কৈশোরহাটা
২২ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:৪১
রুদ্রাক্ষ তোমার দরজায় একটা সাধারণ ছোট্ট গোলগাল কলিংবেল লাগিও। রোজ রাতে তোমার দরজার কড়া নাড়লে, ভেতর থেকে যে দরজা খোলে সে আমি নিজে! রুদ্রাক্ষ, রুদ্র রুদ্রাক্ষ… দরজায় একটা কলিংবেল লাগিও। বোতামে চাপ দিয়ে দেখব আমার বদলে রুদ্রাক্ষ তুমিই দরজা খোলো কিনা! জীবনের যতটা পথ হেঁটেছি পুরোটা পথ জায়নামাজের মতো গুটিয়ে আমি তোমার হাতে তুলে দেবো বলে বারবার তোমার দরজার কড়া নাড়ি। বারবার আমিই দরজা খুলি। ঘরের ভেতরে আমাকে রেখে, তুমি কোথায় যাও রুদ্রাক্ষ?
সিগারেটের খালি প্যাকেট কুড়োতে যাও নাকি তুমি? কোন প্যাকেটের মূল্য সবচেয়ে বেশি ছিলো যেনো? ব্রিস্টল, ক্যাপিস্টান, কিংস্টর্ক, স্টার নাকি ডায়মন্ডের? যার কাছে যত বেশি মূল্যবান, শূন্য সিগারেটের প্যাকেট সে তত বেশি বিত্তবান! খেলাটার নাম কী ছিলো যেনো রুদ্রাক্ষ? বিত্তের হিসেব যদি আজও ঐ সিগারেটের শূন্য প্যাকেট দিয়েই হতো, রুদ্রাক্ষ তুমি তবে হতে সবচেয়ে বিত্তবান। তোমার চেয়ে আর কেউ বেশি কুড়োতে পারতো না শূন্য প্যাকেট। তুমি তো কুড়োতে জানতে রুদ্র। জীবনে আর কিছু কুড়োলে না কেনো? গতকাল তোমার দরজায় কড়া নেড়ে আমারই কাছ থেকে আমি জানলাম তুমি বাড়ি নেই। ডাংগুলি খেলতে গেছ। তুমি কাদের সাথে ডাংগুলি খেলতে গিয়েছিলে রুদ্রাক্ষ? চিনু ছিলো নিশ্চয়? ঐ যে জামগাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ে মারা গিয়েছিলো যে চিনু, চিনুর কথা মনে পড়লেই তুমি কাঁদতে… তোমাদের গলা জড়িয়ে ধরা খালি গায়ের একটা ছবি তুলে দিয়েছিল মুকুলভাই। ডাংগুলি খেলতে কি চিনু এসেছিলো!
জীবনের ভূগোলে তুমি কৈশোরহাটায় একটা বাড়ি বানিয়েছ শুনলাম। এই বয়সে তুমি ওখানে বাড়ি বানাতে গেলে কেনো? কাদের সাথে সময় কাটাও কিছুই বলো না তুমি, মুচিপাড়ার শিতু আসে তোমার ওখানে? ওর বাবা নরেনকাকা বিয়ের আসরে ঢোল বাজাতো, শিতু বাজাতো কাঁসা; বিয়েবাড়িতে গেলে শিতু পেটপুরে খেতো, আর বাকি দিনগুলো শিতু কেবল একবেলা ভাত আর দুবেলা উপোস খেয়ে থাকতো। উপোস উদরে কত অবলীলায় শিতু হাডুডু খেলা শেষে পদ্মপুকুরে নেমে কাছিম ধরতো। এক মিলাদের আসরে মওলানা সাহেব যখন বললেন, হিন্দুরা সব দোজখের আগুনে পুড়বে; তিনি দোজখের তীব্র আগুনের বর্ণনাও দিয়েছিলেন সেদিন! আমি দেখলাম তুমি কাঁদছো, কারণ জানতে চাইলে তুমি ফিসফিস করে বললে, শিতুর জন্যে খারাপ লাগছে। শিতু দোজখের আগুনে পুড়বে। সেই প্রথম কোনো মিলাদের আসর থেকে বাতাসা না নিয়েই তুমি কাঁদতে কাঁদতে চলে এসেছিলে। ওলি নামে আমাদের এক সুবোধ বন্ধু ছিলো মনে আছে? আমাদেরকে মাঝে মাঝেই মানবজন্মের ভুল নিয়ম শেখাতো ওলি। বাড়িতে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করলেই নাকি স্ত্রীর পেটে বাচ্চা আসে, সেই ওলি এখন দুই সন্তানের পিতা। দোয়া মাহফিল ছাড়াই তার সন্তান হলো কী করে, খুব জানার ইচ্ছে আমার।
শুনেছি কৈশোরহাটায় ঠিক সেরকম একটা ঘর তুলেছো তুমি; তোমার বাবা বাগানের ভেতরে তোমার জন্যে যেমন একটা ঘর তুলে দিয়েছিলেন। ঘরটায় একটামাত্র জানালা, আহ! স্বর্গীয় সে জানালা; খুললেই আরেক জানালা দেখা যেতো। আনন্দ নিকেতনের বড় মেয়ের ঘরের জানালা। তার নামটা নিশ্চয়ই ভোলোনি, জ্যোতি। নাম জ্যোতি, কিন্তু ভালোবাসত অমাবস্যা। পায়ের স্যান্ডেল থেকে শুরু করে পাজামা, কামিজ, কপালের টিপ তার সবই ছিলো কৃষ্ণবর্ণের। তোমার খুব কৌতুহল হতো ওর অন্তর্বাসের রঙও কালো কি-না জানতে! একদিন ওর খোলা জানালা দিয়ে ওর বিছানার উপরে দেখেছিলে অসতর্কে রাখা ওর লাল বক্ষবন্ধনী; রঙটা ও বুকে লুকিয়ে রাখতো। …কৈশোরহাটার সেই ঘরের জানালা খুলে এখনও মাঝে মাঝে জ্যোতিকে দেখতে পাচ্ছো কি রুদ্র? ওর অসতর্ক রক্তিম অন্তর্বাস? মেয়েটার প্রেমে পড়েছিলে তুমি। একদিন কলেজের ক্লাসরুম থেকে চুরি করে একটা নীল চক নিয়ে ফিরলে বাড়িতে। তোমার জানালার একটা পাল্লার বাইরের দিকে চক দিয়ে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা লিখে জানালা বন্ধ করে দিলে। দু’দিন কাটলো অজানা শঙ্কায়। তারপর ভালোবাসি শব্দটা মুছে ফেলবে বলে, একটা ভেজা কাপড় হাতে জানালাটা খুলতেই দেখলে সেই অভাবনীয় দৃশ্য। জ্যোতির বন্ধ জানালার একপাল্লায় লেখা ‘আমিও’। তুমি ফুটবলে গোল করার মতো লাফিয়ে উঠে স্বর্গীয় জানালায় দেখা অলৌকিক সেই শব্দটা বিড়বিড় করে জপেছিলে ‘আমিও, আমিও, আমিও’। তারপর কতো কতোদিন তুমি, আমিও’র সাথে করেছো গোপন অভিসার। অভিধান থেকে নেমে এসে ‘আমিও’ শব্দটা কেবল তোমারই হয়ে গিয়েছিল তখন…।
জ্যোতিকে তুমি কোথায় হারিয়েছো রুদ্র? কোন মায়াজলে ভাসিয়েছ তার প্রণয়ের মৃতদেহ! রুদ্র কথা শোনো, আমি দরজার কড়া নাড়ছি; তুমি দরজা খোলো। তুমিই দরজা খুলবে রুদ্রাক্ষ, আমি করজোড়ে বলছি শোনো…। আমি তোমাকে নিয়ে কৈশোরহাটায় যাবো, সিগারেটের শূন্য প্যাকেট কুড়োবো। চিনুর সাথে লাগাতার ডাংগুলি খেলবো আমি। ওর সাথে গলাগলি করা খালিগায়ের ছবিটা দেখে আমি কাঁদবো। ওর মা ঘন দুধের পায়েস রান্না করে রেখেছেন। আমি খেলে, চিনুর খাওয়া হবে তার কাছে। রুদ্র তুমিই দরজা খুলবে, আমি শিতুর দোজখে যাওয়ার কষ্টে মিলাদে বসে কাঁদবো। আমি বাতাসা না নিয়েই বেরিয়ে আসবো মিলাদ থেকে। অবাধ্য হয়ো না রুদ্র। তুমিই দরজা খোলো। আমি ওলির সামনে বসে মানুষের ভ্রান্ত জন্মবৃত্তান্ত শুনবো আবার। জায়নামাজের মতো গুটানো সব পথ আমি আবার বিছিয়ে ফিরে যাবো বাগানের ভেতরে সেই ঘরে। জানালায় দাঁড়িয়ে আনন্দ নিকেতনের বড় মেয়েকে চিৎকার করে বলবো, ‘আমিও, আমিও, আমিও, এখনও আমিও’। রুদ্র কড়া নাড়ছি দরজা খোলো। তুমিই খুলবে, আমি না তুমি, তুমিই…।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ কৈশোরহাটা মাসুম রেজা মুক্তগদ্য সাহিত্য