Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অর্ণব সান্যালের গল্প ‘জানালায় পরকীয়া’

অর্ণব সান্যাল
১১ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:৫৯

রফুর সঙ্গে রেহানার বেশ কিছুদিনের সম্পর্ক, কয়েকমাস হবে। জানালা দিয়ে। সকালের একটি নির্দিষ্ট সময়ে রফু এসে রেহানার ঘরের জানালার বিপরীতে দাঁড়ায়। কয়েক হাত দূরত্বে পাশাপাশি বাসস্থান থেকে দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হয়। সেটি শুভ দৃষ্টি কি না, তা নিয়ে রফু ও রেহানা বাদে আর সবারই দ্বিমত আছে। যদিও সেসব রফু বা রেহানার দৃষ্টি বিনিময়ে বাধা হতে পারেনি কখনোই।

রেহানা শুরুতে একা একাই জানালার সামনে দাঁড়াত যখন–তখন। অর্থাৎ কোনও সুনির্দিষ্ট ক্ষণ ছিল না। তবে রফু ধীরে ধীরে নিয়মিত দর্শনার্থীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে দুজনই নিজেদের সুবিধার্থে কিছু সময় নির্দিষ্ট করে নিয়েছিল। এই যেমন, সকালে ঘুম থেকে ওঠার একটু পরই একটিবারের জন্য হলেও রফুকে দেখতে জানালার পাশে দাঁড়াত রেহানা। আবার রান্নার ফাঁকে ফাঁকেও মাঝে মাঝে চোখাচোখি হতো। কখনও কখনও অলস দুপুরে ভাতঘুমের সময়টায় দুজনের চোখে চোখে কথা হতো। মুখের ভাষায় আসলে তো অনেক কিছুই বলা যায় না। এর চেয়ে চোখের ভাষায় বাক্যালাপ যে দুর্দান্ত হয়, তা বুঝে গেছে রফু–রেহানা।

বিজ্ঞাপন

রফুর নামটাও রেহানার দেওয়া। ছদ্মনাম। রফিক থেকেই ছোট করে রফু। যদিও রেহানার কাছে কখনও এই নাম দেওয়ার কারণ জানতে চায়নি রফু। বরং অজ্ঞাতকূলশীল এই জীবনে আদুরে একটি নাম পাওয়াকেই মোক্ষলাভ হিসেবে মেনে নিয়েছিল সে। হয়তো সেভাবেই রেহানার আদরের আঁচ কিছুটা হলেও পাওয়া যেত। আর যার যেটায় অভাব, সে সেটারই কাঙাল হয়।

দেখা করার সময়টায় রফু আগেভাগেই উপস্থিত থাকত। রেহানা আসলে সময় বের করে রফুর সঙ্গে দেখা করতে আসত। তবে রফুর ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক তেমন ছিল না। বরঞ্চ রেহানার চোখে চোখ রাখাটাই ছিল রফুর দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অফিসে ঠিক সময়ে যাওয়ার মতো তাই রফু ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৯টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে রেহানার জানালার উল্টো পিঠে অবস্থান নিত।

বিজ্ঞাপন

রেহানাদের ফ্ল্যাটটা তিন তলায়। স্বামীর সঙ্গে থাকে। সংসার বেশ ছোট। ছোট হলেও স্থানাভাব ছিল না। কারণ মানুষ কম, জিনিসও কম। আর স্থানাভাব না থাকলে বুঝে নিতে হয়, শূন্যতাও আছে। সেই শূন্যতার অনুভূতি থেকেই হয়তো রফুর সঙ্গ বেছে নিয়েছিল রেহানা। আর রফুর তো কেউই ছিল না। সম্পূর্ণ একার পৃথিবীতে দোকা হওয়ার অনুভূতিতেই মাতোয়ারা রফু। কেউ তো আছে এখন, যার চোখে তাকানো যায়। এটাই বা কম কী!

সকালে শয্যাসঙ্গী ঘর ছেড়ে রোজগারের উদ্দেশে বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই জানালার কাছে দাঁড়াত রেহানা। খুব বেশি সময় না, পনের থেকে বিশ মিনিট। এর পরই কাজে লেগে পড়ত দুজনেই। রেহানার কাজ ছিল ঘরের, রফুকে পেটের দায়ে অবশ্য বাইরেই যেতে হতো। রেহানা যদিও দৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়েছিল যে, মাছের মুড়ো রফুর জন্য আলাদা করে রাখতে সে আগ্রহী। রফুই তাতে গা করেনি। সব সম্পর্কে হয়তো লেনদেন ভাল লাগে না! রেহানা একে রফুর অনাগ্রহ ভাবত। ভাবত, হয়তো তার রন্ধনশৈলীর ওপর ভরসা নেই রফিকের। ওদিকে রফু একে অনুগ্রহ হিসেবে দেখতেই পছন্দ করত। তবে প্রকাশ করেনি কখনও, পাছে রেহানার রাগ হয় সেই ভেবে! আর রেহানা নিজের কমতি ঢাকতে শুরুতে দেখত মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া। কিছুদিন দেখার পরই অবশ্য বুঝে গিয়েছিল রফিকের মন তুষ্ট করার জন্য হলেও এত ঢং পোষাবে না। তাই শেষে শিক্ষাগ্রহণ এসে থেমেছিল স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলের রান্নার অনুষ্ঠানে।

এই অনুষ্ঠান দেখা নিয়ে ঢের খোঁটাও শুনতে হতো রেহানাকে। শয্যাসঙ্গী রাতে বাসায় ফিরে চারকথা শোনাতোই। টিভিটা বিয়েতে রেহানার বাবা দিয়েছিল, কিন্তু ডিশ কানেকশনের বিল ভরত শয্যাসঙ্গী। তার দাবি ছিল, মেয়ের খায়েশ পূরণের জন্য হলেও ডিশের বিলটা রেহানার বাবার দেওয়া উচিত। আর তার সঙ্গে এককালীন দেওয়া উচিত পাঁচ লাখ টাকা। ওটা দেবে দেবে বলেও দেয়নি কিনা!

নিত্যকার এসব গঞ্জনা থেকে একটু দূরে যেতেই হয়তো নিয়ম করে প্রতিদিন রফুর চোখে চোখ রাখত রেহানা। রফিক বা রফু- এই নামটার সঙ্গে তার অনেকদিনের সম্পর্ক। প্রায় ১০ বছর। সেই সম্পর্কের গাছ থেকে কোনও ফল হয়নি। তাই এবার যাকে রফু বানিয়েছে রেহানা, তার সঙ্গে সম্পর্কে কিছুটা দূরত্ব রেখেছে সে। কয়েক হাত দূরত্ব হবে, এবং পুরোই প্লেটোনিক। প্লেটোর এসব তত্ত্ব শিখিয়েছিল সত্যিকারের রফু। যদিও তাই বলে কোনও কিছুই বাকি থাকেনি। ওসব ক্ষেত্রে প্লেটো হয়ে যেতেন প্লেবয়।

এই যে এত করত, হতো, বলত ক্রিয়াপদগুলো ব্যবহার হচ্ছে, তার কারণ হল গত তিনদিন ধরে রেহানার দেখা পাচ্ছে না রফু। সে ঠিক সময়েই আসছে জানালার উল্টো পাশে, কিন্তু রেহানা আসছে না। একেবারেই না। প্রথমে রফু ভেবেছিল, রেহানা অসুস্থ। তবে এর আগে অসুস্থ হলেও দিনে একবার অন্তত দেখা পাওয়া যেত। কিন্তু এবার কোনও চিহ্নই নেই। এমনটা হচ্ছে তিনদিন ধরে। ঠিক তিনদিন আগেই মধ্যরাতে রেহানার ফ্ল্যাট অসময়ে মাংস পোড়ার গন্ধ এসেছিল।

রেহানাকে না দেখতে দেখতে বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে রফু। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে নিজের কোনও ছবিও কখনও দেয়নি রেহানা। তাই স্মৃতি ছাড়া আর কোনও অবলম্বনও নেই রফুর। তবে কি কৃষ্ণকালো রফুকে আর মনে ধরছে না রেহানার? এড়িয়ে চলতে চাইছে? হতেও পারে। এমন ঘটনা কত ঘটেছে রফুর জীবনে! কুচকুচে কালো বলে বাবা-মা থেকে শুরু করে কারও মনের ঘরেই জায়গা পায়নি সে। কেউ কেউ অবশ্য সময় কাটিয়েছে। আর সাদা-কালোর মিশেল বা শুধু সাদা কাউকে পেলে ছেড়ে দিতেও দেরি করেনি। কুচকুচে কালো হওয়ায় দূর দূর করে খেদিয়েছে অনেকে। তবে এ কারণে একা একা সময় কাটানোটা হয়েছে রফুর। সেটিও কখনও কখনও খারাপ না আসলে। একা একা বসে থাকতে দেখেই তো রেহানার চোখ তার দিকে গিয়েছিল। কিন্তু এখন কেন চোখ ফিরিয়ে নিল সে?

এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই চোখদুটো ছলছলে হয়ে এল রফুর। আর ভাল লাগছে না এ জীবন। অভিমান করে না খেয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু খিদেয় পেট চোঁ চোঁ অবস্থা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হালকা স্বরে রেহানাকে ডাকতে চাইল সে। একটু দেখতে চায়, তাই স্বগতোক্তির সুরে আহ্বান।

ওদিকে রেহানার পাশের বাড়ির মিনু শুনল করুণ কন্ঠে মিউ মিউ করে ডেকেই চলেছে একটি বিড়াল!

বৈশাখী আয়োজনের আরও গল্প পড়তে: 

রবিউল কমলের ছোটদের গল্প ‘তুতু’

মাসুম মাহমুদের গল্প ‘পরস্পর বোঝাপড়া’

জুঁই মনি দাশের গল্প ‘নীহারিকার বানপ্রস্থ’

জহিরুল ইসলামের গল্প ‘একজন হোসেন আলী’

রয় অঞ্জনের গল্প ‘বিজিতের বিজয়রথ’

রোখসানা ইয়াসমিন মণির গল্প ‘দূরত্বের জলে রঙিন ফুল’

শ্যামল নাথের গল্প ‘কাদামাটির আঙুল’

গৌতম বিশ্বাসের গল্প ‘নতুন জীবন’

সারাবাংলা/এসবিডিই

অর্ণব সান্যাল গল্প-উপন্যাস জানালায় পরকীয়া বৈশাখী আয়োজন বৈশাখী আয়োজন ১৪৩০ সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর