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খায় রাহুল। বাংলাদেশ থেকে স্কলারশিপ নিয়ে এসেছে সে। টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে এটি তার প্রথম ক্লাস। জিওসায়েন্সে স্কলারশিপ পাওয়া রাহুল মি. স্যামনের প্রশ্নে নির্বিকার প্রাণীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মি. স্যামন সাড়া না পেয়ে বলেন, ওকে নো প্রোবলেম। রিলাক্স। রাহুল থ্যাংকস বলে বসে পড়ে। মি. স্যামন নিউকামার মেয়েটিকে এবার জিজ্ঞেস করেন, জুডি, ইউ এনস টু মি। ডু ইউ নো এনিথিং এবাউট দিস?
ইয়েস স্যার, আই কেন এক্সপ্লেইন ইট।
অলরাইট, ডু ইট।
স্যার, জিওসায়েন্সে যে নতুন প্রাণীর ফসিল পাওয়া গেছে সেটির সাথে কম্ব জেলিফিশের মিল আছে। কম্ব জেলিফিশের মুখ এবং পায়ুপথ অন্ত্রের মাধ্যমে যুক্ত। কম্ব জেলিফিশের সাথে ওই প্রাণীর মিলের কারণে এদেরও একই ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকার কথা। ওদের ফসিলে প্রথমে যেটা চোখে পড়ে, সেটা হচ্ছে এদের প্রস্থ ০.৭ মিলিমিটার। এরচেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে কম্ব জেলিরা কিন্তু শিকারি প্রাণী— সামুদ্রিক বিভিন্ন জীব এদের খাবার। তার মানে, নতুন এই প্রাণীরাও যদি এমন হয়ে থাকে, তাহলে তারা যে ফুড চেইনের অংশ ছিল, সেটা বেশ জটিল হওয়ার কথা। এবং আরও বেশ কিছু নতুন প্রজাতির প্রাণীর সন্ধানও ওই একই জায়গা থেকে পাওয়া সম্ভব, যা জিওসায়েন্সে নতুন এক সম্ভাবনা তৈরী করেছে।
আই মিন, তুমি কি বলতে চাচ্ছ আবিষ্কৃত ওই ফসিল কম্ব জেলিফিস গোত্রের?
এটা অনুমান স্যার। কারণ ওই জেলিফিস বিলুপ্ত। অথচ কম্ব জেলিফিস একই গোত্রের হয়েও আজও বহাল তবিয়তে টিকে আছে।
জেলিফিস আর কম্ব জেলিফিস কি এক?
না স্যার, সাধারণ জেলিফস নিডারিয়া গোত্রের । আর কম্বো জেলিফিশ টিনোফ্যারা গোত্রের প্রাণী। ওদের গঠন মাইক্রোস্কোপের নিচে রাখলে এদের কর্ষিকা, শরীরের টিস্যু, স্নায়ুকোষ, প্রজননতন্ত্র, মিউকাস ঝিল্লি এবং চুলের মতো গঠনের সিলিয়া চোখে পড়ে, যা কিনা কম্ব জেলিফিশেরা সাঁতার কাটার কাজে ব্যবহার করে।
তোমার মনে হয় কি ওই নতুন প্রাণী আর কম্বো জেলিফিশ বিবর্তনের অংশ?
স্যার, ওরা নতুন নয়। আমরাই ওদের ফসিল এতবছর পর আবিস্কার করেছি। তাই নতুন মনে হচ্ছে। অথচ ওরা প্রকৃতিতেই ছিলো। এতদিন ধারনা করা হয়েছে ডিকিনসনিয়া ছিলো পৃথিবীর আদিম প্রাণী। কিন্তু আবিস্কৃত এই ফসিল বলেছে ডিকিনসনিয়া থেকেও চারকোটি বছরের পুরনো এই ফসিল।
বিবর্তনবাদে আর কী কী লুকিয়ে আছে কে জানে? তবে এই আবিষ্কারে তোমার কী মনে হয়?
স্যার ব্যাপারটা মজার, ডিকিনসোনিয়া বিলুপ্ত। তবে ৬০ কোটি বছর আগের এই জেলিফিশদের সাথে যে কম্ব জেলিফিসের মিল পাওয়া গেছে এরা এখনো টিকে আছে। জিওসায়েন্সে এটাই আশ্চর্যের খবর। ওই জেলিফিশ ধ্বংস হয়েছে ষাট কোটি বছর হলো। অথচ কম্ব জেলিফিশ কী করে টিকে আছে? ওই জেলিফিশগুলোর সাথে মুলত কী হয়েছিলো? এটাই এখন জিওসায়েন্স ভাবছে।
এই প্রাণীর ফসিল আর কম্ব জেলিফস নিয়ে তোমার আর কী জানা আছে?
স্যার, এই নতুন প্রাণীর সঙ্গে কম্ব জেলিফিশের যেখানে সবচেয়ে বেশি মিল তার নাম প্লুরোব্রেকিয়া (Pleurobrachia)। এদের সি গুজবেরিও বলা হয়। কম্ব জেলিফিশ কিন্তু সাধারণ জেলিফিশ থেকে আলাদা পর্বের প্রাণী। জেলিফিশেরা নিডারিয়া পর্বের অন্তর্ভুক্ত, আর কম্ব জেলিরা টিনোফ্যারা। টিনোফ্যারা পর্বের প্রাণীরা সে জন্য জেলিফিশ থেকেও অনেক পুরোনো, আর এদের শারীরিক গঠন এবং জীবনচক্রও অপেক্ষাকৃত সরল। সেই হিসেবে চিন্তা করলে নতুন আবিষ্কৃত এই প্রাণীটির শারীরিক গঠনও বেশ সরলই হওয়ার কথা।
বেশ বলেছো। মি. স্যামন অভিভূত জুডির উত্তর শুনে। তিনি বলেন, জুডি তুমি অনেক প্রস্তুতি নিয়েছো। আগামি গবেষণার জন্য তোমাকে সিলেক্ট করা হবে। তার আগে তোমাকে অনেক নোট, ফুটেজ, লিংক এবং গবেষণার জন্য কিছু মৌলিক তথ্য দেওয়া হবে। ওগুলো ভালোমতো ধারণ করবে। অনেকের সাথে তোমাকেও পরীক্ষায় বসতে হবে। টিকে গেলে সাকসেস।
মি. স্যামন ক্লাসের উদ্দেশ্যে বলেন, এটি ক্লাসের অংশ। ট্যাক্সাসে যারা স্কলারশিপ নিয়ে আসে রেগুলার স্টুডেন্টের সাথে ওদের যাচাই করা হয়। কারণ যারা আসে তারা প্রচুর মেধা নিয়ে আসে। এদের রেগুলার স্টুডেন্টদের সাথে কম্পিটিশনে বসতে হয়। যা হোক, জুডি তোমাকে অভিনন্দন। এরপর তিনি রাহুলকে বললেন, নিশ্চয়ই আগামি থিসিস তোমাকে দিয়ে শুরু হবে।
ক্লাস শেষ। নিউকামারদের বেঞ্চ আলাদা। জুডি আর রাহুল পাশাপাশি বসে আছে। রাহুল ওর হাত বাড়িয়ে দেয়।
আমি রাহুল ধুম্ররাজ। বাংলাদেশ থেকে এসেছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণীবিজ্ঞান অনুষদে ছিলাম।
আমি জুডিনাদ এহমেদ। বাংলাদেশ। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছিলাম। একই অনুষদে।
বাহ। তোমার বর্ণনা অনেক গতিশীল। সবাইকে মুগ্ধ করেছো। তুমি যতটুকু টেক্সাসের ততটুকু বাংলার। আমি গর্বিত, শুরুতেই তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে। আমরা বন্ধু হতে পারি?
ইয়েস, জুডি হাত বাড়িয়ে দেয়। রাহুল হ্যান্ডস্যাক করে। মি. স্যামন চলে গেলে অনেকেই এসে হাই হ্যালো করে জুডির সাথে। রাহুলও পরিচিত হয় কয়েকজনের সাথে। এই সময় ওদের বিরতি। টেক্সাসে আসার পর কারওই ইউনিভার্সিটি ঠিক করে দেখা হয়নি। রাহুল স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে বলে, জুডি, লেটস হেভ কফি।
ইয়েস রাহুল, বাট উই স্পিক বেঙ্গলি, হোয়াট ডু য়্যু সে?
অফকোর্স, ইট উইল বি সো। জুডি বলে, দেশ ছেড়ে এলেও সাথে ভাষাটা নিয়ে এসেছি। আর কিছু আনিনি। তুমি আমি বাঙ্গালি। বাংলায় কথা বলবো দুজন। মনে হবে দেশের সাথে আছি।
ঠিক বলেছো জুডি। তুমি অসাধারণ।
একটি কথা বলবে? তুমি মি. স্যামনের প্রশ্নের এনসার করোনি কেনো?
আমি এমনই। প্রশ্নের এনসার করতে পারি না। তবে বিশ্লেষণে এ্যাসাইনমেন্ট ভালো করি। আমি জড়তাগ্রস্ত।
এমন হলে টেক্সাসে আসার কথা না।
ঠিক বলেছো। আমার এ্যাসাইনম্যান্ট সাড়া ফেলেছে। সেই তথ্য টেক্সাসের লাইব্রেরিতে আছে। ওটা পয়েন্টে এগিয়ে আছে বলেই আমি এখানে চান্স পেয়েছি। আমার এই দূর্বলতা বায়োতে দেওয়া হয়নি। দেওয়া থাকলে মি. স্যামন আমাকে কোশ্চেন করতেন না।
ও আচ্ছা, তাই বলো।
ওরা নরম নরম সবুজ ঘাস মাড়িয়ে কফিবারে ঢোকে। কফিমগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাহুল। । জুডির সিরিয়াল তিনের পরে। নিজের মগ জুডির হাতে ধরিয়ে দেয়, টেক ইট জুডি। জুডি না না করলে রাহুল বলে, বাঙ্গালিই তো! বাঙ্গালকে বাঙ্গালি না দেখলে কে দেখবে? তোমার হাতে কফিমগ।
দেখবো আমি, গিলবে তুমি ঢকঢক।
রাহুলের কথা শুনে জুডি হেসে ওঠে। সাথে রাহুলও।
তবে তুমি এখনও ইংরেজি বলো। টেক ইট বলেছো। জুডির কথা শুনে রাহুল আবারো হেসে ওঠে। তুমি খুব সার্প। ওহহ, পরিস্কার!
আবারো দুজন হেসে ওঠে। নরম ঘাসের মতো ওদের কথা টেক্সাসের ঘাসে মিশে যায়।
রাহুল বলে, উঠেছো কোথায়?
এখান থেকে আধা কিলো হবে পেয়িং গেস্ট হয়েছি। ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি। বয়স্ক দুজন মানুষ ওরা আমাকে পেয়ে গদগদ। তুমি?
আমি বাসা খুঁজতে সময় পাইনি। টিকিট তাড়াতাড়ি হয়ে গিয়েছিলো। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাদ স্যার যিনি আমাদের জিওসায়েন্সের প্রধান তার সহযোগি হয়ে একটি থিসিস করতে হয়েছে। ওটা সমাপ্ত করার জন্য এদিকে দেখা হয়ে ওঠেনি। হোটেলে উঠেছি। দেখি কি করা যায়।
হোটেলে অনেক খরচ হবে।
ঠিক বলেছো।
দেখা যাক আমার হোস্টকে বলে তোমার জন্য ব্যাবস্থা করতে পারি কিনা!
থ্যাংকস জুডি। রাহুল খুশি হয় জুডির কথা শুনে। মনে হয় মেয়েটা পারবে। ওর ভেতর দারুণ আত্মবিশ্বাস আছে। পরদিন ঠিকই জুডি ওর হোস্টকে বলে কাছেই একটি বাসায় ওর থাকার ব্যবস্থা করে।
ধীরে ধীরে ওরা এটা সেটার জন্য একে অপরের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ে। একদিন জুডির বাড়ি থেকে টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়। দু’মাস হতে চলেছে। টাকা পয়সার কুলকিনারা করতে পারছে না ওর মা সুরাইয়া বেগম। তিনি একটি স্কুলের টিচার। জুডির বাবা নেই। সুরাইয়া বেগমের বেতনে সমস্যা হয়েছে। ব্যাপারটা আজ ছয়মাস। জুডিকে তিনি জানাননি। মেয়ে টেনশনে পড়বে জেনে। এই পর্যন্ত ধারকর্জ করে চালিয়েছেন। আর পারছেন না। মেয়েকে সত্যিটা জানালে জুডি চোখেমুখে অন্ধকার দেখে। দু’মাস বাসাভাড়া বন্ধ। কোনরকম খেয়ে না খেয়ে আছে। রাহুল ব্যাপারটা লক্ষ্য করে। হাসিখুশি জুডি ক্লাসে মনমরা হয়ে থাকে। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলে মাথাব্যথা করে। লাইব্রেরিতে টেবিলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকে। রাহুল ওর জন্য কফি নিয়ে আসে। জুডি খেতে চায় না। জোর করে খেতে দিলে খেয়ে বমি করে। রাহুল আর্তনাদ করে। কী হয়েছে জুডি? তোমার কী হয়েছে? জুডি কথা বলে না। নিরুত্তাপ জুডি শুধু বলে, শরীর খারাপ লাগছে রাহুল, আমি চলে যাচ্ছি।
দুদিন জুডি ক্লাসে নেই। রাহুল কেমন যেনো অনুভব করে। প্রথম দিন আসেনি দেখে সে অবাক হয়েছে। ক্লাস অন্তপ্রাণ জুডিতো এমন করে না। কী হয়েছে ওর? ফোন করতেই বলে, শরীর খারাপ ছিলো আসতে পারিনি। এখন একটু ভালো লাগছে। কাল আসবো। পরদিনও জুডিকে না দেখে সে ছটফট করে। ফোন করে, জুডি, আজ তুমি নেই। নিরবতা পালন করছি। কী হয়েছে তোমার?
কিছুই হয়নি। কাল আসবো বলে জুডি ফোন কেটে দেয়।
রাহুলের ভালো লাগে না। মেয়েটা অসুস্থ। ডাক্তার ডাকেনি কেনো? এই ইউনিভার্সিটিতেও ডাক্তার আছে। হাফভিজিটে দেখানো যায়। সে জুডির বাসায় গিয়ে হতভম্ব। এই দুদিনে জুডি শুকিয়ে লাশের কাঠামো হয়ে গেছে।
জুডি, তোমার এরকম অসুখ আমাকে বললে না কেনো?
তুমি খুব ব্যস্ত তাই বলিনি।
মেরে তক্তা বানাবো পাজি মেয়ে কোথাকার! আমরা বাঙ্গালি না? সুখ দুঃখের? আমাকে তুমি দ্বিধায় রেখে দিলে? কী হয়েছে বলো! রাহুলের পীড়াপীড়িতে জুডি সব বলে। রাহুল শুনে একটি চড় মারে জুডিকে। বদমাশ মেয়ে। সামান্য সমস্যাকে পুষে কত বড় করেছে। অথচ আমাকে বললে এতকিছু হয়? সে জুডির বাসাভাড়া মিটিয়ে ওকে নিয়ে বের হয়। ডাক্তার দেখিয়ে আরও কিছু টাকা দিয়ে বলে, যাই রে মুটকি। যা হোক, এই কদিনের পেরেশানিতে শুঁটকি হয়েছিস। তবে খবরদার, আর শুঁটকি হবি না। তোকে মুটকিতে মানায়। আর শোন, তোর মতো পুঁচকেকে কোন দুঃখে তুমি বলবো আমি? যাই, কাল আসবি ভার্সিটিতে। বলে দিলাম।
অনেকদিন পর মি. স্যামন ভীষণ উৎফুল্ল। তিনি স্টুডেন্টদের একটি ডায়নামিক গ্রাফিক দেখাচ্ছেন। এই গ্রাফিকে প্রাণীজগতের আদিপর্ব থেকে বর্তমান পর্ব বিশ্লেষন করা আছে। এত নিঁখুত, যে কেউ দেখলে চোখে তুলে রাখতে পারবে। ভুলবে না। তিনি রাহুলের সামনে এসে বললেন, ইয়াং বয়। তুমি তো মারাত্মক দেখালে। একদম কেটেকুটে ক্যামব্রিয়ান এক্সপ্লোশন নিয়ে এলে। এখন শুনো, ক্যামব্রিয়ান যুগের আগেই জটিল গঠনের প্রাণীদের অস্তিত্ব ছিল। ইডিয়াক্যারান যুগে যেসব ম্যাক্রোফসিল পাওয়া গিয়েছে নানা কারণেই সেগুলির সঠিক জাতিজনিত শ্রেণিবিন্যাস করা যাচ্ছিল না। এখন এটিকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?
মি. স্যামনের এই প্রশ্নে রাহুল ইউক্যালিপটাস গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এই অবস্থা দেখে জুডির মারাত্মক হাসি পায়। কোনমতে নিয়ন্ত্রণ করে হাত দিয়ে একটি গুঁতো মারে জুডি। এতে রাহুল আরও কুঁচকে যায়। পরদিন রাহুলকে এটার ওপর থিসিস নিয়ে আসতে বলেন মি. স্যামন। এরপর ক্লাস শেষ করে চলে যান।
স্যামন চলে গেলে রাহুল বলে, তুই মজা পাচ্ছিলি তাই না? এত হাসছিলি যে?
আমি আমার চোখের সামনে ইডিয়াক্যারান যুগের কোন প্রাণীকে দেখছিলাম। যিনি ক্যামব্রিয়ান যুগে এসে মানবাকৃতি পেয়েছেন। এই বলে জুডি আবারো ফিক করে হেসে ওঠে।
আমি ইডিয়াক্যারান?
ইয়েস, এন্ড অলজো লাইক ইউক্যালিপটাস।
ওহহ, তুই আমাকে টাইটেল দিচ্ছিস। দ্যাখ, এঞ্জেল আর রোজেন কীভাবে হাসছে। ওরা যদি এই নামে ডাকে?
ডাকলে ডাকবে।
তাই? তাহলে দেখ মজা! রাহুল ওর ঘাড় ধরে একটি কিল মারে।
ব্যথা দিলে কেনো এ্যামিবা শয়তান?
আমি এ্যামিবা? দারুণ বলেছিস মুটকি? তবে এ্যামিবা বললি কেনো?
দাঁড়িয়ে থাকলে তোমাকে সরল প্রাণীর মতো দেখায়। তোমার ফসিলের ভেতর পূর্বপুরুষ একটু হাড় রেখে গেছে। তাই মানুষ আকৃতি পেয়েছো বলেই জুডি আরও হাসতে থাকে।
তবে যাই হই না কেন তুই ভালো বলেছিস। মি. স্যামন আমাকে যে থিসিস করতে বললেন, তোর এই তত্ত্ব কাজে লাগবে।
জুডি, একটি কথা বলতো আবার যদি ইডিয়াক্যারান
যুগের সুচনা হয়?
অবশ্যই প্রাণীজগত আবার এককোষী পৃথিবীতে ফিরে যাবে।
এটির নিশ্চয়তা কী?
এটি হলো বিবর্তন। বিবর্তনের নিয়ম অনুসারে তাকে সৃষ্টির শুরুতে চলে যেতে হবে। আমাদের এই যে কশেরুকা একদিন এটি আবার মিলিয়ে যাবে। বা আমরা তখন অন্যকোনো প্রাণীতে পরিণত হবো।
রাহুল অবাক হয়। দারুণ তো! এটিই আমার থিসিসে আসবে। আমার থিসিসে তুই থাকবি।
জুডির প্রতিটি বিশ্লেষণ শোনে রাহুল। মেয়েটা জিনিয়াস। সে লাফিয়ে জুডিকে কোলে তুলে নাচে।
ওহহ, কী করছিস! পড়ে যাবো তো!
আরে পড়বি না। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি এই রাহুল ধুম্ররাজ। পাঁচফুট চার ইঞ্চির জুডি, পড়লে তাকে নিয়েই পড়বে। সমস্যা আছে?
রাহুল ছেড়ে দেয় জুডিকে।
ওহহ কী ভয় পেয়েছিলাম। তুই আসলেই একটা ক্যামব্রিয়ান শয়তান। এভাবে কেউ নাচে? জুডি চোখ পাকায়।
জুন এলো লাফিয়ে লাফিয়ে। এই সময় গ্রীষ্ম অবকাশের জন্য মুখিয়ে থাকে সবাই। ভার্সিটির নিয়ম অনুযায়ী অবকাশ যাপনের জন্য বিভিন্ন স্থান পছন্দ করার জন্য টস করা হয়। টসে যার নাম যেভাবে ওঠে সেখানে স্টুডেন্টদের যেতে হয়। পশ্চিম টেক্সাসের বেন্ড দেশ জুডি টসে পেয়ে যায়। ছুটি এবং অবকাশের জন্য এটি দারুণ। এখানে রয়েছে ন্যাশনাল পার্ক, রিও গ্রান্ড নদী এবং ডেভিস পর্বতমালা ও জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান।
রাহুলের পায় পূর্ব টেক্সাসের উডসে। সারি সারি পাইনে আবৃত এখানে কিলগোর, মার্শাল এবং লংভিউ-এর মত রাজ্যগুলি ভীষণ ঐতিহাসিক। এছাড়া ইতিহাসে ভরা ন্যাকোগোডেসের সমৃদ্ধ শহর তেলের জন্যও বিখ্যাত।
ওরা যে যার মতো চলে যায়। বিকেলে জুডি গ্রান্ড রিও নদী তীরে বসে রাহুলকে নদীর ছবি পাঠায়। রাহুল পাঠায় সারিসারি পাইন গাছের ছবি। দুজন দুজনকে অস্তমিত সূর্য আর তার লাল টকটকে বিভার ছবিতে মাতিয়ে রাখে। একই সূর্য, একই আঁচ, একই সন্ধ্যে। তবে দুজন দুজনকে ছেড়ে একা। এই একাকীত্বের ছবি কেউ কাউকে পাঠাতে পারে না। ওদের ভেতরে শুন্যতার স্ন্যাপ হৃদয়ে কালো ছাপ মারে ন্যাগেটিভের মতো। হৃদয় ওয়াশ করলেই হয়তো দুজন দুজনের ছবি দেখতে পেতো। কে কার ভেতরে কেমন করে বসে আছে! কতটুকু বসে আছে! রাহুল অনুভব করে, কে যেন পাশে নেই। ভীষণ শুন্য শুন্য লাগে সব। এত সুন্দর চারিদিকে! তবু কেমন যেনো ফাঁকা লাগে সব। এই সৌন্দর্য দেখার চোখ সে রেখে এসেছে আর কোথাও। ওর চোখ যেনো মরে পড়ে আছে। ঝড়ে বাসাভাঙ্গা পাখির মতো যেনো মাটিতে মিশে গেছে। পরদিন ন্যাকাগোডেসের একটি সৌন্দর্যমণ্ডিত নগরীর কফিবারে বসে জুডিকে খুব মনে পড়ে। ওয়েটার কফি দিলে অভ্যাসবশত কফিমগ সামনে এগিয়ে ধরে। হঠাৎ সম্বিত পেয়ে হেসে ওঠে। ওহহ! কী পাগলামি করছি আমি! জুডিতো নেই। এভাবে সে প্রতিটি দিনের অবকাশ অভিজ্ঞতা নোট করে আর জুডিকে কল্পনায় বসিয়ে পড়ে শোনায়।
ওদিকে জুডিও ঢেউ গুণে গুণে কথা তৈরী করে। আচ্ছা রিও নদী, রাহুল কী করছে? নিশ্চয়ই খুব মজা করছে তাই না? ও তো মজাই করবে। ওর গ্রুপের মেয়েরা যা সুন্দরী! আমার মতো মোটা বোঁচা চেহারা আর শ্যামলা মেয়েকে সে মনে করবে কেনো? সেও খুব সুন্দর ছেলে। বিদেশি মেয়েগুলোও ওর প্রেমে হাবুডুবু খায়। আমার কী আছে? ওই একটু বিদ্যের জোর ছাড়া? সুন্দর ছেলেরা সুন্দরী মেয়ে খোঁজে। বিদ্যে খোঁজে না। বিদ্যে ধুয়ে কী রাহুল জল খাবে? সে যেখানে এত মেধাবী সেখানে জুডির মতো ওরকম মেধাবী মেয়ে না হলেও ওর চলবে। আচ্ছা, আমি কী ভাবছি এসব? রাহুল আমাকে ভালোবাসবে কেনো? আমরা কি কখনো কাউকে প্রপোজ করেছি? এমনও হতে পারে সে কাউকে ভালোবাসে। হয়তো আমি জানি না। জুডি মাথা থেকে রাহুলের ভাবনা ঝেড়ে ফেলে।
রিওর কালো জলের ভেতর সন্ধ্যা নামে। সেই সন্ধ্যায় টুং একটি শব্দ আসে। রাহুলের নোটিফিকেশন। জুডির বুক কেঁপে ওঠে। সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। মেসেজ ওপেন করে। কী রে মুটকু ভুত! হাওয়া হয়ে গেলি। আমাকে ভুলে ভালো আছিস? জনসনটা তোর দলে পড়েছে। তোর সাথে লটকুকুটকু করে তাই না! বেশ গদগদ আছিস! রাহুলের মেসেজ পেয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় জুডির। জবাবে মিথ্যে লেখে, বেশ ভালো আছি। জনসন আমার পাশে বসা। আমরা রিও নদী দেখছি। তোমার খবর বলো। তোমার বান্ধবীরা কই?
রাহুলের বুক মোচড় দিয়ে ওঠে। সে আর কিছু লিখে না। মনে মনে বলে, জুডি তুই জানিস না, আমার কী নিয়ে চলে গেছিস! এতদিন এত কাছাকাছি ছিলাম। বুঝতেই পারিনি তোকে। তুই জনসনকে ফিরিয়ে দে। আমাকে রাখ তোর কাছে। রাহুল প্রায় কেঁদে ফেলে।
জুডিকে ভেবে সারারাত ঘুমাতে পারেনি রাহুল। এটি সত্যি হতে পারে না। জনসন জুডিতে আসক্ত। সবাই জানে। এই অবকাশে ওদের যদি প্রেম হয়ে যায় তাহলে রাহুল মরে যাবে। এই প্রথম সে উপলব্ধি করে জুডি ছাড়া সে অচল। নাহ, অবকাশের গুল্লি মারি। কালই পশ্চিম টেক্সাসে রওয়ানা দেবো। যা হবার হবে। ওর সাথে কথা বলবো সরাসরি। প্রত্যাখ্যাত হলেও সরাসরি হবো। সেও ভালো। মেসেজে জানাবো না, তাকে ভালোবাসি। যদি অবজ্ঞা করে?
এদিকে মিথ্যে বলায় সারারাত জুডিও ঘুমাতে পারেনি। নিজের মাথায় চাপড় মারে আর বলে, এই হলো মিথ্যে বলার ফল। সারারাত জেগে প্রায়শ্চিত্ত করো। কী ভাববে রাহুল ওকে? প্রেম না করেও রাহুলের কাছে মিথ্যেবাদী হয়ে থাকতে হবে। ধ্যাত, কিছু ভালো লাগছে না।
পরদিন সকাল অবকাশ ছেড়ে জুডি পূর্ব টেক্সাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। রাহুলকে যদি পেয়ে যায় বলবে, অবকাশের অংশ হিসেবে এইপাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম যাবার পথে তোমাকে দেখে যাই। দেখতে আসছি কেমন কাটছে তোমার অবকাশ। এরপর সুযোগমতো মিথ্যে মেসেজের কথাটা বলব।
আর যদি না পারি তাহলে চোখের দেখা তো হবে। তাকে ছেড়ে থাকার তীব্র যন্ত্রণা তো কিছুটা হলেও কমবে।
ওদিকে রাহুলও অস্থিরতা আর ছটফটানি একপাশে রেখে পশ্চিম টেক্সাসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সে ভেবে রেখেছে জনসনের কথাটা সরাসরি জিজ্ঞেস করবে না। শুধু বলবে অবকাশরে অংশ হিসেবে এ পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। কেমন আছিস তোরা একটু দেখে যাই।
ওরা বের হয়। কেউ কাউকে ফোন করে না। ভাবছে, একজন আরেকজনকে গ্রেট সারপ্রাইজ দেবে। আর বলে কয়ে গেলে কে কী অবস্থায় আছে দেখা যাবে না। জুডি মনপ্রাণ বেঁধে ছুটছে রাহুল কেমন মৌজমাস্তিতে আছে দেখার জন্য।
ওদিকে রাহুল না জানিয়ে ছুটছে হাতেনাতে জনসন আর জুডিকে ধরার জন্য। একটা বোঝাপড়া হোক। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত জুডিকে দেখে দেখে রেখেছি। আর ছিনিয়ে নেবে অন্য কেউ? না, তা হবে না। প্রয়োজনে জুডিকে টেনে নিয়ে আসবো। তারপরও জনসনের আশেপাশে ছেড়ে দেবো না। যেমন কথা তেমন কাজ।
বুকে আশা নিরাশার একজানালা অন্ধকার নিয়ে ছোটে রাহুল। মন সংশয়ের জালে আটকে আছে। দিনের পর দিন স্মৃতিদের ডালপালা ভালোবাসার গুটিদানায় চোখ মেলে। এতদিন এই চোখ কোথায় ছিলো? কেনো সে জুডির সুগোপন সিঁড়িতে পা রাখেনি?
ওদিকে জুডি অবারিত অভিলাষের তালা খোঁজে। চাবি হাতে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়? তালা তো লাগবে? তালা যে রাহুল? তার মনে কে এঁটে আছে কে জানে? তবুও দ্বিধাবিভক্ত জুডি ভাবে, থাক, রাহুল ওর নাইবা হলো। কিন্তু এই ক’দিনের অসহ্য শুন্যতা তো কাটিয়ে আসতে পারবে রাহুলকে এক ঝলক দেখে। তাই বা কম কীসে?
ঘুম থেকে জেগে ওঠা সোনালি সকালের মতো রাহুল পশ্চিমে থামে। জুডিকে দেখবে এই আনন্দে রোদের মতো ছড়িয়ে পড়ে ওর উচ্ছ্বাস।
জুডি পুবে থামে। মাঝখানে বয়ে যায় মেরুণ রঙের মাল্টিকালার স্বপ্ন। একজন আরেকজনকে দেখার। চোখের তৃষ্ণা মেটানোর সে কী পরানে পরান টানাটানি! কে কাকে ছিঁড়বে বুকের ভেতর জঘন্য উদ্যম।
রিও নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে রাহুল। পাশে জনসন। সে বলছে, জুডির কী কাজ আছে জানিয়ে আজ কোথায় যেনো চলে গেছে। জিজ্ঞেস করতেই কোন কথা বললো না। আমি ওকে বারবার ডেকেছি। সে ফিরেও তাকায়নি। তুমি কেনো এসেছো? জুডি কোথায়, জানো কিছু?
রাহুল নিশ্চুপ। জলের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে। ওখানে সে জুডির চোখ খুঁজছে। যে চোখ এই নদীর জলে ডুবেছিলো। জনসনের কথায় রাহুল বোঝে জুডি তাকে খুব অনুভব করেছে।
হৃদয়ের টান মিছে হতে পারে না। সে ওর সমস্ত পরিধি থেকে শক্তি সঞ্চয় করে ফোন হাতে নেয়। ভিডিও কল দেয় জুডিকে। অপরপ্রান্ত থেকে, হ্যালো রাহুল!
রাহুলের বুক ধ্বক করে ওঠে। এই প্রথম ভিডিওতে জুডিকে দেখে। এই প্রথম জুডির স্বর শুনে চমকে ওঠে। বুক কাঁপছে। জুডির কণ্ঠ এত সুন্দর! এতোদিন বুঝেনি কেনো?
সে মোবাইল স্ক্রিনে ঝুঁকে বলে, জুডি আমি রিও নদীর পাড়ে।
রাহুল, আমি পূর্ব টেক্সাসে। তোমার ওপাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভেবেছি যাওয়ার পথে তোমার সাথে দেখা করে যাই। তুমি ওখানে কী করছো?
থাক আর মিথ্যে বলতে হবে না। তুমি ওখানে আছো ওখানেই থাকো। আমি আসছি।
মনের কথা তুই থেকে তুমিতে এসে আবারো ঠেকেছে। রাহুল নিজের আবডাল ভাঙে। মোবাইল অফ করে। অস্তমিত সূর্যের মতো ডুবতে থাকা রাহুলের স্ক্রিন থেকে জুডির ছবিও ডুবে যায়। জুডির ছবি ডুবে যাবার আগেই সে স্ক্রিনে চুমু খায়। খুব জোরে। রিও নদীর ঢেউ ছলাৎ করে ওঠে চুমুর শব্দে। মনের নদে জোয়ার এলে যা হয়, অস্ফুটে বলে রাহুল, জুডি আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। জুডিরে, তুই… তুমির মতোই সুন্দর!
বৈশাখী আয়োজনের আরও গল্প পড়তে:
রবিউল কমলের ছোটদের গল্প ‘তুতু’
মাসুম মাহমুদের গল্প ‘পরস্পর বোঝাপড়া’
জুঁই মনি দাশের গল্প ‘নীহারিকার বানপ্রস্থ’
জহিরুল ইসলামের গল্প ‘একজন হোসেন আলী’
রয় অঞ্জনের গল্প ‘বিজিতের বিজয়রথ’
অর্ণব সান্যালের গল্প ‘জানালায় পরকীয়া’
শ্যামল নাথের গল্প ‘কাদামাটির আঙুল’
গৌতম বিশ্বাসের গল্প ‘নতুন জীবন’
সারাবাংলা/এসবিডিই
গল্প-উপন্যাস দূরত্বের জলে রঙিন ফুল বৈশাখী আয়োজন বৈশাখী আয়োজন ১৪৩০ রোখসানা ইয়াসমিন মণি সাহিত্য