প্রেম এবং ইত্যাদি
২০ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:২৮
আনিসের বস একজন অতি রূপবতী ভদ্রমহিলা। নিজেই একটা গাঢ় নীল গাড়ি ড্রাইভ করে অফিসে যাতায়াত করেন। ঈদের আগের দিনও উনি অফিসে এসে বসে আছেন। পুরো অফিস ফাঁকা। আনিসের উনার উপর প্রচন্ড বিরক্ত হওয়া উচিৎ, কিন্তু হচ্ছে না। হাসিমুখে চিনি ছাড়া কফি নিয়ে প্রবেশ করল ম্যামের রুমে। ম্যাম ওর সাথে কখনোই কোনও কথাবার্তায় যায় না। পিয়ন শ্রেনীর কারও সাথে উনি কথা বলবেন না, এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। আজ রীতিমতো চমকে দিয়ে বললেন- তুমি এখন চলে যেতে পার, তোমার ডিউটি শেষ। তোমাকে এবং তোমার পরিবারের সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। আনিস উনাকে ঈদের শুভেচ্ছা না বলেই দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। অফিসের সিঁড়ি বাড়ির কাছের নদীর পাড় মনে হয়ে বিভ্রম হল ওর! আনিসের ঢাকায় ভাল লাগে না, ভাল লাগে বাড়ির কাছের নদীর পাড়ে বেড়াতে। দ্রুত ব্যাগ গুছাতে গিয়ে ছিঁড়ে গেল ব্যাগের চেনটাও। যাক যাক ছিঁড়ে যাক, বাড়িতেই তো যাচ্ছি, মা গাল ভরা হাসি নিয়ে জড়িয়ে ধরলে কিসের ব্যাগ কিসের কি! আর বন্ধু মৃদুল, তন্ময় ওরা তো আছেই। মৃদুলটা যা সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, প্রাণটা ভরে যায়। ওরা অবশ্য চাকরিও করে ভাল। আনিস অবশ্য নিজের অবস্থান কখনও ওদের বুঝতে দেয় না। সেও বিরাট চাকরি করে এরকম একটা ভাব ধরতে খুব একটা কষ্টও করতে হয় না।
ঈদের একদিন পরেই আনিস ফিরে এল ঢাকায়, অথচ ছুটি আরও দুইদিন। যথারীতি অফিসের পার্কিংয়ে দেখল, নীল গাড়ি। আনিস পরিচ্ছন্ন মগে কফি নিয়ে ঢুকতেই নিশিনূর ভড়কে গেলেন। হাত থেকে মোবাইলটা রেখে থতমত গলায় বললেন, ছুটির শেষ হবার আগেই চলে এসেছ? তাছাড়া খবর দেখোনি? খবর! কি খবর ম্যাম? নিশিনূর বুঝতে পারল নগরের বাইরে যে কোনও ব্যাপার ছড়াতে সময় লাগে। মৃদু হেসে বললেন- এটা কি নতুন পাঞ্জাবি নাকি? আনিস সম্ভবত তার ২৮ বছরের জীবনে এতো আনন্দিত হয়নি। ম্যাম তার পাঞ্জাবি খেয়াল করে প্রশ্ন করেছেন! ভাবা যায়! আনিস বলল- জ্বি ম্যাম, নতুন। মার জন্য শাড়ি, ছোট বোনটার জন্য একটা জামা, এই তো আমার ঈদ।
ম্যাম, মোবাইলে মনযোগ দিলেন। আনিসের বের হতে ইচ্ছে করছে না, তবুও গ্লাসের দরজা ঠেলে বেরিয়ে নিজের বসার জায়গায় গিয়ে বসলো। ঈদে সে আরও একটি জিনিস কিনেছে। কিন্তু, যার জন্য কিনেছে দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। যদিও তার পাঞ্জাবির পকেটেই আছে জিনিসটা। একটা চারকোণা গ্লাসের ভেতর নীল পাখি। জীবন্ত না! ঘরে সাজিয়ে রাখা যায়, একটা সুইচ আছে সেটা টিপ দিলে গ্লাসের ভেতর আলো জ্বলে। পাখি নিয়ে ভাবতে ভাবতে আনিস ওয়েস্ট পেপারগুলো সরিয়ে অফিস গোছগাছ করছে। মনে মনে ভাবছে, ম্যাম এরকম কেন? কোনও উৎসব করেন না, সারাক্ষণ অফিসের ঘরটায় বসে থাকেন, উনার বাড়ির লোকজন উনাকে কিছু বলে না! নাকি উনার কেউ নেই?
তখনই বেল বাজলো! আনিস খুশি হয়ে গেল, ম্যাম তো অনেক দীর্ঘজীবী হবেন। যদিও আনিস সারাক্ষণই তার কথাই ভাবে, সুতরাং বেল চাপলেই দীর্ঘদিন পৃথিবীতে থাকার সম্ভাব্য প্রবচনটা খাটছে না। ও প্রায় দৌড়ে নিশিনূরের ঘরে প্রবেশ করল। নিশিনূর বিরক্ত মুখে বলল- সম্ভবত গাড়ির চাবিটা নিচে কোথাও ফেলে এসেছি। দেখো তো একটু নিচে। আনিস গাড়ির কাছে গিয়েই চাবি পেলো, নিচেই পরে আছে! উপরে এসে চাবি দিলো। নিশিনূর বললেন- বুড়ো হয়ে গেলে এসব হয়, চাবি কখন পড়ে গেছে টেরই পাইনি। আমি বের হচ্ছি। ওই কালো ব্যাগটা একটু নাও তো, গাড়িতে দিয়ে এসো। আনিসের খুব প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে কই চললেন! কিন্তু সেই দুঃসাহস না দেখিয়ে, সে পেছন পেছন লিফট পর্যন্ত গেল। লিফটে উঠে ম্যাম বললেন- অফিস যেদিন খুলবে সেদিন এসো। এরমধ্যে ঘর থেকে বের হবার দরকার নাই।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার টাকা আছে? ম্যাম ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে দিলেন। আনিস কিছুই বুঝতে পারছে না, এতগুলো টাকা কেন দিচ্ছেন হুট করে!
অন্য সবদিনের মতই আনিস গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে, নিশিনূর তার ড্রাইভিং সীটে একটি বক্স দেখে, চেহারায় চিন্তিত ভাব ভেসে ওঠে। তিনি বক্সটা হাতে নিয়ে আনিসকে জিজ্ঞেস করলেন- এটা কি, এখানে কিভাবে এল! জানিনা তো, ম্যাম! খুলে দেখো তো! আনিস নিজের রাখা উপহার নিজেই খুলছে, মলিন মুখে। ম্যাম কি এটা সামনের ডাস্টবিনে ফেলে দেবেন! ওর বুক ধড়ফড় করছে। চাবির সুযোগ পেয়ে বক্সটা রাখা উচিৎ হয়নি, অন্যায় হয়ে গেছে! ম্যাম বুঝে ফেললে চাকরি চলে যাবে! আনিস পাখিটা বের করে ম্যামের হাতে দিল। ম্যাম মৃদু হেসে বলল- আরেহ জিনিসটা চমৎকার তো! দেখো তো বক্সে কিছু লেখা আছে কিনা! কে রাখল! বক্সের দিকে না তাকিয়েই আনিস উত্তর দিল- কিছু লেখা নেই ম্যাম। বাদ দিন না, আমাকে দেন আমি বিনে ফেলে দিচ্ছি। ফেলে দেবে কেনো! এটা এখন থেকে গাড়িতেই থাকুক। গাড়ির সাথে কালারেরও ম্যাচ আছে। নিশিনূর গাড়িতে বসলো। পাখিটা গাড়ির সামনে টিস্যু বক্স সরিয়ে যত্ন করে রাখলেন। আনিসের চোখে পানি এসে যাচ্ছে, ইস্পাতের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
গাড়ির দরজা বন্ধ করবেন সেসময় ম্যাম বললেন- তুমি অফিসে কি করবা অযথা, চলো তোমাকে তোমার আস্তানায় নামিয়ে দিই। আশেপাশেই থাকো না? জ্বি, ম্যাম! কিন্তু, আমি! মানে অফিসের লাইট, লক…। আমি অপেক্ষা করছি, শেষ করে এসো। আনিস জীবনে প্রথম বসের পাশে, মানে গাড়িতে বসে আছে। ঘেমে পাঞ্জাবি একাকার। ম্যাম নিশ্চুপ গাড়ি চালাচ্ছেন। আনিস হুট করে সাহসী হয়ে জিজ্ঞেস করল- আপনি ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন, ম্যাম? হ্যাঁ। খবরে দেখোনি, ভয়ংকর একটা ভাইরাস সংক্রমণ করছে দেশে। সবাইকে ঘরে থাকতে হবে। আমি তো ঢাকার ঘরে বেশিক্ষণ থাকতে পারিনা, তাই আগেই ভাগছি। ইমেইল দিয়েছি সবাইকে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অফিস বন্ধ। তোমাকে জানায়নি কেউ? না তো! এডমিনের ছেলেটাকে নিয়ে আর পারলাম না। ছাগল একটা। তোমাকে জানাবে না ছাগলটা! কিন্তু আপনি যে বলছেন ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন! তাহলে ওই ভাইরাস? বললাম তো, ঢাকায় আমি ঘরে থাকতে পারব না। তাই খাগড়াছড়ি যাচ্ছি। এক বান্ধবির বাসায়। কতদিন? মানে আবার কবে আমরা অফিসে আসব? হয়তো অল্পদিন, নয়তো কখনও না। ধরো, এটা আমাদের কিংবা সকলের সাথে সকলের শেষ দেখাও হতে পারে।
আনিস নেমে গেল অচেনা কোনও দুঃসময়ের গল্প শুনে। তারপর আশেপাশে খেয়াল করল সত্যিই তো রাস্তায় মানুষ কম, দোকানপাট বন্ধ। আর্মি, পুলিশ কি যেনো মাইকিং করছে…।
সারাবাংলা/এসবিডিই
অণুগল্প ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প প্রেম এবং ইত্যাদি মদিনা জাহান রিমি মদিনা জাহান রিমির ‘প্রেম এবং ইত্যাদি’ সাহিত্য