বসন্ত বাতাসে নজিরবিহীন বর্বরতা
২২ এপ্রিল ২০২৩ ২০:৪৯
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল বুধবার, ১৩ ফাল্গুন ১৪১৫ বঙ্গাব্দ। গাছের শাখায় তখন বসন্তের দোলা। শীত শেষে গরম পড়বে পড়বে ভাব। বেশ মনোরম, আরামদায়ক আবহাওয়া। এমনই এক শান্ত, স্বাভাবিক ঝকঝকে সকালে দিন শুরু হয়েছিল রাজধানীবাসীর। সকাল ১০টা পার না হতেই যা পরিণত হয় এক নরকযজ্ঞে। বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরাসহ বিশ্বের প্রায় সব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনামে চলে আসে ঢাকার পিলখানায় অভূতপূর্ব বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্বরতম ঘটনা এই বিডিআর বিদ্রোহের হত্যাযজ্ঞ। যে ঘটনায় প্রাণ হারান ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন মানুষ। নৃশংসভাবে হত্যা, মরদেহ ক্ষতবিক্ষত করা, গণকবরে লাশ পুঁতে ফেলা, লাশ পুড়িয়ে ফেলা, ম্যানহোলে মরদেহ ফেলে দেওয়া, নারী নির্যাতন, চুরি, নির্বিচার লুট এমন কোনও ঘৃণ্য অপরাধ নেই যা ঐ দুইদিনে (২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি) পিলখানার অভ্যন্তরে সংগঠিত হয়নি। আধুনিক সমাজে, সভ্য কোনও দেশে এ রকম ঘটনা সত্যিই কল্পনা করা দুষ্কর।
২০০৯ সালে আমি কাজ করতাম টেলিভিশন চ্যানেল ওয়ান-এ (২০০৭ সালের ২৭ এপ্রিল চ্যানেলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়)। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ পর্যায়ে থাকায় এ সময় আমি থাকতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়াউর রহমান হলে। স্পষ্ট মনে আছে, ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল বসন্তের ঝকঝকে একটি দিন। একটি সুন্দর, স্বাভাবিক সকাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান বিজয় একাত্তর হলের সামনে ২০০৯ সালে একটি দোকান ছিল। সেখানে সকালের নাস্তার জনপ্রিয় একটি মেন্যু ছিল চিড়া-দই। খাবারটি আমার খুব প্রিয়। মনে আছে সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে আমার মোবাইলে একটা কল আসে। কলটি এসেছিল পিলখানা সংলগ্ন একটি বাড়ি থেকে। কোনও এক এ্যাসাইনমেন্টে গিয়ে একজনকে ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিলাম। সেখান থেকে নম্বর নিয়ে অজ্ঞাত ও-ই ব্যক্তি ফোন করেন। তিনি বললেন, পিলখানার মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে। অনেক হৈ-চৈ। গুলি করে মানুষ মারা হচ্ছে। আমি বললাম- না না, তা কি করে হয়! হয়তো মহড়া চলছে, ভাল করে দেখুন। ফোনের ওপাশ থেকে বললেন, না না। মহড়া এমন নয়। মহড়া আমরা আগেও দেখেছি। মনে হচ্ছে খারাপ কিছু একটা ঘটছে। প্রচুর হৈ-চৈ। আমি তাকে আরও ভাল করে দেখার অনুরোধ জানিয়ে ফোনটি রাখলাম।
ফোন রেখে আমি কল দিলাম চ্যানেল ওয়ানের এ্যাসাইমেন্ট এডিটর শাকিল আহম্মেদকে (বর্তমানে ৭১ টিভিতে কর্মরত)। শাকিল ভাইয়ের ফোন ব্যস্ত। একটু পরে কল ব্যাক করলেন। বললাম, একটা ফোন পেলাম। মনে হয় পিলখানায় কিছু একটা ঘটেছে। শাকিল ভাই বললেন, আমরাও এমন খবর পাচ্ছি। মনে হয় খারাপ কিছু ঘটেছে। এর অল্পসময়ের মধ্যেই এই ঘটনার তথ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এলোপাথাড়ি গোলাগুলির সময় পিলখানার খুব কাছে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও কুয়েত মৈত্রী হলের মেয়েরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। নিরাপদ স্থানে দ্রুত সরে যেতে কয়েকজন আহত হন। ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে সুমনা শারমিন শাওন নামে আমার এক সহপাঠী থাকতেন। ফোনে শাওন হলের অবস্থা জানায়। এমন পরিস্থিতিতে আমি ক্যাম্পাস থেকে একটু এগিয়ে নীলক্ষেত মোড়ে যাই। রাস্তায় যান চলাচল এরমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষজন উত্তেজিত। একেকজন একেক কথা বলছেন। নীলক্ষেতের পেট্রল পাম্প মোড় পর্যন্ত গিয়ে আর এগুতে পারলাম না। সামনে জটলা। সবার মধ্যে কেনো যেনো এক ধরনের উৎসাহ উৎসাহ ভাব। ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি, খুনোখুনি দেখা বা এসবের তথ্য উপাত্ত জানার ক্ষেত্রে বাঙালি জাতি মনে হয় একটু বেশি তৎপর বা উৎসাহী। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়ত আমার এক বন্ধু। নাম শিবলী সাদিক। এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র। ওর সাথে দেখা হলো। উঠলাম ওর হলের ছাদে। দেখলাম পিলখানার ভেতর থেকে ধোঁয়া উড়ছে। আকাশে হেলিকপ্টার। একটু পরপর টানা গুলির শব্দ।
এদিন একটা বিষয় আমাকে খুব অবাক করেছিল। কেনো যেন এ ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ও নীলক্ষেতের ব্যবসায়ীদের একটি অংশের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা একটু বেশিই ছিল। বিডিআর তিন নম্বর গেটের সামনে কেউ কেউ জওয়ানদের পক্ষে মিছিলও করেছিলেন। এটা ঠিক কেনো ঘটেছিল তা বলা মুশকিল। যদিও এ সময় পিলখানার ভেতরের বর্বর হত্যাযজ্ঞের খবর কারও জানা ছিল না। তবে ঐ দিন দুপুরে নবাবগঞ্জ এলাকায় বিডিআরের দুইজন কর্মকর্তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। হতভাগ্য এই সেনা কর্মকর্তা দুজন ছিলেন বিডিআরের ঢাকা সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল সৈয়দ মুজিবুল হক ও ৩৬ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এনায়েত। এই দুইজনের লাশ ইঙ্গিত বহন করেছিল ভেতরে আরও কতো ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে। তবে তারপরও অনেকেরই ধারণা ছিল দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত হওয়ায় বিডিআর জওয়ানরা বিদ্রোহ করেছে। আর অফিসারদের বিরুদ্ধে তাদের দাবি ন্যায়সঙ্গত। এফ রহমান হলের ছাদ থেকে নামার পর আবার নীলক্ষেত মোড়ে গেলাম। সেখানে দেখা হলো চ্যানেল ওয়ানের প্রতিবেদক কামরান করিমের সাথে। তিনি জানালেন, পিলখানায় ব্যাপক খুনাখুনি হয়েছে। বিডিআরের ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদকে মেরে ফেলা হয়েছে। আরও অনেক অফিসার মারা গেছেন। উনি বললেন, এটা অনেক বড় ঘটনা। কখন কী ঘটে বলা যায় না।
দুপুর দেড়টার দিকে আমি হলে ফিরে আসি। তখন ঘটনাটা অনেক পরিষ্কার। বিডিআর জওয়ানরা বিদ্রোহ করেছে। অকল্পনীয় বর্বরতায় হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে। পিলখানার চারপাশে সেনাসদস্যরা চলে এসেছেন। মিরপুর সড়কে যান চলাচল বন্ধ। চারপাশে যুদ্ধাবস্থা। গেলাম হলের টিভি রুমে। অনেক ভীড়। সবাই উৎকণ্ঠা নিয়ে টিভি দেখছেন। সেখানে জানতে পারলাম, সকাল ১০টার কিছু পর সম্ভবত সাড়ে দশটার দিকে একুশে টিভি প্রথম বিডিআর বিদ্রোহের খবর দেয়। এরপর অন্য টিভিগুলোও এই সংবাদ পরিবেশন করতে থাকে। ২০০৯ সালে টেলিভিশন প্রযুক্তি ততোটা আধুনিক ছিল না। লাইভ সম্প্রচারের বিপরীতে ফোনো বা টেলিফোনে বেশি করে সংবাদ সম্প্রচারিত হচ্ছিল। কিছু টিভি বিশেষ করে এটিএন বাংলা ও এনটিভি বিডিআরের গেট থেকে কিছু জওয়ানের ভক্সপপ বা বক্তব্য নিয়ে তা সম্প্রচার করে। জওয়ানদের বক্তব্য ছিল, তাদের বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। তারা অনেকদিন ধরে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। যদিও হত্যাকাণ্ড নিয়ে তারা কোনও কথা বলেনি। তাদের মুখ কাপড়ে ঢাকা ছিল।
ঐ সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন আমার এক বন্ধু। বর্তমানে বড় পদে কর্মরত। তার পোস্টিং ছিল বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে। তাকে ফোন করলাম। বললাম, বিডিআরের ডিজি নিহত, অনেক সেনা কর্মকর্তা বেঁচে নেই। সে বললো, বিষয়টা সত্য নয়। আমি বললাম, সত্যিই হয়তো এমন কিছু ঘটেছে, খোঁজ নাও।
দুপুরের পর রওনা হলাম গুলশানের দিকে। গুলশান-১ এর উদয় টাওয়ারে চ্যানেল ওয়ানের অফিসে। ঢাকা শহর থমথমে। যানবাহন পেতে সমস্যা হচ্ছিল। সময় যতই যাচ্ছে, ততোই নানা ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। অফিসে পৌঁছে পুরো ঘটনাটি জানতে পারি। ডিজি শাকিল আহম্মেদসহ অনেকের মৃত্যুর সংবাদ শুনি। তখন আর এসব ঘটনা অবিশ্বাস করার সুযোগ ছিল না। টিভিতে লাল কালিতে ব্রেকিং নিউজ চলছে। চারদিকে চরম উত্তেজনা।
অফিসেও উত্তেজনা। একের পর এক খবর আসছে। সবই মৃত্যু আর হত্যাযজ্ঞের বিভৎস বর্ণনা। অফিসে গিয়েই জানলাম, বিডিআর বিদ্রোহের সূত্রপাত পিলখানার দরবার হলে। দরবারের শুরুতে মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বিডিআর জওয়ানদের কুশল জিজ্ঞাসা করে এক পর্যায়ে অপারেশান ডাল-ভাতের প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি এই অপারশনে লোকসানের কথা বলছিলেন। এ সময় একজন জওয়ান দাঁড়িয়ে তার বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। যদি অন্য কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে ঐ জওয়ান বসে পড়েন। এরপর এক পর্যায়ে দুই জওয়ান মঞ্চে উঠে আসে। একজনের হাতে ছিল অস্ত্র। ঘড়িতে তখন সময় ৯টা ২৬ মিনিট। এরপরই বাইরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। এ সময় ডিজি ফোন করে বিদ্রোহের কথা জানিয়ে অনেকের সাহায্য চান। সকাল ১০টার দিকে ডিজিসহ অন্য কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে বের করে আনা হয়। এ সময় মুখে কাপড় বাঁধা ও মাথায় হলুদ রংয়ের হেলমেট পরা চার জওয়ান ব্রাশফায়ার করে ডিজিকে হত্যা করে। এরপরই শুরু হয় নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। দুপুর ১টার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তরফ থেকে শান্তির সাদা পতাকা হাতে পিলখানার ৪ নম্বর গেইটে যান প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সংসদের হুইপ মির্জা আজম।
এরপর বেলা তিনটার দিকে ঘটে আরও নাটকীয় ঘটনা। ১৪ সদস্যের একটি বিডিআর প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন যমুনায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। বিডিআরের তরফ থেকে বিদ্রোহী এই ১৪ জনের দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডিএডি তৌহিদ। সন্ধ্যা ৬ টার দিকে খবর প্রকাশিত হয় প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের ক্ষমা করেছেন। যদিও এ সময় আনুষ্ঠানিকভাবে হত্যাযজ্ঞের কোনও খবর ছিল না। পিলখানার ভেতরে যে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে তা নিশ্চিত করে কেউই জানায়নি। এদিকে সন্ধ্যার পর পিলখানার ভেতরে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। পরে নিশ্চিত হওয়া যায়, এ সময় দুটো গণকবরে মরদেহগুলো পুঁতে ফেলার কাজ করেছিল বিদ্রোহী জওয়ানরা।
সংবাদকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের দিন আমি পিলখানা এলাকায় আসি সন্ধ্যার পর। ঐ সময় পিলখানার সংবাদ কাভারের জন্য চ্যানেল ওয়ানের দুটি ইউনিট ছিল। আমি ছিলাম চ্যানেলটির জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কেরামত উল্লাহ বিপ্লবের সহযোগি। অর্থাৎ বিপ্লব ভাই মূল নিউজটা করবেন, আমি সহযোগি হিসেবে সাইড স্টোরি করব। এই ঘটনা এতোই বড় ছিল যে, ঐ রাতে প্রায় সব টিভি চ্যানেলেরই একাধিক সাংবাদিক ছিলেন রাইফেল স্কয়ারের সামনে (বর্তমান নাম সীমান্ত স্কয়ার)। আমি নিশ্চিত সংবাদপত্রগুলোরও একাধিক প্রতিবেদক ও ফটো সাংবাদিক ছিলেন।
সন্ধ্যার পর সংবাদকর্মীরা জড়ো হয়েছিলেন ধানমন্ডি দুই নম্বর সড়কের পিলখানার মূল গেইটের পাশে। এখানে আম্বালা ইন নামের একটি হোটেলে বিদ্রোহীদের সাথে সরকারের প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়। আম্বালা ইনের সামনে সাংবাদিকদের প্রচণ্ড ভীড় ছিল। দেশবরেণ্য সাংবাদিক মুন্নী সাহাকে দেখলাম, সন্ধ্যা সাতটার বুলেটিনে এটিএন বাংলার জ.ই. মামুন লাইভ করলেন, ছিলেন আল-জাজিরার নিকোলাস হক ও অন্যান্য বিদেশী গণমাধ্যমের কর্মীরা।
উৎকন্ঠার ওই রাতে মূলত তিনটা ঘটনা ঘটে। এক. হোটেল আম্বালা ইন এ সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে বিদ্রোহীদের বৈঠক। দুই. পিলখানার ভেতরে অস্ত্র সমর্পণের নাটক ও কিছু জিম্মির মুক্তি এবং তিন. পিলখানার ভেতরে গণকবরে সেনা কর্মকর্তাদের লাশ পুঁতে ফেলা। একজন সংবাদকর্মী বা প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমি ঠিক কীভাবে ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করেছিলাম সেই বিষয়টিই আলোচনা করব।
আম্বালা ইন এ বৈঠক
২৫ ও ২৬ তারিখের বিডিআর বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ছিল বিদ্রোহী জওয়ানদের সাথে সরকারের প্রতিনিধি দলের হোটেল আম্বালা ইন এর বৈঠক। ১৪ জন বিডিআর জওয়ানের সাথে এই বৈঠকে অংশ নেন স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপস ও পুলিশের মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ।
আম্বালা ইন এ যখন এই বৈঠকটি চলছিল তখন পিলখানার চারপাশে চাপা উত্তেজনা। এই আলোচনাটি ছিল মূলত ফলো-আপ বৈঠক। কারণ এর আগে বিকেল আনুমানিক চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বিদ্রোহীদের একটি বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকে বিদ্রোহী জওয়ানরা অনেকগুলো দাবি দাওয়া তুলে ধরেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল বিদ্রোহী জওয়ানদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা। বিদ্রোহ পরিস্থিতি অবসানের জন্য তাদের দাবি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে অস্ত্র ফেলে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। জওয়ানরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে অস্ত্রসমর্পণ করার কথা বললেও তা আসলে বাস্তবায়িত হয়নি। এসব বিষয় কার্যকরের জন্যেই আম্বালা ইনে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বিভিন্ন সূত্রে আমরা জানতে পারি, এই বৈঠকটি ছিল টানটান উত্তেজনার। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণের প্রতিশ্রুতি দিলেও জওয়ানরা আসলে অস্ত্র ত্যাগ করতে রাজি হচ্ছিলেন না। জওয়ানদের ভয় ছিল অস্ত্রসমর্পণের পরপরই সেনাবাহিনী অভিযান চালাবে। কারণ পিলখানার চারপাশে সকাল থেকেই সেনা সদস্যরা সশস্ত্রভাবে অবস্থান করছিলেন। বিদ্রোহীরা মূলত রাষ্ট্রীয় ক্ষমার বিশ্বাসযোগ্য নিশ্চয়তা চাচ্ছিল। অন্যদিকে ভেতরে আটকে পড়া সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছিল প্রবল উৎকন্ঠা। নির্যাতন-নিপীড়নের গা হিম করা সব বর্ণনা বাতাসে ভাসছিল। তাই সরকার চাচ্ছিল এই অবস্থার দ্রুত অবসান। কিন্তু ফয়সালা হচ্ছিল না। তাই দফায় দফায় বৈঠক হয়। আমি যতদূর মনে করতে পারি, ঐ রাতে তিন দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, জওয়ানদের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। তবে এ সময় আমি অবাক করা একটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। যখন ফজলে নূর তাপস সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছিলেন, তখন তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন বিডিআর জওয়ান। তার হাত ছিল ফজলে নূর তাপসের কোমরে। এই দৃশ্য দেখার পর আমি নিশ্চিত হই, প্রকৃতপক্ষে কোনও সমঝোতা হয়নি। কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। নিশ্চিতভাবেই দু’পক্ষের কেউই কাউকে আস্থায় নিতে পারেনি। তখন এ বিষয়টি আমি চ্যানেল ওয়ানের প্রধান নাজমুল আশরাফকে জানাই। আমি নিশ্চিত করে বলি, কোনও ধরনের সমঝোতা হয়নি।
আত্মসমর্পণ নাটক ও জিম্মি মুক্তি
বিদ্রোহীদের সাথে তিন দফা বৈঠক শেষে নামকাওয়াস্তে একটা আপোষ রফা হয়। এতে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজি হন। অস্ত্রসমর্পণ হবে পিলখানার ভেতরে। তবে প্রবেশ করতে পারবেন শুধু বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যামেরাপারসন। অন্য গণমাধ্যমের কর্মীদের অস্ত্রসমর্পণ কাভার করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। রাত দেড়টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের উপস্থিতিতে লোক দেখানো অস্ত্রসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়। বিটিভি থেকে ধার করে নেওয়া টিভি ফুটেজে আমরা দেখতে পাই কয়েকজন জওয়ান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র জমা দিচ্ছেন। কিছু অস্ত্র স্তুপ করে রাখা। এ সময় পিলখানার ভেতরের জিম্মিদেরকেও ছেড়ে দেওয়া হয়। এ্যাম্বুলেন্স ও কিছু ব্যক্তিগত গাড়িতে করে তারা বেরিয়ে আসেন। বেশিরভাগই নারী ও শিশু। তারা বের হলে সাংবাদিকরা তাদের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেন। তবে তারা ছিলেন ভীষণভাবে আতঙ্কিত, বিদ্ধস্ত। ভেতরের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদের খুব স্পষ্ট ধারনা ছিল না। তাদের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছিল, তারা নরক থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তারা এতোটাই ট্রমাটাইজ (আতঙ্কগ্রস্ত) ছিলেন যে, তারা ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছিলেন না।
পিলখানার গণকবর
ঘন্টার হিসেবে বিডিআর বিদ্রোহের দৈর্ঘ্য ছিল আনুমানিক ৩৩ ঘন্টার কাছকাছি। ২৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার সকালে শুরু হয়ে এর সমাপ্তি হয় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। শেষপর্যায়ে অনেক জওয়ান বিডিআরের পোশাক খুলে সিভিল পোশাকে পালিয়ে যান। পিলখানার ভেতরে স্তূপ করা অনেক পোশাক পাওয়া যায়। আর যাওয়ার সময় অনেকেই পিলখানার ভেতরে লুটপাট করেন। অফিসারদের পরিবারের সোনা-দানা, অলংকার সাথে নিয়ে অনেকেই পালিয়ে যান। যাত্রাপথে মহাসড়কে তাদের অনেকেই পুলিশের হাতে ধরাও পড়েন। কী ভয়াবহ ব্যাপার। এদিকে মাত্র ৩৩ ঘন্টার এই স্বল্পসময়ে পিলখানার ভেতরে অকল্পনীয় বর্বরতা চালায় বিদ্রোহী জওয়ানরা। বিভৎস ও নজিরবিহীন নৃশংসতা।
একজন সংবাদকর্মী হিসেবে বুধবার দিবাগত রাতে পুরোটা সময় আমি পিলখানার প্রধান ফটকের সামনে ছিলাম। বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ কাভার করেছি। এ সময় অন্য গণমাধ্যমের কর্মীদের সাথে আমার বিস্তারিত আলাপ হয়েছিল। ওই সময় আমরা জানতে পারি, বিডিআরের ডিজি শাকিল আহমেদ নিহত হয়েছেন। হত্যা করা হয়েছে জঙ্গীবাদ বিরোধী অভিযানে অন্যতম সফল সেনা কর্মকর্তা কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদকে। সে সময় তিনি বিডিআরের সিলেট সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। এছাড়া নারী নির্যাতনের কথাও আমরা শুনেছিলাম। অভিশপ্ত ঐ রাতে বিডিআরের ভেতরের বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আলো নিভিয়ে ফেলা হয়েছিল। পুরো এলাকায় ছিল এক ভূতুড়ে পরিস্থিতি।
পরে আমরা জানতে পারি পুরো পিলখানা অন্ধকার করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মরদেহগুলো গণকবরে পুঁতে ফেলে জওয়ানরা। অগভীর এই গণকবরটি ছিল বিডিআর হাসপাতালের মর্গের পেছনে। ঐ অন্ধকার সময়ে লাশগুলো একের পর এক নিয়ে এসে তীব্র জিঘাংসায় গণকবরে ফেলেছে জওয়ানরা। যাদের মধ্যে ছিলেন বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ ও অন্যান্য সেনা কর্মকর্তা। উদ্ধারকারীরা এই গণকবর শনাক্ত করেছিলেন শুক্রবার দুপুরে। তারপর সেখানে খনন কাজ শুরু হয়। এ সময় পিলখানায় ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ। আরও মরদেহের সন্ধানে পিলখানার পুকুর ও সুয়ারেজের লাইনে ডুবুরিরা তল্লাশি চালায়। এছাড়া একটি জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে দীর্ঘ সময় ধরে কিছু একটা পোড়ানো হয়েছে। পরে জানা যায়, প্রথমদিকে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার মরদেহ পুড়িয়ে ফেলে জওয়ানরা। কী ভয়াবহ নৃশংসতা! কী ভয়াবহ সেই দিন। এমন দিন শুধু বাংলাদেশ কেনো, বিশ্বের কোনও দেশেই যাতে না আসে।
বিডিআর বিদ্রোহের অবসানের পর একদল সংবাদকর্মী পিলখানার ভেতরে গিয়েছিলেন। তারা মূলত পিলখানার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও গণকবর আবিষ্কারের ভয়াবহ ঘটনা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। আমার খুব ইচ্ছে ছিল পিলখানার ভেতরে যাওয়ার, কিন্তু সে সুযোগ হয়নি। চ্যানেল ওয়ানের পক্ষে পিলখানার ভেতরে গিয়েছিলেন সুজন মেহেদি। তার নিয়ে আসা ফুটেজ দেখেছিলাম ভিডিও প্যানেলে। কী ভয়াবহ সেই চিত্র! আমি আমার জীবনে এতো ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ আর দেখিনি।
বিশেষ আদালতে রায় ঘোষণা
সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালনে এ হত্যাযজ্ঞের অনেক ঘটনা আমি কাভার করেছি। এরইমধ্যেই আমি চলে আসি এটিএন বাংলায়। এটিএন বাংলার হয়ে আমি পিলখানার ভেতরে স্থাপিত বিশেষ আদালতে বিদ্রোহের বিচারের ঘটনা কাভার করি। শুনানীতে অনেক আসামী তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে রাষ্ট্রের অনুকম্পা চেয়েছেন। অনেকেই আবার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। কেউ কেউ আবেগতাড়িত হয়ে অফিসারদের বাঁচাতে নিজেদের ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন। অনেক অভিযুক্তই কান্নাকাটি করতেন।
এদিকে এই ঘটনার হত্যা মামলার বিচার চলে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে। যে আদালতে বিডিআর বিদ্রোহে হত্যাযজ্ঞের জন্য ৮৫০ জন বিডিআর জওয়ানের বিচার হচ্ছিল। অর্থাৎ হত্যাকাণ্ডের মামলায় চার্জশিটভূক্ত আসামী ছিলেন ৮৫০ জন। বিচার চলাকালে এদের মধ্যে ৪ জনের মৃত্যু হয়। যাদের বিরুদ্ধে আদালত রায় ঘোষণা করেন ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তখন আমি কাজ করি যমুনা টিভিতে। এদিন আমি পুরাতন ঢাকার বকশিবাজারে স্থাপিত বিশেষ আদালতের এজলাসে থেকে মামলার রায় ঘোষণার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। এর আগে সকালে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে ডান্ডাবেড়ি পড়া অবস্থায় আসামীদের আদালতে আনা হয়। রায় ঘোষণা শুরু হওয়ার কথা ছিল সকাল ১০টায়। কিন্তু বিচারক মো. আখতারুজ্জামান আদালতে আসেন সাড়ে ১২ টার দিকে। এসে সূচনা বক্তব্য তুলে ধরে তিনি রায় ঘোষণা করেন।
প্রথমে ২৭৭ জন আসামীর নম্বর উল্লেখ করে তাদের মামলা থেকে খালাস দেওয়ার রায় দেন বিচারক। এ সময় অনেকেই উল্লাস প্রকাশ করেন। এরপর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১৬১ জন আসামীর নম্বর ঘোষণা করা হয়। এ সময় এজলাসে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই চিৎকার করে কান্নাকাটি করেন। কেউ কেউ বলেন, এ দেশে বিচার নেই। এ সময় আদালতের পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিচারক দায়িত্বরত পুলিশদের মোটামুটি ধমক দেন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। এরপর ঘোষণা করা হয় মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের নম্বর। মোটা ১৫২ জনের ফাঁসির দণ্ড ঘোষণা করেন আদালত। এই পর্যায়ে আদালতে শুরু হয় কান্নার রোল। অনেকেই ‘আল্লাহ, আল্লাহ’ বলে বিলাপ করতে থাকেন। এদের মধ্যে অনেকে বলেন, ‘আল্লাহর দরবারে বিচার হবে, এ দেশে কোনও বিচার নেই’। নানা কথা। রায় ঘোষণা শেষে আসামীদের আবার গাড়িতে তোলা হয়। এ সময় অনেকেই কান্নাকাটি করেন। অনেকেই আবার গণমাধ্যমের প্রতি বিষোদগার করেন। এদিন রায়ে যাবজ্জীবন দণ্ড হয়েছিল বিএনপি নেতা সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীর। তারা বিডিআরের কেউ ছিলেন না। কিন্তু পুরাতন ঢাকার বাসিন্দা হিসেবে বিদ্রোহের সময় ভূমিকা পালন করেছিলেন। এদিন আমি পিন্টুকে দেখেছিলাম তসবিহ হাতে। সবসময় দোয়া পড়ছিলেন। আর লম্বা দাড়ি রেখেছিলেন তোরাব আলী। গায়ে ছিল পাঞ্জাবি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ প্রবন্ধ বসন্ত বাতাসে নজিরবিহীন বর্বরতা রাহাত মিনহাজ সাংবাদিকতা সাহিত্য