বিপদে বন্ধুর পরিচয়
২২ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৩৫
তিন বা চার মাস হবে ব্যাপারটা লক্ষ্য করছি, অবশ্য ধাক্কাটা প্রথমদিনই খেয়েছি। আমাদের বাসার উল্টোদিকের বাসার তিনতলায় ওরা ফ্ল্যাট কিনে শিফট হয়ে এসেছে। যেদিন প্রথম অন্তরা ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিল, আমার ঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণ স্ট্যাচু হয়ে ছিলাম। এমন কুউউল একটা মেয়ে আমাদের উল্টোদিকের বাসায়! নিজেকে বেশ গর্বিত মনে হচ্ছিল।
সাধারণত সকাল ১০টার দিকে ও বের হয়। কখনও ওদের গাড়িতে, কখনও রিক্সায়। বিকেলে বাড়ি ফেরার পরের সময়টা আমি ওকে মিস করি। আমি সকালে ঘুম থেকে দেরি করে উঠি বলে দুপুরের পর দোকানে যাই। প্রায়ই দোকান বন্ধ করে রাতে ফিরি। ইসলামপুরের হোলসেল মার্কেটে আমাদের কাপড়ের ব্যবসা। এখন সকাল সকাল দোকানে চলে যাই, বাবাকে বলে বিকেলে ফিরে আসি। অন্তরা বাইরে যায়, ব্যালকনিতে বসে ফোন টেপাটেপি করে, ছাদে যায়, আমি জানালা দিয়ে দেখি। বেশিরভাগ সময়ই সাথে ওর বয়সী মেয়েটা থাকে। বোঝাই যায় আপগ্রেডেড গৃহকর্মী। দুজনে হাসাহাসি করে, আমি কল্পনায় অন্তরার সাথে গল্প করতে করতে হাসি।
সাহস করে দু’একদিন কথা বলার চেষ্টা করেছি, কাজ হয়নি। শুধু নামটা জেনেছি। একদিন বাইরে থেকে ফিরছিল। সাহস করে নীচে নেমে সামনাসামনি দাঁড়ালাম। ঘামতে ঘামতে বললাম, ‘হাই! আমি আজাদ, আপনাদের উল্টোদিকের বাসায় থাকি। আপনারা নতুন এসেছেন, আমরা এখানকার পুরোনো। কোনও দরকার হলে বলবেন।’ রেসপন্সটা ছিল কোল্ড। ভুরু কুঁচকে বলল, ‘থ্যাংকস! আমি অন্তরা, দরকার হবে বলে মনে হয় না, হলে বলবো।’ বলে ভেতরে চলে গেল। মনে হল আমার কাঁপাকাঁপি টের পেয়ে হাসি চাপছিল। এই কোল্ড রেসপন্সটাই আমাকে বেশ কয়েকদিন ঘোরের মধ্যে টাসকি খাইয়ে রাখল। আমার কাছে সেটুকুই ছিল সুপার হট! এরপর দুই একদিন কথা বলার চেষ্টা করেছি, পাত্তা পাইনি। এই ব্যাপারে আমার ট্র্যাক রেকর্ড খুবই খারাপ। অভিজ্ঞতার অভাবে কীভাবে এপ্রোচ করতে হয় সেটাই জানি না।
কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে পাশের গলির ইয়াসমিনের জন্য দিওয়ানা হয়েছিলাম। ও দুইপাশে বেণী দুলিয়ে মনিজা রহমান গার্লস স্কুলে যেত, ক্লাস টেনে পড়ত। এমন সরল মায়াবী চেহারা! ওকে দেখতে গিয়ে আমার কলেজে প্রায়ই দেরি হয়ে যেত। ওর স্কুলে যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমার হাসির উত্তরে সেও সামান্য হাসি দিয়ে মাথা নিচু করে চলে যেত। একদিন আধারাত জেগে চিঠি লিখে সাহস করে ওর হাতে দিলাম। সেও হাত পেতে নিল। বিকেলে ইয়াসমিনের মা সেই চিঠি হাতে আমাদের বাসায় এল। মাকে বলল, ‘আপা আপনার ছেলে আমার মেয়েকে প্রেমপত্র দিসে। কথা সেইটা না, কথা হল, ওর বাংলা ভীষণ কাঁচা। মনে হয় সদরঘাটের ফুটপাত থেকে আদর্শ প্রেমপত্র টাইপের বই কিনে কপি করছে। মেয়ে আমার আপনার ছেলের লেখার মানে বুঝতে না পেরে আমাকে দেখাইসে। আমি নিজেও ঠিকমত বুঝি নাই। ওর জন্য আলাদা বাংলার প্রাইভেট টিচার রাখবেন।’ সঙ্গে জানালেন, ইয়াসমিনের বাবার রাগ অনেক বেশি। তার দুইজন বন্ধু থানার ওসি। তাই উনি ইয়াসমিনের বাবাকে চিঠির কথা বলেন নাই। মা আশ্বস্ত করলেন, ওসি সাহেবদের বলার দরকার নাই। বাবাকে বলে আমাকে হাজতি মাইর দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। পঞ্চাশবার কান ধরে উঠবস করে, মায়ের পায়ে ধরে মাফ চেয়ে বাবাকে না জানাতে রাজী করিয়েছিলাম। তারপর আর প্রেমে পড়ার সাহস হয় নাই। কিন্তু এবার সত্যি সত্যি অন্তরার জন্য কেমন কেমন লাগে। রানাকে ফোন করে বললাম, দোস্ত, কাল বিকালে আমাদের বাসায় আয়। জরুরি দরকার।
বন্ধুদের কাছে রানার নিকনেম হচ্ছে, মেসিলদো অর্থাৎ, মেসি এবং রোনালদোর যুগলবন্দী। সামনে মেসি রোনালদো রিটায়ার করার পর ওর নাম হবে হালাম্বাপে। এ পর্যন্ত গোটা ছয়েক রিলেশনশিপে জড়িয়েছে, সপ্তম ব্যালন ডি অরের অপেক্ষায় আছে। সাকসেস রেট শতভাগ। যাকে ভাল লাগে তাকেই পটিয়ে ফেলার অদ্ভুত দক্ষতা আছে রানার।
পরদিন বিকেলে রানা এলে জানালা দিয়ে ওকে অন্তরাকে দেখালাম। দেখে বলল, মেয়েতো সুন্দর! তোর সমস্যা কি? এপ্রোচ করছিলি? বললাম, দোস্ত, একদমই পাত্তা দেয় না। ট্রাই করছিলাম, আইস কোল্ড রেসপন্স।
ফেবুতে রিকু পাঠাইছিস?
পাঠাইসি, কোনও রেসপন্স নাই।
ডাইরেক্ট একশনে যা, সামনাসামনি প্রপোজ কর।
সাহস পাই না।
হালা গাধা! সাথের ওই মেয়েটা কে?
ওদের বাসায়ই থাকে। মনে হয় কাজকর্ম করে। কিন্তু স্টাট্যাস নরমাল বুয়াদের চাইতে একটু উপরে, কিছুটা সহচরী টাইপের।
তুই তাইলে অন্য লাইনে যা। ডাইরেক্ট যেহেতু গাছের আগায় উঠতে সাহস পাইতেছিসনা, মই বাইয়া ওঠ।
ওইটা কেমনে?
অন্তরা গাছ হইলে সাথের মেয়েটা হইলো মই। তুই আগে ওর সাথে খাতির লাগা। তারপরে এই মেয়েই তোরে সাপলুডুর মইয়ের মত গাছের আগায় উঠায় দিবো। এর সাথে খাতির লাগাইয়া এর পটা। এর থ্রুতেই অন্তরার অন্তরে পৌঁছায় যাবি।
লক্ষ্য করলাম, দুপুরে আমি যেই সময়টায় দোকানে যাই, সেই সময় এই মেয়েটা অন্তরার ছোট ভাইকে স্কুল থেকে আনতে যায়। দু’একদিন সামনাসামনি দেখা হয়ে গেছে এমন ভাব করে হাসলাম। মেয়েটাও হাসি দিলো, কিন্ত এতেও সাহস পাচ্ছিলাম না। এ-ও যদি অন্তরার মত হয়। নিজেকে সাহস দিলাম, আমিতো আর এই মেয়ের সাথে রিলেশনে যাচ্ছি না, জাস্ট অন্তরার কাছে পৌঁছানোর জন্য একটু খাতির লাগানো। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছো?
উত্তর দিলো, ভাল, আপনে কেমন আছেন?
পরদিন আরও এগুলাম। মেয়েটা মনে হয় অন্তরার ছোট ভাইকে স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছিল। বললাম, আমি তোমাদের উল্টোদিকের বাসায় থাকি, তোমাকে রোজ দেখি। তাই কথা বলতেসি, রোজ এইসময় কোথায় যাও?
মেয়েটা মুখ টিপে সেইরাম একটা হাসি দিয়ে বলল, জানি, আপনার নাম আজাদ। আমি আমাদের বাসার রনিরে স্কুল থেকে আনতে যাই।
তোমার সাথে প্রায়ই দেখা হয়, কিন্তু তোমার নাম জানিনা।
আমার নাম আলেয়া। আমি ওই বাসার আংকেলের একই গ্রামের। ওনাদের সাথে অনেক বছর ধইরা আছি।
পরদিন মোড়ের আইসক্রিম শপের সামনে দাঁড়িয়ে আলেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আলেয়া এদিকে আসতেই ওকে বললাম, বাইরেতো অনেক গরম। রনির স্কুল ছুটি হইতে দেরি আছে, আইসক্রিম খাও।
এদিক ওদিক তাকিয়ে আলেয়া রাজী হয়ে গেল। আইসক্রিম খাওয়ার ফাঁকে গল্পে গল্পে অন্তরাদের সম্পর্কে অনেককিছুই জেনে নিলাম। আজ আর এর বেশি এগোলাম না।
সপ্তাহখানেক পরে দোকানের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছি তখন রানার ফোন এল। কিরে প্রেমিক, কি খবর তোর? কদ্দুর আগাইছিস? মইয়ের সাথে খাতির হইসে? নাকি সেইখানেও হাত পাও কাঁপে?
বললাম, প্রগ্রেস ভাল দোস্ত। গল্প টল্প হয়, সেদিন আইসক্রিম খাওয়াইলাম। আরেকটু খাতির হইলেই গাছে ওঠার চেষ্টা করমু, মানে অন্তরার সাথে পরিচয় করায় দিতে বলমু।
বেকুব! খালি আইসক্রিম খাওয়াইলে কি কাজ হয়?
তাইলে কি অন্তরার সাথে রিলেশনে যাওয়ার জন্য আগে আলেয়ার সাথে প্রেম করতে হইব?
ওরে ভাল কিছু গিফট দে, আগে সহচরী মেয়েটারে খুশি রাখ। ধীরে ধীরে আগে বাড়। কথায় কথায় জানার চেষ্টা করবি অন্তরা তার সহচরীরে তোর কথা কিছু জিগায় কিনা।
রানা জানতে চাইলো, তুই কি বাসায় আছোস?
দোকানে যাব, বাইর হইতাসি, আসবি নাকি?
ওইদিকে কাজ আছে। পরে যাব, তুই যা দোকানে। আমি নেক্সট উইকে আসবনে।
আলেয়ার জন্য গিফটের প্যাকেট নিয়ে আইসক্রিম কর্নারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দূর থেকে আমাকে দেখতেই আলেয়া যেই হাসিটা দিলো, তা দেখে আমার মনে কু-ডাক দিতে আরম্ভ করল। এই মেয়েটা মনে হচ্ছে আমাকে ঝামেলায় ফেলবে। আমার ভুল হতে পারে, মনকে এই সান্ত্বনা দিয়ে হাসিমুখে ওর দিকে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, তোমার সাথে এতো গল্প হয়, দেখা হয়, তোমাকে কোনও গিফট দেওয়া হয় নাই। আড়ং থেকে তোমার জন্য এই ড্রেসটা আনছি, দেখো পছন্দ হয় নাকি।
ব্যাগ থেকে ড্রেসটা বের করে দেওয়ার পর ওর হাসি কান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকলো, অসম্ভব সুন্দর ড্রেস। আপনে আমার পছন্দের কালার জানলেন কেমনে?
আন্দাজ করে কিনছি, মেয়েদের জামা কিনে অভ্যাস নাইতো, ভয় পাইতেছিলাম কেমন হয়, তোমার পছন্দ হয় কিনা!
খুব পছন্দ হইছে। তারপর নিচু স্বরে বলল, জানেন, আমি না অন্তরা আপুরে আপনার কথা বলছি।
আমার হার্টবিট বেড়ে গেল কৃতজ্ঞতায়। মনে মনে আলেয়াকে আরেকটা ড্রেস কিনে দেওয়ার প্ল্যান করে ফেললাম। আমি না বলতেই মেয়েটা আমার জন্য এতোটা করেছে, আমার মনের খবর জেনে গেছে! হড়বড় করে বললাম, আমার কথা কি বলছ অন্তরারে? সে কি বলসে?
অন্তরা আপুরে আমি আমার আর আপনের কথা বলসি। বলসি আপনি আমারে পছন্দ করেন, আমার জন্য রাস্তায় দাঁড়ায় থাকেন, আইসক্রিম খাওয়ান। আপু শুইনা খুব খুশি হইসে। বলছে আমাদের হেল্প করবে।
আমার মাথার ভেতর ভোঁ ভোঁ করছিল। আমি কিছু বলার আগেই আলেয়া আবার কলকল করে উঠল, আমি আপনেরে ফেবুতে রিকুয়েস্ট পাঠামু, আপনি একসেপ্ট কইরেন। রাতে আমারে ম্যাসেঞ্জারে নক দেবেন।
এই মেয়ে কি বলছে এসব! এ তো সাপ-লুডুর মই না হয়ে সাপ হয়ে গেছে! রানা হারামজাদার কুবুদ্ধিতে আমার এই সর্বনাশ! ওর গলাটা সামনে পেলে দুই হাতে টিপে ধরতাম। মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করলাম। বললাম,
আমি তোমার অন্তরা আপুর সাথে কথা বলতে চাই।
কি কথা বলবেন? আপুতো এখন ঘুমাইতেসে।
দুপুর পর্যন্ত কিসের ঘুম ঘুমায় তোমার আপু?
ইউনিভার্সিটি বন্ধ তো, তাই অন্তরা আপু সারা রাইত আপনের বন্ধু রানা ভাইয়ের সাথে চ্যাট করে আর দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ কাজী শামীম আহমেদ কাজী শামীম আহমেদের রম্য 'বিপদে বন্ধুর পরিচয়' বিপদে বন্ধুর পরিচয় রম্য সাহিত্য