Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রয় অঞ্জনের গল্প ‘বিজিতের বিজয়রথ’

রয় অঞ্জন
১২ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:৪৮

তাইজুল।
গ্রামের লোকেদের নামের বিকৃতিকরণজনিত অভ্যাসের কারণে কখনও তাজুল, কখনও আবার তাইজ্জা ধরেও ডাক পড়ে। এই রুটে রিক্সা চালায়, তাইজুল। একটা বিশেষ কারণে তাইজুল ড্রাইভারের বড় কদর এই রাস্তায়। সেদিন তার রিক্সাটা সাই সাই করে ছুটে এসে থামল বাড়ির সামনে। তখন এই জায়গাটাকে বাড়ির সামনেই বলা হতো। এখন গেইট হয়েছে, সুউচ্চ ফটক যাকে বলা যায়। সাই সাই বলতে কী আর! খানা-খন্দক-গর্তে ভরা রাস্তা, তার উপরে আবার গর্তে কাদাপানি জমে থাকে। রিক্সার চাকার চাপে কাদা ছিটিয়ে রাস্তার পাশের ভাঁটফুল থেকে শুরু করে জলকলস, ঢেঁকিশাকসহ আর সব গাছেদের চেহারা প্রায় একইরকম হয়ে যায়। এমন রাস্তায় স্বাভাবিক স্পিড লিমিটের চেয়ে সেদিনের স্পিড একটু বেশিই ছিল তাইজুলের। বহুদূর থেকে বেহুদাই ক্রিং- ক্রিং- কিরিং কিরিং শব্দে বেল বাজিয়ে আসছে। রাস্তা ফাঁকা করার এক রকমের বন্য উদ্দামতা তার রিক্সার।

বিজ্ঞাপন

কাইতলীতলা থেকে বদরগঞ্জ হয়ে নোহানগর পর্যন্ত সাত মাইলের রাস্তা। আধেক রাস্তায় পিচ পড়েছে, বাকিটা কাঁচা। শুকনো মৌসুমে ধুলা উড়লেও বর্ষাকালে কাদা-পানিতে একাকার থাকে। রিক্সা ছাড়া যানবাহন বলতে তেমন কিছুই চলে না এই পথে। যারা রিক্সা ধরে হয় তারা একটু স্বচ্ছল, নতুবা পায়ে হাঁটায় অক্ষম বুড়ো-শিশু-রোগী। কদাচিৎ কয়েকটা ইঞ্জিন গাড়ি চললেও, তা বাবু-সাহেবদের। এরা শহরে থেকে গ্রামে আসেন উৎসবে পার্বণে, নানান উছিলায়।

বিজ্ঞাপন

বর্ষাকালে এই কাঁচা রাস্তাটা অন্য চেহারা ধারণ করে। কেউ বলে রেল লাইন, খেউ বলে খাল বা গাঙ। রিক্সার চাকার মাপের তিনটা করে সমান্তরাল রেখা রাস্তাজুড়ে। তার উপরেই চাকারা চলে। চলে না বলে বলা যায় হাঁটে। এই সময়টায় রিক্সার সামনের চাকায় এঁটেল মাটির কাদা আটকে মোটরসাইকেলের চাকার মতো মোটা হয়ে যায়। এই সময়ে তাইজুলের মতো বলবানরাই রিক্সা চালায়, অন্যরা মাছ ধরা বা নাও চালাতে চলে যায়।

তাইজুলের চেহারায় আজ কেমন একটা চকচকে ভাব। ক্রিংক্রিং ঘন্টা বাজিয়ে হুড তোলা রিক্সাটা একটা বড় ফটকওয়ালা বাড়ির সামনে এনে থামিয়ে গলার গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মোছে। ঘাম তেমন জমেনি, কিন্তু বারে বারে নতুন গামছাটা সবাইকে দেখানোতেই যেন গর্ব। তার রিক্সার হ্যান্ডেলে লাল-নীল- হলুদ ঝালর ঝুলছে, হুডেও নতুন ছাউনি। পেছনদিকের বাঁকা বডিতে হরেক রকমের ফুল আঁকা, ফুলের ওপর প্রজাপতি। একটা নতুন পেইনটিংও লাগিয়েছে দোস্ত দুশমন সিনেমার। সোহেল রানা আর জসিম কেমন পরম বিক্রমে দুইদিকে দুইটা দুনলা বন্দুক উঁচিয়ে ধরেছে। এদের ঠিক পেছনেই দুই মায়াবী মুখ শাবানা-সুচরিতা।

রিক্সা থামাতেই ছেঁকে ধরে সবাই, এতক্ষণে বোঝা গেল তাইজুলের এতো ঘটা করে ঘন্টা বাজানোর শানে-নজুল। আজ সে বিয়ের খ্যাপ মেরেছে, আগের রাত থেকেই তাকে বুকড করা। বর-কনে তার রিক্সায় উঠবে, তাই মহাজনের কাছে বলে কয়ে নিজের লক্করঝক্কর রিক্সাটা জমায় রেখে একেবারে নতুন বাঁধানো এই রিক্সাটা নিয়েছে। সাথে বাবুর বাড়ির দেওয়া নতুন গামছা, ফুলছাপের শার্ট আর তহবন তো আছেই। না দেখালে কী আর হয়! কী মনে করে যেন তাইজুলও কাল রাতে হাতের তালু আর আংগুলের ডগায় মেহেদীও লাগিয়েছে, ভাব যেন বিয়েবাড়ির সবাইই বরযাত্রী। এমনিতে তাইজুল খুব সহজ সরল তাগড়া যুবক। কারোর ফায়ফরমায়েশ বা কোনো সাহায্যসহযোগিতায় না নেই। অনেকটা ঘাটে বাঁধা নাইওরী নৌকার মত। বাড়ির সামনে নববধুকে বরণ করতে আগে থেকেই পাড়া ভেঙ্গে পড়েছে। তাদেরকে জানান দিতেই অবিরত ঘন্টা বাজানো।

আশালতা রায়। স্বামী বীরেন্দ্র কিশোরকে হারিয়েছেন অনেক আগেই। বীরেন্দ্র কিশোর বাড়িতে বসেই এই পাতা, সেই লতা, অমুক শেকড়, তমুক ছাল দিয়ে পুরিয়া বানিয়ে কবিরাজি করতেন। হাতের যশও মন্দ ছিল না। শিক্ষিত হলেও একটা পা চলৎশক্তিহীন ছিল বলে তেমন একটা কাজকর্ম করতে পারতেন না। এমন ছেলের কাছে কে আর মেয়ে বিয়ে দেয়! তাই উল্টো পণ বা কনেসেবা দিয়ে আশালতাকে জমিদার বাড়ির বউ করে আনা হয়েছিল। দুধে-আলাতায় মেশানো গায়ের রঙ্গের ছোটখাটো আশালতা নাকি বিয়ের দিন প্রায় হেঁটে হেঁটেই পালকীতে চড়ে বসেছিলেন, কুঁজো হতে হয়নি এতটুকুও। তাই তার উচ্চতা নিয়ে হাস্যরসও কম হয়নি পাড়াজুড়ে। তাদের দুই ছেলে- বিজিত, বিদ্যুৎ আর দুই মেয়ে- শেলী, মমতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পঙ্গু বীরেন্দ্র কিশোরকে রেখেই আশালতা তার চার সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বাধীনের পরে এসে আর স্বামীকে পাওয়া যায়নি। কেউ বলে মিলিটারিরা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে, কেউ বলে পরিত্যাক্ত বাড়িতে যে জঙ্গল জন্মেছিল, ওখানে থাকা শেয়ালেরা খুবলে খেয়েছে!

এই মুক্তিযুদ্ধ যে কত মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে! কারও দিন ফিরেছে! কেউ একেবারেই সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েছে। তারই শিকার অসহায় আশালতা, জমিদার থেকে ভিখারি হবার দশায় পড়েছে! সন্তানদেরকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমেছিলেন তিনি। সেই ভার খানিক কমাতে, আশালতার ছোট মেয়ে মমতাকে কাকু নিয়ে চলে গেলেন তার কাছে, ভারতে। বিধির কী বিধান, শেলী আর বিদ্যুৎ হলো হাবাগোবা কেবল মাত্র বিজিতই তার অন্ধের যষ্ঠি, সাত রাজার ধন হয়ে রইল।

ঘুঁটে শুকিয়ে, লাউ-সিম, ডাব-নারকেল বিক্রি করে আর অল্প একটু ধানের জমির বর্গা ভাগে কোনমতে দিন কাটে আশালতা দেবীর পরিবারের। সরকারি রেশন আর বাড়ির অন্য শরিকদের দয়া-দাক্ষিণ্যে দিনাতিপাত করেন। ধ্যানে -জপে একটাই আশা তার লতার মতো বড় হতে থাকে, সেটা হলো বিজিত। পড়াশোনায় চলনসই হলেও খরচের টানে খুব বেশি এগুতে পারেনি ছেলে। স্কুলের প্রান্ত রেখা ছুঁতে না ছুঁতেই শহরে ডাক পড়ে বিজিতের। লঞ্চের ডকবয় এর চাকুরি। দিনে রাতে পানিতে ভাসা জীবন। যদিও টেনে আনতে ছিঁড়ে যায়, তবুও মন্দ না, অন্তত মাস শেষে কিছু টাকা মাকে পাঠাতে পারে। লঞ্চের কেরানি মাস্টারটা খুব ভাল ছিল, তারই বদৌলতে বিজিতের জলে ভাসা জীবন ডাঙ্গায় এসে থিতু হয়। কেরানি মাস্টারের এক বন্ধুর শাড়ির দোকানে চাকুরি হয়। ঝাড়-পোছ, ধূপ-ধুনী আর খদ্দেরকে দেখানো এলোমেলো শাড়িগুলো ভাঁজ করে তাকে রাখা তার কাজ। বিনিময়ে মালিকের বাসায় খাওয়া-দাওয়া, গদি ঘরে ঘুমানো থেকে শুরু করে নাপিত-ধোপা সব মালিক বহন করেন, সাথে কিছু বেতন। জীবনের চাকা একটু করে ঘুরছে সবে, অমনি সেই চাকা আবার গর্তে পড়ে গেল! আশার লতায় ফুল ফোটে ফোটে অবস্থায় আশালতা চোখ বুজলেন।

নোহানগর থেকে তাইজুলের রিক্সা এসে থেমেছে মাত্রই। টোপরের নিচে লম্বা ঘোমটার আড়াল থেকে চোখ ঘুরিয়ে ইতিউতি তাকাচ্ছে কনে বউ, বেশ মিষ্টি মুখখানি, নাম তার বিউটি। নতুন বাড়ি, নতুন নতুন মুখ, বধূবরণের সাজ সাজ আবহ দেখে সে প্রায় গুটিয়েই গেছিল। রিক্সা থেকে নেমে উঠোন পেরোতে কয়েক পা। তবুও বিউটির পা এগোয় না। হয়তো একারণেই নববধুকে অন্য কেউ হাত ধরে এগিয়ে নেওয়ার চল শুরু হয়েছিল। বিউটিও তার হাত ধরে থাকা মানুষটার উপরে নিজের ভর ছেড়ে দিয়ে এগুচ্ছে। মনে আরেকটা সংকোচ মাত্রই ভেসে উঠল। বাপের বাড়ির অধিবাসের সময়ে পাড়ার দিদি- বউদিরা যখন হলুদ মেখে স্নান করাচ্ছিল, কে একজন বলে উঠেছিল, “ভাল করে ঘষে দে, বেশি করে হলুদ মাখিয়ে দে, এতে যদি বিউটির গায়ের রঙে একটু জেল্লা ধরে, ছেলের বাড়ির সবাই ফর্সা। কাঁচা হলুদের গায়ের রঙ। বরটাও সাদা লাউয়ের মতো, মিলতে হবে না?” এই প্রথম নিজের শ্যামবর্ণের প্রতি একটু অতুষ্টি এলো তার মনে, আগে ওসব নিয়ে ভাবারই সময় ছিল না ডানপিটে বিউটির।

এ বাড়ির অধিবাস (স্নান পর্ব) শেষ হয়েছে একটু আগেই। লাল টুকটুকে ছাপা শাড়ি পড়ে খাটে বসা নতুন বৌ, চারপাশে আরও অনেকে। ভেজা চুল তখনও পিঠের পরে লুটিয়ে আছে। মেয়েটিকে তখন রবীন্দ্রনাথের সেই ময়নাপাড়ার কৃষ্ণকলির মতোই লাগছিল। কী সুন্দর দেখাচ্ছে! কপালে লাল টকটকে সিঁদুরের টিপ, যেন সাক্ষাৎ শিবাঙ্গী।

বেলায় বেলায় বিজিতের অনেকদিন হলো শাড়ির দোকানে। আজকাল মাঝে মাঝে ক্যাশেও বসে। মালিকের বেশ আস্থাভাজন হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যে মালিকের সাথে মোকামেও যায় শাড়ি কিনতে। শাড়ির দোকানের মুখোমুখি একটা দোকান, অনেকটা ত্রিকোণাকৃতি। দোকানটা খালি হয়েছে মালিক সে দোকানটা ভাড়ায় নিয়ে দিয়েছেন বিশ্বস্ত কর্মচারী বিজিতকে। লুঙ্গীর দোকান। ভাগ্যের চাকা দ্রুতই ঘুরতে লাগল বিজিত- বিউটির সংসারের। এরই মধ্যে তাদের কোল জুড়ে এলো কিশোর, রাজপুত্রের মতো দেখতে। বেশ চলছিল। আর বিউটির তো গুণের শেষ নেই। তার হাতে সোনা ফলে। সকলের আপনজন হয়ে উঠতেও সময় লাগেনি খুব বেশি। এমনকি হাবাগোবা শেলী -বিদ্যুতেরও। কন্যাহীনা কাকীশ্বাশুড়ির কন্যার জায়গা দখল করেনিল বিউটি। পূজোর নাড়ু- সন্দেশ থেকে শুরু করে নিয়ম-আচার সব কিছুতেই কাকীমার ডান হাত হয়ে বসে গেছে সে।

একদিন। ছোট্ট একটা নোটিশ। মার্কেট কমিটি পাঠিয়েছে। আধুনিক শহরের মাঝখানে এমন টিনের ছাউনির মার্কেট ঠিক মানায় না। তাই একে উন্নত করতে হবে। বানাতে হবে বহুতলীয় সুপার মার্কেট। আগাম বাবদ যা চাওয়া হলো, বিজিতের কাছে তা স্বপ্নেরও অধিক। ধাক্কা খায় বিজিত, কেঁপে ওঠে, চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে দুলতে থাকে বিউটি আর সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কিশোরের ভবিষ্যৎ। উন্নয়নের জোয়ারে ভেঙ্গে যায় তার স্বপ্ন দেখা নদীর দুকূল। বহু ঘর ঘুরে, বহুপথ হেঁটে, অনেক দুয়ারে হাত পেতেও কিচ্ছুটি জোটেনি বিজিতের শূণ্য থালায়। শাড়ির দোকানের মালিক দানেশ চাচা থাকলেও মাথার উপরের ছাতাটাকে পাওয়া যেত। চাচা চোখ বুজেছেন আরও বছরপাঁচেক আগেই। এরপর থেকে সেই দোকানেরও ঝাঁপ বদলেছে, বদলেছে সাইনবোর্ডও।

লুঙ্গির দোকান খালি করে বিজিত পথে নামে, পা বাড়ায় গ্রামের পথে। শুরু হলো তার জীবনের উল্টোরথ। বাড়ি এসে হাত লাগায় বিউটির সাথে। গরু-ছাগল, হাঁস- কবুতরের পিছু কাটে সারাদিন। আড়ালে চোখ মোছে বিউটি, বিজিতের চোখের উজ্জ্বল দৃষ্টিতে কালো ছায়ার প্রলেপ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। ভাগ্যাকাশে গ্রহণ লাগে। একখণ্ড ধানের জমিটাও হাত ছাড়া করেছে পেটের দায়ে। জমানো সম্বল কমতে কমতে তলানীতে এসে ঠেকে। দিগ্বিদিক অন্ধকার হতে থাকে। অনাহার- অর্ধাহার গলে গলে ঢুকতে থাকে দরজা- জানালার দুর্দশার ফাঁক গলে গলে। কিন্তু তা বলে তো কিছু থেমে থাকে না, এভাবেই চলে যায় দিন। ভালমন্দের দোলায় দুলতে দুলতে অনেকগুলো বছর কেটেও যায় সুখে-দুঃখে।

প্যাঁ-পুঁ প্যাঁ-পুঁ সাইরেন বাজিয়ে ছুটতে থাকে এ্যাম্বুলেন্সটা। বিউটির চোখে আজ রাজ্যের অমানিশা। কোনমতে ঢাকায় পৌঁছাতে পারলেই হয়। এক ঘর স্বজন আছে, যারা সবসময়ই দেবতার মতো হাত বাড়িয়ে রাখে বিউটির মাথার উপরে, তাদের কাছেই নিয়ে যাচ্ছে স্বামীকে। কতক্ষন পরপর বিজিতের বুক হাপরের মতো ফুলে উঠে, যেন এ্যাম্বুলেন্সের ছাদ ছোঁয়, দম আটকে যায়, কিশোর চেপে ধরে বাপের বুক। প্রতিটা অপেক্ষার ক্ষণ এক একটা নিঃশ্বাসের প্রত্যাশায়। নাগরিক জ্যাম ঠেলে কোনমতে এ্যাম্বুলেন্সটা পৌঁছায় হাসপাতালে। ইমার্জেন্সি থেকে বলে দেওয়া হলো হার্ট এটাকড। বিউটি দিগভ্রান্ত হয়। স্বজনেরা ছুটে এসেছে ইমার্জেন্সির ছোট ঘরটায়। স্তব্ধ বিউটির স্থানু শরীর চেয়ারে নিশ্চল হয়ে হেলে আছে। পাশেই ছেলে কিশোর বসা। চোখেমুখে অনিশ্চিত শংকা। ডাক্তার, অক্সিজেন, ট্রলি, আইসিউ সব কিছুতে ছুটেছে সেই পরমাত্মীয়রা। কতক্ষণ সময় কেটেছে কে জানে! অনেক্ষণ পরে ডাক্তার জানালেন, রিং পরানো হয়েছে, আপাতত নিশ্চিন্ত। দিন কয়েক সিসিইউতে অবজারভেশনে রাখতে হবে। সম্বিৎ ফিরেছে বিউটির, খানিক স্বস্তিতে প্রশান্তির ছিটেফোঁটা লেগেছে চোখে মুখে। মনে মনে আশায় বুক বাঁধে- এবার বিপদটা কাটিয়ে দিন প্রভু, ছেলে বড় হয়েছে, সে একটা কাজ পেলে আস্তে আস্তে এই দুরবস্থা কেটে যাবে নিশ্চয়ই।

হাসপাতালের দিনগুলো কাটছে ধীর গতিতে, সাথে স্বজনরাও আছে। ডাক্তার আশা দিয়েছেন আর দুই-এক দিনের মধ্যে বেডে দেওয়া যাবে। বিউটি বাড়ি ফেরার দিন গোণে মনে মনে।

সেদিন রাত তখন প্রায় দশটা। আচমকা হাসপাতালের ফোন। “Patient seems unconscious, need to take under life support” কিছুটা এভাবে বলে বাংলায় শুধু বললেন, “ডিনারের পরপরেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আপনারা চলে আসুন।” স্বস্তি আর নিশ্চিন্তের হিসেবনিকেশ মুহুর্তে পাল্টে গেল সবার! ছুটলো হাসপাতালে। নানাবিধ নল আর যন্ত্রে মুড়ানো বিজিতের প্রায় নিথর দেহ সিসিইউ এর বেডে। একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে কেবল শ্বাস নিচ্ছে, মনিটরে তীক্ষ্ণ চোখ। অক্সিজেন, হার্টবিট আর পালসের রিডিং পড়ছে ডাক্তাররা। এছাড়া যেন আর কিছুই করার নেই। ডাক্তারদের একটাই পরামর্শ, সৃষ্টিকর্তাকে ডাকুন। এমনি করে দিনে দিনে ঘন্টা বাড়ে, সকাল-দুপুর– রাত্রি বাড়ে, দিনের সংখ্যা বেড়ে হয় পাঁচ। কোন উন্নতি বা পরিবর্তন নেই। বিজিতের শ্বাসটাই চলছে কেবল আর গ্রীষ্মকালের পারদের মতো উঠছে হাসপাতালের বিল। অবশেষে ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, “আমাদের চেষ্টার ত্রুটি করিনি, আপনারা ইচ্ছে করলে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেন”। বিউটির ভরসার খাঁচা ছোট হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়, যা হবার হবে, গ্রামেই নিয়ে যাবে। তখনও বিউটি জানতো না যে, এই মেশিনপত্র খুলে দিলেই বিজিত চিরতরে বিজিত হয়ে যাবে, এখান থেকে আর জিতের সম্ভাবনা নেই।

আইসিউ এ্যাম্বুলেন্সটা সাধারণ এ্যাম্বুলেন্সের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। কেমন একটা রাজকীয় ভাব। সবকিছুর ব্যাবস্থা করা আছে এর ভেতরে। অচেতন বিজিতকে তোলা হলো এ্যাম্বুলেন্সে। যন্ত্রপাতি ফিট করার জন্য একজন ব্রাদারও চলল সহযাত্রী হয়ে। উল্কার গতিতে মহাসড়ক ধরে ছুটছে এ্যাম্বুলেন্সটা। বিউটির চোখেমুখে একটাই ভরসা, একবার বাড়িতে নিতে পারলেই হয়, নিজের শাঁখা-সিঁদুরের ক্ষমতায় স্বামীকে সুস্থ করে তুলবেই। কিন্তু কী ঘটতে যাচ্ছে, তা জানে একমাত্র কিশোর। হঠাৎ করেই কিশোর যেন বড় হয়ে গেল! মায়ের কাছে গোপন রাখতে পেরেছে আসল ঘটনাটা। এক চোখে বাবাকে দেখে অন্য চোখে রাস্তার ধারের গাছ, রাস্তার বাঁক, সাইনবোর্ড পড়ে। আর কতক্ষণ বাকি! যখন এ্যাম্বুলেন্সটা বাড়ির উঠোনে পৌঁছালো, পাড়ার লোকেরা ভেঙ্গে পড়েছে ঠিক সেদিনের মতো, যেদিন প্রথম সে বউ হয়ে এসেছিল এই বাড়িতে। বিউটি ছুটে গেল ঘরে, স্বামীর জন্য বিছানা পাততে।

ব্রাদারটা যখন কিশোরকে জিজ্ঞেস করল, মেশিন খুলে দেই? এর উত্তর দেওয়ার মতো শক্তি তার ছিল না, কারণ এর পরিণাম সে জানে। মেশিন খুলে দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাবা যাত্রা করবেন অন্তিমের পথে। এ কেমন কঠিন পরীক্ষা! তবুও নিজেকে ভেঙ্গেচুরে একবার মাথা নাড়াতে পারলো শুধু। মনে মনে তার একটাই আকুতি, পারলাম না বাবা, তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

স্ট্রেচার থেকে বিজিতের শরীরটা যখন বিছানায় ঢেলে দেওয়া হলো, তখনও তার শরীরে স্পন্দন ছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে স্পন্দনের গতি মন্থর হতে লাগল, সেটা কেবল কিশোরই বুঝতে পারে। বাকিরা সবাই তার আরোগ্য কামনায় প্রার্থনা করে। বিউটি যেন নির্ভার! গল্পে মেতেছে অন্যদের সাথে, হাসপাতালের গল্প, স্বজন পরিবারের মহানুভবতার গল্প, স্বপ্ন ভঙ্গের আকস্মিকতার গল্প। কিশোরের অপলক চোখ বাবার বুকের দিকে, স্পন্দনের গতির দিকে। আচমকা তার চিৎকার, ‘ও মা, মা গো, বাবা তো চলে যাচ্ছে।’ ঘরের মধ্যে ঘরটা যেন ভেঙ্গে পড়ল, এই প্রথম বিজিত চলে যাচ্ছে বিজয়ীর বেশে, যে বিজয় এই সারা জীবনে সে উপভোগ করেনি! সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে বিউটির আজীবনের শাঁখা-সিঁদুরে আঁকা বিউটি। কিশোরের মনে একটাই অস্ফুট উচ্চারণ বিজিত আজীবনই বিজিত রয়ে গেল, বিজয়ী হতে পারলা না! আমিও পারলাম না তোমাকে বিজয়ী করতে, তাই মরণে তুমি তা দেখিয়ে গেলে!

বৈশাখী আয়োজনের আরও গল্প পড়তে: 

রবিউল কমলের ছোটদের গল্প ‘তুতু’

মাসুম মাহমুদের গল্প ‘পরস্পর বোঝাপড়া’

জুঁই মনি দাশের গল্প ‘নীহারিকার বানপ্রস্থ’

জহিরুল ইসলামের গল্প ‘একজন হোসেন আলী’

অর্ণব সান্যালের গল্প ‘জানালায় পরকীয়া’

রোখসানা ইয়াসমিন মণির গল্প ‘দূরত্বের জলে রঙিন ফুল’

শ্যামল নাথের গল্প ‘কাদামাটির আঙুল’

গৌতম বিশ্বাসের গল্প ‘নতুন জীবন’

সারাবাংলা/এসবিডিই

গল্প-উপন্যাস বিজিতের বিজয়রথ বৈশাখী আয়োজন বৈশাখী আয়োজন ১৪৩০ রয় অঞ্জন সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর