মাসুম মাহমুদের গল্প ‘পরস্পর বোঝাপড়া’
১২ এপ্রিল ২০২৩ ১৬:১০
চেম্বারের সামনে বসে জহির ভাবছে, সমস্ত কাগজপত্র দেখে ডাক্তার ভারিক্কি একটা চেহারা করে মায়া মায়া কণ্ঠে বলবেন- অপারেশন লাগবে। আরও কিছু কথা বলেটলে ফাইনালি জানাবেন, ১৭ তারিখের আগে আমার কোনো সিরিয়াল নেই। আপনি এখনই আমার অ্যাসিস্ট্যান্টের সাথে কথা বলে ১৭ তারিখের সিরিয়াল নিয়ে নিন। ১৭ মিস করলে আবার কবে দিতে পারব বলতে পারছি না। টাকা কত লাগবে জানেন তো? সব মিলিয়ে চার লাখ পঞ্চাশ হাজার। ভাবতে ভাবতে জহির দেখে চেম্বার থেকে ভারি সুন্দর এক রমণী বেরিয়ে এসে ডাকছেন, ‘সিরিয়াল নাম্বার ২১, মি. রাশেদুল।’
রাশেদুল আর জহির উঠে দাঁড়ায়। জহিরের হাতে আগের সব ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজ আর এনজিওগ্রামের সিডি। তারা ধীরে ধীরে হেঁটে ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করতেই আচমকা ঠান্ডা বাতাস এসে তাদের আধগরম শরীরটা একেবারে হিমশীতল করে দেয়। ঠান্ডায় কুঁচকে যাওয়া চেহারায় সালাম দিয়ে বসতেই ডাক্তার রাশেদুলকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি পেশেন্ট?’
রাশেদুল অবাক হয়! জহির আর ও সমবয়সী। বন্ধু। শারীরিক গঠনগাঠনেও প্রায় একই রকম, কাউকে ছোট-বড় লাগছে না। দেখে অসুস্থ মনে হয় না কাউকে। ডাক্তার তবে কী করে বুঝলেন, কে রোগী! সে আমতা আমতা করে বলল, ‘জি, স্যার।’
জহির কাগজপত্রগুলো ডাক্তারের সামনে এগিয়ে দেয়। ঝড়ের বেগে সব দেখলেন ডাক্তার। পাশ থেকে ডাক্তারের ভারি সুন্দর অ্যাসিস্ট্যান্ট মেয়েটি এনজিওগ্রামের সিডিটা কম্পিউটারে চালু করে দেন। মনিটরে ডাক্তার এবার বেশ সময় নিয়ে সিডিটা দেখেন। ডাক্তারের কপালে ভাঁজ। দেখে বোঝাই যাচ্ছে কিঞ্চিৎ ভাবনায় পড়েছেন তিনি। রিভলভিং চেয়ারটা আচমকা ঘুরিয়ে একেবারে রাশেদুলের মুখোমুখি হয়ে এবার বলেন, ‘কত হলো বয়স?’
জহির মনে মনে বলে, সে তো প্রেসক্রিপশন আর সমস্ত রিপোর্টেই লেখা আছে। এতক্ষণ তবে কী দেখলেন! রাশেদুল উত্তর দেয়, ‘আটত্রিশ’।
‘এত অল্প বয়সে এমন কঠিন অসুখ বাঁধালেন কীভাবে? কী করেন আপনি?’
‘সরকারি চাকরি।’
সরকারি চাকরি শুনেই ডাক্তারের চোখমুখের কোথায় যেন সামান্য খুশির ঝিলিক খেলা করে। খুশিটা বোঝা যায়, আবার যায় না। বেশ আবেগমাখা কণ্ঠে বলেন, ‘শুনুন রাশেদুল সাহেব, রিপোর্টে যা দেখলাম তাতে আপনার অপারেশন লাগবেই।’ রাশেদুলকে ডেকে কাছে নিয়ে একেবারে তার কাঁধে হাত রেখে ডাক্তার নিজের হাত দিয়ে মনিটর ধরে ধরে এনজিওগ্রামের রিপোর্টটা খানিক সময় নিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে ফের বলেন, ‘সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব অপারেশনটা করিয়ে ফেলুন।’ পাশের ক্যালেন্ডারে ডাক্তার তার অনন্তকালের চোখে একবার তাকিয়ে আবার রাশেদুলের দিকে তাকান। বলেন, ‘আজ ২ তারিখ, মুশকিল হলো ১৩ তারিখের আগে কোনো সিরিয়াল নেই আমার। আপনি এক কাজ করুন, এখনই রিসিপশনে কথা বলে ১৩ তারিখের সিরিয়ালটাই নিয়ে নিন। ১৩ মিস করলে আবার কবে দিতে পারব বলতে পারছি না।’
সব শুনে তারা চেম্বার থেকে বেরিয়ে রিসিপশন কাউন্টারে এলে আরেকজন সুন্দরী, স্মার্ট মেয়ে তাদের বুঝিয়ে দেন সমস্ত ক্রাইটেরিয়া। তরতর করে বলেন, ‘অপারেশনের দুই দিন আগে এই টেস্টগুলো করিয়ে এখানে জমা দিতে হবে। অপারেশনের পূর্বে পুরো চার লাখ পঁচাত্তর হাজারই জমা দিতে হবে। পেশেন্ট যে কয়দিন আইসিইউতে থাকবে সে কয়দিন তার জন্য বরাদ্দ কেবিন খালি করে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে পেশেন্টের সাথে যিনি থাকবেন তাকে বাইরে কোথাও থাকার জায়গা খুঁজে নিতে হবে।’
জহির হাঁপ ছেড়ে মনে মনে বলে, যাক! অপারেশনের ডেট সে যা ভেবেছিল তারও তিন দিন আগে পাওয়া গেল। শুধু টাকাটা একটু বেশি হয়েছে এই যা! সাথে সাথে টাকা বেশি হওয়ার একটা যুক্তিযুক্ত কারণও অবশ্য খুঁজে বের করে জহির- যে হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সে তুলনায় পঁচিশ হাজার টাকা বেশি নয়। এত নামিদামি একজন ডাক্তার, দামি গাড়িতে করে চলেন-ফেরেন। সেই গাড়ি তো আর পানিতে চলে না! তেলের দাম কত বেড়েছে খবর আছে কারও! অপারেশনে পঁচিশ হাজার বেশি এ আর এমন কী! কিন্তু জহিরের মেজাজ খারাপ হয় অন্য কারণে। পুরো টাকাটা দেবে সে ঠিক আছে, কেবিনটা কেন পাবে না? ঝটপট বলল সে, ‘চার লাখ পঁচাত্তর হাজার টাকার মধ্যে কেবিনটা আমরা পাই, তাই নয় কি? পেশেন্টকে হাসপাতালে রেখে তার অ্যাটেনডেন্ট আবার বাইরে থাকার জায়গা কোথায় খুঁজবে?’
‘বেশি সমস্যা হলে নিচতলায় আমাদের রিসিপশনে সোফায় বসে রাত কাটিয়ে দিতে পারবেন। সবাই তাই করে।’ রিসিপশনের কর্তব্যরত সুন্দরী মিস শিউলি বললেন।
এবার ডাক্তারের রুমের এসির ন্যায় শীতল হয় জহিরের মেজাজ, আসলেই! সবাই তাই-ই তো করে। বাসে অফিস যাওয়ার সময় রোজ দেখে সে সরকার বেঁধে দেওয়া কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা থেকে শুরু করে ইচ্ছেমতো ভাড়া কাটা অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। জহির একদিন ন্যায্য ভাড়া দেওয়ার প্রতিবাদ করেছিল বটে, কন্ডাক্টর মুখের ওপর সাফ জানিয়ে দেয়, সবাই দেয়, আপনি দেবেন না কেন? শুনে জহির প্রতিবাদ করতে চেয়েছিল। ভয়ে পেরে ওঠেনি। তাকে রোজ বাসার সামনে থেকে এই ‘লোহার বাস’ পরিবহনে করেই অফিসে যেতে হয়, এটাতে করেই আবার বাসায় ফিরতে হয়। ওখানে বাস মালিক, শ্রমিকদের বিরাট সিন্ডিকেট। তাদের অনেকেই সেখানে একসাথে চা-সিগারেট এমনকি গাঁজাও সেবন করে। জহির দেখেছে বহুবার। তার ভয়, কিছু প্রতিবাদ করলে একদিন তাকে নীরবে পেয়ে বসলে ঠিক ধোলাই দেবে। শুধু বাস কেন? প্রায় সব কিছুতেই তো সবাই তাই করে একটা ব্যাপারে অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছে, যা করা উচিত নয়। এসব ভাবতে ভাবতে রাশেদুলকে নিয়ে সে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে আসে রিসিপশনে। এখানটার দামি সোফায় বসে ফের ভাবে, ঠিকই বলেছিলেন মিস শিউলি। এ রকম আরামের সোফায় বসে রাত কাটিয়ে দেওয়া কোনো ব্যাপারই না। ভাবতে ভাবতে রাশেদুলের কাছে জানতে চায়, ‘কী করবি বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?’
‘কী আর করব! আমার কী-ই বা করার আছে। সব তো ডাক্তারদের হাতে।’
“হ্যাঁ, বড় হাসপাতালের ‘স্বনামধন্য’ ডাক্তার, ছোট হাসপাতালের ‘স্বনামধন্য’ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ডাক্তার, দুজনই তো অপারেশনের কথা বলল। তোর কী সিদ্ধান্ত?’
রাশেদুলের চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। যেন চোখ কথা বলছে। যেন সুস্থ হয়ে গেছে সে। এক্ষুনি আবার সেই আগের মতো ঝপাঝপ দৌড়াবে। পটপট করে এক তলা দুই তলা তিন তলার সিঁড়ি ভেঙে উঠে যাবে তার চার তলার ভাড়া বাসার ফ্ল্যাটে। ছোট বাচ্চাটাকে কাঁধে নিয়ে খেলবে, মেজোর সাথে লুকোচুরিও। একটুও আর ক্লান্ত হবে না সে। বুকে ব্যথাও করবে না আর। ভাবতে ভাবতে জহিরের হাত দুটো নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা বল তো দেখি, এইমাত্র যাকে দেখিয়ে এলাম, ডাক্তার সর্বোপরি দাস, তিনি স্বনামধন্য হলেন কেমন করে?’
‘উনি রোজ একাধিক অপারেশন করেন। বেশিরভাগ অপারেশনই সফল। কয়েকবছর ধরে এ রকম চলে আসছে। উনার এই সফলতার খবর ধীরে ধীরে সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। তাই উনি স্বনামধন্য।’
‘ঠিকই বলেছিস। কিন্তু অপারেশন না করেও কি স্বনামধন্য হওয়া যায় না? শুধু ওষুধপত্র দিয়ে?’
‘এ কী কথা! যে রোগটা অপারেশন ছাড়া সারবেই না সেটা শুধু ওষুধে কী করে সারবে? বেকুব কোথাকার!’
“যেটা অপারেশন ছাড়াও সারবে সেটা তো করা যায়? জানি ‘অপারেশন সাকসেসফুল’ এই কথাটা শুনতে যত ভালো লাগে, এরপর ডাক্তার যত সহজে আস্থা অর্জন করেন, একটা রোগীকে ওষুধ দিয়ে, নিয়মের ভেতরে থাকতে বলে, সর্বোচ্চ সেবা আর ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ করে অত সহজে অন্যদের কাছে সেই আস্থা অর্জন করা যায় না। ‘অপারেশন সাকসেসফুল’ স্বনামধন্য হওয়ার শর্টকাট পদ্ধতি।”
রাশেদুলের কথাগুলো জহিরের মাথার ওপর দিয়ে গেল যেন। যতটুকু বুঝেছে তাতেই বলল সে, ‘তার মানে তুই বলতে চাস ডাক্তার সর্বোপরি দাস কেবল অপারেশনই করেন? ওষুধ দিয়ে রোগী সুস্থ করেন না?’
‘আমার মনে হয় রোগীকে ওষুধ দিয়ে দিয়ে অনেক দিন অপেক্ষা করে করে সারিয়ে তোলার অত ধৈর্য বা সময় কেনোটাই নেই উনার। উনি এখন অপারেশনই করেন। এই কাজে এতই অভিজ্ঞ হয়ে গেছেন যে, অপারেশন না করলেও হয় এ রকম একটা হৃদয়েও ছুরি চালাতে এখন আর হাত কাঁপে না উনার। ভালো করে খোঁজ নিলে জানবি কখনো কখনো বাধ্য হয়ে প্রেসক্রিপশনে শুধু ওষুধ লিখতে ঠিকই হাত কাঁপে। ’
‘খোলাসা করে বল তো যা বলতে চাইছিস।’
‘আমার হৃদয় ছুরির নিচে শুতে চায় না, বন্ধু। গভীর গোপনে রোজ সে আমায় বলে, তার যত্ন নিলে, তাকে ওষুধ দিলে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে সে।’
এবার ভীষণ রাগ হয় জহিরের। এ কারণেই রাশেদুলের সাথে কোথাও যেতে চায় না সে। সবখানেই কবিত্ব, কাব্য ফলায়। তবুও না গিয়ে পারে না। এক-দুই দিনের বন্ধু তো আর নয়! পাক্কা ত্রিশ বছরের বন্ধুত্ব ওদের। একসাথে স্কুলে যাওয়া শুরু, সেই থেকে চলছে। দুজনের মতের ব্যাপক পার্থক্য থাকলেও একই পথে কত হেঁটেছে তারা। কবিতা অত একটা পড়ে না জহির, ভালোও লাগে না। তাতে কী হয়েছে! রাশেদুলের কবিতার বই বের হলে জহিরই সব থেকে বেশি প্রচারণার কাজটা করে। মাঝে মাঝে দু-একটা কবিতা মুখস্থ বলে বন্ধুকে চমকেও দেয়। সে ঠিক আছে সব। কিন্তু এ রকম কঠিন এক পরিস্থিতিতে রাশেদুলের ঠাট্টা-মশকরা মোটেও ভালো লাগছে না জহিরের। জহির সেটা মুখ ফসকে বলেও ফেলে, ‘দেখ বন্ধু, এখন কাব্য ফলানোর সময় নয়। আগে সুস্থ হ, তারপর অনেক কাব্য ফলাইতে পারবি।’
রাশেদুল হাসে। নিজের ওপর প্রবল বিশ্বাসের অটুট হাসি তার ঠোঁটেও। বলে, ‘চেষ্টা করে দেখি না, এমন তো হতেও পারে, আমার হৃদয় যা বলছে, সেটাই ঠিক। অপারেশন লাগবে না। তা ছাড়া সে যখন ছুরির নিচে শুতে চাইছেই না, কী করে তাকে আমি…।’ রাশেদুল চুপ করে। তার দু’চোখে পানি থৈ থৈ। জহির আলতো করে বন্ধুর চোখের পানি মুছে দেয়। তাকে জড়িয়ে ধরে।
পরদিন শুক্রবার। তারা নতুন আরেকজন যে ডাক্তারের কাছে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার নাম ডাক্তার মোস্তাফিজ। তিনি শুক্রবার চেম্বার করেন না। একটা দিন তাই বন্ধুকে নিয়ে উদযাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে জহির। খুব সকালে তারা রমনায় হেঁটে বেইলি রোডের চকচকে এক ক্যাফেতে নাশতা সারে। রমনায় হেঁটে শাহবাগ হয়ে আজিজ সুপারমার্কেট যায়। কবিতা অত না বুঝলেও নিজের পছন্দের কিছু কবিতার বই কিনে বন্ধুকে উপহার দেয়। একই রকম টি-শার্ট কেনে। টি-শার্টের গায়ে ছোট ছোট করে বাংলা অক্ষরের ক্যালিওগ্রাফি। দুপুরে পাবলিক লাইব্রেরির ক্যান্টিনে খেয়ে পাশেই জাতীয় জাদুঘর ঘুরে দেখে। কাজের সূত্রে অনেক বছর ঢাকায় থাকে জহির, কখনো জাদুঘর দেখা হয়নি তার। আজ রাশেদুলের জন্যই হলো। সন্ধ্যায় শিল্পকলায় নাটক দেখে ঘরে ফেরে। জহিরের বউ সেই সন্ধ্যা থেকে অনেক খেটেখুটে তিনটি তরকারি রান্না করেছে। রাশেদুলের প্রিয় সাজনা দিয়ে চাপিলা মাছের ঝোলও। হলেই কী, রাশেদুল অত খেতে পারেনি। সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে, নাকি বুকে চিনচিন ব্যথা জানে না কেন, তার ভীষণ ক্লান্তি লাগছিল। অল্প খেয়ে তখনই ঘুমিয়ে পড়ে।
দুই.
দুই বন্ধু একই রকম টি-শার্ট পরে ডাক্তার মোস্তাফিজের সামনে বসা। দেখে ডাক্তার মিটমিট হেসে বলেন, ‘দুই ভাই বুঝি?’
‘না, স্যার। বন্ধু।’ জহির বলল।
‘দেখি কাগজপত্রগুলো দেন। পেশেন্ট কে?’
জহির হাতে ইশারা করে রাশেদুলকে দেখায়। বলে, ‘আপনার আগে আরও তিনজন ডাক্তার দেখিয়েছি। তাদের একজন বলেছেন অপারেশন করানো লাগবে। আরেকজন বলেছেন তিনটি রিং পরালেই হবে। একজন একধরনের থেরাপি দেওয়ার কথা বললেন, তিন মাস নিয়মিত থেরাপি নিলে নাকি হার্ট ভালো থাকবে। আসলে হয়েছে কি স্যার, রাশেদুলের বাবা-মা কেউ নেই। সংসারে স্ত্রী আর ছোট দুটো বাচ্চা। এরকম একটা বড় অপারেশনের ধাক্কা পাশে থেকে সামলানোর মতো তেমন কেউ নেই ওর। তা ছাড়া সরকারি চাকরি করে যে বেতন পায় তাতে খেয়ে-পরে বাঁচা গেলেও এ রকম ব্যয়বহুল অপারেশন করানোর মতো সামর্থ্য ওর নেই। সে ভীষণ সৎ স্যার। উপরি ইনকাম একদমই করে না।’
ডাক্তার মোস্তাফিজ জহিরের কথা শুনতে শুনতে রিপোর্টগুলোতে চোখ বোলান। একটা একটা করে সবগুলো ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনই দেখেন। রাশেদুলের চোখ ডাক্তারের মুখে। বোঝার চেষ্টা করছে তিনি কী বলেন। বুক ধুকপুক করে তার। সে বিশ্বাস করতে চায় তার হৃদয় মিথ্যা বলেনি। দ্রুতই বিশ্বাসের দেখা পেতে তর সইছে না আর। প্রবল অস্থিরতায় তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নিজে থেকেই জানতে চায়, ‘স্যার, অপারেশনটা কি করাতেই হবে?’
‘ডাক্তার মৃদু হেসে বলেন, ‘দেখুন, অপারেশন যদি করাতেই হয় তবে যতই অসুবিধার কথা বলেন লাভ আছে কোনো? নেই। যেটার যে চিকিৎসা। তবে হ্যাঁ, আপনার রিপোর্টগুলো দেখে যতটুকু যা বুঝলাম এ যাত্রায় অপারেশন না করিয়ে রিং লাগিয়ে নিলেও চলবে। আরও পরে ডাক্তারের কাছে এলে তখন হয়তো অপারেশন করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকত না। ’
পাশ থেকে জহির বলে ওঠে, ‘আরও আগেই যদি ডাক্তারের কাছে যেত, স্যার?’
‘তাহলে হয়তো শুধু ওষুধেই সেরে যেত। রিংটাও পরানো লাগত না। এমনও হয়, হৃদয়ের কথা শুনলে, তাকে অবহেলা না করলে কখনো কখনো ওষুধেরও প্রয়োজন হয় না। মুশকিলটা কী জানেন তো! আমরা হৃদয়ের কথা শুনি না। সব সময় উল্টো চলতে চাই।’
ডাক্তার মোস্তাফিজকে ধন্যবাদ জানিয়ে চেম্বার থেকে বেরোয় জহির ও রাশেদুল। চেম্বারে প্রবেশ করেন পরবর্তী পেশেন্ট। আগেই দেখিয়েছিলেন তিনি। এখন রিপোর্ট নিয়ে এসেছেন। সমস্ত রিপোর্ট দেখে প্রেসক্রিপশনে যখনই ডাক্তার অপারেশনের কথা লিখতে যাবেন, অমনি অচেনা দুই শিশুর মুখ ভেসে ওঠে তার চোখে। খুব চেনা চেনা লাগছে শিশু দুটিকে। একবার মনে হচ্ছে শিশু দুটি তারই ঔরসজাত, ফের মনে হচ্ছে এ দুটো শিশুই রাশেদুলের। আসলে ওরা কে? ভাবতে ভাবতে দেখেন তার হাত কাঁপে। কিছুই লিখতে পারছেন না সাধের প্রেসক্রিপশনে। ঠাওর করেন তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। যেন শুনতে পাচ্ছেন তার হৃদয় বলছে, ‘আজ থেকে আর অপ্রয়োজনীয় অপারেশন লিখো না প্রিয়, ডাক্তার।’
ঔষধাদির ব্যবস্থাপত্রে অপারেশন না লিখে তরতর করে কতগুলো ওষুধের নাম লিখলেন ডাক্তার মোস্তাফিজ। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, আজ থেকে আর কখনোই অপ্রয়োজনীয় অপারেশন লিখবেন না। যেমনটি লেখেন না এই শহরের অনেক ভালো ভালো ডাক্তার। এই সংখ্যা এতটাই বেড়ে যাক, যেন রাশেদুলের মতো পেশেন্টরা প্রথমবারেই একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ডাক্তারের দেখা পায়। ভাবতে ভাবতে ডাক্তার মোস্তাফিজ দেখেন ফের রাশেদুলের আগমন। হাসিতে ভরা মুখ তার। বলছে, ‘আপনাকে ধন্যবাদ দিতে ভুলে গিয়েছিলাম, তাই আবার ছুটে আসা। ধন্যবাদ, স্যার।’
রাশেদুল বেরিয়ে যায়। ডাক্তার মোস্তাফিজ স্থির তাকিয়ে আছেন রাশেদুলের প্রস্থানের দিকে। ভাবছেন, ডাক্তাররাই শুধু রোগীদের চিকিৎসা দেয় না। কখনও কখনও রোগীরাও ডাক্তারদের চিকিৎসা দিয়ে যায়।
বৈশাখী আয়োজনের আরও গল্প পড়তে:
রবিউল কমলের ছোটদের গল্প ‘তুতু’
জুঁই মনি দাশের গল্প ‘নীহারিকার বানপ্রস্থ’
জহিরুল ইসলামের গল্প ‘একজন হোসেন আলী’
রয় অঞ্জনের গল্প ‘বিজিতের বিজয়রথ’
অর্ণব সান্যালের গল্প ‘জানালায় পরকীয়া’
রোখসানা ইয়াসমিন মণির গল্প ‘দূরত্বের জলে রঙিন ফুল’
শ্যামল নাথের গল্প ‘কাদামাটির আঙুল’
গৌতম বিশ্বাসের গল্প ‘নতুন জীবন’
সারাবাংলা/এসবিডিই
গল্প-উপন্যাস পরস্পর বোঝাপড়া বৈশাখী আয়োজন বৈশাখী আয়োজন ১৪৩০ মাসুম মাহমুদ সাহিত্য