সন্তান
২২ এপ্রিল ২০২৩ ২০:৩৪
কোয়ার্টেজের জানালার ওপাশে এই মুহূর্তে ভেসে উঠেছে সাগর আর বালুকাবেলার দৃশ্য। একটু একটু করে দূর সাগরে ডুবে যাচ্ছে লাল সূর্য। সম্পূর্ণ দৃশ্যটাই এইখানে কৃত্রিমভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত এই রকম অসংখ্য কৃত্রিম দৃশ্য দেখেই সময় কাটে রিশার। আর অপেক্ষায় থাকে রুহান কখন বাসায় ফিরে আসবে। রিশা ও রুহান একসাথে আছে অনেকদিন হলো। রুহান একটি রবোটিক্স কোম্পানিতে চাকরি করে। প্রতিদিন সকাল বেলা কাজে যায়। ফিরে আসে সন্ধ্যায়।
রুহানকে প্রচণ্ড ভালোবাসে রিশা। রুহানও প্রচণ্ড ভালোবাসে রিশাকে। রিশা স্বপ্ন দেখে ছোট্ট একটি শিশুর। যে শিশুটি জন্ম নেবে রুহান-রিশার ভালোবাসায়। সারাঘরে কুটকুট করে হেঁটে বেড়াবে শিশুটি। কারনে অকারণে খিলখিল করে হাসবে। আবার কখনও অভিমান করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। রিশা তখন পরম মমতায় মান ভাঙানোর চেষ্টা করবে। শিশুটি মা মা বলে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরবে। কী চমৎকার একটা ব্যাপার! ভাবতেই আনন্দ লাগছে। কিন্তু একটি শিশু জন্ম দেওয়া কি চাট্টিখানি কথা। চাইলেই এখনকার পৃথিবীতে শিশু জন্ম দেওয়া যায় না। শিশু জন্ম দিতে চাইলে প্রথমেই ‘চাইল্ড সেলে’ আবেদন করতে হয়। শুক্রানু ও ডিম্বানুর নিষেকের পর সিমুলেশন করে দেখা হয় যদি শিশুটিকে জন্ম দেওয়া হয় তাহলে শিশুটি কী কী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে। কোন নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি থাকলে জিনোটাইপ মডিফিকেশন করা হবে। জিনোটাইপ মডিফিকেশন হলো, জিনগত সীমাবদ্ধতার কারণে কোন একটি জিনের ভুল উপস্থিতি দূর করে সুস্থ জিন প্রতিস্থাপন করা। সবকিছু ঠিক থাকলেও বিপত্তি। পৃথিবীর জনসংখ্যা যাতে বেড়ে না যায় সে জন্য রুহান ও রিশা তখনই সন্তান জন্ম দিতে পারবে যখন লটারিতে রুহান ও রিশার নাম আসবে। এখন কমিউনিটিগুলোতে জনসংখ্যার ভিত্তিতে জন্মহার ও মৃত্যুহার সমান রাখার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। বছরে যে ক’জন মানুষ মারা যাবে, ঠিক সে কজন মানবশিশু জন্ম দেবার অনুমতি দেয় কমিউনিটি। লটারির মাধ্যমে কিছু সংখ্যক ভাগ্যবান দম্পতি পেয়ে থাকে সন্তান জন্ম দেবার অধিকার। কমিউনিটির মানুষদের খাদ্য ও বাসস্থান নির্দিষ্ট থাকায় জনসংখ্যা যাতে বেড়ে না যায় তাই এই ব্যবস্থা।
এতো কিছুর পর রুহান ও রিশা সন্তান জন্ম দেবার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। তবুও রিশা প্রতি বছর চাইল্ড সেলে আবেদন করে অপেক্ষায় থাকে যদি কোনোদিন লটারিতে নাম আসে তাদের। পুরাতন বছর যায় নতুন বছর আসে। এভাবে চলতেই থাকে। আর সেই সাথে একটি সন্তানের জন্য হাহাকারও বাড়তে থাকে রিশার মনে। রুহান রিশার কষ্টটা বুঝতে পারে। রিশাকে পরম ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়। হঠাৎ একদিন চাইল্ড সেল থেকে জানানো হয় রুহান রিশা দম্পতিকে এবছর সন্তান জন্ম দেবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। খবরটা জানতে পেরে রিশা আনন্দে হতবাক হয়ে যায়। এতদিনের অপেক্ষার পর পূর্ণ হতে চলেছে তাদের স্বপ্ন। রিশার কোল জুড়ে জন্ম নেবে একটি শিশু। জীবনটাকে অনেক অর্থবহ মনে হতে থাকে।
পরবর্তী কয়েকমাস খুব ধকল যায় রিশা ও রুহানের। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রিশার গর্ভে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে একটি মানবশিশু। এসময় রুহানও খুব যত্ন নেয় রিশার। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া হচ্ছে কিনা, সময় মত চেকআপ করাচ্ছে কিনা এক কথায় রুহান এখন পুরোপুরি রিশাকে নিয়েই ব্যস্ত। রুহানের এই দায়িত্বজ্ঞান খুব উপভোগ করে রিশা। এখন প্রায়ই রিশাকে নিয়ে বেড়াতে বের হয় রুহান। সুন্দর সুন্দর জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যায়। কোলাহল কখনই পছন্দ করত না রিশা। সারাজীবন অতিরিক্ত মানুষ এড়িয়ে চলেছে। কিন্তু ইদানিং মানুষের সহচর্য ভালো লাগতে শুরু করেছে তার। অনেকের সাথে মিশে থাকার মাঝে এক ধরনের আনন্দ খুঁজে পায় রিশা। মাঝেমাঝেই তলপেটে হাত বুলিয়ে আদর করতে চায় তারই গর্ভে বেড়ে উঠতে থাকা সন্তানটিকে। ভাবতে থাকে তার সন্তানটি কি ছেলে হবে না মেয়ে হবে। যদি ছেলে হয় তাহলে সন্তানটিকে তার বাবার মত একজন হৃদয়বান মানুষ হিসেবে সে গড়ে তুলবে। আর যদি মেয়ে হয় তাহলে নিজের মতন করে তৈরী করে নেবে সে। এভাবে আরো কিছু দিন চলে যায়। একদিন চাইন্ড সেল থেকে ডেকে পাঠানো হয় রুহানকে এবং চাইল্ড সেল এর প্রধান সায়মার সাথে দেখা করতে বলা হয়।
সায়মা ব্যক্তি হিসেবে চমৎকার, মধ্যবয়স্ক। সে রুহানকে একটি ভয়াবহ কথা জানায়, রুহান, তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুত হও। আমি জানি তুমি সাহসী ছেলে। যেকোনো কিছু সহজেই সামলে নেবার একটা সহজাত বৈশিষ্ট্য তোমার মধ্য রয়েছে।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে রুহান একটু নড়েচড়ে বসে হঠাৎ তার মনে কোণে এক অজানা আশঙ্কা উঁকি দেয়। কী হতে যাচ্ছে! রুহান কিছু ভেবে পায় না। আড়চোখে তাকায় চাইল্ড সেলের প্রধানের দিকে। সায়মা বেশকয়েকবার এই রকম অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজ যেন পরিস্থিতি একটু অন্যরকম। রুহান নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে,
তুমি বলো সায়মা। আমি প্রস্তুত।
সায়মা বলতে শুরুকরে, এই রকম পরিস্থিতি পূর্বে আরও কিছু দম্পতির ক্ষেত্রেও ঘটেছে। আমি আশা করব তুমি আমাদের আইনের প্রতি অনুগত থাকবে। অন্যদের ক্ষেত্রে যা করা হয়েছে তোমার ক্ষেত্রেও তাই করা হবে। তোমার স্ত্রী রিশার দেহে যে একটি সন্তান বড় হচ্ছে বলে জেনে এসেছো তা ঠিক নয়। ভালো করে বলতে চাইলে রিশার গর্ভে একটি নয়, দুটি সন্তান। এরা জমজ, একটি ছেলে, আর একটি মেয়ে। কমিউনিটি তোমাকে একটি সন্তান জন্ম দেবার অনুমতি দিয়েছে, দুটি নয়। জনসংখ্যার ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য অতীতে অন্যান্য দম্পতির ক্ষেত্রে একটি সন্তানকে মেরে অপর একটি সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। তোমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটবে। তুমি রিশার সাথে আলোচনা করে ঠিক করে নাও কোন সন্তানটিকে বাঁচিয়ে রাখবে।
নিষ্ঠুর কথাগুলো প্রায় একনিঃশ্বাসে বলে শেষ করল চাইল্ড সেলের প্রধান সায়মা।
বেশকিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না রুহান। এই কথা কী করে সে বলবে রিশার কাছে আর রিশাই বা কী করবে তখন। এতোদিন ধরে অপেক্ষা করে এসেছে আর এখন নিজের এক সন্তানকে জন্ম দিতে আরেক সন্তানকে হত্যা করতে হবে। সবকিছু কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সুস্থভাবে চিন্তা করতে পারছে না রুহান। এক ধরনের ঘোর তৈরী হলো রুহানের মধ্যে। হঠাৎ দুটি ফুটফুটে শিশুর ছবি ভেসে উঠে চোখের সামনে। শিশুটি দুইটি হাত বাড়িয়ে কী যেন বলতে চাচ্ছে রুহানকে। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে সবকিছু। নিজেকে দুর্বল লাগে রুহানের। এমন সময় রুহান একটি কঠিন সিদ্বান্ত নিয়ে ফেলে। যে করেই হোক তার সন্তান দুটিকে এই পৃথিবীর আলো দেখাতেই হবে। কিন্তু এর জন্য একটু ত্যাগস্বীকার করতে হবে।
সায়মা এতক্ষণ অবাক হয়ে রুহানের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু এরপর রুহান যা বলল তা মোটেই আশা করেনি সে। পুরোপুরি হতচকিত অবস্থা। রুহান তার দুটি সন্তানকেই বাঁচাতে চাইছে। রুহানের দাবি রুহান যদি নিজে মারা যায় তাহলে কমিউনিটিতে জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষা পাবে এবং সেই সাথে তার কোন সন্তানকেই হত্যা করতে হবে না। দুজন শিশুকেই জন্ম দেওয়া সম্ভব হবে। অকাট্য যুক্তি, তবুও কেন যেন মেনে নিতে পারছিল না সায়মা। অবশেষে রুহানের চাপাচাপিতে এক পর্যায়ে মেনে নিতে বাধ্য হলো চাইল্ড সেলের প্রধান সায়মা।
কিন্তু এসবের কিছুই জানতো না রিশা। তাকে বলা হয়েছে জরুরি কাজে রুহানকে এক অজ্ঞাতস্থানে পাঠানো হয়েছে। কাজ শেষে ফিরে আসবে রুহান। রিশাও সরল বিশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে। একসময় রিশার কোলজুড়ে জন্ম নেয় দুটি ফুটফুটে শিশু। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। তারও অনেক পরে রিশা জানতে পারে রুহানরে মৃত্যুসংবাদ।
শেষ কথা: সাগরের বালুকাবেলায় আনুমানিক তিন বছর বয়সের দুটি শিশু খেলা করছিল। খানিকদূরে রিশা বসে আছে। তার এখন খুব ব্যস্ত সময় কাটে শিশু দুটি নিয়ে। তবুও মাঝেমাঝেই সে ছুটে আসে এই বালুকাবেলায়। কারণ, এই বালুকাবেলায় সে রুহানের সাথে অনেকবার বেড়াতে এসেছে। এখন রুহান নেই কিন্তু রুহান তাকে দিয়ে গেছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার। তাদের সন্তান। ভালোবাসার সন্তান।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ সন্তান সাইফ ইমন সাইফ ইমনের সায়েন্স ফিকশন ‘সন্তান’ সায়েন্স ফিকশন সাহিত্য