প্রাচীন আর্মেনিয়ায় হিন্দুদের ধর্মযুদ্ধ
২০ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:১৫
মূল: মেসরভ জে সেঠ, ভাষান্তর: জিয়া আরেফিন আজাদ
আমাদের অনেকেই মহান কিন্তু ভাগ্যবিড়ম্বিত জাতি আর্মেনিয়দের সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না। বাণিজ্যের প্রতি তাদের অনুরাগ সর্বজনবিদিত। অনাদিকাল থেকে তারা ভারতের সাথে বাণিজ্য করছে। অন্যান্য ইউরোপিয় বণিক, অভিযাত্রী এবং ভাগ্যান্বেষীদের অনেক অনেক আগে তারা ভারতবর্ষের মশলা, মসলিন আর মূল্যবান পাথরের আগ্রহে তাদের জন্মভূমি আর্মেনিয়ার বরফাচ্ছাদিত পর্বতরাজি থেকে নেমে এসেছিল। এই সব বাণিজ্যসম্ভার তারা স্থলপথে আফগানিস্তান, পারস্য এবং আর্মেনিয়ার সেই সময়কার রাজ্য ত্রেবিজোন্দ এর উপর দিয়ে ইউরোপের বাজারে নিয়ে যেত। এমনকি এ কথাও আস্থার সাথে বলা যায় যে মুসলমানদের আগমনেরও আগে তারা ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র আর রাজধানীগুলোতে শান্তিপূর্ণভাবে ব্যাবসা করছিল।
ঠিক কবে প্রথম আর্মেনিয়রা ভারতভূমিতে পদার্পণ করেছিল, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোন থেকে সেই তথ্য জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই উদ্যমী বণিক সম্প্রদায়ের বিষয়ে তথ্যাদি জানতে অযথাই আমরা প্রাচীন যুগের সংস্কৃত পুঁথি আর মুসলমান আমলের দলিলপত্রাদি ঘাঁটাঘাটি করেছি। রাজনীতিতে তারা মোটেই উৎসাহী ছিলেন না। ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করেছেন কদাচিৎ। সেটি সীমাবদ্ধ ছিল কেবলমাত্র ভারতবর্ষের হাট-বাজার-বিপনী বিতানে। এই ভুবনে তারা বিশাল একটা প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। কেননা, এখানকার বাজারে কোনো প্রকার বিদেশী পণ্যের অনুপস্থিতিতে তারা রফতানি বাণিজ্যে একচেটিয়াত্ব (monopoly) উপভোগ করেন। এই মনোপলি দীর্ঘসময় জুড়ে অব্যাহত ছিল।
প্রাচিন দলিলাদির নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর লেখক জানিয়েছেন, আর্মেনিয়রা প্রাচীনকাল হতেই ভারতবর্ষের সাথে পরিচিত ছিলেন, সম্ভবত, নাইনাসের স্ত্রী সেমিরামিস পরাক্রমশালী আসিরিয়ান রাজ্য ব্যাবিলনের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। জাতি হিসেবে আসিরিয়দের সমসাময়িক হওয়ার কারণে এটা ভাবা খুব অবাস্তব হবে না যে, তারা সেমিরামিসকে ভারতবর্ষ আক্রমণে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে সহযোগিতা করেছিল। তেসিয়াস ও ডিওডোরাস সাইকুলাসের মতে এই অভিযানটি খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে পরিচালনা করা হয়েছিল। বৈদিক সূত্র অনুসারে ওই সময়ে স্থাবরপতি নামে একজন যোদ্ধা ভারতবর্ষে তার বিজয় কেতন উড়াতে সক্ষম হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ সালে আর্মেনিয়রা, খুব সম্ভবত, গ্রিক বীর আলেকজান্ডারকে ভারত বিজয়ের সময় মিত্র হিসেবে অথবা কোনোভাবে সহযোগিতা করেছিল। কেননা এটা সকলেরই জানা যে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট আর্মেনিয়ার উপর দিয়ে এসে পারস্য সম্রাট দারিয়াসকে পরাভূত করে তারপর ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন। ওই সময়ে দারিয়াস থাকতেন স্থাপত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন, সেই বিশ্বখ্যাত পার্সিপোলাসে।
এ প্রশ্ন কারও মনে আসতেই পারে, আর্মেনিয় ঐতিহাসিকগণ এ সম্পর্কে কী বলেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, প্রাক-খ্রিস্টান যুগের আর্মেনিয়ার দিনপঞ্জী যে সকল মন্দিরগুলিতে সংরক্ষিত ছিল সেগুলিকে আর্মেনিয় অ্যাপোজেল সেইন্ট গ্রেগরি (আলোকবর্তিকাবাহী হিসেবে পরিচিত ছিলেন) সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলেছিলেন। চতুর্থ শতাব্দীতে যখন আর্মেনিয় রাজা টাইরেডেটস সদলবলে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন, বিশ্বের বুকে প্রথম খিস্টরাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল আর্মেনিয়া। নবদীক্ষিত রাজা আতিশয্যে সেইন্ট গ্রেগরিকে মন্দিরের সব দলিলাদি, দিনপঞ্জী ধ্বংস করে ফেলতে হুকুম করলেন।
প্রথম যে দলিলটিতে আমরা আর্মেনিয়ার ভারত সংশ্রব নিয়ে তথ্য পাই তা হলো ক্রিশ্চিয়ান আর্মেনিয়ার প্রারম্ভিক পর্যায়ের ধ্রুপদী সাহিত্যিক জেনবের লেখাতে। জেনব বা জেনোবিয়াস ছিলেন সেইন্ট গ্রেগরি, দ্যা ইল্যুমিনেটরের একেবারে প্রথম দিককার শিষ্য। তিনি তার গুরুর হুকুমে ট্যারন (আর্মেনিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ) রাজ্যের ইতিহাস লিখতে বসেন। সেই রচনায় তিনি আর্মেনিয়াতে একটি হিন্দু কলোনির অস্তিত্বের কথা ব্যাখ্যা করেন। তার মতে কলোনিটি খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি থেকে খ্রিস্টধর্মের আগমন অর্থাৎ চতুর্থ শতকের শুরু পর্যন্ত টিকে ছিল। এমনকি সেটা ৪৫০ বছরও হতে পারে। সেই সুদূর প্রাচীনকালে কীভাবে আর্মেনিয়ার মাটিতে হিন্দু বসতি গড়ে উঠল তা জানার একমাত্র সূত্র জেনবের এই রচনা। জেনবের বর্ণনা থেকে জানা যাচ্ছে যে, ওই সময়ে উত্তর ভারতে কনৌজ নগরী ছিল খুবই বিখ্যাত একটি স্থান। গিসানেহ আর দিমিতার নামে দুজন যুবরাজ কনৌজের রাজা দীনাক্ষপালের বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। ষড়যন্ত্রটি ধরা পড়ে যায়, এবং ফলশ্রুতিতে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। পালিয়ে বাঁচা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। দূরদেশ আর্মেনিয়াতে তারা যে কেবল নিরাপদ আশ্রয় পেল তা নয়, যুবরাজের জন্য মানানসই সংবর্ধনা পেল সেখানকার রাজার কাছে। সেই সময়ে আর্মেনিয়ার রাজা ছিলেন আর্সাসেডিস ডাইন্যাস্টির প্রতিষ্ঠাতা আর্সেসেস দ্যা গ্রেট এর ভ্রাতা ভ্যালারসাসেস। এই রাজবংশ খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯ সাল থেকে ৪২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আর্মেনিয়া শাসন করে।
এই ঘটনাটি ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ১৪৯ সালে। রাজা ভ্যালারসাসেস তাদের উপর বেশ খুশি ছিলেন। তিনি তাদেরকে ট্যারন প্রদেশটি বরাদ্দ করেন। সেখানে তারা ভীষপ নামে একটি নগর স্থাপন করেন। আর্মেনিয় ভাষায় ভীষপ অর্থ হল ড্রাগন। তাদের বাসভবনের নাম ছিল ‘তক্ষকের ঘর’। হিন্দু পুরান সম্পর্কে ধারণা আছে এমন সকলেই জানেন ‘তক্ষক’ অর্থ ড্রাগন। এরপর তারা প্রাক-খ্রিস্টান যুগের দেবদেবীদের জন্য বিখ্যাত অ্যাসটিসাথ শহরে গেলেন এবং সেখানে অন্যান্য দেবতাদের পাশে ভারতবর্ষে তারা যে দেবতার উপাসনা করতেন তাকেও প্রতিষ্ঠা করলেন। নতুন দেশে শান্তি তাদের কপালে ছিল না। আর্মেনিয়া আগমনের পঞ্চদশ বর্ষে তাদের পৃষ্ঠপোষক, স্বয়ং রাজা তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। তাদের এই পরিণতির কারণ সম্পর্কে এই ঐতিহাসিক কিছুই বলতে পারেন নি। হয়ত তারা নিজ দেশে যেমনটি করেছিল, ঠিক তেমনি তাদের পৃষ্ঠপোষকের বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল অথবা তার আতিথ্যের অবমাননা করেছিল। অতপর রাজা তাদের সমুচিত জবাব প্রদান করেন। মৃত্যুর পর তাদের বংশধরেরা তাদের উপর দেবত্ব আরোপ করে। আর্মেনিয়াতে তারা তাদের পরিবার ও বড়সড় দল নিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী ঘটনাপঞ্জি সেটাই প্রমাণ করে। আর্মেনিয় ঐতিহাসিদের মতে এই দুই যুবরাজের তিন পুত্র ছিল- কৌরস, মেঘতেস এবং হরিয়ান। আর্মেনিয়ার রাজা তাদেরকে কলোনির সরকার চালানোর দায়িত্ব দেন। তারা ট্যারন প্রদেশের খাজনা আদায় এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দেখাশোনা করতেন।
কৌরস একটি ছোট নগরী স্থাপন করেন এবং সেটির নাম দেন কৌর। একইভাবে মেঘতেস আরেকটি ছোট নগরী প্রতিষ্ঠা করে সেটির নাম রাখেন মেঘতি। হরিয়ান শহর প্রতিষ্ঠা করেন পলুনিয়ান রাজ্যে। সেটির নাম দেওয়া হয়- হরিয়ানস। সে দেশে নতুন এসে প্রথম প্রথম তারা বসতির জন্য উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছিলেন না। তাই, কিছুদিন পর তারা নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে ঠিক করলেন একেবারে অকর্ষিত নতুন জমি আর তৃণভূমি খুঁজে বের করতে হবে। তখন তারা খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছালেন খার্ক পাহাড়ের ঢালে। সেখানকার অপূর্ব দৃশ্যাবলী আর বাসপোযোগী পরিবেশ দেখে তারা মুগ্ধ হলেন এবং সেখানে একটি নগরী পত্তন করলেন। সেই স্বপ্নের নগরীতে তারা দুটি দেবতার মূর্তি স্থাপন করলেন। মূর্তিদুটি ছিল তাদের মৃত পিতা গিসানেহ আর দিমিতারের যাদেরকে তারা দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্রত করেছিলেন। এই দেবতা দুজনের মূর্তিদুটি ছিল পুরোপুরি পিতলে তৈরি। জেনবের ভাষ্য অনুযায়ী গিসানেহর মূর্তি ছিল ২০ হাত উঁচু আর দিমিতারেরটা ১৫ হাত। এই দুই দেবতার সেবার জন্য যে সকল পুরোহিতকে নিযুক্ত করা হয়েছিল তারা সকলেই ছিলেন হিন্দু। এই হিদেন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়, প্রভূত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে, আর্মেনিয়া রাজ্যে হিন্দু কলোনিটি যথেষ্টকাল জাঁকের সাথেই টিকেছিল। কিন্তু ৩০১ খ্রিস্টাব্দে পৌত্তলিক আর্মেনিয়ায় খ্রিস্টধর্ম আবির্ভাবের সাথে সাথে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা খুব দ্রুত গতিতে হ্রাস পেতে থাকল। কেননা, জাতীয় দেব-দেবীদের সাথে সাথে হিন্দু দেবতারাও একই পরিণতি বরণ করল। তেজি আইকোনোক্লাস্ট, সেইন্ট গ্রেগরি দ্যা ইল্যুমিনেটর, মূর্তিদুটো ধ্বংস করে ফেলেন। তিনি যখন গিসানেহ আর দিমিতারের মন্দিরদুটি মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছিলেন, প্রতিমাগুলি টুকরো টুকরো করে ফেলা হচ্ছিল, তখন পুরোহিতেরা বাধা দেবার চেষ্টা করে। তাদেরকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করা হয়। ঘটনাগুলি নিখুঁতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে প্রত্যক্ষদর্শী জেনবের বর্ষপঞ্জিতে। হিন্দু মন্দির আর দেবতাদের ধ্বংসলীলার সময় জেনব সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এই দুই মন্দিরের ধ্বংসস্তুপের উপর সেইন্ট গ্রেগরি একটি মঠ নির্মাণ করেন। সেখানে তিনি সীসেরিয়া থেকে নিয়ে আসা সেইন্ট জন দ্যা ব্যাপ্টিস্ট এবং আথানাগিনেথ দ্যা মার্টিয়ারের দেহাবশেষ স্থাপন করেন। ৩০১ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত সেই পবিত্র ভবনটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে সোজা। স্থাপনাটি সেইন্ট ক্যারাপিয়েট অব মূশ নামেই সবাই চিনে। বিশ্বের সকল প্রান্তের আর্মেনিয়দের কাছে স্থানটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। খুব স্বাভাবিকভাবেই, গিসানেহ আর দিমিতারের সেই মন্দিরের সেবায় নিয়োজিত পূজারিরা তাদের প্রাণের দেবতার এই ধ্বংসলীলা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। মূর্তিধ্বংসকারী সেই সকল বিজয়ী আর্মেনিয় সেনা, যারা এতদিন তাদেরই মত মূর্তিপূজারি ছিল, তাদের কাছে তারা জোড়হাত করে কাকুতি-মিনতি করল, নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে হলেও যেন তারা তাদের শক্তির দেবতা গিসানেহকে ধ্বংস না করে। বিজয়ী সেনাদের যজ্ঞে এটুকু বাধা দেওয়ার অপরাধে তৎক্ষণাৎ ছয়জন পুরোহিতকে হত্যা করা হল।
আর্মেনিয় ও হিন্দুদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ হিসেবে সিইয়ুনাইস গোত্রের এক আর্মেনিয় যুবরাজ কৌরস গ্রামের অধিবাসীদের কাছে গিয়ে তাদের বোঝাতে সক্ষম হল যে, শান্তির সাথে বাঁচতে হলে পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে এখন তাদের রাষ্ট্রধর্ম খ্রিস্টানত্ব গ্রহণ করাটাই সবচেয়ে বুদ্ধির কাজ হবে। তার প্রচেষ্টা বিফল হয় নি। তাদেরকে ব্যাপ্টিজমের জন্য প্রস্তুত করা হল। আইজাসান উপত্যকার কোলে সেইন্ট গ্রেগরী স্বয়ং তাদের ব্যাপ্টিজমের দীক্ষা দেন। যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, জেনব ছিল আর্মেনিয় অ্যাপোস্টেল এর অনুসারী, আর এই ঘটনারও একজন প্রত্যক্ষদর্শী। আর্মেনিয় নববর্ষ নাভাসার্দ এর দিন কৌরস গ্রামের হিন্দু অধিবাসীদের ব্যাপ্টিজমে মোট ৫০৫০ জন মানুষ উপস্থিত ছিল। সেই অনুষ্ঠানে কেবল পুরুষ ও শিশুরাই উপস্থিত ছিল। নারীদের জন্য একটি পৃথক দিনে বিশেষ আয়োজনে ব্যাপ্টিজমের ব্যবস্থা করা হয়।
সেইন্ট গ্রেগরির পিতৃসুলভ সদুপদেশ এবং নিষেধ-ভৎর্সনা সত্ত্বেও কিছু কিছু স্বধর্মত্যাগী হিন্দু মনেপ্রাণে তাদের পিতৃপুরুষের ধর্মের পূজা-পার্বণের চর্চা আঁকড়ে থাকল। তারা এমনকি এতদূর পর্যন্ত গেল, আর্মেনিয় যুবরাজদের তারা এই বলে উত্যক্ত করছিল, তারা যদি বেঁচে থাকে তা হলে তাদের উপর আর্মেনিয় যুবরাজদের নির্মম ব্যবহারের বদলা নেবে। আর যদি মারা যায় তা হলে তাদের পক্ষে তাদের দেবতা আর্মেনিয় জাতির উপর চরম শোধ নেবে। এতে আগনেহ গোত্রের যুবরাজ ক্ষিপ্ত হয়ে তাদেরকে ফাইতাখারান শহরে নির্বাসনে পাঠালেন। সেখানে তাদের বন্দি করে রাখা হল আর অপদস্থ করার জন্য তাদের মাথা মুণ্ডন করে দেওয়া হল। বন্দিদের সংখ্যা ছিল চারশ। সিরিয়ান জেনবের বর্ণনা থেকে জানা যাচ্ছে যে, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ সালে আর্মেনিয়াতে প্রথম বসতি স্থাপনের পর ৩০১ অব্দের সেই যুদ্ধ পর্যন্ত সাড়ে চারশ বছরের দীর্ঘ সময় গেছে। ট্যারনের সেই উর্বর প্রদেশে তারা যথেষ্ট সংখ্যায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে একটি উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায়ে উন্নীত হয়েছিল। তাদের প্রদেশেই ২৮৬ খ্রিস্টাব্দে ম্যামিকোনিয়ান গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা ম্যামগুনের নেতৃত্বে একটি চাইনিজ কলোনি প্রতিষ্ঠা লাভ করল। এই গোত্রে ভার্দান নামে এক যুবকের জন্ম নেয়। ৪৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি খ্রিস্টান আর্মেনিয়াকে সাসানিজদের জরাথ্রুস্ট ধর্মের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করেন। আর্মেনিয়ার হিন্দু জনগোষ্ঠি যারা খ্রিস্ট ধর্মের আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত স্বতন্ত্র একটি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব নিয়ে টিকে ছিল তারা ধীরে ধীরে স্থানীয় খ্রিস্ট ধর্মীয় জনগোষ্ঠির মধ্যে বিলীন হয়ে গেল। জেনবের বিকাশকাল ছিল চতুর্থ শতাব্দীর প্রারম্ভকাল। জেনবের পর আর কোনো খ্রিস্টান ঐতিহাসিকের বিবরণে এই সম্প্রদায়ের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় না।
আর্মেনিয়ার হিন্দু কলোনি সম্পর্কে সংক্ষেপে একটি সামগ্রিক চিত্র দেওয়ার পর এখন আমি জেনবের রচনা থেকে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য প্রদান করব। এ কথা জানিয়ে রাখা প্রয়োজন যে জেনব ছিল একজন সিরিয় এবং তার রচনাও ছিল সিরিয় ভাষায়। তবে, তার এই লেখা তিনি অবশ্যই পরবর্তীতে আর্মেনিয় ভাষায় অনুবাদ করেন। অনুবাদ করলেও সেটি সিরিয় লিপিতেই লেখা হয়েছিল কেননা ওই সময়ে আর্মেনিয় লিপির অস্তিত্ব ছিল না। সেইন্ট মেসারভ আর সেইন্ট সাহাকের যৌথ প্রচেষ্টায় বর্তমান আর্মেনিয় লিপির উদ্ভব হয়। তারা মূল সিরিয় এবং গ্রিক গ্রন্থ থেকে আর্মেনিয় ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন। বিশ্বস্ততা এবং অপূর্ব ভাষাশৈলীর কারণে এই অনুবাদ গ্রন্থকে ইউরোপিয় সন্তরা সঠিকভাবেই ‘সকল বাইবেলের রাণি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
ধ্রুপদী আর্মেনিয় ভাষায় লেখা জেনবের যে রচনা হতে আলোচ্য অংশটুকু অনুবাদ করা হয়েছে সেটি ১৮৩২ সালে প্রথম প্রকাশ হয় ভেনিসে। বিজ্ঞ মেখিথারিস্ট ফাদারগণ বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রকাশিত পাঁচটি স্বতন্ত্র পাণ্ডুলিপি অত্যন্ত সতর্ক পর্যবেক্ষণের এই টেক্সটটি চূড়ান্ত করেন। এর প্রথম অংশে আছে আর্মেনিয়ার হিন্দু কলোনির বিবরণ। এর পরে আমরা পাই চতুর্থ শতাব্দীতে পৌত্তলিক আর্মেনিয়ায় হিন্দু ও প্রথম যুগের খ্রিস্টান প্রচারকদের মধ্যে সংঘটিত বিভিন্ন ধর্মযুদ্ধগুলোর সচিত্র বিবরণ। সিরিয়ান জেনব বর্ণনা করেছেন ৩০১ খিস্টাব্দে তিনি যখন সেইন্ট গ্রেগরি, দ্যা ইলুমিনেটরের সাথে আর্মেনিয়ায় আসেন তখন তারা প্রথমবারের মত হিন্দু জাতির দেখা পেলেন।
বর্ণিত আছে, ‘এই মানুষগুলি ছিল অদ্ভুৎদর্শন, কালো ও লম্বা-চুলবিশিষ্ট। দৃষ্টির জন্য এরা খুবই অস্বস্তিকর কারণ এরা ছিল জাতিতে হিন্দু। এখানে দিমিতার ও গিসানেহ নামে দুইটি দেবতার মুর্তি ছিল। এই দেবতা দুইজনের উৎস ভারতে এবং তারা যুবরাজ ও পরস্পর ভাই। তারা তাদের রাজা দীনাক্ষীর বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে রাজা তাদের দমন করতে সেনা পাঠায়, হয় তাদের হত্যা করতে অথবা রাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে। কোনোমতে জীবন রক্ষা করে তারা রাজা ভ্যালারসাসেসের রাজ্যে আশ্রয় নেয়। রাজা তাদেরকে ট্যারন জেলার অধিকর্তা নিয়োগ করেন। সেখানে তারা ভীষপ নামে একটি নগর নির্মাণ করেন।
পরে তারা অ্যাসটিসাথ নামে একটি শহরে বসতি স্থাপন করেন। ভারতবর্ষ থাকতে তারা যে সব দেব-দেবির আরাধনা করতেন তারা সেখানে সেই সব দেব-দেবির মূর্তি স্থাপনা করেন। পনেরো বছর পর কোনো এক অজ্ঞাত কারণে রাজা তাদের দুইভাইকেই মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন এবং তাদের সন্তান কৌর, মেঘতেস ও হরিয়ানের উপর রাজ্য সামলানোর দায়িত্ব দেন। মেঘতেস সেখানকার সমভূমিতে মেঘতি নামে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। হরিয়ান পালুনিজ প্রদেশে হরিয়ানস নামে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন।
কিছুদিন পর কৌর, মেঘতেস ও হরিয়ান খারকি নামে একটি পাহাড়ে গিয়ে বসতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন কারণ স্থানটি ছিল শীতল এবং তৃণ, বন ও শিকারে পরিপূর্ণ। সেখানে তারা বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করেন এবং গিসানেহ ও দিমেতারের নামে দুইটি মুর্তি স্থাপন করেন। মুর্তি দুইটি দেখাশোনার জন্য নিজেদের বংশধরদের মধ্যে থেকে সেবক নিয়োগ করেন।
গিসানেহর ছিল লম্বা ঢেউ খেলানো চুল। সেই কারণে তার পুজারিরা মাথায় লম্বা চুল রাখত। রাজা তাদেরকে চুল কাটার হুকুম দেন। এই লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষের বিশ্বাসে ভীষণ অনুরক্ত ছিল। খ্রিস্টান ধর্মমতে দীক্ষা নেওয়ার পর যেহেতু তারা প্রকাশ্যে পেগান বিশ্বাসের চর্চা করতে পারছিল না, তারা একটা ছলনার আশ্রয় নেয়। তাদের সন্তানদের তারা মাথায় ঠিক চাঁদিতে এক গুচ্ছ চুল রাখার অভ্যাস গড়ে তুলে। এভাবে তারা তাদের মনে পৌত্তলিক অতীতের অবমাননার স্মৃতি জাগরুক রাখতে চেয়েছে।’
৩০১ খ্রিস্টাব্দে আর্মেনিয়ার মধ্যে দিয়ে ভ্রমণকালে জেনব হিন্দু ও আর্মেনিয়ানদের মধ্যে যে যুদ্ধ দেখেছেন তার বিবরণ দিয়েছেন এভাবে- ‘থোরডান থেকে প্রস্থান করার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কারিন এবং হারখ অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে। কিন্তু কিছু আর্মেনিয়ান যুবরাজ সেইন্ট গ্রেগরিকে অবহিত করল যে, ট্যারন অঞ্চলে দুইটি মন্দিরে তখনও শয়তানের উপাসনা চলছে। অতঃপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সেগুলিকে ধ্বংস করার। পালুনিজ রাজ্যে আসার পর কুয়ার্স নামের গ্রাম্য শহরতলীর পাশে গিসানেহ নামের বিশাল এক গ্রামে আমরা কিছু হিদেন পুরোহিতের দেখা পেলাম। হিন্দু যুবরাজ হস্তিনের কাছে তারা যখন জানতে পারল পরদিন গিসানেহ এবং দিমিতারের পবিত্র মুর্তি দুইটি মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হবে তখন তারা সেই রাতেই মন্দির হতে সমস্ত অলংকার মণি-মানিক্য খুলে নিয়ে মাটির নিচে গোপন কোনো স্থানে লুকিয়ে রাখল।
অতঃপর তারা অ্যাসটিসাথের পুরোহিতদের কাছে সৈন্যসংগ্রহের জন্য মিনতি জানাতে থাকলো এবং পরদিন সকালে তাদের সাথে যুক্ত হতে অনুরোধ করল। কারণ প্রতিপক্ষ আর্মেনিয়ানদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করতে মহান গিসানেহ তাদের সঙ্গ দেবে। সেই অনুযায়ী তারা কুয়ার্সের অধিবাসীদের বাগানের ঝোপের মধ্যে গেরিলা ভঙ্গিতে শায়িত হতে নির্দেশ দিল। আর কিছু লোককে বনের এক প্রান্তে খ্রিস্টানদের জন্যে অ্যামবুশ করতে পাঠালো। প্রধান পুরোহিত আর্তজান (অর্জুন) ও তার ছেলে দিমেতার চারশত সৈন্যদলের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন এবং তাদের নিয়ে কুয়ার্সে অবস্থান নিলেন। কুয়ার্সের বিপরীতে যে পাহাড় সেটিতে আরোহন করে তারা অন্যান্য স্থান থেকে সরবরাহ আসার জন্য কিছু সময়ের জন্য থামলো। স্বভাবসুলভ লুটতরাজের বাসনায় পরদিন তারা পাহাড়ের পাদদেশে অবতীর্ণ হল। দিনের তৃতীয় ঘণ্টায় আর্তজ্রুনিস, আন্দেজেভাতিজ ও আনগেজ এর যুবরাজ তিনশো সৈন্য নিয়ে সেইন্ট গ্রেগরি পাহাড় বেয়ে ওঠার সময় আর্তজান যেখানে ওঁৎ পেতে ছিল সেখানে আসলেন। তারা অসতর্কভাবে চলছিলেন কেননা তারা কোনোভাবেই ভাবতে পারেননি পাহাড়ের এই উচ্চতায় তাদের জন্য বিপদ আছে। হঠাৎ করে ট্রামপেট বেজে উঠলো আর গোপন আস্তানা থেকে ক্ষিপ্রতার সাথে আর্তজান ও দিমেতার বেরিয়ে এসে তাদের উপর আক্রমণ চালালো। যুবরাজদের ঘোড়াগুলি ভীত হয়ে উচ্চস্বরে হ্রেস্বাধ্বনি করতে থাকলো। যুদ্ধের উত্তেজনা দেখে যুবরাজগণ অস্থির ও সতর্ক হয়ে উঠলেন। আনগেজের যুবরাজ বললেন, ‘সিউইনিজের যুবরাজ, সামনে অগ্রসর হোন। এরা সম্ভবত উত্তরের যুবরাজের সৈন্য।’ তিনি সামনে আগালেন কিন্তু বুঝতে পারলেন না এরা কারা। ফিরে এসে সিউইনিজের যুবরাজ বললেন, ‘সেইন্ট গ্রেগরি ও তার সঙ্গিদের কোনো নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। তারা যদি শত্রুদের হাতে ধরা পড়েন তা হলে রাজার সামনে আমাদের কোনো মুখ থাকবে না।’ তিনি আরও বললেন, ‘আমাদের সৈন্যদের ডেকে আনতে একজন বিশ্বস্ত লোক পাঠান। মনে হচ্ছে খুব বড় একটা যুদ্ধ হবে কেননা প্রতিপক্ষ শিবিরে অসংখ্য পতাকা উড়তে দেখছি।’
অতঃপর আনগেজের যুবরাজ মকের যুবরাজের হাতে সেইন্ট গ্রেগরির সুরক্ষার দায়িত্ব দিলেন। তিনি সেইন্ট গ্রেগরিকে ওঘকানের দুর্গে পৌঁছে দিতে এবং সেখান থেকে সৈন্য ও রসদ পাঠিয়ে পরবর্তী পরিস্থিতি নজর রাখতে নির্দেশ দিলেন। সেইন্ট গ্রেগরিকে নিয়ে মকের যুবরাজ কৌরাসের উদ্দেশ্যে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামছিলেন। কিন্তু সেখানকার অধিবাসীরা তাদের পথ অবরোধ করল। সেইন্ট গ্রেগরি তার সাথে করে যে রেলিকসগুলো নিয়ে এসেছিলেন বিপদ দেখতে পেয়ে সেগুলি পাহাড়ের অপর পাশে একটি ঝর্ণার ধারে লুকিয়ে রাখলেন। ওই স্থানটি তারা এমনভাবে চিহ্নিত করে রাখলেন যাতে কেউ বুঝতে না পারে কিন্তু সেইন্ট গ্রেগরি ফিরে এসে তা উদ্ধার করতে পারে। গ্রামের লোকেরা আমাদের ধাওয়া করলেও ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হওয়ার কারণে তারা আমাদের ধরতে পারলো না। আমরা ওঘকানের দুর্গে পৌঁছে গেলাম। সেখানকার কর্মীরা আমাদের গ্রহণ করতে এগিয়ে আসলো। গ্রামের হিন্দুরা তখন কুয়ার্সে চলে গেল এবং সেখানকার লোকদের আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জানালো। এই সংবাদ পেয়ে তারা এখানে এসে ওঘকানের দুর্গ অবরোধ করল। ভীতি ও আশংকা নিয়ে আমরা একজন দূতের মাধ্যমে অবরোধের পরিণতি সম্পর্কে আনগেজের যুবরাজের কাছে বার্তা পাঠালাম। তিনি তড়িৎ চার হাজার বাছাইকৃত সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরণ করলেন যাদের হাতে ছিল তরবারি। তারা নদী পার হয়ে পরদিন এখানে চলে আসলো। তারা তিন দিন কুয়ার্স শহর অবরোধ করে রাখল। প্রতিরক্ষা দেওয়াল চুরমার করে স্থানটিকে তারা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করল। সেখানকার অধিবাসীরা পালিয়ে মেঘতেসে আশ্রয় নিল।
এই সংবাদ পেয়ে আর্মেনিয়ান যুবরাজেরা পাহাড় বেয়ে নেমে আসলো। তারা দেখলো চারশো লোক নিয়ে আর্তজান সেখানে ওঁৎ পেতে আছে। সাহসী যুবরাজেরা তৎক্ষণাৎ প্রচণ্ড আক্রমণ করে তাদেরকে পশ্চাদপসরনে বাধ্য করল। যুদ্ধের আওয়াজ শুনে আর্মেনিয়ান সৈন্যরা দ্রুত পাহাড়ের সন্নিকটে উপস্থিত হল। তখন আর্তজান আর্মেনিয় যুবরাজদের উদ্দেশ্যে যুদ্ধের আহ্বান করতে শুরু করল। সে বললো, ‘সামনে আয়, নীচ বেঈমানের দল! তোরা তোদের বাপ-দাদার ভগবানকে পরিত্যাগ করেছিস। তোরা মহাপ্রভু গিসানেহর শত্রু। তোরা কি জানিস, আজ তোদের বিরূদ্ধে যে যুদ্ধ সেটা স্বয়ং গিসানেহ পরিচালনা করছেন। তিনি তোদেরকে আমাদের হাতে পরাজিত করবেন এবং তোদেরকে মৃত্যু অথবা অন্ধত্ব বরণ করতে হবে।’
এই কথায় আর্তজ্রুনিসের যুবরাজ ক্ষিপ্র গতিতে সামনে এগিয়ে এসে হুংকার ছাড়লো, ‘ও রে বাকওয়াজ, তুই যদি তোর ঈশ্বরের জন্য লড়াই করিস তা হলে জেনে রাখ, তুই মিথ্যার উপর আছিস। আর যদি তুই তোর দেশের জন্য লড়াই করিস তা হলে তুই বোকার স্বর্গে আছিস। দেখ, আনগেজ এর যুবরাজ, সিউইনিসের যুবরাজ আরও যত অভিজাত এদের তুই ভাল করেই চিনিস।’
এই কথায় আর্তজানের পুত্র দিমেতার জবাব দিল, ‘ও আর্মেনিয় যুবরাজেরা, আমার কথা শোন, আজ চল্লিশ বছর হয় আমরা এই পরাক্রমশালী দেবতাদের সেবায় নিয়োজিত। এদের ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা অবহিত। এরা তাদের সেবকের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করেন। এটা আর্মেনিয়ার রাজার দেশ আর আপনারা তারই সভার অভিজাতবৃন্দ। এই দেশে আমরা আপনাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করে টিকতে পারব না। কিন্তু এ কথাও জেনে রাখুন, আমরা হয়ত আপনাদের পরাজিত করতে পারব না, দেবতাদের সম্মান রক্ষার্থে মৃত্যুবরণ করাও আমাদের জন্য অনেক গৌরবের। বেঁচে থেকে তাদের মন্দিরগুলির অবমাননা দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অতঃপর মৃত্যু আমাদের কাছে জীবনের চেয়ে বেশি আকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু আপনারা, আগনেজ এর যুবরাজেরা সামনে আসুন এবং মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হন।’
আনগেজের যুবরাজ এবং আর্তজান দুজনে সামনে এগিয়ে আসলো। তারা একে অপরের চারিদিকে ঘুরতে থাকলো। হঠাৎ অর্জুন তার বর্ষা দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীর উরুতে আঘাত করল যাতে সে অনেকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়তে উদ্যত হল। কিন্তু আনগেজের যুবরাজ আবারও উঠে দাঁড়ালো এবং প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ও হে আর্তজান, তুমি কি জানো, এই জায়গাটার নাম হবে আর্তজান (আর্মেনিয় ভাষায় অর্তজান অর্থ মূর্তি) কারণ তুমি এখানে মূর্তির মত নিথর হয়ে পড়ে থাকবে।’ এরপর তার বাহুটা তুলে প্রচণ্ড শক্তিতে তার ঘাড়ের ডান দিকে এমন এক আঘাত করল যে আর্তজানের বাম কাঁধ থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত শরীরের অর্ধেকটা আলাদা হয়ে গেল। আর্তজান মাটিতে লুটিয়ে গড়াতে থাকলো। তারা তার শবের উপর মাটি চাপা দিল। যে মাটিতে সে সমাহিত হল সেই পাহাড়টিকে আজ আর্তজান নামে ডাকা হয়। এই ঘটনার পরই ভীষপ শহর থেকে পুরোহিতদের সৈন্যরা সাথে পারতুখ ও মেঘতির লোকেদের নিয়ে ঘটনাস্থলে সমবেত হল। বাকিরা আসলো আস্তাগন থেকে। তাদের নিজেদের বয়ান অনুযায়ী তাদের মোট সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার চারশত পঞ্চাশজন। যখন তারা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাল তখন দুই পক্ষেই চরম হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা চলছিল। এর মধ্যে হিদেন সৈন্যরা আর্মেনিয় সৈন্যের উপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে পালাতে বাধ্য করল। পাহাড় থেকে নেমে তারা গ্রামের দিকে ছুটতে থাকলো। সেইখানে ওঁৎ পেতে থাকা গ্রামবাসীরা আমাদের সৈন্যদের বাঁধা দিল। তারা দুই দিক থেকে তরবারি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু আনগেজের যুবরাজ হিন্দু পুরোহিতদের প্রতিরক্ষা ভেদ করে পেছন দিক থেকে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে গেল যেখানে কিছু শত্রু সৈন্য সংরক্ষিত ছিল। তারা আমাদের ঘোড়াগুলির উপর পাথর নিক্ষেপ করে মারাত্মক আতংকের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু দিমেতার যখন আনগেজের যুবরাজকে পাহাড় বেয়ে উঠতে দেখলো তখন তিনি তার সৈন্যদের পেছনে রেখে যুবরাজকে ধাওয়া করলেন। অশ্বারোহী সৈন্যরাও তাকে অনুসরণ করল।
তারা উপরে উঠলে আবারও যুদ্ধ শুরু হল। আমাদের যুবরাজেরা আরও সৈন্য সরবরাহের জন্য অপেক্ষা করছিল কারণ তখনও সব সৈন্য সমবেত হয়নি। মেঘতির বন্দিদের জন্য চার হাজার সৈন্য নিয়োজিত ছিল। বাসিয়ান আর হারখের উদ্দেশ্যে আরও তিন হাজার সৈন্য অগ্রসর হচ্ছিল। বাকিরা তখনও মাঠের মধ্যে লুটতরাজে ব্যস্ত ছিল। চূড়ান্ত আঘাতের জন্য যখন তারা যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তখন দিনের আলো ফুরিয়ে আসলো। পরদিন সকাল পর্যন্ত তারা সেখানে তাঁবু খাটালো। ভোরবেলা অবশিষ্ট আর্মেনিয় সৈন্যরা সেখানে সমবেত হল। আর ও দিকে তিরাকাতার শহর থেকে হিদেন পুরোহিতদের দলে আরও পাঁচশো লোক যোগ দিল। এইভাবে দুই পক্ষেই সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। হিদেনদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ছয় হাজার নয়শত ছিচল্লিশ, অপরপক্ষে আর্মেনিয় যুবরাজদের দলে ছিল সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার আশি।
ট্রামপেট বেজে উঠলো। উভয়পক্ষ যুদ্ধের জন্য সারিবদ্ধ হয়ে নিজ অবস্থানে দাঁড়ালো। যুদ্ধের শুরুতে আর্মেনিয়রা হিদেনদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। হস্তিনের যুবরাজ যদিও দিমেতারের মতই একজন হিন্দু, সে ছিল আর্মেনিয় বাহিনীর একজন অধিনায়ক। সহসা সে সাতশো সৈন্য নিয়ে আত্মপক্ষ ত্যাগ করে হিদেনদের পক্ষ নিল এবং আর্মেনিয় যুবরাজদের বিরূদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হল। আর্মেনিয় সৈন্যরা তাকে এই চেহারায় দেখে হতাশায় ভেঙে পড়ল এবং তার আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কারণ সে ছিল অসামান্য শক্তির একজন যোদ্ধা, তার ছিল অদম্য স্পৃহা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তার বিস্তর অভিজ্ঞতা ছিল। আর্মেনিয় যুবরাজদের সকলেই তার সামনে ছিল কম্পমান। বিরতিহীন দুর্মর আঘাতে আর্মেনিয় সৈন্যরা চিৎকার করে সিউইনিজের যুবরাজের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করল। সিউইনিজের যুবরাজ হুংকার দিলেন, ‘শোন, নেকড়ের বাচ্চা! তোর স্বভাব হল তোর বাপের মত। তুই তো মরার মাংস খেয়ে বাহাদুরি করিস।’
প্রত্যুত্তরে বিদ্রোহী যুবরাজও দাঁত খিঁচানি দিয়ে বললো, ‘তুমি তো ঈগলের বাচ্চা, খুব গর্ব কর তোমার শক্ত ডানা নিয়ে। কিন্তু একবার যদি তুমি আমার বাগে পড় তা হলে দেখিয়ে দেব আমার শক্তি।’
সিউইনিজের যুবরাজ এই টিটকারি সহ্য করতে পারলো না। প্রচণ্ড ক্রোধে তার দিকে ধেয়ে তিনি তার কুড়ালটা দিয়ে হস্তিনের যুবরাজের শিরস্ত্রাণে সজোরে আঘাত করলেন। আঘাতের ঝাপটা সামলাতে সে তার বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। এই অবস্থায় তাকে অনেকদূর ধাওয়া করে পূর্বদিকের পাহাড় পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। ইন্নাকিয়ান (নয়টি ঝর্ণা) নামের সেই স্থান পর্যন্ত তাকে তাড়া করে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি তাকে ঝটিকা আঘাতে ঘোড়া থেকে নিচে ফেলে দিলেন। এরপরে ঘোড়া থেকে নেমে তিনি তরবারির আঘাতে তার মাথাটা ধর থেকে আলাদা করে দিলেন আর সেই মুণ্ডটা পাহাড়ের ঢালে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, ‘শকুনিরা এখন তোকে দেখবে আর জানবে কীভাবে ঈগল খরগোশটাকে মেরেছে।’ এই ঘটনার পর সিউইনিজের যুবরাজ দ্রুত যুদ্ধের ময়দানে তার সৈন্যদলের কাছে ফিরে আসলেন। যে স্থানে হস্তিনের বিদ্রোহী যুবরাজের পতন হয়েছিল, ওই দিন থেকে স্থানটির নাম হল ঈগলস।
এরপর আর্তজ্রুনিসের যুবরাজ অ্যাসটিসাথের প্রধান পুরোহিত মেতাকেসের বিরূদ্ধে আক্রমণ চালালেন। তাকে তিনি পাহাড়ের চূড়া, যেখান থেকে সমগ্র যুদ্ধক্ষেত্রটা দেখা যায়, সেই পর্যন্ত তাড়া করে নিয়ে গেলেন। তিনি যখন সেখানে পৌঁছালেন মেতাকেস ভীষণ প্রতিরোধ গড়ে তুললো। এক পর্যায়ে যুবরাজের উরুতে একটা আঘাত করল সে। এই আঘাতে আর্মেনিয় যুবরাজ ক্রোধে জ্বলে উঠলেন। তিনি তার কৃপাণটা দিয়ে এক কোপে মেতাকেসের গর্দানটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। অতঃপর তিনি মেতকেসের মুণ্ডহীন দেহটা পাহাড়ের নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। যে স্থানে এই ঘটনাটা ঘটেছিল সে জায়গার নামা রাখা হল মেতসাকগ।
এই অবস্থা দেখে আরজুতের হিন্দু যুবরাজ একটি গোপন স্থানে আশ্রয় নিলেন। আর্তজ্রুনিসের যুবরাজ সে দৃশ্য দেখেও না দেখার ভান করলেন। তারপর তিনি পলাতকের পিছু নিয়ে তাকে হঠাৎ আক্রমণ করে বসলেন। আরজুতের যুবরাজ প্রাণভয়ে বনের মধ্যে দৌড় দিলেন। তড়িঘড়ি পালাতে গিয়ে গাছ থেকে ঝুলে থাকা একটি ধারালো কাণ্ডের আঘাতে তার হৃদযন্ত্র ও যকৃৎ এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেল এবং তিনি অকুস্থলেই প্রাণত্যাগ করলেন। বিজয়ী যুবরাজ দুইটি ঘোড়া নিয়ে ফিরে আসলেন এবং সেই থেকে জায়গাটার নাম হল আরজুতের উপত্যকা।
ফিরে এসে তিনি দেখলেন দিমেতার ও আনগেজের যুবরাজ মল্লযুদ্ধে লিপ্ত। আনগেজের যুবরাজ তড়িৎ একটা আঘাতে দিমেতারের ডান কাঁধটা বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন এবং দিমেতার মাটিতে পড়ে গেল। এরপর তিনি তার মাথাটা বিচ্ছিন্ন করে সেটা তার ঝোলাতে ছুঁড়ে দিয়ে সে স্থান ত্যাগ করলেন। আর্মেনিয়রা এরপর হিদেন সৈন্যদের উপর তাণ্ডব চালিয়ে তাদের এক হাজার আটত্রিশ জনকে কচুকাটা করলেন। বাকি যারা ছিল তাদের সব সম্বল কেড়ে নেওয়া হল। এই যুদ্ধে দিমেতার মকের যুবরাজের পুত্রকে হত্যা করেছিল। এই ঘটনা আর্মেনিয়দের মধ্যে গভীর শোকের সৃষ্টি করে। দিমেতার যখন পরাভূত হল তখন সিউইনিজের যুবরাজ ট্রামপেটে শান্তির ধ্বনি বাজালেন। দুইপক্ষই একে-অন্যকে হত্যার অবস্থান থেকে থেমে গেল। যে সকল হিন্দু পুরোহিত তখনও বেঁচে ছিল তারা মৃতদের সমাহিত করার জন্য আর্মেনিয় যুবরাজদের অনুমতি প্রার্থনা করল। এই অবেদন সাথে সাথে মঞ্জুর হল। দুইপক্ষের মৃতদেহগুলি এক জায়গায় জড়ো করা হল এবং নিচু একটা ভূমিতে তাদের সমাহিত করা হল। তাদের কবরের উপরে স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড় করানো হল যেখানে সিরিয়ান, হেলেনিক ও ইসমায়েলেতিশ ভাষায় নিচের কথাগুলি খচিত হল-
“এই ভূমিতে সংঘটিত প্রথম এক প্রচণ্ড যুদ্ধ। যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, প্রধান পুরোহিত আর্তজান এবং তার সাথে আরও এক হাজার আটত্রিশজন এখানে শায়িত আছে।
আমরা যুদ্ধ করেছি দেবতা গিসানেহ এবং খ্রিস্টের মর্যাদা রক্ষার্থে।”
নোট: জেনবের বর্ণনায় কিছু হিন্দু নামসমূহের সম্ভাব্য অর্থ হতে পারে এমন- গিসানেহ সম্ভবত কৃষ্ণের অপভ্রংশ। দিমেতার সম্ভবত জগন্নাথ বা গনেশের হেলেনিক সংস্করণ। হিন্দু পুরান অনুযায়ী তারা দুজনে যথাক্রমে ধরিত্রী ও সৃষ্টির দেবতা। অনুরূপভাবে কুয়ার্স হতে পারে কৈলাস, মেঘতেস হতে পারে মুক্তি, হরিয়ান হতে পারে হরেন্দ্র এবং আর্তজান হল অর্জুন। এর সবগুলিই প্রাচীন ভারতের প্রকৃত হিন্দু নাম।
লেখক পরিচিতি: মেসরভ জ্যাকব সেথ (১৮৭১-১৯৩৯) ছিলেন কোলকাতা নিবাসী একজন আর্মেনিয়ান লেখক, ইতিহাসবিদ ও শিক্ষাবিদ। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ও ক্লাসিকাল আর্মেনিয় ভাষার এক্সামিনার পদে নিয়োজিত ছিলেন। এ ছাড়া রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের সদস্য ছিলেন। ইতিহাস বিষয়ে তার সেরা রচনা Armenians in India। মেসরভের এই প্রবন্ধটি ১৯২৭ সালে Calcutta Historical Society এর জার্নাল Bengal Past and Present এর তেত্রিশতম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, হবিগঞ্জ
সারাবাংলা/এসবিডিই
জিয়া আরেফিন আজাদ প্রবন্ধ প্রাচীন আর্মেনিয়ায় হিন্দুদের ধর্মযুদ্ধ সাহিত্য